ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টোর সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ২৪তম অন্তর্জাল আসরটি ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। সদ্য প্রয়াত ফুটবল-কিংবদন্তি ম্যারাডোনার স্মরণে আসরে আলোচিত হয় শতাব্দীর অন্যতম সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার আত্মজীবনী ‘ম্যারাডোনা দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ সকার’স গ্রেটেস্ট অ্যান্ড মোস্ট কনট্রোভার্শিয়াল স্টার’। আলোচনা করেন বইটির অনুবাদক (বাংলা) শেখ রানা।
আত্মজীবনীর শুরুতে ম্যারাডোনা লিখেছেন – ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার গোটা জীবনটাই যেন একটা ফিল্মের কিংবা উপন্যাসের চরিত্র। তা কিন্তু না, তা একেবারেই না। এমন অনেক বিষয় আছে যা শুধু আমার অন্তরে লুকানো – যা কেউই জানে না। অবশেষে আমি সমস্ত কিছু বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও ইতোমধ্যে আমি অনেক কিছু বলে ফেলেছি, কিন্তু আমার মনে হয়, সবচেয়ে জরুরি জিনিসগুলোই কখনো আমার বলা হয়নি।’
ম্যারাডোনার সতীর্থ ভালদানো বলেছেন, ‘বেচারা ম্যারাডোনা! কত কাল ধরে আমরা তাকে বারবার বলে এসেছি – ‘তুমি ঈশ্বর’, ‘তুমি মহাতারকা’, ‘তুমি আমাদের ত্রাতা’, ‘তুমিই আমাদের মুক্তিদাতা’, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বিষয়টাই আমরা বলতে ভুলেছি – ‘তুমি একজন মানুষ।’ ‘ম্যারাডোনা দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ সকার’স গ্রেটেস্ট অ্যান্ড মোস্ট কনট্রোভার্শিয়াল স্টার’- এই আত্মজীবনীতে অবশেষে সেই মানুষ ম্যারাডোনা কথা বলেছেন।
প্রায় সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার তথ্যে ঠাসা এই বইটিতে ম্যারাডোনার সহলেখক ড্যানিয়েল আরুচ্চি ও আরনেস্টো বিয়ালো। বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন মার্সেলা মোরা আরাউজো। স্প্যানিশ ভাষায় বইটি ছাপা হয় ২০০০ সালে। ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ২০০৪ সালে। এপিলোগসহ পেপারব্যাক এডিশন বের হয় ২০১০ সালে।
ম্যারাডোনা ৯৪এর বিশ্বকাপে বাদ পড়লে, বাংলাদেশের অনেকে আত্মহত্যা করেন। বইয়ের ভূমিকায় অনুবাদক এটি উল্লেখ করেন। ভূমিকায় আরো বলা হয়, ম্যারাডোনার জীবনটা খুব চরম দুই এক্সট্রিমে। একদিকে তিনি ঈশ্বর, আরেকদিকে ড্রাগ এবিউজার; একদিকে নায়ক আরেকদিকে খলনায়ক। ম্যারাডোনা বস্তি থেকে উঠে আসা এক বিদ্রোহী, যিনি মিলিয়ন ডলার পায়ে মাড়াতে দ্বিধা করতেন না। তিনি ছিলেন রূপকথার আদি নায়ক। কখনো মনের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। যে কোনো আপোস ছিল তার জন্য সবচেয়ে কষ্টকর।
বইটাতে ম্যারাডোনা খেটে খাওয়া মানুষের স্থানীয় ডায়ালেক্ট ব্যবহার করেছেন।
‘দ্য বিগিনিং’ শিরোনামে প্রথম অধ্যায়ে ম্যারাডোনা লিখেছেন ভিলা ফাইওরিটো, লস সেবোলিতাস, আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ও জাতীয় দল নিয়ে।
১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর ফাইওরিটোয় জন্ম ম্যারাডোনার, বুয়েনস আয়ার্স এর প্রান্তসীমায় এক দরিদ্র শহরতলীতে। পরিবারের পঞ্চম এবং প্রথম ছেলে সন্তান তিনি। রেশমের মতো ফোলাফোলা চুল – আর্জেন্টাইন ভাষায় ‘পেলুসা’ থেকে তাঁর ডাক নাম – পেলু। শৈশবে তাঁর ছোটখাটো আনন্দ থাকলেও এক শব্দে ম্যারাডোনার শৈশবকে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় – ‘সংগ্রাম’। তাঁর সেরা উপহার ছিল ৩ বছরের জন্মদিনে পাওয়া কাজিন বেটোর দেওয়া একটা চামড়ার ফুটবল। সারাক্ষণ তিনি সেটা আগলে রাখতেন।
ম্যারাডোনার বাবা ডন ডিয়েগো, মা লা টোটা। বাবা কোরিয়েন্তেস থেকে বুয়েন্স আয়ার্সে এসে থিতু হন এবং তিনি পশুর হাড় চূর্ণ করতেন। ম্যারাডোনার ভাইবোন – আনা, কিটি, এলসা, মারিয়া, রাউল ও হুগো।
ম্যারাডোনার বাসার কোণার দিকে ছিল সিয়েটে কাঞ্চিটাস – সেভেন লিটল পিচ। নামটা বাহারী হলেও তা ছিল শক্ত মাটির পিচ, ঘাস নেই। কোনোটায় গোলবারও নেই। বাবার ফুটবল দল ছিল ‘রেড স্টার’। সেখানেই ম্যারাডোনার খেলার শুরু।
১৯৬৯ সালে ৯ বছর বয়সে ম্যারাডোনার লস সেবোলিটাসে (দ্য লিটল অনিয়ন) খেলার শুরু। ফ্রান্সিস করনেজো ছিলেন লস সেবোলিটাস দলের ম্যানেজার। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স দলের জুনিয়র স্কোয়াডের নাম ছিল লস সেবোলিটাস। লস সেবোলিটাস একটানা ১৩৬ ম্যাচ জেতে। সেই সময়ের গোল গোনা হলে ম্যারাডোনার গোল পেলের চেয়েও বেশি হতো। তখন ম্যারাডোনা ১০ নাম্বার জার্সি পরতেন।
ফাইওরিটো মানে – শুধুই বলের পেছনে ছুটে বেড়ানো। ওটাই ছিল ম্যারাডোনার জীবন, শৈশব, কৈশোর।
১৯৭১ এর ২৮ সেপ্টেম্বর (১১ বছর বয়সে) কাগজে প্রথম বেরোয় – ‘তারকার মতো চালচলন আর মেধা নিয়ে এক বালকের আবির্ভাব।’
এ সময় আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান সাবাডোস সার্লকুলেরস এ ডাক পান ম্যারাডোনা বল নিয়ে কারিকুরি দেখানোর জন্য।
১৯৭৬ সালের ২৬শে অক্টোবর ক্লাব ফুটবলে ম্যারাডোনার অভিষেক ঘটে। তিনি বলেন, ‘প্রথম ডিভিশনে অভিষেক ছিল আদতে আমার কাছে আর একটা নতুন প্যান্ট কিনতে পারার সম্ভাবনা।’ এই সময়ে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে সবার নজরে আসে এই নবীন ট্যালেন্ট। তখন কাগজের একটা শিরোনাম সব বলে দিচ্ছিল – ‘অন্য সব বাচ্চাদের মতো গল্প শুনে দিন কাটাবার বদলে তার দিন কাটে করতালি আর হর্ষধ্বনি শুনে।’
১৯৭৭ সালে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ ঘটে ম্যারাডোনার। ১৬ বছর বয়সে। সিজার ‘এল ফ্লাকো’ মেনোত্তি তখন জাতীয় দলের কোচ।
এই সময়কালে ক্যারিয়ারের উত্তরনের পাশাপাশি ম্যারাডোনার জীবনে আসে ক্লাউডিয়া নামে এক নারী এবং এ ক্লাউডিয়াই সুখে-দুঃখে ম্যারাডোনার জীবন সঙ্গীনি ছিলেন।
‘দ্য এক্সপ্লোশন’ শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, আর্জেন্টিনা ‘৭৮ ও জাপান ‘৭৯ নিয়ে লিখেছেন।
১৯৭৮র বিশ্বকাপের মূল একাদশে ম্যারাডোনা সুযোগ পাননি। তিনি এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রচণ্ড রাগ আমার জন্য জ্বালানী শক্তির কাজ করে। আমাকে তাতিয়ে দেয়। এটা সত্যিই আমার চালিকাশক্তি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিশোধস্পৃহা থাকলেই আমি আমার সেরা খেলাটা খেলতে পারি।’
আর্জেন্টিনোসের সময়কালে ম্যারাডোনা শিক্ষা নেন, কিভাবে তলানি থেকে একদম শীর্ষে ওঠার জন্য লড়াই করতে হয়। ’৭৮ এর মেট্রোপলিটন চ্যাম্পিয়নশিপে ২২ গোল, ’৭৯র মেট্রোপলিটন চ্যাম্পিয়নশিপে ১৪ গোল আর ’৮০র মেট্রোপলিটনে ২৫ গোল করে ম্যারাডোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
আর্জেন্টিনোসে খেলার সময় বোকা জুনিয়র্স দলের গোলরক্ষক হুগো এল লোকো গাত্তির সাথে বিবাদে জড়ান ম্যারাডোনা। গাত্তি তাকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে তাঁকে মিডিয়া হাইপ, মোটা ইত্যাদি বলে। এর পরদিনই ছিল বোকার সাথে ম্যাচ। ম্যারাডোনার ম্যানেজার জর্জ সাইটার্সপিলার বলেছিলেন, ‘তুমি যতো তেতে ওঠ, ততো ভালো খেলো।’ জর্জ তাঁকে গাত্তির জালে ২টা গোল দিতে বলেন কিন্তু ম্যারাডোনা বলেন গোল দেবেন ৪টা। পরে সত্যি সত্যি ৪টা গোল দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নেন ম্যারাডোনা। গাত্তিকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন।
আর্জেন্টিনোসে ম্যারাডোনা খেলেন ৫ সিজন। ১৯৭৬-৮১। গোল করেন ১১৬টা (১৬৬ খেলায়)। কোনো শটই তখন তাঁর জন্য অসম্ভব ছিল না। তাঁর নামডাক তখন বাড়তেই থাকে এবং প্রতি রবিবারে মানুষ এই ফেনোমেননের বাম পায়ের ম্যাজিক দেখার জন্য উপচে পড়তো।
জাপান যুব বিশ্বকাপে (১৯৭৯) ম্যারাডোনাদের দলটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা দল। এই সময়টা ছিল তাঁর জীবনের শেষ্ঠ সময়।
এই সময়টায় আর্জেন্টিনায় ছিল সামরিক জান্তার শাসন। লেফট্যানেন্ট জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলার এই সময়ে ৩০,০০০ মানুষ গুম হয়েছিল। এই সরকার ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করত। এই দুঃশাসনে একমাত্র ফুটবলই ছিল দেশের মানুষের আনন্দের উৎস।
১৯৭৯র জাপান যুব বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার অধিনায়কত্বে আর্জেন্টিনা ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথম ফিফা কোকা কোলা বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়ী হয়। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে ম্যারাডোনা ব্যালন ডি’ওর পান। ‘আবেগের দিনগুলো’ শিরোনামের তৃতীয় অধ্যায়ে ম্যারাডোনা বোকা জুনিয়র্স দলে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন।
বোকা ছিল ম্যারাডোনার স্বপ্ন। এদিকে বোকার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী রিভারপ্লেট ম্যারাডোনাকে অফার দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর বাবারও সুপ্ত ইচ্ছে, ম্যারাডোনা বোকায় খেলুক। ম্যারাডোনা বলেন, ‘রিভারের আছে অঢেল টাকা কিন্তু আমার হৃদয় সেখানে বাঁধা নেই। অন্যদিকে বোকার ফুটোকড়ি নেই কিন্তু আমার হৃদয়ের সব অনুরাগ বোকার জন্য।’
১৯৮১ সালে বোকার সাথে চুক্তি হয় ম্যারাডোনার। ধারে বোকায় যোগদান করেন তিনি।
বোকা ক্লাব ক্যাশ ফ্লো ধরে রেখেছিল প্রীতি ম্যাচ দিয়ে। ১৯৮১র অক্টোবরে আবিদজানে প্রীতি ম্যাচে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয় ম্যারাডোনার। এক বাচ্চা ওঁর শৈশবের ডাক নাম ‘পেলুসা’ বলে ডাকে। পেলের সান্তোসের সাথে তুলনা করা হয় ওঁদের দলকে।
এ সময় প্রচন্ড প্রত্যাশার চাপ আর নিতে পারছিলেন না ম্যারাডোনা। খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথাও তিনি ভাবছিলেন তখন। তিনি বলেন, ‘মানুষকে এই কথাটা বুঝতে হবে যে, ম্যারাডোনা আনন্দ দেওয়ার কোনো যন্ত্র না।’
১৯৮১-১৯৮২ সময়কালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে নীল-হলুদ জার্সি গায়ে ৪০ খেলায় ২৮ গোল করেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা যোগ দেওয়ার পর ১৯৮১ সালে বোকা জুনিয়র্স প্রথম মেট্রোপলিটন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে।
ম্যারাডোনার নাম ছড়িয়ে পড়ে তখন ইউরোপেও। এই সময়ই ম্যারাডোনা পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়ে-আর্জেন্টিনীয়দের আইডলে পরিণত হন।। কিন্তু কখনো নিজের ফেলে আসা অতীত ভোলেননি ম্যারাডোনা।
‘দ্য ফ্রাস্ট্রেশন’ শিরোনামের ৪র্থ অধ্যায়ে ম্যারাডোনা লেখেন স্পেন ’৮২ ও বার্সিলোনা নিয়ে। ’৮২র স্পেন বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন জাতীয় দল একদমই ফেভারিটের মতো খেলতে পারেনি। বার্সেলোনায় ইটালির বিরূদ্ধে ম্যাচে ক্লাডিও জেন্টিল ম্যারাডোনাকে খুব বাজেরকম ট্যাকল করে। ব্রাজিলের সাথে খেলায় ম্যারাডোনা বাতিস্তাকে ফাউল করে লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়েন। সেটাই ম্যারাডোনার সেই বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ এবং ব্রাজিলের কাছে হেরে আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। বিশ্বকাপের তিক্ত অভিজ্ঞতা যেন প্রতীকিভাবে ম্যারাডোনার বার্সার সাথে ভবিষ্যৎ তিক্ততাকে প্রতিফলিত করে।
ম্যারাডোনা বার্সায় মুখোমুখি হন আর্জেন্টিনার শান্ত ফুটবল বনাম বিশৃঙ্খল দ্রæতগতির ফুটবলের। শেষমেষ গতির সাথে ম্যাজিকেল টাচের মিশ্রণ ঘটান তিনি।
১৯৮২-১৯৮৪ সময়কালে বার্সার হয়ে খেলেন ম্যারাডোনা। ৭ মিলিয়ন ডলার রেকর্ড পরিমাণ টাকায় যোগ দেন তিনি বার্সায়। ১৯৮৩ সালে বার্সেলোনা কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির অধীনে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেটিক বিলবাওকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জয় করে। বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ খেলায় ৩৮ গোল, ২৪ এসিস্ট করেন ম্যারাডোনা। ৮৩র লা লিগায় আর্চ রাইভ্যাল এথলেটিকের বিরুদ্ধে খেলায় এথলেটিকার বাস্কো আন্তোনি গয়কোক্সেয়া ম্যারাডোনার গোড়ালি চুরমার করে দেয়। মার্কা পত্রিকা লেখে – “শিল্পী হওয়া নিষেধ।” রুবেন ডারিও অলিভার এর অধীনে চিকিৎসায় ৩ মাস পর আবার খেলায় ফেরেন ম্যারাডোনা।
ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে বিরোধ, ইনজ্যুরি, বিশ্বকাপের হতাশা, ক্লাব প্রেসিডেন্ট নুনেজের সাথে সম্পর্কের ক্রমাবনতি, হেপাটাইটিস মিলিয়ে ম্যারাডোনা জড়িয়ে পড়েন নেশার সাথে। এবং ২ সিজন খেলে বিদায় নেন বার্সিলোনা থেকে। ‘দ্য রিজারেকশন’ শিরোনামের ৫ম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে ম্যারাডোনার নেপোলি অধ্যায়।
১৯৮৪ সালে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি ৯ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বার্সেলোনা থেকে ইতালির ক্লাব নেপোলিতে যোগ দেন ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার পরিচিতির দিন সান পাওলো স্টেডিয়ামে, ১৯৮৪র ৫ জুলাই, ৮০০০০ দর্শক শুধু তাঁর ১০ মিনিটের উপস্থিতির জন্য উপস্থিত হয়।
নেপোলির পারফর্মেন্স তখন করুণ। আগের সিজনে কোনোমতে সিরি-বি’তে অবনমন আটকেছে।
কাগজে ম্যারাডোনা লেখেন, ‘আমি নেপলস এর সব গরিব বাচ্চাদের আদর্শ হতে চাই। কারণ ওরা আমাকে আমার বুয়েন্স আয়ার্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি ওদের মাঝেই আমার শৈশবের ছায়া খুঁজে পাই।’
নেপোলির সংগ্রাম শুধু ফুটবলে না, ছিল উত্তর বনাম দক্ষিণের, বর্ণবাদ বনাম দারিদ্র্যের সংগ্রাম। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে সত্যিকার অর্থেই শ্রমজীবি মানুষের প্রাণের ক্লাবে, গরিব মানুষের সমর্থনপুষ্ট ক্লাবে পরিণত হয় নেপোলি। বড়ো ক্লাবগুলোতে তখন ভয়, আতঙ্ক। দক্ষিণ ইতালির গরীব ছেলেরা ওদের কৌলীণ্য চুরমার করে দিচ্ছিল।
ম্যারাডোনা নেপোলিতে থাকাকালীন আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট গ্রæপ ভোটের আয়োজন করে – পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখ কে? আসে ম্যারাডোনার নাম। ওরা ম্যারাডোনার ছবির স্বত্ত¡ কিনে নিতে চায় ১০০ মিলিয়ন ডলারে। শর্ত দেয় দ্বৈত নাগরিকত্বের। ম্যারাডোনা এতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এ শুধু টাকার ব্যাপার না। একজন আর্জেন্টাইন হওয়ার কাছে এ সবকিছু মূল্যহীন।’
নেপলস শহরের রাজা-সেইন্ট হয়ে উঠেছিলেন ম্যারাডোনা। প্রতি রোববারে নতুন নতুন ভাবে মুগ্ধ করতেন তিনি খেলা দিয়ে? নেপোলি মানেই ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা আর নেপোলি এক হতে হতে এক স্বত্ত¡ায় পরিণত হয়। অন্য জার্সিতে নেপোলিটানরা তাকে কল্পনাই করতে পারত না। নেপোলসে রাস্তায় বের হতে পারতেন না তিনি লোকের ভিড়ে। ওরা বলত, ‘তোমাকে আমার সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।’ নেপলসকে ম্যারাডোনা সব দিয়েছিলেন – হিল ফ্লিকস, ড্রিবল, টাইটেল, সর্বোপরি – গর্ব। ম্যারাডোনা বলেন, ‘আজও কোনো নেপোলিটানকে প্রশ্ন করলে উত্তর আসবে – সেই দলটা কোনো পরিচালক গড়ে দেয়নি, সেই দলটা গড়ে উঠেছিল ম্যারাডোনার হাত ধরে।’
৭ সিজন নেপোলিতে খেলেন ম্যারাডোনা, ১৯৮৪-৯১। আগে কখনো যা অর্জন করেনি, ম্যারাডোনার হাত ধরে সে সমস্ত সাফল্যের দেখা পায় নেপোলি এই ৭ বছরে। ১৯৮৭ সালে সিরি এ স্কুডেট্টো চ্যাম্পিয়ন হয় নেপোলি। সিরি এ’র সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ম্যারাডোনা ১৫ গোল করে। এ বছরই দল কোপা ইটালিয়া জয় করে। ১৯৮৮ সালের কোপা ইটালিয়ার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ম্যারাডোনা ৬ গোল করে। উয়েফা কাপ জয় (৮৭/৮৮) করে নেপোলি – প্রথম এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় দলের জন্য। ১৯৮৯ সালে আবার সিরি এ স্কুডেট্টো চ্যাম্পিয়ন (৮৯/৯০) হয় নেপোলি। ম্যারাডোনা লেখেন, ‘নেপোলির হয়ে স্কুডেটো (সিরি এ) জয়ের আনন্দ, ৮৬র বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও যেন বেশি।’ নেপোলির ৬০ বছরের ইতিহাসে প্রথম এই অর্জন। একদম তলানি থেকে তিলে তিলে ম্যারাডোনা নেপোলি দলকে গড়ে তুলেছিলেন। ৭ বছরে নেপোলিতে ম্যারাডোনার গোল ১১৫ আনুষ্ঠানিক ম্যাচে এবং যোগ দেবার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অধিনায়ক হন। ঐ সময়ে ম্যারাডোনা ছিলেন আনস্টপেবল।
নেপোলির শেষদিকে, একদিকে ম্যারাডোনার নামডাক, সৌভাগ্য, তাঁর নেতৃত্বে নেপোলির একটানা সাফল্য, আরেকদিকে ড্রাগ সেবন, ড্রাগ পাচার, মাফিয়ার সাথে সম্পর্কের অভিযোগ ওঠে।
৯১ এর মার্চে ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হয়ে ফিফার ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞায় ম্যারাডোনা নেপলস ও ইতালি ছাড়েন। নেপলস এর সান পাওলো স্টেডিয়ামে ইটালি ৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আর্জেন্টিনা বনাম ইটালির খেলায় ম্যারাডোনা নেপলস এর দর্শকদের আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিতে বলেন। এতে অনেক শত্রæ তৈরি হয় পুরো ইতালিতে। ১৯৯০ এর সামারে নেপলসে আর্জেন্টিনা ইতালিকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয়। ফুটবল ফেডারেশন এর সভাপতি মাতেরেসে এর প্রতিশোধ নেন এভাবেই। ম্যারাডোনা লেখেন, ‘কিন্তু এটাই গল্পের শেষ না। গল্পের সমাপ্তি এভাবে হওয়ার কথা ছিল না।’
‘দ্য গেøারি’ শিরোনামে ষষ্ঠ অধ্যায়ে ম্যারাডোনা তাঁর অধিনায়কত্বে মেক্সিকো ‘৮৬ বিশ্বকাপ জয় নিয়ে লিখেছেন।
খুব ছোটো থাকতেই ম্যারাডোনা বলতেন, ‘আমার স্বপ্ন দুটো। এক বিশ্বকাপে দেশের হয়ে খেলা এবং দুই বিশ্বকাপ জয়।’ নেপোলির বড় সাফল্যের আগেই ৮৬’র বিশ্বকাপ তাঁকে সারাজীবনের জন্য বদলে দেয়।
পেরুর সাথে কোনোমতে জিতে বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জিত হয় আর্জেন্টিনার। ম্যারাডোনা বলেন, ‘বিশ্বকাপ এভাবেই শেষ হবে আমাদের। নানা বাধা বিঘেœর ভেতর দিয়ে যাবো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা জিতব।’
কোচ বিলার্দোর এই বিশ্বকাপ দলটার ওপর কারো ভরসা ছিল না। ম্যারাডোনা বলেন, ‘যা কেউ বোঝেনি – আমাদের ঐক্যবদ্ধতা আর শক্তিমত্তার উৎস হলো আমাদের রাগ, আমাদের কিছু করে দেখানোর চেষ্টা। একটা দল যার গড়ে ওঠা অনেক উত্থান পতনে কিন্তু বিপক্ষ দলকে সামনে পেলে যারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত – এটাই ছিল আমার দল।’
কোয়ার্টার ফাইনালকে বলা যায় – গ্রেটেস্ট ট্রায়াম্ফ ও গ্রেটেস্ট স্ক্যান্ডাল। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল এটি, ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারেরও।
আজটেকা স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের শোধ নেয় ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা দল। এই ম্যাচে ম্যারাডোনা ২ গোল করেন। ম্যাচের ৫১ মিনিটে রেফারিকে ফাঁকি দিয়ে হাত দিয়ে বল জালে ঠেলেছিলেন তিনি। এই গোলটি হয়তো ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়েই থাকত। কিন্তু চার মিনিট পরেই যে অবিশ্বাস্য গোল তিনি করে দেখান, তাতে সব মিলিয়ে পুরো গল্পটা হয়ে উঠল ফুটবলীয়-পুরাণের অংশ। ছয় ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে মাঝমাঠেরও ভেতর থেকে একাই বল টেনে নিয়ে গিয়ে করেন ম্যাচের এবং নিজের দ্বিতীয় গোল। ম্যারাডোনা একে বলেন – ড্রিম গোল।
২৫ জুনের সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবেই দলকে জেতান ম্যারাডোনা এবং একটি দুর্দান্ত গোল করেন।
ফাইনালে প্রতিপক্ষ জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ম্যারাডোনার দল আর্জেন্টিনা।
এক সিঙ্গেল খেলোয়াড়ের দ্বারা ডমিনেটেড ৮৬র বিশ্বকাপ ছাড়া আর কখনো দেখা যায়নি। এ সময় পেলে, ক্রুয়েফ এর মতো গ্রেটেস্ট খেলোয়াড়দের সাথে তাকে তুলনা করা হয় ম্যারাডোনাকে। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত মানুষে পরিণত হয় তিনি।
‘দ্য স্ট্রাগল’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে ম্যারাডোনার কোপা আমেরিকা ৮৭ ও ৮৯ এর কথা।
খেলার মাঠে একদিকে তখন নেপোলির স্কুডেট্টো জয়, কোপা ইটালিয়া জয় আর অন্যদিকে কোপা আমেরিকা। দুই কোপা আমেরিকায় ম্যারাডোনা জাতীয় দলের হয়ে খেলেন।
কোপা ’৮৭ এ ৪র্থ স্থান আর কোপা ’৮৯ এ ৩য় স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় আর্জেন্টিনা দলকে।
এ সময় আর্জেন্টিনার রাজনীতি ও অর্থনীতির বাজে অবস্থা ছিল। ফুটবলই ছিল একমাত্র স্বস্তির সুবাতাস।
কোপা ৮৯ এর খেলার মাঝামাঝি ম্যারাডোনা তাঁর উপলব্ধি লিখেছেন, ‘আমি কিন্তু অতিমানব না, সুপারম্যান না। আমি কাঁচের গ্লাস চিবিয়ে খেতে পারি না। আর এমনটা পারবও না।’
সবার চরম নিন্দার শিকার হয়েও আর্জেন্টাইন দল একতাবদ্ধ হয়ে ইতালি ‘৯০ বিশ্বকাপে যাত্রা শুরুর প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
‘দ্য ভেনডেটা’ অধ্যায়ে, তাঁর অধিনায়কত্বে ইতালি ৯০ বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা লিখেছেন ম্যারাডোনা?
নেপোলিতেই তখনো ম্যারাডোনা। নেপোলি ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি এই সময়ে। এর মধ্যেই আসে ৯০ এর ইতালি বিশ্বকাপ।
‘জাতীয় দলটা ম্যারাডোনা নির্ভর।’ ‘দিয়াগো ভালো থাকলেই আর্জেন্টিনা জিতবে।’ এরকম কথাবার্তার মধ্যে ম্যারাডোনা ছিলেন মানসিক চাপে। ইনজ্যুরি নিয়েই যোগ দেন তিনি বিশ্বকাপে। গত বিশ্বকাপের চেয়ে এবারের দল শক্তিশালী হলেও, দলের ওপর কারো ভরসা ছিল না।
৮ জুন ক্যামেরুনের সাথে প্রথম খেলায় শুরু থেকেই ফাউল করে ক্যামেরুনের খেলোয়াড়রা। আর্জেন্টিনা হেরে যায় এই ম্যাচে। কোচ বিলার্দো বলেন- ‘হয় এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ফাইনাল, আর না হয় আর্জেন্টিনায় ফেরত।’ কোনোমতে গ্রæপে ৩য় হয়ে ২য় রাউন্ডে ওঠে ম্যারাডোনার দল।
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। এই ম্যাচে ব্রাজিলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা ম্যারাডোনার সেরা স্মৃতি।
নেপোলিতে সেমিতে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ইতালি। ইতালিকে হারিয়ে দল ওঠে ফাইনালে। এবং ইতালিকে হারানোর বিরাট মাশুল গুনতে হয় ম্যারাডোনাকে।
ফাইনালকে ম্যারাডোনা বলছেন, ‘একদম নিচ থেকে লড়াই করে উঠে আসার রূপকথা’। ৪ বছর বাদে আবারো ফাইনালে জার্মানির মুখোমুখি আর্জেন্টিনা। ১-০ গোলে হেরে আর্জেন্টিনা রানার আপ হয়ে শেষ করে ৯০ এর বিশ্বকাপ।
‘দ্য কামব্যাকস’ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ম্যারাডোনার সেভিলা ও নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজ এর গল্প।
নিষিদ্ধ থাকাকালীন ম্যারাডোনা বেশ কয়েকটি চ্যারিটি ম্যাচ খেলেন।
১৯৯২ এর ১লা জুলাই ইটালির আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর বিষাদময় ১৫ মাস কাটে ম্যারাডোনার।
১৯৯২ সালে নেপোলি ছেড়ে দেন ম্যারাডোনা। স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও ফরাসি ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই এর আগ্রহকে পাশ কাটিয়ে তিনি আরেক স্প্যানিশ ক্লাব সেভিলাতে যোগ দেন। বিলার্দো ছিলেন সেভিলার কোচ। বিলার্দোই অফার দেন ম্যারাডোনাকে। এর মধ্যে জাতীয় দলের কোচ কোকো বাসিল জানান, বিশ্বকাপের জন্য ম্যারাডোনাকে ডাকবেন।
ম্যারাডোনা, ব্রাজিল (কোপা জয়ী) আর ডেনমার্কের (ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন) বিরুদ্ধে দেশে ফ্রেন্ডলি খেলতে গেলে সেভিলাতে ঝামেলা হয়। সেভিলা হয়রানি করা শুরু করে। এবং ১ বছর খেলে সেভিলার সাথে চলার সমাপ্তি টানেন ম্যারাডোনা।
২ মাস পরে, ১৯৯৩তেই আর্জেন্টিনার নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজে যোগ দেন ম্যারাডোনা। ৯ বছর পর আর্জেন্টাইন লিগে ফেরা তাঁর।
এবারে ওল্ড বয়েজের সাথে অভিষেকে আবার নেপোলির অভিষেকের মতো দৃশ্য। স্টেডিয়ামে ৪০০০০ দর্শক আসে শুধু ম্যারাডোনার অনুশীলন দেখতে। এ সময় জাতীয় দলে ফেরেন তিনি। এবং ২ বছর খেলার পর নিউওয়েল থেকে বিদায় নেন ম্যারাডোনা।
একইদিনে বাগানবাড়িতে সাংবাদিকদের এয়ার রাইফেল দেখানোর লজ্জাজনক ঘটনাটিও ঘটে।
‘দ্য পেইন’ অধ্যায়ে ম্যারাডোনা লিখেছেন তাঁর অধিনায়কত্বে ৯৪ এর আমেরিকা বিশ্বকাপের কথা।
এল কোকো মেনোত্তি দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্জেন্টাইন জাতীয় দল একটানা ২২ খেলায় জয়লাভ করে। পুরো জাতির অকুন্ঠ সমর্থন পাচ্ছিল দলটা। ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা, সিমিওনে, এরিয়েল ওর্তেগা, বেলবো, ইসলাস, গয়কোচিয়া তখন দলে। দলের ঝুড়িতে দুটো কোপা জয়।
এ সময় ম্যারাডোনা এএফএ কর্তৃক সর্বকালের সেরা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি লাভ করেন।
৯৪ এর বিশ্বকাপে সঠিক ওজন এবং ফর্ম ফিরে পেতে বেশ বেগ পেতে হয় ম্যারাডোনাকে।
মূল পর্বে গ্রিসের বিপক্ষে জয় পায় ম্যারাডোনার দল। নাইজেরিয়ার সাথে ২য় খেলায় ২-১ গোলে জয় দলের। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের ২১তম এপিয়ারেন্স ছিল ম্যারাডোনার।
এই খেলার পরেই ড্রাগ টেস্ট, ১৯৯৪ এর ২৫ জুন। পরের খেলা বুলগেরিয়ার সাথে। দলের সাথে ডালাসে যান ম্যারাডোনা। ওখানেই টেস্ট পজিটিভের খবর জানেন। মিডিয়ায় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, তিনি পারফর্মেন্স বর্ধক ড্রাগ নেননি। আর্জেন্টিনায় যে ঔষধে এফিড্রিন নেই, আমেরিকায় একই ঔষধে এফিড্রিন ছিল অল্প পরিমাণে। নির্দোষ ভুল ক্যারিনির, বলেন তিনি। এছাড়া ম্যারাডোনা আরো দাবি করেন যে, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগে ওজন কমানোর জন্য ঐ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে ফিফার সাথে তাঁর একটি চুক্তি হয়েছিল।
ম্যারাডোনা বলেন, একদিন হলেও প্রমাণ করবেন যে তিনি নির্দোষ।
অতঃপর ফুটবল বিশ্বকাপকে বিদায় জানান ম্যারাডোনা।
‘দ্য ফেয়ারওয়েল’ অধ্যায়ে, ৯৫-৯৬ সময়কালে বোকার সাথে শেষ পথচলার কাহিনি লিখেছেন ম্যারাডোনা।
৯৪ এর আগস্ট থেকে আবারো নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ম্যারাডোনার। নিষেধাজ্ঞার সময়কালে, কোরিয়েন্তেসের মান্দিউ ক্লাবে ২ মাস ও রেসিং ক্লাবে ৪ মাস ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন ম্যারাডোনা।
নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই, ৯৫ এর জানুয়ারিতে ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন ‘ফ্রান্স ফুটবল’ ম্যারাডোনার ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রতি সম্মাননা জানিয়ে ‘ব্যালন ডি ওর’ তুলে দেয়।
এর মধ্যে ম্যারাডোনা অফার পান তাঁর আজন্ম প্রিয় বোকা জুনিয়র্স থেকে। প্যারিসে ফুটবলারদের বিশ্ব সংস্থা গড়ে তোলেন ম্যারাডোনা। এ সময় বেশ কয়েকটি প্রীতি ম্যাচ খেলেন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিভাগ থেকে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পান। সেখানে ‘ইন্সপায়ার অফ ড্রিমস’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৯৬ এ প্রেসিডেন্ট মেনেম পরিচালিত ক্যাম্পেইন ‘নির্মল সূর্য দিন’ এর প্রচারণার সাথে যুক্ত হন তিনি। এ সময় জাপানে ২ বছর খেলার জন্য ২০ মিলিয়ন ডলারের অফার ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘বম্বেনেরাতে ট্রফি হাতে দৌড়ানোর সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় না।’
বোকায় ম্যারাডোনা ছিলেন ১১ মাস। বোকার সাথে তাঁর গল্প শেষ হয় আর এক ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ নিয়ে।
১৯৯৭ এর ৩০ অক্টোবর, ৩৭ তম জন্মদিনে, গুজব রটে যে – ম্যারাডোনা ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ এবং তাঁর বাবা মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন ম্যারাডোনা বলেন, ‘ব্যাস যথেষ্ট হয়েছে। ওরা আরো বেশি কষ্ট পাওয়ার আগেই থেমে যাওয়া ভালো। আমি ফুটবলকে তাই বিদায় জানালাম। চিরদিনের জন্য? আমি ঠিক নিশ্চিত নই।’
‘অ্যাট এ গø্যান্স’ নামে দ্বাদশ অধ্যায়ে ম্যারাডোনার চোখে সেরা ১০০ ফুটবলারের পরিচিতি ছাড়াও লিখেছেন তাঁর প্রিয় মানুষজনের কথা? লিখেছেন – অপ্রিয়জনদের কথাও।
অপছন্দের মানুষের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন পোপের কথা, রাজনীতিবিদদের কথা, ক্লাব ডিরেক্টরদের কথা, মানুষ হত্যাকারী আর্জেন্টাইন মিলিটারির কথা।
লিখেছেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, ক্যামেরার সামনেই আমার সারাটাজীবন কেটেছে? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে অমন না। আমার ব্যক্তিগত জীবন আছে। কিছু জিনিস শুধু আছে আমার অন্তরে, কেউ সেসব জানে না। সেসব অনুভূতি বর্ণনাতীত, কারণ কোনো শব্দেই সেসব প্রকাশযোগ্য না।’
প্রিয়জনের কথায় ক্লাউডিয়ার কথা বলেছেন, যিনি সুখে দুঃখে সবসময় আগলে রেখেছেন ম্যারাডোনাকে। ১৯৮৯ এ বিয়ে করেন ম্যারাডোনা ক্লাউডিয়াকে। অভিজাত লুনা পার্কে বিয়ের অনুষ্ঠানে তারকা-মহাতারকার পাশাপাশি নিমন্ত্রণ পেয়েছিল তাঁর শৈশবের ফাইওরিটোর হতদরিদ্র লোকজনও। দুই মেয়ে দালমা আর জিয়ানিন্নার কথা বলেছেন। বলেছেন স্নেহমহী বাবা ডন ডিয়েগো-মা ডোনা টোটা, ২ ভাই লালো, টারকো, ৪ বোন এনা, রিতা, মেরি, ক্যালির কথা।
১০০ জন ফুটবলারের তালিকার শুরুতেই পেলের কথা লিখেছেন। লিখেছেন, ‘পেলে খেলায় সেরা। কিন্তু তিনি তাঁর ট্যালেন্ট ফুটবলকে গেøারিফাই করতে কাজে লাগাননি। তিনি ভেবেছেন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি বরং খেলোয়াড়দের দাবি দাওয়া নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারতেন। গারিঞ্চার পাশে দাঁড়াতে পারতেন।’
এই অধ্যায়ের শেষটুকু জুড়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও চেগুয়েভারার কথা লিখেছেন ম্যারাডোনা। লিখেছেন, ‘ফিদেলকে দেখা মানে, হাত দিয়ে আকাশ স্পর্শ করা। আমি আমার সমস্তকিছুর জন্য দুই দাড়িওয়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই – ঈশ্বর আর ফিদেল।’
আর্নেস্তো চে গুয়েভারার ট্যাটু তিনি আমৃত্যু হাতে ধারণ করেছেন। চে’র আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ম্যারাডোনা বলতেন, ‘আমি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। আমি তাদেরই একজন।’ ‘আই অ্যাম এল দিয়েগো’ শিরোনামের অধ্যায়ে, পুরো বইটায় ম্যারাডোনা যেভাবে ধরা দিয়েছেন, সেসবই একসাথে করে আছে।
ম্যারাডোনা লেখেন, ‘জাতীয় দলের হয়ে খেলা সবসময় আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। ক্লাবে মিলিয়ন ডলারে খেললেও এর সাথে কোনো তুলনা চলে না। আমি চাই, আগামির খেলোয়াড়দের মাথায় এ বিষয়টা ঢুকুক।’
অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গে লেখেন, ‘আমি অধিনায়কত্ব পছন্দ করতাম। তাতে করে, খেলোয়াড়দের বিপক্ষে কিছু হলে, অন্যায় হলে, কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে ‘আমি হস্তক্ষেপ করতে পারতাম। আর এর জন্য আমাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আমি ওয়ার্ল্ড ফুটবলারস এসোসিয়েশন তৈরি করেছি। বুঝেছি, খেলোয়াড়রা ঐক্যবদ্ধ থাকলে, যে কোনো অন্যায্যতার প্রতিবাদ-প্রতিকার সম্ভব।’
খেলায় খেলোয়াড়দের অবস্থান প্রসঙ্গে লেখেন, ‘২৫ বছরের অভিজ্ঞতায় বলছি – ফুটবলে ফুটবল খেলোয়াড়রাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এসব বলার জন্য ক্ষমতাসীনরা আমায় ক্ষমা করেনি। কিন্তু ওরা যা পারেনি তা হলো – আমাকে বদলাতে।’ আরো লেখেন, ‘আজকাল খেলার অনেককিছু পেছন থেকে নির্ধারণ হয়ে যায়। কিন্তু আমি ৮৬তে মেক্সিকো বিশ্বকাপে লাঞ্চের সময় খেলার প্রতিবাদ জানিয়েছি। ৯০ এ জার্মানি-ইতালি ফাইনাল হতে দিইনি। এর জন্য আমাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।’
আবার জন্মালে কী চাইবেন ম্যারাডোনা? ‘আবারো জন্ম নিলে ঈশ্বরকে বলব ঠিক আগের মতো করেই জন্ম দিতে। কারণ তিনি আমাকে মাত্রাতিরিক্ত দিয়েছেন এ জীবনেই। আর চাইব নেপোলিটানরা আমার যেসব মুভ, যেসব গোলে আনন্দে ভেসেছে, একই জিনিস আমার দেশ আর্জেন্টিনার জন্য করতে। আমার দেশের মানুষের জন্য করতে।’
নিজের সম্পর্কে ম্যারাডোনা লেখেন, ‘আমি আমার দোষ, গুণ – আমার সব কর্মকাণ্ডের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছি। আমি নিজের ছাড়া আর কারো সর্বনাশ করিনি। আমার জীবনে আমার কিছু আপনজনকে সবসময় পাশে পেয়েছি। সর্বোপরি পেয়েছি আর্জেন্টিনাবাসীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।’
‘বইয়ে আমি আগাগোড়া সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। একটাই বার্তা দিতে চেয়েছি – আমি শেষ পর্যন্ত সত্য বলে যাব। আপোস করব না। আমি অন্যায় সইতে পারি না।’
একদম শেষে লেখেন, ‘আমি জানি আমি দুনিয়াটা পাল্টাতে পারব না। কিন্তু কেউ আমার জগতে এসে আমাকে পাল্টাতে পারবে না। কেউ আমাকে বিশ্বাস করাতে পারেনিÑ ড্রাগ এবং অন্যান্য ভুলত্রæটিতে আমার অনুভূতি পাল্টেছে। না, কিচ্ছু পাল্টায়নি। আমি সবসময় একইরকম আছি। এই আমি, ম্যারাডোনা। আমি এল দিয়েগো।’
পেপারব্যাক ভার্সনের জন্য ২০১০ সালে, স্প্যানিশ প্রথম ভার্সনের ১০ বছর পর, এপিলোগ লেখেন মার্ক ওয়াইনস্টাইন।
১৯৯৮ সালে প্রতিযগিতামূলক খেলা থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায়ের ১ বছর পর, আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে (বুয়েন্স আয়ার্সের উপকণ্ঠে ম্যারাডোনার হোমটাউন থেকে ১৮০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে) তৈরি করা হয় ‘চার্চ অফ ম্যারাডোনা।’ ক্যাথলিক এই চার্চে ম্যারাডোনাকে সুপ্রিম গড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর ক্রিসমাস উদযাপন করা হয় প্রতি বছর অক্টোবরের ৩০ তারিখ, ম্যারাডোনার জন্মদিনে।
২০০০ সালে বইটি স্প্যানিশে প্রকাশিত হবার পরপরই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পার্সোনাল গেস্ট হিসেবে কিউবার হাভানায় ক্লিনিকে ভর্তি হন ম্যারাডোনা রিহ্যাবের জন্য। কিন্তু এতে প্রভাব পড়েনি ঐ বছরেরই শেষ দিকে, ফিফার ‘প্লেয়ার অফ দ্য সেঞ্চুরি’ জরিপে। ম্যারাডোনা ৫৩.৬% ভোট পেয়ে শীর্ষস্থান দখল করেন। ফুটবল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে পরে পেলে এবং ম্যারাডোনা দুইজনকেই যৌথভাবে শীর্ষস্থান দেওয়া হয়।
কিউবা থেকে ৪ বছরের চিকিৎসা থেকে ফিরে ম্যারাডোনার আবার কোকেনে আসক্তি দেখা দেয় ২০০৪ সালে। কিন্তু ২০০৩ সালের ক্রিসমাসে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স (ম্যারাডোনার প্রথম পেশাদারী ক্লাব) তাদের স্টেডিয়ামের নাম রাখে ম্যারাডোনার নামে। ওরা এই ঘটনার পরও পরিবর্তন করেনি নাম।
এপ্রিল ২০০৪ এ বুয়েন্স আয়ার্সে আবার হাসপাতালে ভর্তি হন ম্যারাডোনা। ঐ সময় হাজার হাজার ভক্ত ২৪ ঘণ্টা একটানা ক্লিনিকের বাইরে অবস্থান নেয়, তিনি সুস্থ হওয়া পর্যন্ত।
এর পরপরই আর্জেন্টিনা টিভির আলোচিত টক-ভ্যারাইটি শো ‘দ্য নাইট অফ টেন’ এর হোস্ট হন ম্যারাডোনা।
২০০৫ এর সামারে বোকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হন ম্যারাডোনা। তিনি ও কোচ আলফিও বাসিল মিলে বোকাকে কতগুলো শিরোপা জেতান।
ম্যারাডোনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পান ২০০৮ সালে। ২০১০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ তে হেরে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।
মার্ক ওয়াইনস্টাইন লেখেন, ম্যারাডোনা তার ভক্তদের সবসময় প্রাউড করতে পারেনি সত্য কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চিত যে, দোষে-গুণে তিনি সবসময় ‘এল দিয়েগো’ই থাকবেন।
সদ্য-প্রয়াত ফুটবল-কিংবদন্তি ম্যারাডোনার স্মরণে নিবেদিত এই আসরে, ম্যারাডোনার আত্মজীবনী বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে, ম্যারাডোনার বয়ানেই ম্যারাডোনার খেলোয়াড় জীবন ও ব্যক্তি ম্যারাডোনাকে নির্মোহভাবে তুলে ধরেন আলোচক শেখ রানা। এ আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।