অনলাইন ডেস্ক : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল এ কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৫ বছর আগে এ দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী কুচক্রী মহল।
নৃশংসভাবে হত্যার পর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে নয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আরও দুটি বাড়ি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে উদ্ধার করা হয় অন্যদের লাশ।
এদিকে ওই ঘটনার ৪৫ বছর পর দেশের বাইরে পলাতক থাকার পর গত ৬ এপ্রিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গ্রেফতার করে এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুল মাজেদকে।
গত ১২ এপ্রিল ১২টা ১ মিনিটে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। এ জবানবন্দির ভিডিও বিভিন্ন অনলাইনে প্রচারিত হয়েছে।
জবানবন্দিতে ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদ বলেন, ‘১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান সাহেব ১০-১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট অডিটোরিয়ামে সব অফিসার এবং জওয়ানদের এড্রেস করেন। ওখানে উনি মোটিভেট করেন, যে ঘটনা গত রাতে ঘটে গেছে তোমরা সেসব নিয়ে কোনো মাথা ঘামাবে না। তোমরা সব চেইন অব কমান্ডে ফিরে যাও। তোমরা সবাই ফিরে যাও, তোমরা কাজকর্ম কর। এটা জাতির ব্যাপার, আমাদের ব্যাপার না।’
মাজেদ আরও বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের সমর্থন আছে, না হলে উনি আগ বাড়িয়ে এসব মোটিভেশন কেন করবেন? উনার সমর্থন ছিল তা পরিষ্কার কথা। রেগুলার ওরাই ডিরেক্ট করতো সবকিছু, হুকুম চালাতো ওখান থেকে। ওরা যা চাইতো জিয়াউর রহমান তাই করে দিতেন। এ ধরনের অবস্থা ছিল তখন। এতেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। এরা সব ভিআইপি অবস্থায় ছিল। প্রেসিডেন্টের গেট দিয়ে এরা প্রবেশ করতো। প্রেসিডেন্টের পাশের ভিআইপি স্যুটে মোশতাক সাহেব যে রুমে থাকতেন, সেই পাশে ওরা থাকতো। ওখানেই ওদের সাথে জিয়াউর রহমান সাহেবের কথোপকথন হতো।’
তিনি বলেন, আর্মির চেইন অব কমান্ড বলতে তখন কিছু ছিল না। ওরাই চালাতো প্র্যাকটিক্যালি। পরে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমি সেনা হেড কোয়ার্টারে উনার কাছে সাক্ষাৎকার দিতে যাই। সেখানে উনাকে বললাম, আমার একটা সার্ভিসের বিষয়ে। আমি উনাকে বাইরে সিভিল সার্ভিসের বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম। তখন উনার সাথে আলোচনা হয়েছিল।’
খুনি মাজেদ বলেন, ‘তখন উনি এ হত্যাকাণ্ড (ক্যু) এর পক্ষপাত সুলভ কথাবার্তা বলছেন। এবং এটাই বোঝা গেছে ক্যুর সমর্থক। ওদের সঙ্গে উনার সবকিছু যোগাযোগ ছিল। পরে বঙ্গভবনে অবস্থানকারী সব সেনা অফিসার ছিল তাদের বিদেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করেন জিয়াউর রহমান। আমি এগুলো দূর থেকে দেখেছি। উনি সব কাগজপত্র তৈরি করতে মিলিটারি সেক্রেটারি তখনকার ব্রিগেডিয়ার মাশহুর হককে নির্দেশ দিয়েছেন। যেহেতু আমরা বঙ্গভবনে ডিউটিরত ছিলাম সেখানকে আমাদেরকেও ব্যাংককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যাংকক থেকে আমাদের আর ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হয়নি। পরে শুনলাম জিয়াউর রহমান সাহেব পুরো ক্ষমতায়। পরে তাদের লিবিয়ায় আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করেছেন। পরে শুনলাম তারা জেলখানাতেও জাতীয় চার নেতাকে মেরে ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘লিবিয়াতে আমরা গিয়েছিলাম। তারপর বলে যে ফরেন সার্ভিস হবে সবার। আমরা শুনি জিয়াউর রহমান সাহেব ফরেন সার্ভিস দেবেন সবাইকে প্রাইজ হিসেবে। সেই সঙ্গে একটা করে প্রমোশন দিয়ে দেবেন। কিছুদিন পরে জিয়াউর রহমান জেনারেল নুরুল ইসলামকে পাঠান। তিনি ওদের সাথে মিটিং করে। জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে কার কার ফরেন পোস্টিং হবে সেই সব চয়েজ নিতেই উনি গেছেন। জিয়াউর রহমানের ডাইরেক্ট মদদ ছিল ওদের প্রতি। উনি ওদের টোটাল পেট্রোনাইজড করেছেন। একটা করে প্রমোশন জাম্পড করে একটা করে ফরেন প্রাইজ পোস্টিং দিয়েছেন। এসব অফিসার ফরেন সার্ভিসের জন্য উপযুক্ত নয়। তারা গ্রাজুয়েটও না। এতেই বোঝা যায় জিয়াউর রহমান পুরোপুরি ওদের সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের জন্য বঙ্গভবন থেকে পাসপোর্ট এমনকি পরিবারও তাদের সাথে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যারা বিয়ে করেননি তাদের হবু স্ত্রী, গার্লফ্রেন্ড সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মেজর শাহরিয়ার বিয়ে করে নাই এক ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান। সেইসব কাগজপত্র তাদের বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সব সুযোগ সুবিধার জন্য বোঝা যাচ্ছে তিনি (জিয়াউর রহমান) এর সঙ্গে জড়িত। যেহেতু তিনি আর্মি চিফ আর এরা আর্মি অফিসার।’
সূত্র জানায়, মাজেদ শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নয়, কারাগারে চার নেতা হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এ দুটি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে তিনি সঙ্গী হিসেবে পান আরেক পলাতক খুনি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনকে। বিদেশে আত্মগোপনে থাকার সময় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের সঙ্গেও মাজেদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মাজেদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মোসলেহ উদ্দিনের খোঁজে ব্যাপক অনুসন্ধান তৎপরতা চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে মোসলেহ উদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের ছেলে সাজিদুল ইসলাম খান বর্তমানে নরসিংদীতে বসবাস করেন। তিনি বলেন, বহু বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে তার বাবার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও তারা জানেন না।
মাজেদের সন্ধান ও পরবর্তী গ্রেফতার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টির সঙ্গে শুরু থেকে সংশ্লিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে ইউরোপের একটি দেশে তার (মাজেদ) অবস্থান শনাক্ত করা হয়। এরপর আমেরিকায় ছেলের বাড়িতে মাজেদের অবস্থানের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হন গোয়েন্দারা। মূলত আমেরিকা থেকেই তার ওপর নিবিড় নজরদারি শুরু হয়। একপর্যায়ে ভারতের কলকাতায় তার অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এরপরই তাকে গ্রেফতারের জন্য কঠোর গোপনীয়তায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়। ভারতের গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই কলকাতায় হাজির হয় বাংলাদেশের একটি চৌকস গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল। তারাই মাজেদকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।