আকতার হোসেন
টরেন্টো শহরে ৭৬ বছরের এক যুবক এখনো কাঁধে ঝোলা নিয়ে হেঁটে বেড়ান। তাঁর সেই চির চেনা কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুলগুলো আর নেই তবে কাঁধের ঝোলাটি ঠিকই আছে। আরও আছে সেই অকৃত্রিম হাসিহাসি মুখটি।
বাংলাদেশের যে কয়জন কবি এখনো তাঁদের মননশীল লেখা ও কথা দিয়ে সাহিত্যানুরাগীদের আপ্লুত করে রেখেছেন তাঁদের অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরী এখন বছরের অর্ধেকটা সময় থাকেন কানাডার টরেন্টো শহরে। কবির বড় ছেলে আসিফ ও মেয়ে শাঁওলি যদি সুইজারল্যান্ডে থাকতো কবিও বোধহয় সুইজারল্যান্ড থাকতেন। ওরা যদি মালয়েশিয়ায় থাকতো তাহলে কবি আসাদ চৌধুরীও মালয়েশিয়ায় থাকতেন এবং হয়ে যেতেন সেখানকার প্রবাসীদের আপনজন। কিন্তু আসিফ আর শাঁওলির কারণে টরেন্টোর বাঙালিরা এখন বলতে পারে আসাদ চৌধুরী তাদের নিজস্ব কবি।
তিনি মানুষটাই এমন যে ছোট-বড় উঁচু-নিচু জাত-ধর্ম বিচার না করে সব ধরনের মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারেন। এক কথায় তাঁর দুয়ার সকলের জন্য খোলা। রাস্তার এপার থেকে কেউ যদি ডাক দেন, আসাদ ভাই একটু দাঁড়ান! কবি আসাদ চৌধুরী ঠিক ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকেন। যতক্ষণ সেই ব্যক্তিটি রাস্তা পার হয়ে তাঁর কাছে এসে হাজির না হয় ততোক্ষণ পর্যন্ত। হয়তো লোকটি কাছে এসেই বলবে আসাদ ভাই আমি আপনার খুব ভক্ত। একটা সেলফি তুলি? কবিও জানতেন এমন কথাই তাঁকে বলা হবে। তিনিও হাসিখুশি মুখে সেলফি তোলার পোজ দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ঠিক এই কথাগুলোই উঠে এসেছিল কবি আসাদ চৌধুরীকে দেওয়া টরেন্টো শহরে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
দেশের কবিকে দেশে থাকাকালীন সময় যারা দূর থেকে দেখেছেন এখন তাদের অনেকেই কবিকে ডাকেন আসাদ ভাই অথবা আসাদ চাচা। সুযোগটি কবি নিজেই সকলকে দিয়েছেন। এখানেই তিনি গরিমাহীন কবি। তিনি সাদা মনের মানুষ। ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প’ এমন ক্ষুরধার পঙক্তির রচয়িতা প্রতিদিন ছোট ছোট সমাবেশে ঘরোয়া কিংবা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন সঠিক মানবিক গুণে বড় হবার জন্য। এসব কথাও উঠে এসেছিল টরেন্টোর বাঙালিদের অতি প্রিয় নাইন ডজ রোডে অবস্থিত অডিটোরিয়ামে নাগরিক সংবর্ধনায়। গত ১৭ নভেম্বর কবিকে দেখার জন্য সর্বস্তরের নাগরিকদের আগমন ঘটেছিল সেখানে। প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট সদস্যসহ একাধিক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আবৃত্তি শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, রেডিও টেলিভিশন উপস্থাপক সংগঠক পত্রিকার সম্পাদক এবং বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকসহ সব বয়সের কবি ভক্তদের দেখা গেছে অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়।
সংবর্ধনা কমিটির কেন্দ্রে ছিলেন কবি ইকবাল হাসান। তিনিই অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেছিলেন। তাঁকে কাছ থেকে জোরালোভাবে শক্তি যুগিয়েছিল কবি আসাদ চৌধুরীর এক ঝাঁক ভক্তকুল অনুরাগী। যাদের মধ্যে কবি দেলোয়ার এলাহির নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। বিশাল কমিটির অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন তারা আর দশজন সদস্যের মত কাজ করতে পারেননি তবুও যাদের সংশ্লিষ্টতা নজর কেড়েছে তাঁদের মধ্য নাট্যজন আহমেদ হোসেন, আবৃত্তি শিল্পী হিমাদ্রী রয়, জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপক সুমন রহমান প্রমুখ।
কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘সকলেই কবি না, কেউ কেউ কবি’। জীবনানন্দ দাশের এই কথার সুরে হয়তো বলা যায়, একাধিক সুপঠিত কবিতা সৃষ্টি করেও অনেকে সত্যিকারের কবি মর্যাদা পায়নি। কেননা, কবি নিজে স্বপ্ন না দেখলেও তাঁকে স্বপ্ন দেখাতে সফল হতে হবে। যারা সেই স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হন এবং শুধু শব্দের মারপ্যাঁচে, ভাষার দক্ষতা দিয়ে কবিতা লিখে কবি খ্যাতি আশা করেন তাদের সে আশা কখনো মিটবার নয়। অথচ গেল রবিবার হল ভর্তি লোকের উপস্থিতি এবং তাঁদের আগ্রহ প্রমাণ করেছে তারা একজন সত্যিকার কবিকেই সংবর্ধনা দিতে উপস্থিত হয়েছিল। বিশেষ একটা বিশ্বাস থেকেই তারা কবিকে সংবর্ধনা দিতে উপস্থিত হয়েছিল আর সেই বিশ্বাসটি ছিল একজন মানুষ এত বড় কবি খ্যাতি পেতে পারেন না যদি তিনি সত্যিকার অর্থে একজন ভালো মানুষ না হতেন। কথাটা টরেন্টোবাসী খুব কাছে থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মত সময় ধরে বসে থেকেছেন কবির কথা এবং কবিকে নিয়ে কথা শোনার জন্য।
যিনি লিখেছেন ‘তবক দেওয়া পান’। তিনি নিজেই এখন আর পান খান না। কিন্তু সেই অনেক দিন আগে লেখা কবির তবক দেওয়া পান পড়ার পর থেকে আজ অব্ধি যারা পান দেখলেই তবকের গন্ধ পান তারাই কবিকে সেদিন সংবর্ধনা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করে। বাংলাদেশের সুখ দুঃখ নিয়ে তারা চিন্তা করে। বিশেষ করে বাংলাদেশে কোন দুর্যোগ এলে, কিংবা বাংলাদেশ জেগে উঠলে অথবা বাংলাদেশ যদি কেঁদে ওঠে তবে তারাও দাঁড়িয়ে যায় ড্যানফোর্থ রোডে মানববন্ধন করতে। এই সমস্ত প্রবাসীদের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য যে কবি অনেক আগেই লিখেছিলেন তাঁর কবিতার পঙক্তি ‘তোমাদের যা বলার ছিল – বলছে কি তা বাংলাদেশ’? সেই ‘তোমাদের’ প্রতিনিধিরা এসেছিল কবি আসাদ চৌধুরীর নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাক্ষী হতে।
বাংলাদেশের কথা এলেই চলে আসে গৌরবান্বিত মুক্তিযুদ্ধের কথা। আসে যুদ্ধকালীন মর্মান্তিক ঘটনা প্রবাহ। মুক্তিযুদ্ধের একটি বিতর্ক পর্ব অনেকদিন থেকেই চলে আসছে আর তা হলো যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহিদদের সংখ্যা। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই এই ত্রিশ লক্ষ সংখ্যার পক্ষে। কিন্তু ত্রিশকে খাটো করে দেখার লোকেরও অভাব নেই। তারা যা বলে সেটা ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যাকারীদের পক্ষেই যায়। এদের কথার জবাব দিতে হরহামেশা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকগুলোকে তথ্য উপাত্ত হাজির করতে হয়। এমন একটি তথ্য পাওয়া যায় কবি আসাদ চৌধুরীর যুদ্ধকালীন সময়ে লেখা একটি কবিতায় যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘পনেরো লক্ষ’ সংখ্যাটি। ‘বারবারা বিডলারকে’ নামক কবিতায় কবি লিখেছেন;
‘তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়
বিবেকের বোতাম খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ লোককে সে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে’।
ত্রিশ লক্ষের পক্ষে যারা একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে লেখা কবির কবিতা থেকে তুলে এনে পনেরো লক্ষকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করেন তারাও এসেছিল এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
বাংলা একাডেমি পুরষ্কারসহ একাধিক পুরস্কার প্রাপ্ত কবি আসাদ চৌধুরীকে কিছুদিন আগেই কানাডার অন্যতম শহর মন্ট্রিয়লে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। টরেন্টোর বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকেও ২০০৮ সালে কবিকে গুণীজন সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। কবি আসাদ চৌধুরী অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। অনেক বিশাল সমাবেশে তিনি কথা বলেন। কিন্তু গত রবিবার নাগরিক সংবর্ধনার আকারের দিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে তিনি হয়তো ইঙ্গিতটা অনুধাবন করেছেন বেশি। কেননা এই শহরের লোকগুলো এখন তাঁর অনেক আপন। নিজের অজান্তেই টরেন্টো এখন তাঁর নিজের শহর হয়ে গেছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে, আজ থেকে অনেক অনেক দিন পর লোক বলবে, অনেক অনেক দিন আগে এই শহরে কবি আসাদ চৌধুরী থাকতেন। সেই সত্যের বুনিয়াদ গাঁথা হলো ১৭ নভেম্বর ২০১৯।
কবি আসাদ চৌধুরী নাগরিক সংবর্ধনা কমিটির সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।