ফরিদ আহমেদ : হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্সের জন্ম কোলকাতায়। তাঁর বাবা ছিলেন মিশনারি। লন্ডন মিশনারি সোসাইটির সদস্য হিসাবে ১৮২১ সালে চুঁচুড়াতে এসেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিলো খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার। ১৮২৬ সালে হানার জন্ম হয়।

বাড়ির আয়া এবং অন্যান্য চাকর-বাকরদের কাছ থেকে বাংলা ভাষা শেখেন তিনি। সেই বিদ্যা নিয়েই মাত্র বারো বছর বয়সে বাড়ির পাশের একটা সদ্য গড়ে ওঠা স্কুলে শিক্ষকতা করা শুরু করেন। তিনি যে সময়ে বাংলা শিখেছিলেন, সেই সময়ে বাংলাতে সাহিত্য সাধনা করা হতো না। সংস্কৃত ভাষাই ছিলো অভিজাত ভাষা, সাহিত্যের ভাষা। বাংলা মূলত ছিলো কথ্য ভাষা।

এই কথ্য ভাষাতেই ১৮৫২ সালে তিনি একটা বই লিখে ফেলেন। সেটার নাম হচ্ছে ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ। কেউ কেউ এটাকে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশিত হয়েছে ১৮৫৮ সালে, ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ প্রকাশ হবার ছয় বছর পরে। কাজেই, ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’-কে উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি দিলে, এটাই বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি পেতো। একজন বিদেশি নারী হয়ে যেতে পারতেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক। এই বিষয়টা নিয়ে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো। তাঁর আগে আসুন দেখি এই বইটা কী নিয়ে ছিলো।

হানা ম্যুলেন্স তাঁর পিতার মতো নিজেও একজন মিশনারি ছিলেন। খৃস্ট ধর্মের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আন্তরিকতার সাথে এর প্রচারে কাজ করে গিয়েছেন তিনি। তাঁর এই গ্রন্থটাও মূলত লেখা হয়েছে খৃস্ট ধর্মের মহাত্ম প্রচারের জন্য।

গ্রন্থটা লেখা হয়েছে উত্তম পুরুষে। একজন খ্রিস্টান মিশনারি নারী এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। আমরা ধরে নিতে পারি সেটা হানা ক্যাথেরিনেরই চরিত্র। তিনি তাঁর বাড়ির পাশের একটা খ্রিস্টান পল্লীতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। যাতায়াতের মূল উদ্দেশ্য ছিলো গ্রামবাসীর মধ্যে খ্রিস্টের শিক্ষাকে সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। এই কাজটা করতে গিয়ে গ্রামের দুটো পরিবারের প্রধানা নারীর সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর। এদের একজন হচ্ছে ফুলমণি আর অন্যজন হচ্ছে করুণা। ফুলমণি এবং করুণার পরিবারকে তিনি সমান্তরালে চলতে দিয়েছেন। কখনো কখনো এরা ছেদও করেছে পরস্পরকে।

ফুলমণি আদর্শ রমণী। যীশু খ্রিস্টকে ভালবাসে প্রাণ দিয়ে। খ্রিস্ট ধর্মের সব নিয়ম কানুন মেনে চলে। শুধু সে একাই না। তাঁর এই সুমতির কারণে তার স্বামীও একই রকমের ধর্মভীরু এবং মহৎ মানুষ। দু’জনেই সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছে ধর্মের আদর্শের। ফলে, তাদের সন্তানেরাও সব সভ্য এবং সুমতি সম্পন্ন। যে কারণে এই বাড়িতে সুখ উথলে ওঠে। এটা হয়ে ওঠে এক সুখ শালা।

অন্যদিকে করুণার আবার এতো ধর্ম-প্রীতি নেই। তার স্বামী মদ্যপ এবং দুষ্টু প্রকৃতির লোক। ধর্ম থেকে বিচ্যুতির কারণে সন্তানদেরও তারা দিতে পারেনি সুশিক্ষা। ফলে, করুণার বড় সন্তান বখে গিয়েছে। একদিন চুরি করতে গিয়ে পিটুনি খেয়ে মারা যায় সে। অন্যদিকে মদ্যপ স্বামীর হাতে লাঞ্ছিত হয়ে অসুখী এক জীবন যাপন করতে থাকে করুণা। তবে, করুণার এই অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তখনই যখন সে ধর্মের দিকে তাঁর মনকে ধাবিত করে। তার স্বামী মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, বাকি সন্তানেরাও সুশিক্ষা পেয়ে সভ্যভব্য হয়ে ওঠে।

হানা ক্যাথেরিন তাঁর বইতে মূলত খ্রিস্ট ধর্মের জয়গানই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। যে খ্রিস্ট ধর্ম অন্তর থেকে পালন করে, তার জীবনে সুখ উপচে পড়ে, জীবন হয় গোছানো, আর যে পালন করে না, সে অসুখী এক জীবনের ফাঁদে পড়ে। এলোমেলো এবং বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে তার জীবন, এটাই তাঁর বইয়ের মূল বক্তব্য।

আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসাবে কোনো স্বীকৃতি পায়নি, সে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবো। হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বাঙলা সাহিত্যে, পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতোই উপন্যাস এসেছে বেশ পরে; উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালকে (১৮৫৮) বাঙলা ভাষার প্রথম উপন্যাস বলা হয়। আবার কেউ বলেন, এটি প্রথম উপন্যাস নয়, প্রথম উপন্যাস এক বিদেশিনীর লেখা। তাঁর নাম হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেনস। তাঁর বইয়ের নাম ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ। বইটি বেরিয়েছিলো ১৮৫২ খ্রীস্টাব্দে। বইটিতে কিন্তু লেখিকা মানুষের গল্প শোনাতে চান নি, চেয়েছিলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে। তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত এক বাঙালি পরিবারের ছবি এঁকেছেন এ -বইতে, দেখাতে চেয়েছেন জিশুতে যার আস্থা গভীর, সে সুখে থাকে এবং যার আস্থা নেই, সে থাকে কষ্টে। বইটিতে উপন্যাসের গুণ নেই বললেই চলে, তাই এটিকে প্রথম উপন্যাস বলা যায় না। অনেক ত্রুটি সত্তে¡ও প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ই বাঙলা ভাষার প্রথম উপন্যাস।”

উপন্যাসের কোন গুণগুলো ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণে’ অনুপস্থিত সেটা সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট ধারণা দেন নাই। একটা বিষয় তিনি বলেছেন যে লেখিকা মানুষের গল্প শোনাতে চান নি, চেয়েছিলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে।’ লেখিকা খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে, নীতিবাক্য শোনানোর জন্য বইটা লিখেছিলেন, তা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। সংশয় রয়েছে শুধু ওই বক্তব্যে যে লেখিকা মানুষের গল্প শোনাতে চাননি।

এই বিষয়ে আমার অবস্থান হুমায়ুন আজাদের বিপ্রতীপ। হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স এই বইতে শুরু ফুলমণি এবং করুণারই গল্প শোনাননি, সেখানে আরো অনেক চরিত্রও ভিড় করে এসেছে।

সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’ বইতে আলালের ঘরের দুলালকেও উপন্যাসের স্বীকৃতি দিতে চাননি। তিনি লিখেছেন, “আলালকে ঠিক উপন্যাস বলা চলে না; ইহা একটি গল্পসূত্রে রচিত কতকগুলি চিত্রসমষ্টি মাত্র। আর ইহার উদ্দেশ্য স্পষ্টতঃই নীতিমূলক।” তাহলে দেখা যাচ্ছে, হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স এবং প্যারীচাঁদ মিত্র দু’জনেই নীতি শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থ দু’টি রচনা করেছেন।

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত’ বইতে হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি করুণার বিবরণ’-কে উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “স¤প্রতি আর একখানি উপন্যাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হইয়াছে যাহা প্যারীচাঁদের পূর্ববর্তী এবং উপন্যাসের লক্ষণ বিচারে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ অপেক্ষা কোন দিক দিয়াই নিকৃষ্ট নহে। ১৮৫২ খ্রীঃ অব্দে কলিকাতা ক্রিশ্চিয়ান ট্রাস্ট এ্যান্ড বুক সোসাইটির উদ্যোগে হানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স নাম্নী উক্ত মিশনের এক মহিলা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ রচনা করেন।”

এই গ্রন্থের কাহিনি, চরিত্র এবং ভাষার ব্যাপারেও উচ্ছ¡সিত ছিলেন তিনি। তিনি লিখেছেন, “কাহিনী, চরিত্র, ভাষা প্রভৃতি আলোচনা করিলে ইহাকে কোন দিক দিয়াই নিন্দা করা যায় না। মাঝে মাঝে ইহার ভাষা এত সহজ ও সরল যে, উহা কোনো বিদেশিনীর লেখা বলিয়াই মনে হয় না।

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ভাষার ব্যাপারে আমি একমত। ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বইটা লেখা হয়েছে অত্যন্ত সরল ভাষায়। হানা ক্যাথেরিন যে সময়ে বইটা লিখেছিলেন, সেই সময়কার ভাষা আর আজকের ভাষ এক নয়। একশো সত্তর বছরে কথ্য ভাষাতো পাল্টেছেই, লিখিত ভাষারও পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ পড়োতে গেলে কখনোই ভাষার জায়গাটাতে হোঁচট খেতে হয় না। এতো বোধগম্য ভাষা যে পাঠক নিজের উপরে কিংবা অভিধানের উপরে কোনো চাপ না ফেলে তরতর করে এগিয়ে যাবার সুযোগ পান।

একটা উপন্যাস উপন্যাস হয়ে উঠতে গেলে কয়েকটা প্রধান গুণ থাকা লাগে। সেগুলো হচ্ছে কাহিনি, চরিত্র, মনস্তাত্তি¡ক দ্ব›দ্ব, স্থানীয় পরিবেশ, সংলাপ এবং ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শন। এর কোনো কোনোটাতে হয়তো কিছু ঘাটতি ছিলো হানা ক্যাথেরিনের রচনাতে। যে কারণে এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি বেশিরভাগ পণ্ডিতদের।

এই স্বীকৃতি না পেলেও কোনো সমস্যা নেই। একজন বিদেশিনী হয়েও তিনি যে বাংলাতে বই লিখেছেন, কাহিনিচিত্র এঁকেছেন, সেটাকে প্রকাশ করেছেন এবং প্রচার করেছেন, এর জন্যেই তিনি আমাদের কাছ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ পেতে পারেন। এই বইটাও পেতে পারে বিশেষ মনোযোগ।