হাসান গোর্কি : ইগনোরিং দ্য অপনেন্ট
সানাউল হক খান ছিলেন আশির দশকের বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক। বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ব্যাডমিন্টন দলের সাথে তিনি একবার বেইজিং গিয়েছিলেন। একটা আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে দুইজন খেলোয়াড়ের সাথে ছিলেন একজন ম্যানেজার, একজন কোচ এবং একজন সাংবাদিক।
চায়না থেকে ফিরে ক্রীড়া জগত পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, “টুর্নামেন্ট শুরু হবার দুইদিন আগে আমরা পিকিং পৌঁছুলাম। লাঞ্চ করার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আমরা সবাই শহর দেখতে বের হলাম।
কিছু দূর হাঁটার পর দেখলাম একটা বাড়ির সামনের লনে দুজন বালিকা ব্যাডমিন্টন খেলছে। আমরা দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে শুরু করলাম। মুগ্ধ হবার মত ক্রীড়াশৈলী। কোচ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের দুজন তাদের সাথে একটা ম্যাচ খেলতে পারে কিনা। মেয়ে দুজন ইংরেজি জানে না। পরে ইঙ্গিতে বুঝানো গেল। ম্যাচ শুরু হলো। আমাদের খেলোয়াড়রা নীল গেম খাবার পর দ্বিতীয় ম্যাচের প্রস্তাব দিল। আরও একটা ম্যাচে একই ফলাফল।
এবার আমাদের ঘর্মাক্ত খেলোয়াড়রা তৃতীয় ম্যাচের প্রস্তাব দিল। তুমুল প্রতিদ্ব›িদ্বতার পর পয়েন্ট যখন ঐ দুই মেয়ের পক্ষে ১২-০ তখন বালিকাদের একজন বলল, ‘ত-ই-ফেন’ এবং শুন্যে ফেদার তুলে দিল।
আমাদের একজন খেলোয়াড় সজোরে স্ম্যাশ করে সার্ভ পেয়ে গেল। বালিকাদের অন্যজন বলল, ‘ত-ই-ফেন’ এবং আবার শুন্যে ফেদার তুলে দিল। আমাদের একজন খেলোয়াড় সজোরে স্ম্যাশ করে এক পয়েন্ট জিতে নিল। ১-১৩ পয়েন্টে আমাদের দল তৃতীয় ম্যাচ হেরে গেল। বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে আমি দর্শকদের মধ্যে থেকে ইংরেজি জানা লোকের খোঁজ করলাম। একজনকে পাওয়া গেল। আমি ঐ দুই মেয়ের পরিচয় জানতে চাইলাম। সে আধা ইংরেজিতে বলল, দুই বালিকা পিকিং স্কুল ব্যাডমিন্ট নেডাবলস এ চ্যাম্পিয়ন। ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের হোস্টেলে থাকে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। হোটেলে ফেরার পথে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, “ত-ই-ফেন”।
হোটেলে ঢুকেই আমি রিসিপসনিস্টকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ত-ই-ফেন’ মানে কী? সে বলল, এক পয়েন্ট দেবো।”
আমি স্কুল-কলেজ জীবনে ভাল ব্যাডমিন্টন খেলতাম। আমার চৌহিদ্দিতে ভীতি সঞ্চার করার মত খেলোয়াড়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর একদিন সন্ধ্যায় জিমনেশিয়ামে গেলাম ব্যাডমিন্টন খেলতে। দেখলাম, একজন মাত্র খেলোয়াড় নিজে নিজে উপরে ফেদার ছুঁড়ে একাই খেলছে। আমি কোর্টের এক পাশে দাঁড়ালাম।
আমার শরীরী ভাষা বুঝে সে আমার দিকে কিছুটা আলস্য এবং অবজ্ঞা ভরে ফেদার ছুঁড়ল। আমি কায়দা করে থার্ড কোর্টে স্ম্যাশ করলাম। উদ্দেশ্য শুরুতেই তার মনে গভীর ভীতির সঞ্চার করা এবং সমীহ আদায় করে নেওয়া। কাজ হলো না।
সে র্যাকেটটি বাঁ হাতে নিয়ে ফেদারে একটা আলতো টোকা দিল এবং সেটা নেটের ইঞ্চিখানেক ওপর দিয়ে আমার কোর্টে পড়ে গেল। পরের বার আমি নতুন কায়দা অবলম্বন করলাম।
নেটের ওপর দিয়ে সুক্ষভাবে ফেদার পাড় করে দিলাম। এত সুক্ষ শৈলীর কাছে পরাজিত না হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু এবারও আমি পরাজিত হলাম।
সে আরও সুক্ষভাবে ফেদারটা আমার কোর্টে পার করে দিল। আমি সেটা ধরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। যে কোন পতনের একটা অপমানজনক দিক আছে। আমিও বিব্রত হলাম এবং ভাবলাম তাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার। এই অনাকাক্সিক্ষত অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া জরুরি। আমি একটা পুরো ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দিলাম এবং পরপর দুটি নীল গেম খেলাম। তৃতীয় ম্যাচের শেষ অধ্যায়ে সে আমাকে ইচ্ছা করে দুটি পয়েন্ট নিতে দিল। সে-ও মনে মনে “ত-ই-ফেন” বলেছিল কিনা আমি জানি না।
ক্লান্তি এবং অবসাদে মাথা ঝিমঝিম করছে। তবু ভদ্রতার খাতিরে তাকে বললাম, “আপনি অনেক ভাল খেলেন। আপনার উচিত জাতীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া।”
সে বলল, “আমি তো গত চার বছরের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন।” আমার মনে পড়ল আমাদের জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেটা আমি আগে থেকেই পত্রিকা পড়ে জানতাম। আমি তার নাম ভুলে গেছি।
এটুকু মনে আছে যে সে কাম্রুন নাহার ডানার সাথে থাইল্যান্ড থেকে একটা মিক্সড ডাবলস জিতে এসেছিল। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল এবং এস এম হলে থাকত।
তৃতীয় ঘটনা তেপান্তরের ওপারের। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাজিলে। কোয়ালিফাই করার পরও বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নেয়নি ভারত, তুরস্ক এবং স্কটল্যান্ড। ফলে ১৩ দেশের মধ্যে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এই টুর্নামেন্টে আসার দুই সপ্তাহ আগে ইংল্যান্ড ইতালীর বিরদ্ধে ৪-০ গোলে জিতেছে। লিসবনে গিয়ে পর্তুগালের মত বিশ্ব শক্তির বিরুদ্ধে ১০-০ গোলের তরতাজা বিজয়ের স্মৃতি নিয়ে ব্রাজিলে পৌঁছেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র গেছে গত সাত ম্যাচ ২-৪৫ (মোট) গোলের বিশাল ব্যবধানে হারার স্মৃতি নিয়ে।
এর মধ্যে নরওয়ের বিরুদ্ধে ০-১১ গোলের একটা হারছিল। তাদের ধারণা ছিল এই টুর্নামেন্টে তাদের হয় তো ভাঁড়ের ভুমিকায় থাকতে হবে। তাই তাদের খেলোয়াড়দের কয়েকজন বিমান থেকে নামার সময় ক্লাউনদের মত পোশাক পড়েছিলেন। স্ট্রাইকার জোগেইটজেনস (নামটি মনে রাখুন) একটা রনপা-তে উঠে এরাইভাল কাউন্টারে হেঁটে এসেছিলেন। পুরো দলটিকে আচার-আচরণে একটা পিকনিক পার্টির মত দেখাচ্ছিল। তাদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় মজাদার খবর ছাপা হতে থাকল। ইংল্যান্ড-ইউএস ম্যাচের আগে বাজির পাল্লা ছিল ৫০০-১। ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সন্মেলনে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জোসেফ ম্যাকল্ভ্যানিকে এক ইউএস সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি কত গোলের জয় আশা করো?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমরা নরওয়ের মত নিষ্ঠুর হতে চাই না।
আশা করছি আমার খেলোয়াড়রা ১০ এ থেমে যাবে। গেইটজেনস বিদেশি। তার নামে আমরা কোন বরাদ্দ রাখিনি।” (গেইটজেনস ছিলেন হাইতিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান)। কিন্তু সব অনুমান, দম্ভ, ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমান করে ম্যাচে প্রবল আধিপত্য ধরে রেখে, পুরো ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে রেখেও ০-১ গোলে ম্যাচ হেরে যায় ইংল্যান্ড। খবরটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে পৌঁছুলে পত্রিকাগুলোর সম্পাদকরা এটাকে টাইপিং মিসটেক ভেবেছিলেন।
তাদের ধারণা হয়েছিল ইংল্যান্ড ১০ গোলে জিতেছে। সম্পাদকরা খবরটা ছাপার আগে ফিফার কাছে বার্তা পাঠিয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন।
আমার বাড়ি বগুড়ার গাবতলী থানা সদরে। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। একবার আন্ত ইউনিয়ন ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন হলো।
টুর্নামেন্টের শুরুতেই গাবতলী ইউনিয়নের পক্ষে খেলে আমরা হেরে বিদায় নিলাম। নারুয়ামালা ইয়নিয়নের চেয়ারম্যান ধনাঢ্য ব্যক্তি। তার দল দোর্দণ্ডপ্রতাপে খেলে ফাইনালে গেল। প্রতিপক্ষ নেপালতলী ইউনিয়ন। ফাইনাল খেলার আগে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে নারুয়ামালা ইয়নিয়ন ঢাকার প্রথম বিভাগের দল থেকে ৭ জন খেলোয়ার হায়ার করেছে।
তাদের মধ্যে প্রথম বিভাগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা শিমুল এবং জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক মোতালেবও আছেন। খেলার দিন মাঠে উপচেপড়া দর্শক। নারুয়ামালা ইউনিয়ন ফুটবল টিম নির্দিষ্ট সময় জার্সি পরে মাঠে নামল। প্রতিপক্ষের খোঁজ নাই। কারণ তারা বড় পরাজয়ের ঝুঁকি নিতে চায় না।
ফাইনালে ওয়াকওভার দেওয়া বেমানান। গাবতলীর অর্বাচীন দলকে বলা হলো নেপালতলীর পক্ষে মাঠে নামতে।
আমরা নেমে গেলাম। আমাদের অর্ধেক খেলোয়াড়ের পায়ে সকার বুট ছিল না। ৪ জনের হাফপ্যান্ট ছিল না। তারা লুঙ্গি মালকোঁচা দিয়ে নেমে গেল।
খেলার শুরুতে প্রতিপক্ষ তাদের পায়ে বল রেখে আমাদের সাথে ইঁদুর বেড়াল খেলতে শুরু করল। কিন্তু তাদের গোল করার কোন আগ্রহ নেই। বলের নাগাল না পেয়ে আমরা হাঁপিয়ে উঠলাম।
তারা বার দুই ফাঁকা পোস্টের সামনে থেকে বল ফিরিয়ে নিয়ে গেল এবং আমাদের নিয়ে খেলতে থাকল। প্রথমার্ধ শেষ হবার মিনিট খানেক আগে আমরা হঠাৎ একটা গোল করে ফেললাম। আমরা ‘’করে ফেললাম’’ না বলে ‘’তারা আমাদের দিয়ে করিয়ে নিল’’ বলা ভাল।
ব্যাক পাস খেলতে খেলতে তারা বলটাকে তাদের গোলপোস্টের সামনে নিয়ে গেলে আমাদের লুঙ্গি পরা এক বেরসিক স্ট্রাইকার হঠাৎ বলটা জালে জড়িয়ে দিল।
দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর দুই মিনিটে আরও এক গোল। সে গোলটার পঞ্চাশ ভাগ কৃতিত্ব দর্শকদের। কীভাবে সেটা বলছি। আমাদের এক ডিফেন্ডার কোন পরিকল্পনা ছাড়া লম্বা কিক করে বল ফেলেছে তাদের ডিবক্সের মাথায়। বাঁকি কাজটুকু দর্শক করেছে।
তারা এমন গগন বিদারী চীৎকার দিয়ে উঠেছে যে অন্য প্রান্তের দর্শক মাঠে ঢুকে গেছে। আমাদের প্রতিপক্ষের খেলোয়াররা হতচকিত হয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে। এরপর কার পায়ে লেগে বলটা জালে চলে গেছে সেটা আমরা আর বুঝতে পারিনি।
তবে অনেকের দাবি কাজটি করেছে আমাদের গোলরক্ষক- যে দর্শকদের উৎসাহে পুরো মাঠ পাড়ি দিয়ে এই অভিযানে শরিক হয়েছিল। ঘুমন্ত বাঘকে খোঁচা দিয়ে জাগানো হলো। কিন্তু সে ততক্ষণে খাঁচায় বন্দী হয়ে গেছে। আমরা নন-মেথডিক এবং এলোমেলো খেলে তাদের খেলায় ছন্দপতন ঘটাতে পারলাম, ২-০ গোলে জয়ী হলাম এবং প্রায় শূন্য সম্ভাবনা থেকে ট্রফি জিতে নিলাম। আর প্রতিপক্ষের প্রতি অবজ্ঞার খেসারত দিতে হলো তাদের যারা এই ট্রফিটার প্রায় শতভাগ দাবিদার ছিল।
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।