ডঃ বাহারুল হক : *** মা মানুষের জীবনে একটা সবচেয়ে বড় অনুভুতি। মায়ের কাছ থেকেই মানুষ সব শিখে। মায়ের কথা মনে হলেই প্রত্যেকটা মানুষের মনে হাজারটা কথা এসে ভিড় করে। আমার মায়ের কথা মনে হলেই মনে আসে আমার মায়ের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা আর পরিপাটি থাকার কথা। দিনভর না হয় থাকেন, কিন্তু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মা পরনের শাড়িটা খুব সুন্দর করে পরতেন। মাথায় তেল দিয়ে খুব সুন্দর করে মাথা আঁচড়াতেন। মা আয়না-চিরুনী-তেল নিয়ে বসলেই বুঝতাম মায়ের ঘুমানোর সময় হয়েছে। মুসলিম স¤প্রদায়ে মৃতের জন্য করণীয় যা তা হলো- গোসল দিতে হবে, তারপর মৃতদেহকে কাফনের কাপড় নামক নতুন সাদা কাপড় পরাতে হবে। তারপর এই মৃতদেহ কবরস্থ করা হবে। আমার মায়ের আজীবনের লালিত এই অভ্যাসের পরম পরিপুর্ণতা ঘটেছে মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মৃতদেহ কবরস্থ করার মাধমে। আমরা মুসলিম। ফলে গোসল দেয়া আতর গোলাপ মাখানো সাদা নতুন কাপড় (কাফনের) পরানো, পরিয়ে একটা নতুন বিছানায় (কবর হলেও বিছানাতো) রাখা এ সবই হয়েছে স্বাভাবিকভাবে (যেহেতু এটাই ইসলামের বিধান)। যদি এ বিধান না থাকতো তাহলে আমি সীমাহীন কষ্ট পেতাম। ইসলাম আমাকে সে মহা কষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছে।
*** ছোট্ট একটা শিশু পুত্র নিয়ে তখন আমার সংসার। ডিপার্টমেন্ট থেকে বাসায় ফিরতাম। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়তাম। হাতে নিতাম একটা ম্যাগাজিন। ওটা খুলে পড়তে থাকতাম। আমার ছেলে আসতে দেরি হতোনা। এসেই বসতো আমার বুকের উপর; আমার হাতে ধরা বইটার পেছনে। বেঁকে, হেলে, উপুড় হয়ে সব রকমে বইটা দেখতো। কিন্তু ওটার দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকার মত কিছু সে পেত না। তাই আমাকে জিজ্ঞাসা করতো- আব্বু কি দেখ? আমি বলতাম- বই দেখি বাবা। ছেলে বইটা আমার হাত থেকে নিত এবং ছুঁড়ে ফেলে দিত। তারপর আমাকে বলতো- আব্বু, আমাকে দেখ। তারপর আর কি! বুকের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। জ আর সেই ছোট বেলার মত তাকে দেখতে পাই না। এখন সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সে ব্যাস্ত। আগেত অফিসে যেত, এখন ওর রুমটা ওর অফিস। সারা দিন ওর রুমে। মিটিং করে, কথা হয়, হাসিও শুনি, সাথে কাজত চলছেই। আমি মাঝে মাঝে উঁকি দেই। ছেলে বলে – আব্বু কি দেখ? আমি বলি- তোমাকে দেখি বাবা। মনে মনে ভাবি আহা ছেলেটা যদি আমাকে বলতো- আব্বু, ভিতরে আস, আমাকে দেখ। ছেলের এখন কত কাজ! এইত বিকালের ফ্লাইটে চলে গেল আমেরিকার অরল্যান্ডো শহরে। সেখানে এক সপ্তাহ থাকবে। এই এক সপ্তাহ কোথাও উঁকি দিয়েও ছেলেকে আর দেখতে পাবো না। দিন গুনছি, কবে সাত দিন শেষ হবে, কবে ছেলে ঘরে ফিরবে।
*** ক্যারিং ক্যাপাসিটি একটা গুরুত্ত¡পুর্ণ বিষয়। পুল-কালভার্ট, ব্রিজ-ফেরি, বাস-ট্রাক, এলিভেটর, ইত্যাদির ক্যারিং ক্যাপাসিটি কি রকম তা উল্লেখ থাকে। এ বিষয়টি মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানুষেরও ক্যারিং ক্যাপাসিটি আছে এবং সেটা সব মানুষের এক রকম নয়। এই ক্যাপাসিটি ব্যাক্তি কেন্দ্রিক। এক ব্যাক্তির ক্যাপাসিটি আরেক ব্যাক্তি থেকে পৃথক। এমন কি একই মায়ের সব সন্তানের ক্যারিং ক্যাপাসিটি এক রকম নয়। এখানে ভালো খবর এই যে, বেশির ভাগ পিতা মাতা এই প্রভেদ যে প্রাকৃতিক তা বুঝেন এবং এটা সহজেই মেনে নেন। মেনে নিয়ে পিতা মাতা সব সন্তানের প্রতি সমান ভাবে সদয় থাকেন এবং সন্তানদের ক্যারিং ক্যাপাসিটি বুঝে সন্তানদের সাথে কথা বলেন। ক্যারিং ক্যাপাসিটি বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, কাজের চাপ সহ্য করার, অন্য কোন মানুষ বা পরিবেশের সাথে এডজাষ্ট করার চাপ সহ্য করার, দুঃখ-অপমান-অবহেলা- মানসিক নির্যাতন সহ্য করার বা আনন্দ যা আসে জীবনে তাকে সঠিকভাবে উপভোগ করার ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি। লোড বা চাপ যখন ক্যাপাসিটি থেকে বেশি হয়ে যায় তখন ব্রিজ-কালভার্টের মত মানুষটিও ভেঙ্গে পড়ে। যাদের ক্যারিং ক্যাপাসিটি বেশি তারা ভাগ্যবান; তারা বেঁচে যান, আর যাদের ক্যারিং ক্যাপাসিটি কম তারাই দুঃখী; তারাই অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টে নিপতিত হন।
** ভদ্রলোক ছেলের জন্য মেয়ে দেখতেছেন। অনেক মেয়ের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোনটাই তাদের পছন্দ হয়নি। এবার একটা মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল। তিনি আমাকে বললেন- “মেয়ের বাবার সাথে সরাসরি কথা বললে কেমন হয়”? আমি বললাম- “ভালো সিদ্ধান্ত, বলেন”। এরপর বেশ কিছু দিন কেটে গেল। তিনি কিছু বলেন না। সেদিন আমি জিজ্ঞাসা করলাম- “তো মেয়ের বাবার সাথে কথা হয়েছে”? তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন- “হাঁ, হয়েছে”। তো ফলাফল কী? তিনি বললেন- “ফলাফল জিরো”। আমি বললাম- “কি সমস্যা”? তিনি বললেন- “এত কথা বলতে আমি জীবনে কোন মানুষকে দেখি নাই। কাউকে কথা বলতে দেয় না, কারো কথা শুনতে চায় না। অন্যের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয়। কথা উনি বলবেন, অন্যেরা শুধু শুনে যাবে। এ ধরনের মানুষের সাথে কি কথা”? আমি ভড়কে গেলাম ভদ্রলোকের কথা শুনে। বাপরে! কত রকমের সমস্যা! আচ্ছা, এত কথা বলার দরকার কী? আসলে, বোবার শত্রæ নাই, এটা একদম সঠিক কথা।
*** একটা পুরুষ মানুষ যেন একটা ট্রিপল রীড হারমোনিয়াম। ম্যাঁ, ম্যাঁ, ম্যাঁ; মা, মা, মা, এবং মিঁউ, মিঁউ, মিঁউ। এই তিনটি সাউন্ড নিয়ে ট্রিপল রীড হারমোনিয়ামের মত একটা পুরুষ মানুষের জীবন পরিক্রমা। সেই পুরুষ মানুষটা যে কেউ হতে পারেন; হতে পারেন কোন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর বা কোন হলের ঝাড়ুদার। জীবন তার ম্যাঁ-ম্যাঁ করে শুরু হয় তারপর শেষ হয় মিঁউ- মিঁউ করে। মিঁউ- মিঁউর সাথে শান্তির ডাইরেক্ট সম্পর্ক। মিঁউ -মিঁউ যে যত লাগসই ভাবে করতে পারে সে থাকে তত শান্তিতে।
*** রাত বড় হচ্ছে আর ছোট হচ্ছে দিন। দিনের আলো উষ্ণতা হারাচ্ছে, রাতে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। গাছের পাতা ঝরে পড়ছে; অনাবৃত বৃক্ষরাজি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে কোন সুদুরের কে আসবে বলে। অবশেষে আসবে তীব্র ঠান্ডার পিঠে চড়ে সফেদ বরফ। সব খোলা অনাবৃত। যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসে যাবে বরফ। না বলার কেহ নাই। এখানে কেউ না বলে না। পাখী, প্রজাপতী, কেউ না বলে না । বরং দেশ ছেড়ে চলে যায় দুরে বহু দুরে। উড়ে যায় কানাডা গীজ। রাতে দল বেঁধে ডাক দিয়ে দিয়ে তাদের দক্ষিণ দিকে উড়ে যাবার দৃশ্য দেখি। উড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা দল। ডাক শুনি। সেই একই ডাক যে ডাক আমি শিশু কালে শুনতাম রাতে আমাদের উঠানে দাঁড়িয়ে। সেটি ছিল আগমনের দৃশ্য। হাজার হাজার মাইল দুরে এ পাখীদের জন্মস্থান কানাডায় দাঁড়িয়ে তাদের বহির্গমনের দৃশ্য দেখবো তা কোন দিন ভাবনায় আসেনি। ফিরে আসার আশায় বুক বেঁধে উড়াল দেয়া কানাডিয়ান গীজদের উদ্যেশ্যে আমি বলি- তোমার জন্মভুমি ছেড়ে এখন চলে যাও আমার জন্মভুমিতে; সেখানে শীতের তীব্রতা নাই, বরফের নির্মমতা নাই। সেখানে ভোমরা ফুলের সাথে কথা কয়, নীল পদ্মের উপর নাগ শিশুরা খেলা করে, দিগন্ত বিসতৃত সরিষা ক্ষেতে সরিষা ফুল দোল খায়। আরো বলেছি – সাবধানে থেকো, হয়তো হঠাৎ অচেনা শব্দ শুনবে, সে শব্দ তোমাকে ঠেলে দিবে আরো অচেনা ৩য় এক জগতে, যেখেনে গেলে তোমার আর কোথাও ফিরে যাওয়া হবে না।
*** ঢাকা শহরেই আছেন একজন ডাক্তার যিনি ডাক্তার হিসেবে যত বড় মানুষ হিসেবে তার থেকে অনেক অনেক বেশি বড়। বর্তমানে তিনি একজন কনসালটেন্ট এবং এমডি। ডাক্তার নিয়ে নানা জনের নানা অভিজ্ঞতা। কারো কারো এত তিক্ত যে কসাই-চামার-ডাকাত এসব বলতেও দ্বিধা করেন না। সাধারনত আচরনে মানবিকতার ঘাটতি দেখলে রোগীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের মন্তব্য আসে। আবার ভালো, খুব ভালো এ ধরনের মন্তব্যও করেন অনেকেই। কিন্তু এই ডাক্তার সম্মন্ধে আমার মন্তব্য হলো মানবিকতার বিচারে তিনি অসাধারন একজন ডাক্তার। তিনি তার এক রোগীর সাথে যে আচরন করেছেন সে রকম মানবিক আচরন অন্য কোন ডাক্তার কোথাও করেছেন বলে আমার জানা নেই। ১৯৯৮ সন। তিনি অপারেশন করলেন এক দরিদ্র রোগীর চোখে। ফি নিলেন ত্রিশ হাজার টাকা। অপারেশন বিফল হলো। রোগী আর্জি পেশ করলেন কিছু টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। ডাক্তার বিলম্ব না করে রোগীর হাতে তুলে দিলেন দশ হাজার টাকা।
*** কানাডার মায়াভরা এক প্রজাপতির নাম মিল্কউইড প্রজাপতি। আধা গ্রামের চেয়েও কম ওজনের এই প্রজাপতির শীত সহ্য হয় না। তাই শীতের আগমন বার্তা পেলেই উড়াল দেয় দক্ষিণ দিকে। প্রায় ২৫০০ মাইল পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় মধ্য মাক্সিকোর পাহাড়িয়া বনে। সেখানে শীত কালটা কাটায়। শীতের শেষে আবার পথ ধরে উত্তরে ফেলে আসা নিজ দেশ কানাডার দিকে। শীতকে কি ভয়! বাঁচার কি দুর্মার প্রচেস্টা! রুপবতী এই প্রজাপতি আবার সব কিছুতে মুখ বসায় না। ফুলের নেকটারই এদের প্রধান খাদ্য।
*** হাঁটু ব্যাথা। ফলে যেতে হলো কাইরোফ্র্যাক্টর ডাঃ হাদির ক্লিনিকে। একটা ১৭/২০ বছর বয়সের ছেলে এসে আমাকে হাদির কাছে নিয়ে গেল। হাদি চেপে টেনে টিপে ভালো করে দেখলেন; আমার কথাও শুনলেন। তারপর ছেলেটাকে বলে দিলেন আমাকে কিভাবে কি করা লাগবে। ছেলেটা আমাকে নিয়ে ঢুকলো লেগ প্রেসিং ক্যাবিনে। ছেলের বুকে ট্যাগ লাগানো আছে। তাতে লেখা আছে- ছাত্র। আমি কৌতুহলী হয়ে তার সাথে কথা শুরু করলাম। সে জর্জ ব্রাউন কলেজের ছাত্র; পিতৃভুমি ফিলিপাইন্স। একথা সেকথা- এক সময় নাম জিজ্ঞাসা করলে বললো নাম তার মৃগেল।আমি হাসলাম; তারপর বললাম- তোমার ভাইয়ের নাম কি কাতলা? মৃগেলের জবাব- না, কাতলা নয়। মৃগেল এবার আমাকে বলে বসলো- আচ্ছা আমার ভাইয়ের নাম কাতলা হতে যাবে কেন? আমি বললাম- না আমাদের দেশে মৃগেল যেখানে পাওয়া যায় সেখানে কাতলাও পাওয়া যায়, তাই বললাম। মৃগেল একটু হাসলো; কি বুঝে হাসলো কে জানে!