সাজ্জাদ আলী : খাঁ খাঁ রোদে হাঁটছিলাম দুজনে। গেল গ্রীস্মের এক শনিবারের দুপুর সেটি। হাঁটাসঙ্গী স্টেফিনি ঠিক করেছে, আজ আমরা কুইন্সকী রাস্তাটির এ মাথা থেকে ও মাথা অব্দি হাঁটবো। টরন্টো শহরের দক্ষিণ সীমানা রেখা জুড়ে লেক অন্টারিও’র অথৈ জলরাশি। ডাউনটাউনের পাদদেশে সেই লেকের পাড় ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলা একমাত্র রাস্তা এই কুইন্সকী। অনুমান ৪/৫ কিলোমিটার লম্বা হবে। দুই হাতে দুই বোতল জল নিয়ে অনেকটা লাফাঙ্গা ভঙ্গিতে হাঁটছে আমার সঙ্গিনী। একটি বোতল যে আমার জন্য সে জানি, তবে এখনও তা হাত বদল হয়নি।

শহরের এ দিকটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়, গাড়ি চালিয়ে এ পথে শতবার গিয়েছি। যানজট রোধে কুইন্সকী রাস্তাটির ট্রাফিক আইন ভারি কড়া। ক্ষণিকের জন্য গাড়ি দাঁড় করালেও মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়। তাই হয়তো কখনও দুদন্ড থেমে রাস্তার আশপাশটা দেখা হয়নি। আজ হাঁটতে এসে আমি তো হতবাক। জলের ধার ঘেঁষে যে এত সব জাঁকালো ব্যাপার স্যাপার রয়েছে তাতো জানাই ছিলো না।

পশ্চিম প্রান্ত থেকে হাঁটা শুরু করে খানিকটা এগুতেই দেখি “স্টেজ ইন দ্য রাউন্ড” নামের একটি খোলা মঞ্চ। লেকের পাড় ঘেঁষে গাছগাছালিতে ঘেরা বিশাল চত্তরের ঠিক মাঝখানে গোলাকার মঞ্চটিতে তখন একটি গানের দল গাইছিলো। গিটার, ড্রাম, বেহালা, ট্রামপেটের সাথে সমবেত কন্ঠে গাওয়া কান্ট্রি মিউজিক। লাউডস্পীকার যেন সেই সুরের অনুরণন ঢেউয়ের কলতানের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিলো। সবুজ ঘাসের উপরে (করোনা দূরত্ব মেনে) ফাঁকা ফাঁকা হয়ে বসে কয়েকশত মগ্ন শ্রোতা সে গান শুনছে। আমরাও কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম।

পূর্বদিকে আরো খানিকটা যেতেই জলট্যাক্সি স্ট্যান্ড। কাঠের চওড়া পাটাতন কূল থেকে গভীর জলের দিকে প্রায় ২০০ ফুট লম্বা হয়ে ভেসে আছে। তারই দুপাশে যন্ত্রনৌকা ও পালতোলা নৌকাগুলো সারি করে বাঁধা। মাঝিরা খরিরদ্দারের অপেক্ষায় বসে। তবে পরনে ছেড়া লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, আর মাথায় গামছা বাঁধা টাইপের মাঝি না এরা! একেবারে টাই-স্যুট পরা নেয়ে। যন্ত্রনৌকার ভাড়া প্রতিঘন্টা ৭৫ ডলার, আর পালতোলা নৌকা ১২০ ডলার।
তো এই “বাদাম দেওয়া নাও” আমার জন্য স্মৃতি জাগানিয়া, মনে হলো এ যেন আমাদের “খালেক কাকার নৌকা”। একজন মাঝিকে বললাম, আমার কাছে ১০০ ডলার আছে, আমাদের দুজনকে ৪৫ মিনিট ঘুরিয়ে আনবেন”?

স্টেফিনি নৌকাওয়ালার দিকে হাত উঁচিয়ে নিজের অসম্মতি জানান দিলো। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। সে আমার টি-সার্ট খামচে ধরে ছ্যাড়ছ্যাড় করে টেনে এনে রাস্তায় তুললো। রেগেমেগে বললো, আজ আমরা হাঁটতে এসেছি, নৌকায় চড়তে না, ডিড ইউ আন্ডারস্টান্ড মাই বয়? তুমি জল আর নৌকা দেখলে এমন পাগলামো করো কেন বলতো?

নৌকা, জল, বাদল, কাঁদা ইত্যাদির সাথে আমার শৈশব স্মৃতিকথা স্টেফিনিকে আগেও বলেছি। তবে সে সব কথা ওর বোধের বাইরে। সে তো আষাঢ়ে ব্যাঙের ডাক শোনেনি, টিনের চালে শ্রাবণের ঝুমঝুম বৃষ্টি পড়া দেখেনি, ভাদ্রের থৈ থৈ জলে বাদাম দেওয়া নৌকায় চড়েনি, মাঝিমাল্লার গাওয়া ভাটিয়ালি শোনেনি কখনও। তাই আজ আর নতুন করে কিছু না বলে ওর পিছে পিছে হাঁটা শুরু করলাম।

আরো একটু এগুতেই দেখি জলের উপরে স্টিলের তৈরী সুবিশাল ডেক। ওটি আসলে “ভাসমান ফাস্টফুড প্যাভিলিয়ন”। খানিকটা দূরে দূরে পাতানো মস্ত সাইজের রঙিন ছাতাগুলোর নিচে উন্মুক্ত খাবারের দোকান। হাট ডগ, শুয়োরের পোড়া মাংস, চায়নিজ টেকআউট, স্যান্ডউইচ, ফিস বার্গার, বারবিকিউ চিকেন ইত্যাদি সব খাবারের গন্ধে সেখানকার বাতাস ময়ময়। স্টেফিনি বললো, ফেরার পথে এখানে বসে লাঞ্চ সারবো, আর আজ কিন্তু তোমার খাওয়ানোর পালা।

হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাটির প্রায় শেষ মাথা সুগার বিচে পৌঁছে গেলাম। সেই অর্থে বড়সড় কোনো বিচ না এটি। যদিও ডাউন টাউন সংলগ্ন কিন্তু কোলাহলহীন। ব্যস্তসমস্ত শহরের কলধ্বনির মধ্য থেকে হাঁটতে হাঁটতে নিঝুম এই বালুকাবেলায় এসে পৌঁছেছি। জল ঘেঁষে শ’খানেক বিচ-চেয়ার জোড়ায় জোড়ায় পাতা। প্রায় সব চেয়ারগুলোতেই আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে যুগলেরা বসে। হাত ধরাধরি করে বসে আছে কেউ, কেউ বা অন্যের বুকে মাথা রেখে, কেউ চোখ মুদে, আবার কেউ বা চুম্বনরত। দুই লেসবিয়ান তরুণীর চুম্বনশব্দ তো আমরা দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম।

একজোড়া চেয়ার ফাঁকা পেয়ে আমরাও বসলাম। আমাদের বসবার জায়গাটি একেবারে দূর প্রান্তে এবং আসন দুখানা একটু তেরছা করে পাতানো। সামনের নীল জলরাশি চোখ জুড়িয়ে দেয়। আর একটু ঘাড় ফিরে তাকালেই অন্য সব চেয়ার বাসিন্দাদের মাখামাখি, চুমাচুমি দেখতে পাই। মাঝে মাঝেই ঢেউয়ের তোড়ে জল উঠে এসে আমাদের পা ভিজিয়ে দিয়ে আবার তা লেকে নেমে যাচ্ছে। এই বিচের রোদে বসে ঘন্টাখানেক চামড়া তাতিয়ে আমাদের ফেরত যাবার কথা। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানকার রোমান্টিক পরিবেশে নিজেকে বেখাপ্পা মনে হলো। কারণ সঙ্গিনী থাকতেও এই আবহে আমি নি:সঙ্গ।

চেয়ারের দুই হাতলে হাত রেখে স্টেফিনি চোখ বুজে শুয়ে আছে। কী অপরুপা যে দেখাচ্ছে ওকে! দুপুর রোদের ঝিলিক যেন ওর দুগাল রাঙিয়ে দিয়েছে। গলার কাছে জমে উঠা ঘামের ফোটাগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে তার বুক ভেজাচ্ছে। ওর রাঙা ঠোঁট দুটো যদি একটু ফাঁকা থাকতো তবে নিশ্চয়ই তেড়ে আসা ঢেউয়ের দু ফোঁটা জল ওর গালে ঢুকে পড়তো। আজ সাতটি বছর হয়ে গেল আমরা বনবাদাড়, শহরগাঁয়ে হেঁটে বেড়াই। কত অন্তরঙ্গ মূহুর্ত কাটলো আমাদের, তবুও ওর সুন্দরপানা কপোলে হাত বুলোনো হলো না! কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে জানি না। সে চোখ মেলে আমার চোখে চোখ পড়তেই বললো, তুমি আজও বসে বসে আমাকে দেখছ? এত যে দেখ তবু তৃষ্ণা মেটে না? বরাবরের মতোই ওর হৃদয়হীন প্রশ্নের কোনো জবাব দিলাম না। আড়মোড়া ভেঙ্গে সোজা হয়ে বসতে বসতে সে বললো, যে ভাবে লেগে আছ তাতে মনে হচ্ছে তোমার সুদিন এল বলে!
আমি বললাম, ফাজলামো রাখো তো, উঠে পড়ো। এমন প্রেমময় চেয়ারে তুমি বসবে কেন? কাঠখোট্টা কোথাকার!

সুগার বিচ থেকে বেরুবার মুখে রাস্তায় পা দিতেই স্টেফিনি হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলো। ওর প্রায়-খালি জলের বোতল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ওই যে দেখ ওখানটায় ফুড ব্যাংকের ট্রাক খাবার বিলি করছে। চলো চলো ওখান থেকে খাবার নিয়ে রাস্তায় বসে খাবো আজ।

কথাটা বলেই সে ওই দিকটায় হাঁটা শুরু করলো। ব্যাপারটা আমি তখনও ঠিক বুঝে উঠিনি। ওর পিছু যেতে যেতে বললাম, মানে কী, ফুড ব্যাংকের খাবার আমরা কেন খাবো? সে তো গৃহহীন-ক্ষুধার্ত মানুষদের খাবার!

আরে না না, হোমলেস বলে কথা না। ওরা যে কোনো ক্ষুধার্ত মানুষকেই খেতে দেয়। আর খাবারগুলোও খুব ফ্রেস। ক’বছর আগে একবার খেয়েছিলাম।
শোন স্টেফিনি, আমি দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন থেকে ডাকলাম ওকে। শক্ত গলায় বললাম, ফুড ব্যাংকের খাবার আমরা খাবো না। ওরা দরিদ্র, অনাহারী মানুষদের জন্য খাবার বিলি করে, তাতে আমরা ভাগ বসাবো কেন? তুমি যে রেস্টুরেন্টে খেতে চাও, তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাবো। প্লিজ তুমি গো ধরো না।

ব্যপারটায় আমি যে শক্ত অবস্থান নিয়েছি স্টেফিনি তা বুঝে ফেলেছে। আর এমন পরিস্থিতিতে আমাকে নরম করার উপায়ও তার জানা আছে। কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে ওর কনুই রাখলো। মিস্টি করে বললো, শোনো দরিদ্র নাগরিকদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ ওদের প্রাইমারি টার্গেট বটে। তবে যখন খাবার বিলি করে তখন ওরা মানুষের ক্ষুধাটাই দেখে, কে দারিদ্র আর কে দরিদ্র না, কার সামর্থ্য কতটুকু সেই খোঁজ করে না। এটাই ওদের পলিসি।
ওরা খোঁজ না করুক, কিন্তু আমরা তো জানি যে আজ লাঞ্চ কিনে খাবার মতো টাকা আমাদের পকেটে আছে, বললাম আমি।

আমার কাঁধে ওর কুনুইয়ের চাপ আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমার এই সব নীতিচিন্তাগুলোই আমাকে কাছে টানে। শোন, ওখান থেকে খাবার নিয়ে খাওয়াটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। আর রাস্তায় বসে খাওয়াটা একটা স্মরণযোগ্য অভিজ্ঞতা হবে! কী বলো? আর আমাকে একটা মিনিট সময় দাও। তোমার অস্বস্তি হটাবার ব্যবস্থাও করছি।
এটুকু বলেই তৎক্ষণাৎ ওর স্মার্ট ফোন থেকে কানাডিয়ান ফুড ব্যাংকে ৭৫ ডলার ডোনেশন দিয়ে ফেলল। এর আগেও বহুবার তার অভিনব পাগলামিগুলো দেখেছি আমি। অগত্যা ওর পিছু পিছু খাবার আনতে রওনা হলাম।

মাঝারি একখানা ট্রে’র উপরে নানা সাইজের ডিস্পোজেবল পাত্রে ফ্রায়েড রাইস, রোস্টেড বিফ, মিক্সড ভেজিটেবল, আইসক্রিম ভর্তি কাপ, আর এক বোতল অরেঞ্জ জুস, এই খাবারগুলো আমি নিলাম। স্টেফিনি রাইসের বদলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আর বিফের বদলে শুয়োরের মাংস পোড়া নিল। খাবারগুলো একেবারেই টাটকা এবং ধোঁয়া উড়ছে। গাছের ছায়ায় বসে খেতে খেতে আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে এগুলো গরীবের খাবার!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)