ড: বাহারুল হক : (১) মানুষকে তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে বাধা সৃষ্টি করা একটা ভারি অন্যায় কাজ। এটা অনেকেই বোঝে না। কিন্তু মনসুর তা বোঝে। ১৯৮৭ সনের কথা। ফেনী থেকে আমি উঠলাম চট্টগ্রামগামী এক ট্রেনে। বসলাম এক ছেলের পাশে থাকা একটা খালি সিটে। সেদিনের সে ছেলেটি আর কেউ নয় আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের খ্যাতনামা প্রফেসর ডঃ নুরুল হুদা আবুল মনসুর। উঠেই আমি হাতে থাকা বইটি খুলে পড়ায় মন দিলাম। বিশ মিনিটের মধ্যে আগে থেকে পড়া শুরু করা বইটি পড়া আমার শেষ হয়ে গেল। এবার ছেলেটিকে দেখলাম। কত বয়স হবে- এই হয়তো ১৮ বা ২০ বছর। ‘আপন ভুবনে আপনি হারা’ হয়ে কেমন করে যেন বসে আছে। আমি কথা শুরু করলাম। কথায় কথায় জানলাম সে ঢাবি থেকে সদ্য বের হয়েছে। কাল সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যাবে লেকচারার হিসেবে যোগদান করতে। এ কথা শুনে বুঝলাম আমি যাকে কলেজ পড়ুয়া ছেলে মনে করেছিলাম সে আসলে তা নয়। আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম। তার সাথে আমার অনেক কথা হলেও আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে জানার জন্য তার শুধু একটা প্রশ্ন ছিল- “আপনি কী করেন”? ও কেমন মানুষ তা বোঝার জন্য আমি তার প্রশ্নের উত্তরে “আমি পড়ি” বলে তার মুখের দিকে বিশেষভাবে তাকালাম। আশ্চার্য্য! সে আমার ঐ উত্তরেই সন্তুষ্ট হয়ে গেল। আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। বুদ্ধিমান ভদ্র ছেলেটি বুঝেছে আমার প্রফেশন আমি গোপন রাখতে চাচ্ছি। অথচ অন্য কেউ হলে কী পড়েন, কোথায় পড়েন নানা প্রশ্ন করতো। কয়েকদিন পর শিক্ষক লাউঞ্জে আমার সাথে তার দেখা হলে সে চমকে উঠেছিল। মনসুর আমার খুব প্রিয় একজন সহকর্মী হতে বেশি দেরী লাগেনি। বছর খানেক পর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। তবে মনসুরের সাথে আমার হৃদ্বতাপুর্ণ সম্পর্ক এখনো অটুট আছে।

(২) আমাদের গ্রামে মুসলিম পরিবারগুলোতে বড় ভাইকে ছোট ভাই-বোনেরা ডাকে বাইছা। বাইছা হলো ভাই ছাহেব / ভাই সাহেব-এর সংক্ষিপ্ত গ্রাম্য রুপ। তবে শহরে মুসলিম পরিবারগুলোতে চলে ভাইয়া ডাক। অন্য দিকে হিন্দু পরিবারগুলোতে বড় ভাইকে ছোট ভাই-বোনেরা ডাকে দাদা। কিন্তু আমাদের পরিবারে ব্যবস্থাটা ভিন্ন। আমাদের পরিবারে বড় ভাইকে ছোট ভাই-বোনেরা ডাকে দাদা ভাইয়া। দুই কমিউনিটির দুইটা শব্দের সংমিশ্রণে এক অসাধারণ দ্যোতনায় আমাদের পরিবারে আবির্ভুত হলো নতুন এক সম্বোধন-দাদা ভাইয়া। চেনা-জানা আর কোন পরিবারে ছোট ভাই-বোনেরা বড় ভাইকে দাদা ভাইয়া ডাকে বলে শুনিনি। দাদা ভাইয়া একটা ব্যতিক্রমী সম্বোধন, আমার খুব প্রিয় একটা ডাক। দাদা ভাইয়া-একটা প্রাণকাড়া শব্দ, একটা মিষ্টি ধ্বনি। পৃথিবীর কোন সঙ্গীত-সুর-রাগ-তাল আমাকে এতটা আন্দোলিত করে না যতটা করে এই একটি শব্দ- দাদা ভাইয়া।

সময়ের প্রভাবে সকলের অবয়বের জেল্লা হয়তো কমে আসতেছে, কিন্তু, দিন যত যাচ্ছে ততই ‘দাদা ভাইয়া’ এই ডাকটি আমার ভাই-বোনদের অন্তরের আরো গভীরতম স্থান থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। আরো বহু বহু দিন আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে আমার প্রিয় ছোট ভাই-বোনদের মুখে শুধু দাদা ভাইয়া ডাক শুনার জন্য।

(৩) গ্রীক অংকশাস্ত্রবিদ আর্কিমিডিস কেন কী অবস্থায় কেমন করে ‘ইউরেকা’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন তা আমরা জানি। বিজ্ঞান জগতে ‘ইউরেকা’ শব্দের চেয়ে মশহুর কোন শব্দ নাই। আর্কিমিডিস বিভোর ছিলেন সোনার মুকুট নিয়ে। ‘ইউরেকা’ কানাডায়ও বিখ্যাত। ‘ইউরেকা রিসোর্সেস’ কানাডার মেরু অঞ্চলীয় ইউকন প্রদেশে সোনারখনির সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি নাম। ‘ইউরেকা’ ইউকনিয়ানদের কাছে খুব পরিচিত একটি শব্দ। ইউকন প্রায় জনহীন। ইউকনের আয়তন ৪,৮২,৪৪৩বর্গ কিঃ মিঃ (সমগ্র কানাডার আয়তন ৯৯,৮৪,৬৭০ বর্গ কিঃমিঃ) আর বিশাল এই প্রদেশে বসবাস করে মাত্র ৪১,৫৪২ জন মানুষ। এই ৪১ হাজারের ২৭ হাজার মানুষের নিবাস স্থলের নাম হোয়াইটহর্স, ইউকনের রাজধানী শহর। ইউকনের প্রধান আকর্ষণ আর্কটিক সার্কেল। প্রতি বছর সামার সিজনে বহু লোক ইউকন যায় শুধু আর্কটিক সার্কেল পা রাখার জন্য। দুর্গম পথ দুঃসহ আবহাওয়া ইউকনকে আলাদা করে রেখেছে। সে কারণে ইউকন কানাডা হলেও সেখানে কোথাও কোথাও দেখা যায় চিকিৎসার মত মৌলিক নাগরিক সুবিধার অভাব, চোখে পড়ে এরকম সাইনবোর্ড- Notice- there are no emergency medical services.

(৪) কিছু মনে থাকে না; আবার সব মনে আছে। চাবি, টাকা, বিভিন্ন রকম কার্ড, সেল ফোন, এ সব হারানোর ইতিহাস আমার আছে। কিন্তু বহু বছর আগে কে কি বলেছিল মনে আছে। সে সব কথা হারায় না। হারায় শুধু আমার স্ত্রী কিছু বললে। এইতো কাল বলেছিল- এক প্যাকেট ঝিরার গুড়া নিয়া আসিও। দোকানে যেতে যেতে মাথা থেকে ঝিরা চলে গেছে। আছে শুধু গুড়া। কি আর করবো! ভেবে-চিন্তে হলুদের গুঁড়া নিয়ে এলাম। স্ত্রী বললেন- হলুদ আনলে কেন? বললাম- তুমি একটা আনকমন আইটেমের নাম বলেছ যা আমি মনে আনতে পারিনি, তাই। বহু পুরোনো কারো কোন কথা স্ত্রীকে বললে স্বস্তি বোধ করি না। কারণ স্ত্রী বলে বসেন- তা কোন কালের কথা তোমার কিভাবে মনে থাকলো? আমি কিছু বললে তোমার মনে থাকে না কেন? আসলে আমিও বুঝি না কেন মনে থাকে, আবার কেন মনে থাকে না। তবে, দুবাই এয়ারপোর্টে কি শুনাছি তা বললে আমার স্ত্রী খুব খুশি হয়ে যান। দুবাই এয়ারপোর্টে চেক-ইন – এ দাঁড়ালাম। আমার সামনে কানাডিয়ান পাসপোর্টধারী আমার স্ত্রী। কর্তব্যরত মহিলা তার পাসপোর্ট দেখলো; ও কে হয়ে গেল। সে ভিতরে ঢুকে গেল এবং আমার জন্য দাঁড়িয়ে রইলো। এবার আমার পালা। আমার বাংলাদেশী পাসপোর্টটা কত করে দেখলো! কত কথা জিজ্ঞাসা করলো! শেষে আমাকে প্রশ্ন করলো- ঐ মহিলার সাথে তোমার কি সম্পর্ক? আমি বললাম- সে আমার স্ত্রী। মহিলা চনমনে ভাব নিয়ে হেসে আমাকে বললো- Wow! You are lucky. You have a Canadian wife.

(৫) আমার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমার সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতির কথা আজ বলবো। আমার ছেলে তার জীবন সংগ্রামে প্রথম সফলতা অর্জন করেছিল আজকের এই দিনে। বড় রকমের সফলতা। এরকম একদিনে সে জীবনে প্রথম নিজে একা হেঁটে এসে আমার হাত ধরেছিল। আজকের দিনটি তাই আমার কাছে তার জন্মদিনের মত তাৎপর্য্যপুর্ণ বা আনন্দঘন মনে হয়। তার বয়স তখন এক বছর হতে যাচ্ছে। আমার ছেলে নিজে নিজে হাঁটার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের কাজের মেয়েটা চাচ্ছে সে কাউকে না ধরে নিজে নিজে হাঁটুক। আমি চেয়ারে বসে কি যেন লিখছিলাম। অপর পাশে একটা চেয়ারে আমার স্ত্রী বসে আছে। কাজের মেয়েটা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বললো- মামা, মামা, আনন্দ নিজে নিজে হেঁটে আপনার কাছে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি তাই। ছেলে গালভরা হাসি নিয়ে দুহাত মেলে হেলে দুলে পায়ের আঙুলগুলো চিপে চিপে ধীরে ধীরে পা ফেলে ফেলে আমার দিকেই আসছে। আমি দ্রুত চেয়ারটা সরিয়ে ফ্লোরে বসে তার দিকে দুহাত মেলে ধরলাম। আমাকে ওভাবে দেখে তার হাঁটার গতি বেড়ে গেল। সে দ্রুত হেঁটে আমার হাত ধরলো। তার সেদিনের সফলতাকে আমি মনে করি তার জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা। তার সফলতায় আমি বরাবরই আনন্দ অনুভব করি। কিন্তু তার কোন সফলতার আনন্দ আমার সেদিনের আনন্দকে ম্লান করে দিতে পারেনি। আরেকটা কথা, সেদিন প্রথম হেঁটে সে কিন্তু তার মার কাছে যায়নি; এসেছে আমার কাছে, আমার শক্ত হাত ধরতে। আমার মনে হয় সে বয়সে সেদিন সে বুঝেছে জীবনে সফল হতে হলে আব্বুর শক্ত হাত ধরতে হবে। সে কোন ভুল করেনি। তার সফলতার জন্য, তার খুশির জন্য যা লাগে সাধ্যানুযায়ী তাকে তা দিতে আমার প্রচেষ্টার কোন অন্তঃ নাই। জীবনে প্রথম সে যে বিশ্বাসে আমার হাত ধরেছে তার সে বিশ্বাস যেন চিরদিন অটুট থাকে, আমি সে ভাবেই কাজ কাজ করে যাচ্ছি। আমি কখনো ভাবিনা সে আমার জন্য কী করছে, আমি সারাক্ষণ ভাবি আমি তার জন্য কী করছি।

(৬) নির্দেশ ২টি: (১) কায়েম / পালন কর (২) বর্জন করো। কায়েম করো: নামায। বর্জন করো: মিথ্যা বলা। নামায কায়েম করা বিষয়ে বিকল্প আছে। স্বাভাবিকভাবে না পারলে বসে, বসে না পারলে শুয়ে, শুয়ে না পারলে ইঙ্গিতে। মিথ্যা বলা বিষয়ে কোন বিকল্প নাই; বর্জন করতেই হবে এবং শতভাগ। কোথাও বলা হয়নি- আচ্ছা ঠিক আছে, একেবারে ছাড়তে না পারলে কম কম বলিও বা আচ্ছা ঠিক আছে, মা-বাবার সাথে বলিও না বা আচ্ছা ঠিক আছে, জুমার দিন (শুক্রবার) বলিও না।
পালন করো: হজ্ব। বর্জন করো: ঘুষ খাওয়া।

হজ্ব করা বিষয়ে বিকল্প আছে। তুমি নিজে যেতে না পারলে অন্য কাউকে পাঠাও তোমার পক্ষ থেকে। ঘুষ খাওয়া বিষয়ে কোন বিকল্প নাই। বর্জন করতেই হবে এবং শতভাগ। কোথাও বলা হয়নি- আচ্ছা ঠিক আছে, খাও, তবে বেশি না; একটা লিমিটের মধ্যে থাকিও বা আচ্ছা ঠিক আছে, খাও তবে আত্মীয়-স্বজনদেরকে ছাড় দিও। আমরা ‘করো’ বিষয়ে সিরিয়াস, কিন্তু ‘বর্জন করো’ বিষয়ে একেবারে উদাসিন। কেন?

(৭) আমরা সবাই প্যারোলে আছি। কেউ মুক্ত বা স্বাধীন নই। প্যারোলে আছি বলে ডেইলি পাঁচ বার হাজিরা দিতে হয়। হাজিরা দিয়ে নিজের অবস্থা জানান দিতে হয়। প্রতি বার বলতে হয়- “তুমি আমাদেরকে চালিত করো সঠিক পথে, তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ”। যা ইচ্ছা তা করার, যা ইচ্ছা তা বলার, যা ইচ্ছা তা দেখার, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাওয়ার কোন অনুমতি নাই। এই ব্যবস্থার কোন বিকল্প নাই; এর বিরুদ্ধে আপিল করারও কোন সুযোগ নাই। কারণ যিনি এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তার উপরে কেউ নাই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বময়, সর্বেসর্বা, সর্বকালীন, সর্বদর্শী, সর্বনিয়ন্তা, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বজ্ঞ, এবং সর্বোত্তম।

(৮) গেলাম ক্লিনিকে থেরাপি দিতে। ট্রিটমেন্ট টেবিলে শুয়ে পড়লাম। কাইরোপ্র্যাক্টর ডঃ হাদির সহকারী মিশেল আসলো। আমার পায়ের তালুতে বেল্টের একটা প্রান্ত বেঁধে বেল্টের অপর প্রান্ত আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শিখিয়ে দিল কিভাবে ব্যায়াম করতে হবে। তারপর আমার সেলের পর্দাটা টেনে দিয়ে চলে গেল। আমি ছিলাম হাংরি এবং টায়ার্ড। তাই ব্যায়াম শুরু করে অল্প সময়ের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। মিশেল যে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে তা বুঝিনি। হঠাৎ মিশেলের ডাক- “মিঃ হক, কী করছো তুমি”? আমি হতচকিত হয়ে জোরে বললাম- “কেন, ব্যায়াম করছি”। মিশেল বললো- “না, তুমি ব্যায়াম করতেছ না; তুমি ঘুমাচ্ছ এবং বলতে বলতে মিশেল আমার সেলে ঢুকলো। আমি বললাম- “কে বললো তোমাকে আমি ঘুমাচ্ছি”? মিশেল বললো- “আমি ক্লিয়ারলি শুনেছি তোমার নাক ডাকা”। কী আর বলবো? হাতে নাতে তো ধরা। আরো দশ মিনিট ব্যায়াম করে তবে ছাড়া পেলাম। ডঃ হাদি নয় শুধু তার সহকারীগুলোও ভারি চমৎকার। তারা খুবই আন্তরিক, দক্ষ ও হাসি খুশি। নানা কথা বলে তারা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাওয়া রোগীকেও হাসায়।