মোয়াজ্জেম হোসেন : সময় যুগে যুগে বিচিত্র রূপ নেয়। মানুষের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিও যুগে যুগে বদলে যায়। সাহিত্যের ভাষা প্রতিনিয়ত বদলায় না, কিন্তু জীবনের ওপর যেসব অভিঘাত আসে, তখন সমাজ নিজে যেমন বদলায়, তার ভাষাও বদলায়। এমনকি সাহিত্যের আঙ্গিকও বদলে যায়। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, গল্প, উপন্যাস সবই তো বদলে গেছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের সেই ভঙ্গি এখন আর নেই। আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে, পরিবারে, ব্যক্তিজীবনের যে সমকালীন উপলব্ধি- তা কোনো নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর আগলে রাখা অসম্ভব। সাহিত্যের ধ্রুপদী রূপ নিয়েও আগের মতো ব্যাকুলতা নেই। কবিতা, গল্প, উপন্যাসের রচনার লয়ও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের মূল আনন্দ, বেদনা, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি, অশ্রু সব সময়ই একই রকম আছে। কারণ মানুষ তার অস্তিত্ব বদলাতে পারে না।
স¤প্রতি একখানি নতুন উপন্যাস পড়ার সুযোগ হলো। নাম ‘চন্দ্রমুখী জানালা’। ঔপন্যাসিকের নাম ভজন সরকার। তিনি একজন প্রবাসী বাঙালি। কানাডায় বসবাস করছেন। আদি নিবাস বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের মুখপত্র ‘সনাতন কথা’র ২০২০ সালের শারদীয় পূজাবার্ষিকীতে এবং পরে ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা উপলক্ষে নন্দিতা প্রকাশ প্রকাশনী থেকে।
উপন্যাসের প্রারম্ভিক পর্বে লেখক কাহিনি ধারাবর্ণনার মতো করে ব্যক্ত করেছেন। তবু উপন্যাসের ভেতরের যে প্রবহমান গল্প, তা অবলীলায় ফুটে উঠেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা সারজীবনের শেষে তার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন কেন- এই প্রবল বেদনার অনুভূতি দিয়ে ঘটনাপ্রবাহ পাঠককে এমন সব বিষয়ের সম্মুখীন করে, যা একই সঙ্গে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আলোছায়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের হিন্দু স¤প্রদায়ের মানসিক অস্থিরতা- সবই নদীর তীব্র স্রোতের মতো আঘাতের পর আঘাত করে।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র লেখকের বাবা। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্রযোদ্ধা এবং ওই সন্ধিক্ষণে তার সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যার মাথায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছেন। লেখকের তখন শৈশবকাল। তিনি কাহিনি নির্মাণ করেছেন পরবর্তী বয়সে- যৌবনে ভ্রমণ করে, শুনে শুনে, পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রেরণা দিয়ে। লেখকদের পূর্বপুরুষ ১৯৬৫ সালের দাঙ্গার সময় পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু তার বাবা- যিনি মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক তিনি তার দেশের মাটিকে তার ব্যক্তিসত্তার অনিবার্য অংশ হিসেবে আঁকড়ে ধরেছেন।
যুদ্ধকালীন পশ্চিমবাংলায় খবর গিয়েছিল, লেখকের বাবাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই গুজবের সমাধানের জন্য লেখকের বাবা কলকাতায় গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িসহ সবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মানিকগঞ্জের এই মুক্তিযোদ্ধার কলকাতা দর্শন চন্দ্রমুখী জানালার বিচিত্র দ্বার বিস্তৃত করতে করতে কাহিনির ব্যাপ্তি সৃষ্টি করে। এদিকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাকে তার শ্বশুর নদীয়ায় শিক্ষকের পদে চাকরিরও ব্যবস্থা করেছেন। উদ্ধত মুক্তিযোদ্ধা তার শ্বশুরকে বরং বাংলাদেশকে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব দেন। এসব দৃশ্য একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব আমাদের সামনে তুলে ধরে।
লেখক এই অধ্যায়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভঙ্গুর শাসন ব্যবস্থা, সংখ্যালঘুদের অসহায়ত্ব, একই সঙ্গে পশ্চিমবাংলার নকশাল আন্দোলন, বাংলা কংগ্রেসের নির্বাচনী জয়- সবই সময় এবং ঘটনার পরম্পরা উদ্ভাসিত করার জন্য বিবৃত করেছেন। কাহিনির অন্যতম চরিত্র অমল কাকু। তিনি উপন্যাসের মূল চরিত্রের বন্ধু। অমল কাকুও গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে পশ্চিমবাংলায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। তাদের দুই বন্ধুর সাক্ষাৎপর্ব এবং ‘ইউসিআরসি’ নামে উদ্বাস্তু সংগঠনের বিবরণও উপন্যাসের এক অনিবার্য অংশ। এই উপন্যাসের আঙ্গিক খুব মসৃণ নয়। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক জটিলতা আবার মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর দিনের স্রোত ঘটনাপ্রবাহকে এমনভাবে গভীরতর করেছে- সংক্ষিপ্ত আলোচনায় উপস্থাপন করা সহজ নয়। বাংলাদেশের হিন্দুসমাজের যে ব্যথিত রূপ- তার আভাস কাহিনিতে যতটুকু এসেছে- বাস্তবে এই পটভূমি আরও বিরাট। তবু এই প্রজন্মের পাঠকদের জন্য এই কাহিনি বহু বিষয়কে উন্মোচিত করবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের স্ত্রী-সন্তানদের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে জীবন উত্সর্গ করেছেন- এসব দৃশ্য হৃদয়ে বারবার আঘাত করে। পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের ঘটনাগুলো বহুভাবেই চিত্রিত হয়েছে। মানিকগঞ্জের দৃশ্যাবলিও কাহিনির গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়েছে, যেন পাঠক সুস্পষ্ট প্রামাণ্যচিত্র দেখতে পাবেন। পশ্চিম মানিকগঞ্জ, দক্ষিণ মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মধুপর, নাগরপুরের তথ্য আছে। মির্জাপুরের দানবীর রণদাপ্রসাদের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে।
ধীরে ধীরে তখন ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হচ্ছে- সেই সময়কার স্থানীয় জনগণ, রাজাকার, ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, সব মিশে এক অনবদ্য ইতিহাসের বর্ণনা কাহিনিকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
একদিকে নতুন স্বাধীন দেশ, জাতীয় সংগীতের হৃদয়-ভরা প্লাবন, জয় বাংলা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন, বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে নির্যাতিত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা সবই তথ্যপরিক্রমার রূপে কাহিনিকে বেষ্টন করেছে। তার মধ্যে লেখকের বাবার কলকাতা, সেখান থেকে নদীয়ায় আত্মীয়দের কাছে গিয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার বর্ণনাও এই উপন্যাসের পৃথক আবেগময় দৃশ্য। বিস্ময়কর ছবি হলো, ওই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় থাকা আত্মীয়দের নকশাল আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য। নকশাল আন্দোলনের বিভক্তির কারণ ও দৃশ্যও আছে। বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা ওই মুহূর্তে যে অন্তর্দ্ব›েদ্বর গহিনে সাঁতরাতে থাকলেন, তার বর্ণনা পাঠককে ইতিহাস অধ্যয়নের সুযোগ এনে দেয়। বহু বিভ্রান্তি ও অভিজ্ঞতার ঘ্রাণ পাবে পাঠক এ উপন্যাসপাঠের মধ্য দিয়ে।
অবশেষে কাহিনির শেষ পর্যায়ে- মার্চ মাসের পূর্ণিমারাত্রির সেই ঘটনা লেখকের বাবা, কাহিনির প্রধান চরিত্র (যার নাম আমরা জানি না)- সেই মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়-কাঁপানো অনুভব; ‘স্বাধীনতার তীব্র আলো- শুধু জানালা দিয়েই দেখতে হবে, দুয়ার খুলে গায়ে মাখতে পারব না।’
‘চন্দ্রমুখী জানালা’ এক প্রতীকী বিস্ময় নিয়ে পাঠককে আর অনাগত ইতিহাসের পাতার প্রতি উন্মুখ করে তোলে। আর পাঠকের অশ্রুর ঝলক তখন দেখা যাবে- যখন উপন্যাসের শেষ দৃশ্য- যেখানে মুক্তিযোদ্ধা বাবা অন্য শরণার্থীদের জিজ্ঞেস করছেন, ‘দাদারা কি গেদের ট্রেন ধরতে যাইতাছেন।’
বাংলা ভাষা শুনে উত্তর আসে, ‘জি, দাদাও কি জয় বাংলার?’
এই অধ্যায় পাঠকের জন্য অবিকল তুলতেই হয়-
‘বাবা বললেন, হ্যাঁ, আমি মানিকগঞ্জের। আপনারা?’
শরণার্থী দল থেকে উত্তর এলো, ‘আমরা ময়মুনসিং। বাড়িত যাইতাছি। আর কতদিন থাকবাম এই পরের দ্যাশে। শ্যাখসাব দ্যাশে ফিরছুন, আমরা আর থাকতাম কি-য়ারে? আপনি জয় বাংলায় কবে যাইতান? নাহি আর যাইত্যান না?’
বাবা উত্তর দিলেন, যামু, আজকে বিকালের ট্রেনেই জয় বাংলায় ফিরমু।
‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করতেই ভোরের স্নিগ্ধ আলো বাবার চোখে-মুখে এসে পড়ল। বাবা স্মৃতিমেদুরতায় ডুবে গেলেন। জয় বাংলা মানে স্বাধীনতা। জয় বাংলা মানে মুক্ত প্রাণের উচ্ছ¡াস, যে উচ্ছ্বাস প্রতিটি বাঙালিকে আপ্লুত করে, প্রতিটি বাঙালিকে উজ্জীবিত করে। জয় বাংলা মানে ‘প্রাণের আবেগ, প্রাণের মাঝে ধরে রাখতে না পারা।’
এই কাহিনির নির্মাণশৈলী পটভূমির কারণেই ভিন্নতর। আমাদের রক্তের ভেতরগত এক ভিন্নতর উপাদানের কারণে এর আবেগও ভিন্নতর।
(মোয়াজ্জেম হোসেন : কবি ও সাংবাদিক। ধানমন্ডি, ঢাকা)