মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
চৌষট্টি.
এই বক্সিং সংক্রান্ত সব বিষয় নিয়ে সোফি অবশ্যই এক গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গিয়েছিল। সে টের পাচ্ছিল, এমন এক বক্সিং ম্যাচ এ লড়াইয়ের বিষয়টা আমাকে কি ধরনের সুখী করেছিল এবং সে শুধু দেখে যাচ্ছিল, আমি কি এক উচ্ছ্বাস আনন্দ আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বক্সিং এর অনুশীলন করে যাচ্ছি। কিন্তু সে সত্যি সত্যিই আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। তার মনের মধ্য কাজ করছিল, এমন একজন শক্ত প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই এ আমি ঠিক থাকতে পারবো কিনা। তবে আমি আমার প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের কৌশল নিয়ে সোফির সাথে সব সময় আলাপ করতাম এবং ব্রাজিউ’র শক্তির ও দূর্বলতার দিকগুলি নিয়ে তার সামনে বিশ্লেষণ করতাম। আমার এমন সব বিশ্লেষণ ও আত্মবিশ্বাসী কথাবার্তা অবশ্যই তার মনের মধ্যে এক ধরনের সাহস যুগিয়েছিল এবং তাকে অবশ্যই আশবাদী করে তুলেছিল। সাধারণত, সোফি যখনই কোন বিষয় নিয়ে কোন ধরনের এক আশংকার মধ্য থাকতো এবং আমি মনে করতাম তার এই নিছক আশংকাটা কাটানো দরকার, তখনই তাকে আমি যথার্থ কারণ দেখিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতাম এবং যখন দেখতাম তার আশংকাটা কেটে গেছে, তখন আমি শুধু তাকে বলতাম, ‘সোফি, তাহলে আমি এখন কাজে নেমে পড়লাম।’
২০১২’র ৩১শে মার্চ অটোয়ার হ্যাম্পটন ইন-এ সেই মুষ্টিযুদ্ধের দিন ঠিক হয়েছিল, এবং ছয় মাস ধরে আমি কঠোর পরিশ্রম করে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সত্যিই আমি কঠোরভাবে অনুশীলন চালিয়েছিলাম। অটোয়ার ‘ফাইনাল রাউন্ড’ নামের জিম এ সৌখিন মুষ্ঠিযোদ্ধাদের বক্সিং এর মৌলিক বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সেখানকার প্রশিক্ষণ আমার জন্য যথেষ্ট নয়। যেহেতু আমার প্রতিপক্ষ ছিল খুবই শক্ত একজন, সেজন্য আমার মনে হয়েছিল, তাকে ঘায়েল করতে হলে আমাকে অবশ্যই খুবই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। সেজন্য মন্ট্রিয়লের আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। আলি নেস্টর চার্লস নামের আমার ঐ বন্ধু আমার নির্বাচনী এলাকার একেবারে পূর্ব দিকে মার্শাল আর্টস আর বক্সিং শেখানোর একটা জিম চালাতো। আমি আগে থেকেই তার কাজ সম্পর্কে জানতাম। বিশেষ করে সে ছোট ছোট বাচ্চাদের বখে যাওয়ার হাত থেকে দূরে রাখা এবং যারা স্কুলে যেত না, তাদের সে তার জিম এ বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিত। তার এই উদ্যোগের জন্য আমি সব সময়ই তাকে এক ধরনের শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম। সত্যি বলতে কি, আমি বেশ কয়েকবার তার জিম এর সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টার সময় কাটিয়েছি। সকালে সেই সব বাচ্চারা জিম এর ওপর তলার একটা ঘরে পড়াশুনা করতো আর বিকেলে চলতো তাদের প্রশিক্ষণ। আমি জানি তাদের স্থানীয় এমপি যখন তাদের ওখানে যেত তখন তাদের প্রতিদিনের ব্যস্তটা আরো বেশী বেগবান হত।
আলি শুধু একজন প্রশিক্ষক বা গুরু ব্যক্তিই ছিল না, সেই সাথে সে ছিল একজন পেশাদার বক্সার। যার ফলে আমি ও সে প্রায় ছয় মাস একসাথে নিয়মিত প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছি, এবং এই কঠোর ও নিয়মিত প্রশিক্ষণের পর যখন আমার জীবনে সেই যুদ্ধের রজনী একেবারে কাছে এসে পড়েছিল, তখন আমি এ লড়াইয়ের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম।
সেই পুরাতন বক্সিং ঘরাণায় বেশ কিছু বিশেষ নীতি ও কৌশল আছে। এই ঘরাণায় একজন শুধু শুধু কিছু কৌশলের সাথেই পরিচিত করে দেয় না, বরং এটা একজনকে শিখিয়ে দেয়, এই মুষ্ঠিযুদ্ধ চলার সময়ে একজন একেবারে হাঁপিয়ে উঠলে বা বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেও কিভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে জয়ের ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সব চাইতে বড় কথা হছে, এটা একজনকে শৃংখলা আর কঠোর পরিশ্রমের যে গভীর মূল্য আছে, সে সম্পর্কে চমৎকার সুন্দর এক শিক্ষা দিয়ে থাকে। সেই লড়াইয়ে আমি প্যাট্রিক ব্রাজিউ’কে পরাজিত করেছিলাম। আর এটা সম্ভব হয়েছিল, আমি একটা সুন্দর দলের সাথে কাজ করেছিলাম এবং আমার খুব সুন্দর আর বাস্তবসম্মত একটা পরিকল্পনা ছিল, সেই সাথে সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে ধরনের কঠোর পরিশ্রম আর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল, আমি সেটা করেছিলাম। আমি এই বিষয়ে তোমাদের জানাতে চাই এই জ্ঞানটা রাজনীতির ক্ষেত্রে খুবই বাস্তবসম্মতভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব কিনা, সে ব্যাপারে আমরা ভাবতে পারি।
সেই লড়াইয়ের এক সপ্তাহ আগে আমার অটোয়ার প্রশিক্ষক ম্যাট হুইটটেকার আমার লড়াইয়ের পরিকল্পনাটা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। তার এই জানতে চাওয়ার উত্তরে আমি আমার পরিকল্পনাটা তাকে জানিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, প্রথম দিকে ব্রাজিউ আমার ওপর যেভাবেই চড়াও হতে চাক না কেন, আমি সে সুযোগ তাকে দিব। প্রথম রাউন্ডে আমি তাকে তেমন কোন আঘাত না করে বরং তাকে ব্যস্ত রাখবো। তারপর দ্বিতীয় রাউন্ডে আমি তার থেকে বেশী সক্রিয় হয়ে তার প্রতি চড়াও হব এবং তৃতীয় রাউন্ডে আমি তাকে নক আউট করব। ম্যাট আমার এই প্রত্যয়ী কথা শুনে হেসেছিল, তারপর কিছুটা অবজ্ঞার সুরে বলেছিল, ‘ও, তাহলে তুমি তাকে নক আউট করার জন্য তৃতীয় রাউন্ড পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? আচ্ছা, তুমি কি তার কাছ থেকে এত সময় পাবে?’ আমরা দুজনেই জানতাম, এ ধরনের অলিম্পিক ঘরাণার সৌখিন মুষ্ঠিযুদ্ধে একেবারে ধরাশায়ীর মত ঘটনা একবারেই ঘটে না। আর যদি এমন কিছু ঘটেই থাকে, তবে সেটা নিঃসন্দেহে ঘটবে ব্রাজিউ’র পক্ষ থেকে।
কিন্তু যখন আসল সময়টা আসলো, তখন আমার পরিকল্পনাটাই ফলে গেল। লড়াইয়ের শুরু থেকেই ব্রাজিউ মারমুখী আচরণ শুরু করল, এবং প্রথম রাউন্ডে অর্ধেক সময় না যেতেই সে আমাকে যেভাবে দাপটের সাথে মারতে শুরু করল, সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, আমি কি ভুলভাবে আমার সব পরিকল্পনা করেছি। সে আমাকে এমন জোরে জোরে এবং বিশাল শক্তি নিয়ে মারতে শুরু করল যে, আমি পূর্বে কখনও এমন মার খাইনি। এমনকি প্রশিক্ষণের সময়ও কখনও এমন মারের স্বাদ আমি আস্বাদন করিনি। আমি ইচ্ছে করেই প্রশিক্ষণের সময় কয়েক জন খুবই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করেছি, কিন্তু কখনও এধরনের মার খাই নি। এই অবস্থায় আমি শুধু ভাবছিলাম, আমি তার এ ধরনের প্রচণ্ড জোরের সব ঘুষি কতক্ষণ সামলাতে পারব। লড়াইয়ের মধ্যেই আমি যখন এসব চিন্তা করছিলাম, তখনই শুনতে পেলাম, সে বড় বড় শ্বাস ফেলছে, কিছুটা হাঁপাচ্ছে। তার শ্বাস ফেলা আর হাঁপানোর শব্দ শুনে সেই মুহূর্তে আমি বুঝে গেলাম, আমার পরিকল্পনা মতই সব কিছু হবে। প্রথমেই আমি তার ঘুষিগুলোকে আটকে দিতে দিতে সেগুলো সব ফেরত দেয়া শুরু করলাম। প্রথম রাউন্ডটা আমি হাসি মুখেই শেষ করলাম এবং আমার ভিতরটায় একটা আনন্দের ধারা বয়ে গেল। সে তার সব শক্তি দিয়ে আমাকে যেভাবে মারা যায় সেভাবেই মারার চেষ্টা চালাতে লাগল, আর আমি সব শান্তভাবে গ্রহণ করতে লাগলাম এবং অবস্থা বুঝে জায়গা মত আমি তার পাওনাগুলো ফেরত দিতে লাগলাম। দ্বিতীয় রাউন্ডে আমি আমার পরিকল্পনার ছকে চলে গেলাম এবং লড়াই’টাকে আমার নিজের আয়ত্বে নিয়ে ফেললাম। আর তৃতীয় রাউন্ডে প্যাট্রিক ব্রাজিউ’র আর কিছুই থাকল না। সে তখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তখন তার চোখে এক ধরনের আতংকের ছায়া ফুটে উঠেছে। তাকে তখন দেখে মনে হচ্ছিল সে বক্সিং রিং থেকে কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। তৃতীয় রাউন্ডে যখন আমি তাকে মেরে নাস্তানাবুদ করে ফেললাম, তখন রেফারী আট পর্যন্ত গুনে যখন তার কাছ থেকে কোন সাড়া পেল না, তখন খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করল। সেটা ছিল কৌশলগত নক আউট। অলিম্পিকের নিয়ম অনুযায়ী সেটা ছিল আমার জন্য অন্যরকম এক সাফল্যজনক বিজয়। আর আমি এমনটায় চেয়েছিলাম।
রেফারী যখন আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করল, কেবল তখন আমি চোখ তুলে আশে পাশে তাকালাম এবং দেখতে চাইলাম আমার পাশে কারা আছে আর আমি কোন পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করছি। লড়াইয়ের আগে ও লড়াই চলাকালীন সময়ে আমি সেই লড়াই এর চিন্তায় এত বেশী বুদ হয়েছিলাম যে আমি চারপাশের পরিবেশটা একেবারে ভালোভাবে দেখিনি, মূলত সেদিকে আমার কোন খেয়ালই ছিল না। আমার মস্তিষ্কে সে সময় একটায় চিন্তা কাজ করছিল, যেভাবেই হোক আমাকে জিততে হবে, আর এই জিতাটা আমার ব্যক্তি মানুষের জন্য নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে ছিল আমার পার্টির ইমেজ। ফলাফল ঘোষণার পর আমি চোখ তুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, গোটা জায়গাটা কনজারভেটিভ পার্টির এমপি আর মন্ত্রীতে ভরে আছে। তারা সবাই দল বেঁধে দেখতে এসেছিল, কিভাবে তাদেরই একজন ট্রুডো’কে গো-হারা হারিয়ে দেয়। আমাদের সেই লড়াইটা কনজারভেটিভ পার্টির প্রচারমাধ্যমে বেশ ভালোভাবে প্রচার হচ্ছিল। তারা একেবারে এক অন্যরকম এক ফলাফল আশা করেছিল। আমি জেনেছিলাম, সারা কানাডা জুড়ে বার আর রেস্টুরেন্টে মানুষজন এই বক্সিং লড়াই উপভোগ করার জন্য উন্মুখ হয়েছিল। আমি যেমন ভেবেছিলাম, তেমনই হয়েছিল। আমার সেই বিজয় লিবারেল পার্টির সদস্যদের মধ্যে এক গভীর উদ্দীপনা আর আশা জাগানিয়া ঘটনা হিসেবে কাজ করেছিল। তারপর স্রোতের মত আমার কম্পিউটারের ইনবক্সে অসংখ্য জানা অজানা মানুষের ধন্যবাদ আর প্রশংসা পত্র আসতে লাগলো।
আমি জানতাম বক্সিং ম্যাচের সাথে আসল রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। সেই রাতে অটোয়ার কোন স্থানের কোন সংসদীয় এলাকায় আমরা জয়ী হইনি অথবা সেই রাতে এমন কোন রাজনৈতিক ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু রাজনৈতিক পার্টিতো একটা দল এবং এই দলে সমবেত হয় অনেক একমনা সব মানুষ যারা বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিযোগী মনোভাব নিয়ে সামনে এগুতে চায়। তারা নিজেদেরকে চাঙ্গা রাখতে আর নিজেদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে বিজয় চাই, বিশেষ করে বারবার পরাজয়ের পর তারা যখন হতাশায় অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে তখন তাদের জন্য বিজয় খুব বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেই বক্সিং ম্যাচের বিজয়টা ছিল দীর্ঘ সময় ধরে কনজারভেটিভদের কাছে লিবারেলদের লাগাতার পরাজয়ের পর এক বিজয়। নিছক বক্সিং রিং-এ এ বিজয় হলেও এর গুরুত্ব আর প্রভাব সেই সময়ের লিবারেলদের কাছে ছিল খুবই অপরিসীম। এমন সবকিছুর মধ্যে অন্যরকম এক ভাল লাগা আমার দেহমনে কাজ করছিল।
এমন ঘটনায় যা ঘটে, ঠিক তেমনিই হল, গণমাধ্যমে এমন এক ঘটনার কাহিনী প্রকাশিত হবার পর অসংখ্য মানুষ আগ্রহ সহকারে সেটা সম্পর্কে পড়তে লাগল। এমনকি বেশ কিছু জাতীয় সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এমনও লিখতে শুরু করল, আনঅফিসিয়ালি সেটা ছিল আমার নেতৃত্বের প্রচারণার প্রথম বলিষ্ঠ ধাপ। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি আসলেই লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে যাব কিনা, তখনও আমার তেমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এবং আমার প্রায় মনে হয়, আমি যদি শুরুতেই নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য কাজে নেমে যেতাম, তাহলে এই যে একজন কনজারভেটিভকে নক আউট করার ফলে আমার পক্ষে যে ইতিবাচক সংবাদের জন্ম দেয়া সম্ভব হয়েছিল, সেটা হয়তো তখন আর নাও হতে পারত। (চলবে)