অনলাইন ডেস্ক : সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করে তোলা নয়, বরং সুস্থ হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা প্লাজমা থেরাপি আশার আলো দেখিয়েছিল। গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে—এমন আশায় এর প্রতি ঝোঁক বেড়েছিল। তবে দিনে দিনে সে ঝোঁক ব্যবসার দিকে রূপ নিচ্ছে। মানা হচ্ছে না কোনও নিয়ম-নীতি। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর এ সম্পর্কে এখনও কোনও নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি।

রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া প্লাজমা থেরাপি না দিতে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। নেই কোনও মনিটরিং সিস্টেম। যে কারণে চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে চলছে প্লাজমা ব্যবসা। এমন পরিস্থিতিতে প্লাজমা থেরাপিকে দ্রুত একটি নীতিমালার ভেতরে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ও প্লাজমা থেরাপির জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান।

এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাজমা থেরাপির গবেষণামূলক কাজের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সহযোগিতা না পাওয়া গেলেও এটি প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেডিক্যালের এ সংক্রান্ত কমিটি। দেশে করোনার ওষুধ ও প্লাজমা নিয়ে দুর্বৃত্তচর্চা হচ্ছে বলেও মন্তব্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক জানান, গত ২৭ এপ্রিল থেকে এ ইনস্টিটিউটে প্লাজমা থেরাপির জন্য প্লাজমা ব্যাংক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এ প্লাজমা ব্যাংকে প্লাজমা ‘স্টোর’ করে রাখা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল চাইলে তারা এখান থেকে প্লাজমা নিতে পারছে। এখন পর্যন্ত এখান থেকে ১৭৫ কে প্লাজমা দেওয়া হয়েছে। দান করেছেন ৯৯ জন।

ডা. আশরাফুল হক বলেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়া একজন মানুষ প্লাজমা দিতে পারেন ৪০০ মিলিলিটার, কিন্তু একজন রোগীর দরকার হয় ২০০ মিলিলিটার। সে হিসেবে একজন সুস্থ মানুষের প্লাজমাতে দুইজন রোগী প্লাজমা পান।

এদিকে সুনির্দিষ্টভাবে অন্য কোনও চিকিৎসা না থাকায় প্লাজমা নিয়ে দেশে এখন ব্যবসা হচ্ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। প্লাজমা দেওয়ার প্রধান শর্ত করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা পরীক্ষা করা। অনেক প্রতিষ্ঠানই সেটা করছে না বলেও জানাচ্ছেন তারা।

অ্যান্টিবডি টেস্ট না করেই প্লাজমা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ

করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা এ ভাইরাস মোকাবিলা করে টিকে থাকতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লাজমায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ওই অ্যান্টিবডিই অসুস্থদের সারিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার হয়। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ১৪ দিন পর একজন ব্যক্তি প্লাজমা দিতে পারেন। অথচ দেশে এখন অ্যান্টিবডি টেস্ট না করেই প্লাজমা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক। তারা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ সেন্টার যারা প্লাজমা কালেকশন করছে তারা কেউ অ্যান্টিবডি টেস্ট করছে না। অ্যান্টিবডি টেস্ট না করার কারণে কোনও প্রমাণ নেই, যিনি প্লাজমা দিচ্ছেন তার শরীরে অ্যান্টিবডি গ্রো করেছে বা আদৌ তিনি কখনও করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা।

একাধিক চিকিৎসক বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভিআইপি রোগীদের যখন প্লাজমা দেওয়া হয় তখন সে স্যাম্পল পাঠানো হচ্ছে বার্ন ইনস্টিটিউটে অ্যান্টিবডি চেক করে দেওয়ার জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সেটাও হচ্ছে না। ফলে সঠিক রোগী প্লাজমা পাচ্ছে কিনা সে নিয়েও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

চলছে অবৈজ্ঞানিক চর্চা

দেশে এখন প্লাজমা দেওয়ার অবৈজ্ঞানিক চর্চা চলছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক চিকিৎসক বলেন, এখন প্লাজমা নিয়ে যা হচ্ছে সেটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। একইসঙ্গে সঠিক মানুষ প্লাজমা না পেয়ে যদি যার দরকার নেই তিনি প্লাজমা পান তাহলে মূল চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব নয়।

প্রথমবার প্লাজমা দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার আগে এর উন্নতি বা অবনতি বোঝার সুযোগ নেই। কিন্তু দেশে বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে না, হুজুগের চর্চা করছি জানিয়ে একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা চিকিৎসকরা স্বজনদের একটা প্যানিক সিচুয়েশনের ভেতরে ফেলছি। তাদের বোঝানো হচ্ছে এখনই রোগীকে প্লাজমা দিতে হবে। কিন্তু বলা নেই প্লাজমা এখনই দিলে ভালো হবে, বা ১২ ঘণ্টা পরে দিলে ভালো হবে অথবা প্লাজমা না দিলে রোগী খারাপ হবে।

প্লাজমা দেওয়ার মতো এখনও কোনও প্রটোকল তৈরি হয়নি জানিয়ে ডা. আশরাফুল হক বলেন চীনে পাঁচ জন রোগীর ওপর করা এক গবেষণাতে দেখা গেছে ৪৮ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় প্লাজমা দেওয়া যায়, তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করছে যুক্তরাজ্য। কিন্তু ভারত, যুক্তরাষ্ট্রে একটি ডোজ দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশের কিছু চিকিৎসক কেবল ডাবল ডোজ নয়, যতদিন পারেন ততদিনই প্লাজমা দিতে চান। স্বজনদের সেভাবে পুশ করেন। যেটা আসলে কোনও প্রটোকলই নয়, তারা খামখেয়ালিভাবে এগুলো করছেন।

প্লাজমার ব্যবসা

প্লাজমা দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবেন বিষয়টি কখনও বলা হয়নি, এটা একটি সহায়ক চিকিৎসা। এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত নয়। কিন্তু চিকিৎসকরা তাই করছেন, আর সে কারণেই দালাল শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, আর্থিক লেনদেন এবং রোগীর ভোগান্তি হচ্ছে। কমপক্ষে ত্রিশ হাজার করে টাকা নেওয়া হচ্ছে এক ব্যাগ প্লাজমার জন্য, এটা এখন দেশের অনেক বড় এক ব্যবসা—বলছেন চিকিৎসকরা। তাদের মতে ‘আমরা প্লাজমা নিয়ে যত বেশি হাহাকার তুলতে পারবো, মানুষ তত বেশি এর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং তত বেশি ব্যবসা হবে—এটাই চলছে এখন।’

প্লাজমা নিয়ে যা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্লাজমা থেরাপিকে শুধু পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে রাখার জন্য বলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন দিয়েছে। যেখানে একে ‘ইনভেস্টিগেশনাল থেরাপিউটিকস’ বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এটা সব রোগীর ওপর নিশ্চিতভাবে কাজ করছে এমন প্রমাণ নেই। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, এখনও আমাদের নিজেদের কোনও গাইডলাইন নেই, করোনাভাইরাসের সব চিকিৎসাই এখনও পরীক্ষামূলক। প্লাজমা থেরাপিও তার ব্যতিক্রম নয়।

অধিদফতরেরও নির্দেশনা নেই

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাজহারুল হক তপন বলেন, প্লাজমা থেরাপির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, আমরা ডেটা অ্যানালাইসিস করছি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসানের কাছে গত এপ্রিল মাসে ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকার ফান্ড চেয়ে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু ৩ মাসেও সে ফান্ড আসেনি। কোনও নির্দেশনাও পাইনি আমরা। তবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের মতো করে।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ডা. আমিনুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।