ফরিদ আহমেদ : ব্রুস লী বলেছিলেন, ‘বি লাইক ওয়াটার মেকিং ইটস ওয়ে থ্রু ক্রাকস’। ব্রুস লী-র এই বক্তব্য কি জানতেন অশোক চোপরা? এর সঠিক উত্তর জানা নেই আমাদের। তিনি হয়তো জানতেন, হয়তো না জানতেন না। তবে, তিনি তাঁর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপরাকেও ছোটবেলা থেকে এই একই কথাই বলতেন, ‘বি লাইক ওয়াটার। যেখানেই থাকো, যেভাবেই থাকো, সবসময় সেরাটাকে খুঁজে বের করো এবং সেটা নিয়েই কাজ করো।’
বাবার এই উপদেশকে সবসময় মনে রেখেছে প্রিয়াঙ্কা চোপরা। ফলে, মফস্বলের একটা অচেনা অজানা-অচেনা মেয়ে থেকে আজ বিশ্বজুড়ে সেলিব্রিটি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।
হিন্দি ছবি দেখা হয় না বলতে গেলে আমার। দেশে থাকতে কিছু দেখেছি। আমার স্ত্রীর কল্যাণে। সে হিন্দি ছবির ভক্ত ছিলো। দেশ ছেড়ে বিদেশে আসার পরে গত বিশ বছরে হাতে গোনা দুই একটা ছাড়া হিন্দি ছবি দেখি নাই আমি। আমার অনীহার কারণে হিন্দি ছবি দেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমার স্ত্রীরও। সে কারণে হিন্দি ছবির নতুন যুগের নায়িকাদের সেভাবে চিনি না আমরা। কাজল, রানী, কারিনা, কারিশমা, সুস্মিতা সেনেই থেমে গিয়েছে আমাদের জানার গন্ডি। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে প্রিয়াঙ্কা চোপরা। তাঁর অভিনীত কোনো হিন্দি সিনেমাই দেখা হয়নি আমার, কিন্তু, তারপরেও তাঁকে চিনি আমি, তাঁর সম্পর্কে সামান্য কিছু হলেও জানি। এর পিছনে তিনটে কারণ রয়েছে। এক: তিনি এক সময় মিস ওয়ার্ল্ড হয়েছিলেন। উপমহাদেশের সব মানুষদের মতো আমিও তাঁর সেই অর্জনে দারুণভাবে আনন্দিত হয়েছিলাম দুই: তিনি হলিউডেও কাজ করেন। ফলে, এখানকার কিছু কিছু প্রোগ্রামে তাঁকে দেখা হয়েছে আমার টেলিভিশনে। তিন: ইউটিউবে তাঁর দুই একটা সাক্ষাৎকার দেখেছি আমি। সেগুলো দেখে তাঁকে যথেষ্ট সাহসী, স্পষ্টভাষী এবং সংবেদনশীল বলে মনে হয়েছে আমার। শুধু সৌন্দর্য নয়, একই সাথে ক্ষুরধার মেধারও স্ফুরণ দেখতে পেয়েছি সেখানে। বিউটি উইথ ব্রেন বলতে যা বোঝায়, তাঁকে আমার তাই মনে হয়েছে।
মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে জন্মেছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপরা। বাবা-মা দুজনেই ডাক্তার। দুজনেই কাজ করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। তাঁদের বিস্তৃতি পরিবারের কোনো সদস্যই শো-বীজে কাজ করে নাই। এই ধরনের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা একটাই সরল রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগোয়। সেটা হচ্ছে পড়াশোনা করা। পড়াশোনার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়াটাই মুখ্য লক্ষ্য থাকে। প্রিয়াঙ্কার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। তাঁর বাবা-মা দুজনে প্রিয়াঙ্কাকে ভালো শিক্ষা দেবার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা করে গিয়েছেন। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বোর্ডিং স্কুলে। তেরো বছর বয়সে বাবা-মাকে ছেড়ে আমেরিকাতে পড়তে গিয়েছেন তিনি।
আমেরিকাতে পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়ে ফেলতেন তিনি হয়তো। তবে, বিধি বাম। সেটা হয়নি। তাঁর আমেরিকা অবস্থানের তৃতীয় বছরে স্কুলে বুলিয়িং এর শিকার হন তিনি। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাঁর গ্রেড খারাপ হতে থাকে, মানসিক চাপে ভেঙে পড়েন। ফলে, তাঁর বাবা-মা তাকে ভারতে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন।
ভারতে এসেও সমস্যা কাটে না তাঁর। ভিন্ন গোলার্ধের স্কুলে পড়ার কারণে ভারতে এসেও পড়াশোনাতে স্ট্রাগল করা শুরু হয় তাঁর। বোর্ড পরীক্ষায় পাশ করবেন কিনা সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময় কাটছিলো তাঁর এবং তাঁদের পরিবারের। ঠিক এই সময়টাতেই সবকিছু পালটে যায়।
অনেকটা খেয়ালের বশেই মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেই প্রতিযোগিতায় মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড শিরোপা জিতে নেন তিনি। এর ফলশ্রæতিতে যোগ দেন মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায়। মাত্র সতেরো বছর বয়সে মিস ওয়ার্ল্ড হয়ে শুধু অন্যদেরই চমকে দেন না তিনি, নিজের জন্যেও সেটা চমক হয়ে আসে তাঁর জন্য। নিজেকে নতুন করে চেনা হয় তাঁর। অচেনা এক প্রিয়াঙ্কা বের হয়ে আসে তাঁর ভিতর থেকে।
মিস ওয়ার্ল্ড হবার পর থেকে জীবন পালটে যায় তাঁর। হিন্দি ছবিতে একের পর এক অফার পেতে থাকেন। প্রায় পঞ্চাশটার মতো ছবি করে যখন ক্যারিয়ারের শীর্ষে তিনি, সেই সময়ে আমেরিকাতে গানের ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা একটা আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্ত ছিলো। এমন না যে তিনি গায়িকা হিসাবে নামী-দামী কেউ ছিলেন। গান গাইতে পারেন তিনি, সেই বিষয়টাই কেউ জানতো না। পরিচিত পরিবেশের নিশ্চিত পেশা ছেড়ে অপরিচিত পরিবেশের অনিশ্চিত পেশায় ঝাঁপিয়ে পড়া বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু, প্রিয়াঙ্কা পেরেছিলেন। কারণ, চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি ভালবাসেন। আমেরিকাতে গানের ক্যারিয়ার গড়ার ফাঁকেই আরেক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আমেরিকার মূলধারার টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প গ্রহণ করেন। প্রিয়াঙ্কার আগে যে কোনো ভারতীয় হলিউডে কাজ করে নাই, তা নয়। তবে, তারা সবাই অভিনয় করেছেন এথনিক চরিত্রে। প্রিয়াঙ্কা সেই জায়গা থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন। এর পিছনে কারণ হিসাবে তিনি তাঁর চ্যালেঞ্জ নেবার প্রবণতাকে দায়ী করেছেন। নতুন প্লাটফর্মে একেবারে শূন্য থেকে কোনো কিছু তৈরি করাটাও তাঁর কাছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়। এই ধরনের চ্যালেঞ্জের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন তিনি।
এর জন্য নিজেকে ভাঙতে হয়েছে তাঁর। ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে নিজেকে। ভারতে তিনি বিখ্যাত ছিলেন, এক নামেই সবাই চিনতো তাঁকে। কাজের জন্য কারো কাছে ধর্না দিতে হয়নি তাঁকে। আমেরিকাতে ঘটনা ছিলো উলটো। কাজ পাবার জন্য নানা অফিসে অডিশন দিতে হয়েছে তাঁকে। এর জন্য তাঁর ইগো আহত হবার কথা। কিন্তু, সেটা তিনি হতে দেননি। তাঁর ভাষাতেই। “I swallowed my pride and reminded myself constantly that just because IÕd received recognition in one part of the world was no reason that I should automatically receive it elsewhere”। উচ্চারণের উপরেও কাজ করেছেন তিনি। ভারতীয় এক্সেন্টকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমেরিকান এক্সেন্ট তৈরি করেছেন। এটা বলাটা যতো সহজ, কাজটা ততো সহজ নয়। ছোটবেলা থেকে কোনো একটা ভাষার মধ্যে বড় না হলে, ভাষাটাতে দক্ষতা অর্জন করতে পারলেও উচ্চারণের জায়গাটুকু নিখুঁত করা সম্ভব হয় না।
গত মাসে পেঙ্গুইন প্রকাশনী থেকে তাঁর আত্মজীবনী ‘আনফিনিশড’ প্রকাশিত হয়েছে। এই বইতে প্রিয়াঙ্কা তাঁর জীবন ভ্রমণের একটা বর্ণাঢ্য চিত্র এঁকেছেন। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়স তাঁর। কিন্তু, এইটুকু বয়সের মধ্যেই নানা চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে তাঁকে, যেতে হয়েছে নানা নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে। কখনো সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে পায়ের কাছে, আবার কখনো বা সাফল্যের জন্য নিরন্তর নিষ্ঠা ঢেলে দিতে হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম এবং বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা করতে হয়েছে সামনে আসা বাধাসমূহকে অতিক্রম করার জন্য। এর মোটামুটি সবকিছুকেই তিনি তাঁর বইতে তুলে এনেছেন আন্তরিকতার সাথে।
তবে, এটাও ঠিক। অনেক কিছুই তিনি প্রকাশ করেননি তাঁর বইতে। হিন্দি ছবির জগতে যখন তিনি পদার্পণ করেন, সেই সময়ে শুধুমাত্র মিস ওয়ার্ল্ড খেতাব জেতা ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তাঁর ছিলো না। সেই পর্যায় থেকে তিনি নিজেকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রীতে রূপান্তরিত করেছেন। এই কাজটা এমনি এমনি হয়নি। কিন্তু, এর পিছনের তিনি কোনো ধরনের শ্রম এবং নিষ্ঠা ঢেলেছেন, সেগুলো উঠে আসেনি তাঁর বইতে পরিষ্কারভাবে। এর বাইরে তাঁর লাভ-লাইফকে এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। নিক জোনাসের সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে, বর্ণিল বিয়ের বিস্তারিত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। এড়িয়ে গিয়েছেন অন্য প্রেমিকদের কথা। এর পিছনের তিনি অবশ্য যুক্তিও দেখিয়েছেন একটা। তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকেরা সবাই এখন বিবাহিত। বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে। তাদের সেই সুখের জীবনকে তিনি বিব্রত করতে চাননি সেই সময়কার প্রেমকাহিনি প্রকাশ করে দিয়ে। তাঁর এই সিদ্ধান্তটা খারাপ কিছু নয়, যথেষ্ট সংবেদনশীল বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে।
প্রিয়াঙ্কা চোপরার ‘আনফিনিশড’ উত্থান এবং পতনের এক আবেগী গল্প। সুললিত এক শক্তিশালী ভাষায় তিনি নিজের জীবনকাহিনি বর্ণনা করেছেন। লেখার মধ্যে যেমন সতেজতা আছে, একইভাবে রয়েছে হাস্যরসেরও প্রাচুর্য। পড়লে মনে হবে বই পড়ছেন না আপনি, প্রিয়াঙ্কা যেনো সামনে বসেই তাঁর গল্প শোনাচ্ছে। বিশেষ করে তাঁর ছোটবেলার গল্পগুলোকে খুব সহজেই নিজের জীবনের সঙ্গে বেশিরভাগ পাঠকই মিলিয়ে নিতে পারবেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ওইসব সুখ-দুঃখের গল্পের সাথে আমরা খুবই পরিচিত। সেই পরিচয়টা সহজেই সম্পৃক্ত হয়ে যাবে প্রিয়াঙ্কার গল্পের সাথে। বিশাল বড় সেলিব্রিটির জায়গায় তাঁকে পাশে বাড়ির একজন অতি পরিচিত মানুষ বলেই মনে হবে সবার। তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য নয়, বরং সৌন্দর্যময় সতেজ মস্তিষ্ক, সচেতন মানসিকতা, সংবেদনশীলতা এবং সাহসী বক্তব্যের প্রেমে পড়ে যাবেন আপনি। এতে নিশ্চিত আমি।