ড: বাহারুল হক: (১) উদ্দেশ্য অভিন্ন। উদ্দেশ্য ছিল জেনে নেওয়া আমি মুসলমান না হিন্দু না অন্য কোন ধর্মাবিলম্বী। কিন্তু জানতে সবাই এক কৌশল অবলম্বন করেনি। কেউ বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করেছেন- “আপনার ভালো নামটা বলবেন কী”? কেউ ভদ্রভাবে বলেছেন- “মনে হচ্ছে আপনি মুসলমান”। কেউ প্রশ্ন করেছেন- “আপনি বাঙালি না মোহামেডান”? কেউ কেউ সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছেন- “আপনি মুসলমান না হিন্দু”? ভারতে চার বছর থাকাকালীন ভারতের মানুষ এভাবেই জেনে নিয়েছেন আমি হিন্দু না মুসলমান। তবে এবার টরন্টোতে একজন ভিন্ন এক ভাবে জেনে নিয়েছেন আমি হিন্দু না মুসলমান। তার কৌশলটা ইন্টারেস্টিং। তার সাথে কথা হলো কিছুক্ষণ। বিদায়ের সময় তিনি সহাস্যে বললেন- “আমি কী এখন নমস্কার বলবো নাকি বলবো খোদা হাফেজ”? উল্লেখ্য তিনি বহু বছর কর্মসূত্রে ঢাকা ছিলেন, বাংলা শিখেছেন এবং সেদিন আমার সাথে কথা বলেছিলেন বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে।

( ২) ট্রেনে চড়ে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। সুঠামদেহী এক যুবক এসে বসলো আমার পাশে। বসেই হাতের গ্যালাক্সিটা অন করে গানে গেল। তারপর ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে গান শুনতে লাগলো। গানতো আর আমি শুনতে পারছি না কিন্তু গ্যালাক্সির স্ক্রিনে দেখতে পাচ্ছি গান করছে আমার প্রিয় গায়ক জেসন ডিরুলু। আমার দৃষ্টি স্ক্রিনে বাধা পড়েছে দেখে ছেলেটি বললো- তুমি কী ওর গান পছন্দ কর? আমি বললাম- করি। সে বললো- শুনতে চাও? আমি হাঁ বললাম। এবার সে যেটা আমি ভাবিনি তাই করলো। আমি ভেবেছিলাম সে গ্যালাক্সি থেকে ইয়ারফোন সরাবে। সে তা না করে তার কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিল এবং ১টা উইং লম্বা করে আমার কানে পরিয়ে দিল। এদেশে এমন আপ্যায়ন আমি আগে কোনদিন পাইনি। শুনছিলাম ডিরুলুর গান। ডিরুলুর সেই বিখ্যাত গান ‘ইটস টাইম টু সে গুডবাই’ শেষ হতেই ছেলেটার ট্রেন জার্নিও শেষ হলো। কোন দেশের ছেলে কী তার নাম কিছুই জানা হলো না। তাকে দেখেই বুঝেছি তার শরীরে আছে রক্তের দুটি ধারা- ১টা কালো অন্যটি সাদা। তার গায়ের রঙ, নাক, গাল, থুতনি, আই ভুরু বলে দিচ্ছে সেসব সাদার ফসল। অন্যদিকে তার মাথা ভর্তি কালো ফাঁফা কোকড়ানো চুল, আই ল্যাশ, চোখের কালো রঙ এবং তার ঠোঁট দুটি জানান দিচ্ছে সেসব কালো থেকে এসেছে। কালো-ধলোর সুন্দর সহাবস্থান তার শরীরে। শুনেছি মিশ্র ব্লাডের বাচ্চারা উদার, সাহসী, আর আমুদে হয়।

(৩) ধৈর্য একটা শব্দ, একতা বার্তা, একটা অনন্য সাধারণ দ্যোতনা। ধৈর্য একটি গুণবাচক বিশেষ্য। কার্য সম্পাদনে দেরি বা সমস্যা হলে রাগ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, ইত্যাদিকে কাছে আসতে না দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতাকে বলা হয় ধৈর্য। মানব চরিত্রের এটা একটা বিশেষ গুণ। মনে হয় বাংলা ভাষায় অর্থের ব্যাপকতায় বিপুলভাবে এত ঋদ্ধ শব্দ খুব কমই আছে। জন্মসূত্রে সবাই এ গুণের অধিকারী হয় না। এ গুণ অর্জন করতে হয়। এ দুর্লভ গুণের অধিকারী হওয়ার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে হয়, সাধনা করতে হয়। মানুষকে ধৈর্যশীল হতে হবে এটা শুধু নীতিকথা বা আদর্শ কথা নয়। ধর্মগ্রন্থসমুহেও ধৈর্যশীল হওয়ার তাগিদ আছে। পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে- “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। আল্লাহ তো ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন”। কিসের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবো? পবিত্র কোরআান অনুসারে উত্তর হলো- ধৈর্যের মাধমে আর নামাজের মাধ্যমে। উত্তরে এটা স্পষ্ট যে ধৈর্য নামাজের মতই গুরুত্ত¡পূর্ণ। অতএব, নামাজের মতই বাধ্যতামুলক। নামাজ থেকে দূরে থাকার সুযোগ যেমন নাই তেমনি অধৈর্য হওয়ার কোন অবকাশ ও কারো জন্য নাই। ধৈর্যের কোন বিকল্প নাই। ধৈর্যশীল হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যান্তর নাই। ধৈর্যশীল মানুষ সফল হয়।

(৪) টরন্টোর রাস্তায় Mosquito Toronto লেখা গাড়ি দেখে আমি চমকে উঠলাম আর সাথে সাথে বিশিষ্ট মশা বিশেষজ্ঞ আমাদের প্রিয় হুদা ভাই (প্রয়াত প্রফেসর কে, এম, নুরুল হুদা)কে মনে পড়ে গেল। মশা! টরন্টোতে! এত সুন্দর শহরে মশা! এর কিছুদিন পর একদিন আমি আর আমার স্ত্রী গেলাম বেস্টভিউ পার্কে। এটি এ শহরের একেবারে উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি বিশাল পার্ক। এটিকে পার্ক কেন বলে বুঝলাম না। প্রবেশ পথটুকু পার্কের মত এবং ওটাই দর্শক টানে। ভিতরে গহিন জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতর হাঁটা পথ। মশার জ্বালায় ১০ মিনিটও টিকা গেল না। দৌড়ে বেরিয়ে আসলাম। বড় বেপরোয়া আর হিংস্র প্রত্যেকটা মশা। হুদা ভাই বেঁচে থাকলে আজ ছেলের সাথে থাকতেন কানাডা আর আমি হুদা ভাইকে এনে ঢুকিয়ে দিতাম এই বেস্টভিউ পার্কে আর মশাদের বলতাম- “দেখ কাকে এনেছি”।

(৫) মানুষ তার এক জীবনে পার করে কতগুলি স্তর। প্রথমে সে শিশু তারপর কিশোর তারপর সে বালক তারপর সে যুবক; শরীরে মনে পুরোপুরি সতেজ একজন মানুষ। ইচ্ছাগুলিকে বাস্তবায়নের কঠিন সংকল্প নিয়ে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাওয়া বিপুল সম্ভাবনাময় একজন মানুষ এই যুবক। প্রতিটি যুবক শক্তি আর সাহসের এক যুগ্ম প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবি সব থেকে সুন্দর সব থেকে উজ্জল থাকে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত। ৪০ এর পর উদ্দামতা উচ্ছলতা ক্ষিপ্রতা সব কিছু জয় করার উদগ্র বাসনা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। শরীরের শক্ত গাঁথুনি ধীরে ধীরে ঢিলা হতে শুরু করে। মন আর শরীরের একসাথে এক ছন্দে এক বৃত্তে নেচে নেচে চলার চুক্তি ভেঙ্গে শরীর সরে আসতে চায়। এক সময় হতাশ হয়ে গেয়ে যায়- ‘দৃষ্টিতে আর হয়না সৃষ্টি আগের মত গোলাপ ফুল’। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়ে যায়। এই যুবক একসময় বার্ধক্যে উপণীত হয়। হারায় শরীরের শক্তি মনের সাহস। যে মানুষটি নিজের সব শক্তি দিয়ে বুকে সাহস নিয়ে হাসিমুখে আশার শত বাণী শুনিয়ে দশ জনকে টেনে সামনে নিয়ে গেছে সে-ই দুর্বল শরীর আর ভাঙ্গা মন নিয়ে পড়ে থাকে সবার পেছনে। ব্যাকুল হয়ে খুঁজে বেড়ায় একটি শক্ত হাত যে হাত ধরে সে একটু পথ নির্ভাবনায় চলতে পারবে। যে বুক ভরা ভালোবাসা খুশি মনে যৌবনে বিলিয়েছে সে-ই একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙ্গালের মত চুপ করে চোখ মেলে শুধু চেয়ে থাকে। কানে সাইরেন বাজে, মনের মধ্যে রাজ্যের সব কথা তোলপাড় করে, চোখে নদী বয়ে যায়। কে দেখে কে শুনতে পায়? এভাবে নিবু নিবু করে করে একদিন দপ করে নিবে যায়। সব শেষ হয়ে যায়। যে ঘুড়ি পত পত করে আকাশে উড়ে সবাইকে আনন্দ দিয়েছে সে ঘুড়ি সুতোর বন্ধন কেটে নাটাই ফেলে গহিন এক পাথারে হারিয়ে যায়। কেউ খুঁজে না কেউ খুঁজতে যায় না।

(৬) আমার মনে হয় একজন সরল মানুষ মানে একজন বোকা মানুষ। এই তত্বের সত্যতা বোঝার জন্য উদাহরণ খুঁজতে দূরে যেতে হবে না। আমি ভালো একটা উদাহরণ। আমি ভেবে ছিলাম ফেসবুক আমার মত সহজ-সরল একটা বিষয়। একাউন্ট খোলার পর আমি কোনদিন ‘লগ অফ’ করিনি। পাবলিক, ফ্রেন্ড, ব্লক, আনফ্রেন্ড ইত্যাদি, হাবিজাবি কত কিছু! আমি কোন দিন এসবের দিকে ফিরেও তাকাইনি। যখন হ্যাকারের পাল্লায় পড়লাম তখন বুঝলাম আমি কত বোকা আর ফেসবুক কী জটিল। আমি ইমেইল একাউন্ট খুলেছিলাম ২২/২৫ বছর আগে। সেই একাউন্ট যে ফেসবুক একাউন্টের বাবা তা আমি জানতাম না। সেই ইমেইল-ফেসবুক রাসায়নিক জটিলতায় আজ আমার আগের ফেসবুক একাউন্টটা আটকে আছে। ফেসবুক একাউন্টটা ফিরে পাচ্ছি না। ওটা এখনো হ্যাকার সাহেবের হাতে। আমার একাউন্ট হ্যাকিং বিষয়টা নিয়ে প্রথমে টরন্টো পুলিশ তারপর ফেসবুকের টরন্টো অফিসে আমি গিয়েছি। ফেসবুক আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। যেহেতু একাউন্টটা আমার হাতে নাই, হ্যাকারের হাতে, তাই আপনাদের সকলের কাছে আমার অনুরোধ-আপনারা সবাই নিজের শুদ্ধ চিত্ত¡ এবং নির্মল ভাবনাকে শুদ্ধ ও নির্মল রাখার লক্ষ্যে হ্যাকারকে আনফ্রেন্ড করুন এবং ঐ একাউন্ট থেকে আপনাদের মুখ ফিরিয়ে নিন। সবাই ভালো থাকুন। আপনাদের প্রত্যেকের নিত্যদিন আনন্দের দিন হোক, হোক সফলতার দিন।

(৭) সপ্তাহে ৩/৪ দিন আমি যাই। মেম্বার বলে আমার কাছে কার্ড আছে। সেটা গেটে সোয়াপ করলে গেট খুলে যায়; আমি প্রবেশ করি। কাল কার্ড নিতে ভুলে গেলাম। গেটে বসা রিসেপশনিস্ট লিজাকে হেসে বললাম- “সরি লিজা, আমি কার্ড আনতে ভুলে গেছি”। ভেবেছিলাম এটা বলা মাত্র লিজা তার সামনে বোর্ডে রক্ষিত বাটন টিপে গেট খুলে দেবে। কিন্তু না, লিজা তা করলো না। সে আমার নাম জেনে নিয়ে কম্পিউটারে কী যেন দেখলো, তারপর হেসে বললো- “তুমি প্রবেশ করতে পার”। লিজা আমাকে বহু বছর ধরে দেখছে, চেনে আমাকে। গেলেই হেসে বলে- ‘গুড মর্নিং/গুড আফটার নুন’, ইত্যাদি। সেই লিজা এখন কী চেক করলো বুঝলাম না। তাই প্রবেশ না করে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- “লিজা, কী দেখলে”? লিজা বললো- “দেখলাম তোমার মেম্বারশিপের মেয়াদ এক্সপায়ার করেছে কিনা”। আমি বললাম- “যদি দেখতে এক্সপায়ার করেছে তাহলে”? তার সহাস্য উত্তর- “তাহলে সরি বলতাম, গেট খুলতাম না”। ওর জবাব শুনে আমি খুব খুশি হলাম। মনে মনে বললাম- হাঁ, একেই বলে সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায় নিষ্ঠতা। এভাবে এদেশে নিয়ম মানা হয়, আইন মানা হয়। অথচ আমাদের দেশে? বিমানবন্দরে যে লোক বডি চেক করে বা লাগেজ চেক করে সে যদি দেখে প্যাসেঞ্জার আত্মীয়, বন্ধু বা বস তখন নাকি চেক করে না। কর্তব্যরত ব্যক্তির কর্তব্যহেলার জন্য পিস্তল, ইয়াবা, সোনা, ইত্যাদি চলে যায় প্লেনে। ঘটে দুর্ঘটনা। সেখানে কর্তব্যরত ব্যক্তিটার কাজ করা উচিত এই লিজার মত নির্মোহভাবে, কারো প্রতি কোন রকম দুর্বলতা প্রকাশ না করে। অবশ্য মাঝে মাঝে এলোমেলো হয়ে যায় সব এবং ওসব বলদ কর্মচারী চাকুরি হারায়।

(৮) মানুষের সুখের সঠিক মাত্রা নির্ণয় করতে পারি না। কিন্তু দুঃখের তীব্রতা অনুধাবন করতে পারি। মনের দুঃখের চিত্র বড় স্পষ্ট করে মুখের মধ্যে ফুটে উঠে। সে চিত্র লেখা বুঝার সাধ্য সবার নাই। কারো কারোতো একদমই নাই। এই ‘একদমই নাই’ গ্রুপের মানুষগুলো আবার বড় সুখী মানুষ। যারা অন্যের দুঃখ বুঝে এদের আবার দুঃখ বেশি: নিজের দুঃখ+অন্যের দুঃখের জন্য দুঃখ। এরা বড় হতভাগা। আমি সেই হতভাগাদের একজন।