হোসনে আরা জেমী : ফুলবানু যুবতী বয়সে বিধবা হলো। কিন্তু তার দেহে এখনো ভরা পূর্নিমার আলোর মতো টলমল করে যৌবন। যৌবন নদীর ঘূর্ণি ঝড়ের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে যে কোন পুরুষ। তাই নিজের শরীরকে অনেক সময় অভিশাপ মনে করে ফুলবানু।
চাইলে তার একমাত্র ছেলেকে রাজার হালে রাখতেই পারত। তার যৌবনের খরিতধার হতে চেয়েছে গোপনে অনেকে। বিনিময়ে দিতে চেয়েছে টাকা। আবার গোপনে সাহায্য করতে চেয়েছে অনেকে। কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু না কিছু দিতে হতো। পাড়ার বেপারি কতবার এসেছে বাড়িতে। ফুলবানুকে বেপারী বহুদিন ইশারা ইঙ্গিতে বলেছে। মাঝে মধ্যে রাতে এই একটু আদর আপ্যায়ন করলে টাকার অভাব হবে না। আমি তো আছি তোমার জন্য, ফুলবানু তুমি কোন চিন্তা করো না। কিন্তু সে তা করেনি। ছেলেকে ভর্তি করেছে গ্রামেরই স্কুলে। পাঁচ ক্লাসে পড়ে সে। বিবর্ণ শার্ট, ছেঁড়া হাফ প্যান্ট, চটা ফাটা হাওয়াই চটি, এই হলো ফুলবানুর ছেলের অবস্থা। কাঁধে জোড়াতালি ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন সে স্কুলে যায় তার ভাবতে ভাল লাগে তার ছেলে একদিন ডাক্তার হয়ে ফিরবে। না হোক সরকারি অফিসার কি ইস্কুলের মাস্টার। সেই আশাতেই জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে ফুলবানু। একদিন তার স্বামীও দেশেরটানে ঘর ছেড়েছিলো আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধ শেষে অনেকে ফিরে এলেও ফিরে আসেনি মঙ্গল মিয়া মানে জয়ের বাবা। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট না থাকায় সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা পায়নি ফুলবানু বা জয়।
তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ছেলের যাতে পড়াশোনায় কোনও অসুবিধা না হয়। ছেলের জন্য কি না করে সে মহিলা হয়ে ও পুরুষদের সাথে তাদের মতো পরিশ্রমের কাজ করে। রাজমিস্তিরির জোগাড়, রিকশা চালানো, ভাটায় ইট টানা, ধানের মৌসুমে ধানকাটা, ধান রোয়া। আর কিছু না পেলে লোকের বাড়ি বাসন মাজা কাপড় কাচা। তাকে এই সব করতে দেখে অনেকেই গায়ে পড়ে সাহায্য করতে চায়।
তাদের সাহায্যের আড়ালে কুমতলব ঠিকই বুঝতে পারে ফুলবানু। ঐতো সেদিন হাবু মোল্লার বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে হাবু মোল্লার মতলব জানতে পারলো। ফুলবানুকে গিন্নি বানাতে চায় হাবু মোল্লা। তবে গোপনে। কারণ হাবু মোল্লার আরো দুইজন বউ আছে। হাবু মোল্লা যখন বললো ফুলবানু তোর কষ্ট দেখে মায়া লাগেরে। মনে মনে খুশি হলাম। কিন্তু পরোক্ষনেই মোল্লার আসল উদ্দেশ্য জানতে পারলাম। আসলে কেউ সাহায্য করতে চায় না। সাহায্যের নামে আমার ভরা শরীরটা চায়। অথচ এই মোল্লাই ’৭১ সালে রাজাকার কমান্ডার ছিলো। এখন সে আশেপাশে কয়েক গ্রামের সবচেয়ে বেশি টাকাওয়ালা মানুষ, সম্মানী মানুষ। ধার চাইতে গেলে কেউ পঞ্চাশ টাকাও দেয় না এমনিতে। যেমন হল সেদিন আর কী। ছেলে আগেই বলে রেখেছিল ১৬ই ডিসেম্বরে ফুটবল খেলতে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে। একশ টাকা দিতে হবে। ধার চাইতে গেছিলাম মাতব্বরের কাছে। শুনে মাতব্বর সে কী ফুর্তি। লাফ দিয়ে বলে, ‘একশ কেন, পাঁচশ নিয়ে যা। আয় আয় ভেতরে আয়।’ তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছিল সেদিন। ডিসেম্বরের দিন সকাল থেকে ছেলের সঙ্গে অশান্তি।
টাকা দাও টাকা দাওৃঘ্যান ঘ্যান.. ঘ্যান ঘ্যান..। কত করে বুঝালাম বাপরে আমার কাছে টাকা নাই। কিন্তু সে কি আর বুঝ মানে! শেষে চিৎকার দাঁত খিচুনি কান্নাকাটি পা দাপানি। তারপর দুই ঘা পিঠের ওপর। আর অভিমান করে ছেলের দৌড় ধুলোর রাস্তা ধরে। পিছন পিছন আমি ছুটে এসেছিল খানিকটা। ছেলের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। কিন্তু ছেলে থামে না। ছুটতেই থাকে রাঙা ধুলোর মেঠো পথ ধরে। দু’পাশে পাকা ধানের সোনালি সম্ভার। সামনে কালচে বন রেখা। বনের ওপারে সারি সারি টিলা ডুংরি পাহাড়। সেদিকেই ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায় বাপ মরা অনাথ ছেলেটা।
ছুটতে ছুটতে ছেলে বড়মাঠের কাছে চলে আসে। তার দৌড় দেখে মনে হচ্ছে ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াচ্ছে সে। ঠিক যেন সুনামির ইঙ্গিত। সেখানে তখন ধুম লেগেছে ফুটবল খেলার। গ্রামের মানুষের চিরকালের বিনোদন হচ্ছে এই ফুটবল। তাই বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে সবাই হইচই করছে। দূর থেকে মনে হবে বিয়ে বাড়ি। ছোট বড় অসংখ্য গাড়ি করে লোক এসেছে ফুটবল খেলা দেখতে। বিভিন্ন রকমের গাড়ি। বেন গাড়ি ঠেলাগাড়ি রিকশা ট্রাক এমনকী গঞ্জ থেকে বাসে করেও। চারিদিকে গান বাজছে। মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচ করছে লোকে। গোল হয়ে দলবল নিয়ে বসেছে অনেকে। হাতে হাতে বিভিন্ন রকম বাঁশি। এলাহি কারবার মাঠের চারপাশে। ছেলেটা অবাক হয়ে ফুটবল খেলা দেখছিল। তার খেলা দেখার ভাব দেখে মনে হচ্ছে এই মাঠে ম্যারাডোনা, পেলে ফুটবল খেলছে। যে সে রেফারি হয়ে খেলা চালু রেখেছে। খেলা দেখছে তো দেখছেই একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একজন তার জ্যাকেটটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বলে, ‘ধর তো একটু।’ সে কোনকিছু না বুঝেই বোকার মতো জ্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে এই জ্যাকেটের পাহাড়াদার। আবার সে চিৎকার চেচামেচি করে দলে ভিড়ে গেল। অনেক্ষণ পর নাচ থামিয়ে লোকটা এসে বসে ছেলেটার কাছে। নিজের জ্যাকেটটা ফেরৎ নিয়ে বলে, ‘একটু জল নিয়ে আয় তো।’ তার হুকুমে দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা তার বাড়ির চাকর। আর তিনি জমিদার!
ছেলেটা গিয়ে জল নিয়ে আসে। আর একজন বলে, ‘একটা দেশলাই নিয়ে আয় তো।’ সে গিয়ে দেশলাই নিয়ে আসে। আর একজন ক্যামেরাটা তার হাতে দিয়ে বলে। ‘একটা ছবি তুলে দে তো।’ একজন আবার মোবাইল ফোনটা দিয়ে বলে, ‘ওই ওকে দিয়ে আয়, লাল সোয়েটার।’
লাল সোয়েটার প্রা ছেলেটা খানিক দূরে বসেছিল। ছেলেটা তার কাছে নিয়ে যায় মোবাইলটা। সেটা নিয়ে লাল সোয়েটার ছেলেটা বলে, ‘ওকে বল আমি ডাকছি।’ সে গিয়ে বলে, ‘লাল সোয়েটার প্রা ছেলেটা ডাকছে।’ লোকটা নাচতে নাচতেই বলে, ‘গিয়ে বল আমি নাচছি।’ সে গিয়ে বলে, ‘উনি নাচছেন।’ লাল সোয়েটার প্রা ছেলেটা আবার বলে, ‘গিয়ে বল আমার পেচ্ছাপ পেয়েছে, জায়গা পাচ্ছি না।’ ওদের সব হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে জয়। খেলা শেষে খাবার খেতে যাবে ঐ লোকগুলো হঠাৎ করে জয়ের কথা মনে হলো। ছেলেটা খেলা চলার সময় তাদের সহযোগীতা করেছে। তাদের উচিত ছেলেটাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া। খাবার হোটেলে বসে জয় সম্পর্কে জানতে চায় শহর থেকে আসা সোহান। জয় তার মা এবং বাড়ির সবকিছু বলে।
একদিন হঠাৎ করে জয়দের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় আনিস সাহেব। এসে জানায় জয় ও তার মাকে শহরে নিয়ে যাবে। ফুলবানু বাসার কাজ করবে আর জয়কে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দেবে আনিস সাবেহ। অপরিচিত লোকের এমন প্রস্তাব পেয়ে কিছুটা দ্বিধা দ্ব›েদ্ব পড়ে যায় ফুলবানু। কারণ এই সমাজের পুরুষগুলোকে তার চেনা আছে। আনিস সাবেহ বুঝতে পারছে ফুলবানুর মনে সংশয় কাজ করছে। তারপর সবকিছু খুলে বলে আনিস সাহেব আপনাদের এলাকায় ফুটবল খেলা দেখতে এসেছিল আমার বড় ছেলে সোহান। সেদিন অফিস শেষ করে বাসায় না ফিরে সোজা আপনাদের এখানে এসেছিল বন্ধুদের সাথে। আপনার ছেলে জয়কে ভুল করে তার ব্যাগ দিয়েছিলো রাখতে। সেই ব্যাগে এক লাখ টাকা ও প্রয়োজনী কাগল পত্র ছিলো। যা সহজে আপনার ছেলে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। এযুগে এমন ছেলে পাওয়া কঠিন। আর আপনি তো বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেই সংসার চালান। তাহলে আমার ওখানে গেলে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া জয়ের পড়াশোনার খরচ আমি বহন করো। আপনার ইচ্ছা পূরণ করবো জয়কে লেখাপড়া শিখিয়ে। জয়ের মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে তারপর বলেন একটু অপেক্ষা করেন সাহেব….
হোসনে আরা জেমী ঃ কবি ও লেখক, টরন্টো, কানাডা