সমীর কুমার দে : সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রেসক্রিপশন। এমন কোনো রোগ নেই, যে রোগের চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না ফেসবুকে! ফেসবুকের এই প্রেসক্রিপশন ফলো করে কি সুস্থ হচ্ছে রোগীরা? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বলছেন, এর মধ্যে এমন বহু রোগী তারা পেয়েছেন, যারা ফেসবুকের প্রেসক্রিপশন ফলো করে নানা ধরনের বিপদে পড়েছে।
এমনকি করোনা হয়নি এমন মানুষও আতঙ্কে ফেসবুক দেখে করোনার ওষুধ খেয়ে ভিন্ন ধরনের জটিলতায় পড়েছে। বাধ্য হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছে তাকে।
প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এই কয়েক দিন আগেই আমার কাছে একজন রোগী এসেছেন, তার মুখ ঝলসে গেছে। পুরো বর্ণনা শুনে বুঝলাম ঐ রোগীর মুখে চুলকানি হয়েছিল, ফেসবুক দেখে বাজার থেকে কিছু জিনিস কিনে বেটে মলম তৈরি করে মুখে মেখেছিলেন। এরপর তার মুখটাই ঝলসে গেছে। শুধু এই রোগী নন, এমন অনেক রোগী আসছেন, যারা ফেসবুকের প্রেসক্রিপশন ফলো করে নানা ধরনের বিপদে পড়েছেন। তাই আমি বলব, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া যাবে না।’
করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ফেসবুকে নানা ধরনের টোটকা পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিন আগে তো ফেসবুকে দেখে ভারতে গরুর মূত্র খাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল, যেটা বাংলাদেশেও অনেকে করেছে। অথচ কোনো ধরনের চিকিত্সক এই পরামর্শ দেননি। এখনো ফেসবুকে নানা ধরনের গাছ-গাছড়া বেটে খাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন অনেকে। কেউ চিকিত্সক না হয়েও নিজে উপকার পেয়েছেন এমন কথা বলে নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন, যার কোনো বাছবিচার না করেই হুমড়ি খেয়ে নিতে শুরু করছে একশ্রেণির মানুষ। এমনকি কাঁচা হলুদ বেটে খেয়ে অনেকে সুস্থ হয়েছে এমন তথ্যও ফেসবুকে হরহামেশাই পাওয়া যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা তো শুরু থেকেই বলছি, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাবেন না। অথচ এমন অনেক করোনার রোগী পাচ্ছি, যারা ফেসবুক দেখে নানা ধরনের ওষুধ খেয়ে সমাধান না হওয়ায় আমাদের কাছে আসছেন। ততক্ষণে কিন্তু রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঐ রোগী যদি শুরুতেই আমাদের বা কোনো চিকিত্সকের পরামর্শ নিতেন, তাহলে দ্রুতই তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন। এখন দেখেন, স্টোরয়েডে করোনার রোগী ভালো হচ্ছে এমন প্রচারণা চলছে। কিন্তু এই স্টোরয়েড কোন ধরনের রোগী খাবে, সেটা তো আগে জানতে হবে? স্টোরয়েডে কাজ হচ্ছে এমন ঘোষণার পর বাজারে আর স্টোরয়েড পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে এটা কিনে নিয়েছে। কিন্তু এটা তো মুমূর্ষু রোগীর জন্য। এর ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। হঠাত্ করে কেউ মোটা হয়ে যেতে পারেন। নারীরা বন্ধ্যা হতে পারেন। তাই আমি বলব, ফার্মেসি থেকেও প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনো ওষুধ বিক্রি করা উচিত নয়। এমনকি প্যারাসিটামলও নয়। প্রতিটি ওষুধ রাসায়নিক দিয়ে তৈরি হয়। ফলে প্রতিটিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে।’
শুধু মানুষের দেওয়া টোটকাই নয়, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের প্রেসক্রিপশনও ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন ঐ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কোন রোগীকে সেটা দিয়েছিলেন, তা না দেখেই সেই প্রেসক্রিপশন ফলো করছে অনেকে। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া চিকিত্সাপত্র নিয়ে মানুষের মধ্যে ভাবনা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুকে একশ্রেণির মানুষ করোনা ভাইরাসের উপসর্গ, প্রতিরোধের উপায় এবং সুস্থ হয়ে ওঠার পদ্ধতিও পুরোপুরি বলে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বহু মানুষ সত্যতা বিচার না করেই সেই তথ্যে বিশ্বাস করছে।
বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মোজাহার হোসেন বলেন, ‘এর মধ্যে একজন করোনা রোগী করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে আমাদের হাসপাতালে আসেন। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক তাকে দেখেন। প্রাথমিকভাবে তাকে দেখে করোনা রোগী মনে হয়নি। তাকে ভর্তির পর যখন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা হয়, তখন দেখা গেল রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি ভয়াবহভাবে করোনায় আক্রান্ত। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ঐ রোগী জানালেন, করোনার উপসর্গ দেখা দেওয়ায় তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাওয়া প্রেসক্রিপশন ফলো করে কিছু ওষুধ খেয়েছেন। ঐ ওষুধগুলো খাওয়ার পর তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শুধু হাসপাতালে ভর্তির জন্য ভুয়া নেগেটিভ সনদ কিনে এনেছেন।’ ডা. মোজাহার বলেন, ‘যদিও চিকিত্সার পর ঐ রোগী সুস্থ হয়েছেন, তবে ভুল ওষুধ খাওয়ার অনেক রোগী আমরা পাচ্ছি।’
অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহর মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, গরম পানিতে গারগিল করা, প্রয়োজনে উষ্ণ গরম পানি বা চা খাওয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা বা হাত ধোয়া—এ ধরনের কাজই সাধারণ মানুষকে করতে হবে। তাদের বিনা কারণে ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। যদি সমস্যা হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। বিনা কারণে ওষুধ খেলে ক্ষতি হবেই।