ফরিদ আহমেদ : কিছু কিছু লেখক থাকেন, সাহিত্য করতে গিয়ে সাহিত্যের ধার ধারেন না তাঁরা। ব্যাকরণ মানেন না, মানেন না প্রচলিত কোনো প্রথা কিংবা বিধি-বিধানকেও। সাহিত্যের অলংকার-সমৃদ্ধ সাজসজ্জার দিকে বিন্দুমাত্র নজর দেন না তারা। অনাড়ম্বরভাবে, অলস ঢঙে লিখে যান নিজের ভাবনাগুলোকে। সাজিয়ে গুছিয়ে সোনার পাতে পরিবেশন করার বদলে কলা পাতায়, দীর্ঘ-জীর্ণ-ভাবে উপহার সাজান তারা। এতে করে সেই উপহারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে না কমবে, সে বিষয়ে তাঁরা থাকেন পুরোপুরি অসচেতন। নিজের জনপ্রিয়তা বাড়লো না কমলো, সেদিকেও লক্ষ্য থাকে না তাঁদের। আদৌ তাদের লেখা কেউ পড়ছে কিনা, সেটারও খোঁজ তাঁরা রাখেন না। অবাস্তব শোনালেও এমন লেখকের অস্তিত্ব কিন্তু আছে। এ রকমই একজন লেখক এবং সাহিত্যিক হচ্ছেন হচ্ছেন নজমুল আলবাব।
তাঁর লেখালেখির সাথে আমার পরিচয় এক যুগেরও বেশি সময় আগে। সচলায়তন নামের একটা বøগে লেখালেখি করতেন তিনি। ওই ব্লগটাকে অনুসরণ করতাম আমি। সেখানেই কিছু লেখা পড়েছি আমি। খুব বেশি লেখা তিনি লিখতেন না। লিখতেন খুব কম পরিমাণে। আবার সেই কম পরিমাণের লেখাগুলোও সাধারণত হতো খুব ছোট ধরনের। কিন্তু, সেই পরিমাণ এবং দৈর্ঘ্যের ক্ষুদ্রতা তাঁর লেখার প্রতি ভালবাসা তৈরি করতে সময় লাগেনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অলস এই লেখক আমার প্রিয় লেখকে পরিণত হয়ে যান। নজমুল আলবাবের লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি লেখেন সাদামাটাভাবে। ভাষাটা একেবারেই আটপৌরে। পড়লে মনে হবে লিখিত কোনো গল্প না, বরং কেউ যেনো কানের কাছে এসে ধীরভাবে গল্প শোনাচ্ছে। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ওই আটপৌরে ভাষাটা, শিথিল কথামালাগুলোই কীভাবে কীভাবে যেনো একত্রিত হয়ে শক্তিশালী এক কথার বুননে পরিণত হয়ে যায়। কীভাবে হচ্ছে, সেটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। কিন্তু, বুননটা এতো শক্তিশালী যে সেটা অনুভব না করে থাকা যায় না।

নজমুল আলবাব এ পর্যন্ত মাত্র দুটো বই লিখেছেন তিনি। একটার নাম হচ্ছে, ‘পাতা ঝরার আগের গল্প’ আর অন্যটা হচ্ছে ‘বউ, বাটা, বলসাবান’। ‘বউ, বাটা, বলসাবান’ ছোট গল্পের সমাহার। প্রকাশিত হয়েছে শস্যপর্ব প্রকাশন থেকে। বইটাতে মোট তেরোটা গল্প আছে। এই গল্পগুলো তাঁর সেই অনাড়ম্বর ভাষার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। বইয়ের শুরুতেই লেখক লিখেছেন, “যখন যে ঘটনা ঘটেছে চোখের সামনে অথবা মনে, তখনই মাথায় জন্ম নেয়া শব্দ আর বাক্যগুলো অবিকল বেরিয়ে এসেছে কলমের ডগা দিয়ে। ব্যাকরণ কিংবা চিরন্তন বাক্যবন্ধ এখানে নেই। তাই সাধারণ ভাবনা নিয়েই এই মলাটের ভিতর আপনাকে ঢুকতে হবে।”
সাধারণ ভাবনা নিয়ে বইটা পড়তে পাঠক ঢুকবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খুব সাধারণ সাদামাটা ভাষা-শৈলীর গল্প পাবে, এতেও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু, প্রতিটা গল্পের শেষে গিয়ে পাঠক যে ধাক্কাটা খাবে, সেটা লেখক উল্লেখ করেন নাই। পাঠককে বোকা বানানোর ইচ্ছায় লেখক এই কাজটা করেছে তা নয়। এ কারণেই উল্লেখ করেন নাই যে তিনি সচেতনভাবে পাঠককে ধাক্কা দেবার ইচ্ছা নিয়ে খুব সম্ভবত গল্পগুলো লেখেন না। কিন্তু, তাঁর ভাবনার জায়গাটা এমনই গভীর, এবং সেই গভীরতাটা এতো নির্লিপ্ত-ভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন যে প্রতিটা গল্পের শেষে পাঠকের থ মেরে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না। বিস্মিত হবার মূল কারণ হচ্ছে আটপৌরে একটা গল্পের মাঝে এতোখানি গভীরতা থাকতে পারে সেটা পাঠকের পক্ষে আগে থেকে বোঝা মুশকিল। লেখকের নির্লিপ্ত এবং নিরাসক্ত আচরণও পাঠককে পুরোটা সময় বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে রাখে। যে কারণে সমাপ্তিটা আসে অপ্রত্যাশিত এক আঘাত হিসাবে।

দুটো গল্পের অবতারণা করছি আমি। একটা গল্পের নাম হচ্ছে, ‘বুকের উপর সাপের রাস্তা….’। গল্পের নামটাতে বেশ চমক আছে। কিন্তু, গল্পে তেমন কোনো চমক নেই। খুব সাদামাটা একটা গল্প এটা। এক বাড়ির বউয়ের গলার সোনার হার জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় চোর। এ কারণে বউ বিলাপ করে দোষারোপ করতে থাকে স্বামীকে, ঘরে স্বামী থাকতেও চোর কীভাবে তার গয়না চুরি করে নিয়ে যায়। মা-ও বিলাপ করতে থাকে এই বলে যে ঘরে জোয়ান ছেলে থাকতেও চোর চুরি করে নির্বিঘ্নে চলে যায়। চোরের তো সাহস বেড়ে যাবে। বউ কিংবা মায়ের এই বিলাপ এবং দোষারোপের মধ্যে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যে কোনো বাড়িতে অঘটন ঘটলে কাউকে না কাউকে দায়ী করাটা মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। গল্পের মূল ধাক্কাটা আসে স্বল্পভাষী বাবার বক্তব্যে। তিনি আস্তে করে বলেন, ‘সাপতো মানুষের বুকের উপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে ফেল্লরে, এখন রোজ বুকে চড়তে চাইবে।’

দ্বিতীয় যে গল্পটার কথা বলবো আমি, সেটা হচ্ছে ‘বউ, বাটা, বলসাবান’। এই গল্পের নামেই বইটার নামকরণ করা হয়েছে। পর্যাপ্ত যৌতুক না পাওয়ায় নতুন বউয়ের হাজারটা খুঁত বের করতে থাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা। নানা খুঁতও বের হয়ে আসতে থাকে অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা থেকে। কেউই পছন্দ করে না নতুন বউকে। সংসারে অনেক কিছুই স্থির। কেউ বল সাবান ব্যবহার করে, সেটা ছাড়া তার চলে না। কেউ বাটার জুতো পরে, অন্য কোনো জুতোতে জুত পায় না। এগুলো বদলানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু, বউ এমন কোনো অপরিহার্য কোনো জিনিস না। যে কারণে গল্পের মূল চরিত্র বা কথক, ওই বউয়ের দেবর নির্লিপ্ত-ভাবে বলে যায়, “বল সাবান কিংবা বাটার জুতা বদলানো অসম্ভব। কিন্তু বউ বদলানো কোনো ব্যাপারই না। এটা আমরা সবাই জানি। মা বলেছেন, দাদার বউ বদলে ফেলবেন।”

এমন নির্লিপ্ত এবং নিরাসক্ত চমক প্রতিটা গল্পেই উপস্থিত রয়েছে। আগেই বলেছি অত্যন্ত সাদামাটা ভাষায় লেখা গল্পগুলো। কাহিনিতে কোনো জটিলতা নেই, চরিত্রগুলোও সব আমাদের খুব কাছের চরিত্র। কোনো চরিত্রকেই কাল্পনিক কিংবা অবাস্তব মনে হবে না। গল্পের কোনো সংলাপকেও আরোপিত লাগবে না। সবকিছু খুব সাধারণ। কিন্তু, এই সাদামাটার স্তরের নীচেই অসাধারণ কিছুর উপস্থিতি টের পাবেন। জমাট বরফের নীচ দিয়ে যেমন অন্তঃসলিলা বয়ে চলে, তেমনি এইসব কাহিনির অন্তরালে দিয়েও বয়ে যাবে অন্য কিছু, অন্য কোনো ভাবনা। এখানেই লেখকের মুনশিয়ানা নিহিত। অসাধারণ কথাকে অসাধারণভাবে সবাই বলতে পারে না। অল্প কিছু মানুষ পারে। এর বিপরীতে, অসাধারণ কথাকে সাধারণভাবে প্রকাশ করতে পারে মাত্র দুই একজন। আমাদের এই লেখক সেই দুই একজনের মধ্যের একজন।

সবশেষে বলি, বইটার নামটা আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে। শিরোনামে বৃত্ত্যনুপ্রাস ব্যবহারের কারণে এটা মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ফলে, একবার শুনলে এই বইয়ের নাম ভোলা খুব কঠিন।