হাসান গোর্কি : পাঠকের উদ্দেশ্যে: ‘প্রান্তরে তেপান্তরে’র সবগুলো পর্ব যারা পড়েছেন তারা জানেন, লেখাগুলোর শিরোনাম ভিন্ন হলেও বিষয়বস্তু অভিন্ন ছিলো— ঈশ্বর, মহাবিশ্ব, জীবজগৎ, বিলুপ্তি-বিলয়, পুনরুত্থান-পুনর্জাগরণ, সময়, আধিদৈবিকতা, পদার্থ ও ভৌত জগতের পারম্পর্য ও পরস্পর নির্ভরশীলতা। মহাজগৎ নিত্য, চিরায়ত ও অবিনশ্বর কালের খেয়ায় ভেসে চলা কিছু নাকি বুদ্ধিমান কোনো সত্তার ইচ্ছাময়তার ফসল- সেটা আমরা জানি না। এটা যে এক নিঃসীম রহস্যময়তা প্রবন্ধগুলোতে সে কথা-ই বলতে চেয়েছি। ‘প্রান্তরে তেপান্তরে’র এটা শেষ পর্ব। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমার প্রেরণার উৎস ছিলো ‘বাংলা কাগজ-র পাঠক। তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা। শুরু থেকে জাকির তালুকদার, ফাইজুল ইসলাম ও জাকিরুল হক টিটনের মতো গুণীজনদের কাছে উৎসাহ পেয়েছি। লেখার বিষয়বস্তু ও বক্তব্য নিয়ে কোপেনহেগেন থেকে নিরন্তর তর্ক করে এবং বিপরীত-সম্পুরক-সহায়ক ধারণা দিয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে আমার ছাত্রী মৌ দাশ। লেখায় কো-অথর হিসেবে তার নাম রাখলে সুবিচার করা হতো। আরেক ছাত্র, মাসুদ রানার ভিন্নমত আমার ধারণাকে পুনর্বিন্যস্ত করতে সহায়তা করেছে। ত্রিশ পর্বের পর সবার শ্রদ্ধেয় ইচক দুয়েন্দের স্বীকৃতি ও প্রেরণা পেয়ে বাঁকি পর্বগুলোতে আমি বেশি মনযোগী ছিলাম, যা লেখার মান বাড়িয়েছে। যাদের সমালোচনা ও অনুপ্রেরণা প্রবন্ধগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে ছিলো/ছিলেন বন্ধু অপু, ড. আহাদ, জুঁই, শায়লা, দুই ভাগ্নে -মিশু, রিপন, ভাতিজা গালিব। মনিস রফিক একজন বিরল সম্পাদক। তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাকে ধন্যবাদ লিখতে উৎসাহিত করা এবং লেখার বিষয়বস্তু, শব্দসীমা এবং জমা দেওয়ার শেষ সময় বিষয়ে আমাকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য। ছোট একটা বিরতির পর অন্য কোনো শিরোনামে নতুন কলাম লিখতে শুরু করতে চাই। শেষ পর্বটায় আর কোনো ভারি কথা নয়; এটা একটা ছোটগল্পÑ যেখানে গল্পের এক চরিত্র প্রান্তহীন প্রাণ প্রবাহের কথা বলেছে। বলেছে, আমরা বেঁচে থাকবো অনন্ত আগামীব্যাপী অন্তহীন সময়ের সমুদ্রে
হাসান গোর্কি
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।
প্রতিবিম্ব
ছোটবেলায় বাস থেকে নেমে মামাবাড়ি যেতে এক মাইল পথ হাঁটতে হতো। পথটা শিলার কাছে অনেক দীর্ঘ মনে হতো তখন। ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষার পর খালাতো, মামাতো ভাইবোনদের সবাই আসতো। নানা বেঁচে থাকার সময় তৈরি করা লম্বা দোচালা ঘরটায় খড় বিছিয়ে তার ওপর তোষক, লেপ, কাঁথা দেওয়া হতো ছোটদের ঘুমানোর জন্য। এই শিশু স¤প্রদায়ের প্রশাসকের দায়িত্বে থাকতো রেখাদি- মেজো মামার বড় মেয়ে। গল্প বলার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিলো তার। বুদ্ধিমতী মাশা কীভাবে পিঠা তৈরি করে ভালুকের মাথায় তুলে দিয়ে নিজেই সেই হাঁড়ির মধ্যে বসে নিজের বাড়ি পৌঁছে গেলো এবং শ্বাসরুদ্ধকর বন্দীদশা থেকে নিজেকে মুক্ত করলো সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে রেখাদি যখন মাশা এবং ভালুকের কণ্ঠ নকল করতো তখন কোমল হৃদয়ের ক্ষুদ্র শ্রোতৃমন্ডলী নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলতো। শিলার মনে হতো ঘটনাটা না ঘটে থাকলে তো এমন নিখুঁত ও সাবলীল বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। ভালুক কথা বলার সময় রেখাদি দুই হাতে নাক ও মুখ ঢাকতো এবং কণ্ঠস্বর এতোখানি গম্ভীর করতো যা একটা ভালুকের পক্ষেই মানায়,
— একটু খানি বসে যাই, একটা দুটো পিঠে খাই।
হাঁড়ির মধ্যে বসে মাশা বলছে,
* পাইন বনের চুড়ায় বসে দেখছি তোকে
থামলে তোকে মারবে লোকে
হেঁটে হেঁটে যা দক্ষিণে
নইলে সবাই ফেলবে চিনে।
এসময় রেখাদির কণ্ঠটা ঠিক মাশার মতো শোনাতো। এটা ভেবে শিলার ভয় হতো, যদি ভালুক হঠাৎ বুঝে ফেলে যে মাশা তার মাথায় বহন করা হাঁড়ির মধ্যে থেকেই কথা বলছে! তবে অতীত ইতিহাস থেকে সে জানতো যে মাশাদের বিপদ কেটে যায়। শিশুকালের ঐ সময়গুলোর কথা শিলার এখনও খুব মনে আছে- মামাবাড়ির ডিসেম্বর মাসের কুয়াশা ঢাকা সকালে পিঠা তৈরির চুলা ঘিরে জটলা, শীতলক্ষ্যার খাড়িতে জমে থাকা বরফ শীতল পানিতে গোসল, নলিকা দীঘির পাড়ের ময়নাকাঁটার জঙ্গলে চড়ুইভাতি।
রাজর্ষি দিবেন্দু সাহা প্রজাদের জন্য একটা পুকুর খুঁড়েছিলেন। কিন্তু ঐ পুকুরের পানি ছিলো পানের অযোগ্যরকম তিতা; কোনো লতা গুল্মও জন্মাতো না ঐ পুকুরে। একদিন এক সন্যাসী এসে রানিকে কানে কানে কিছু একটা বলে গিয়েছিলো। পরদিন রানিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর ঐ পুকুরের মিঠা পানিতে মাছেরা জন্ম নিলো, জলজ লতা-গুল্ম জন্ম নিলো। সেখানে পদ্মফুলের মেলা বসলো। সবাই বলতে শুরু করলো, রানি মহামায়া স্বেচ্ছায় পুকুরে ডুবে গিয়ে পদ্মফুলের রুপ নিয়ে জলের গভীর থেকে সংখ্যাতীত মাথা তুলেছে। প্রত্যেক শারদীয় পূর্ণিমার রাতে রানি দীঘি থেকে তার প্রাসাদে উঠে আসে। রক্ষীরা তাকে অনেকবার লুকিয়ে দেখেছে- প্রাসাদের বারান্দায় সাদা পোশাক পরা একটা অবয়ব হেঁটে যাচ্ছে। দীঘিটাকে সবাই বলে ‘নলিকা দীঘি’। শিলার মনে হতো ‘পদ্ম দীঘি’ হলেও ভালো ছিলো। নলিকা শব্দটার মধ্যে একটা সাপ সাপ ভাব আছে। সে মনে মনে নাম দিয়েছিলো ‘মহামায়া সরোবর’।
অনেকদিন মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি শিলার। ডেনমার্কে পড়তে আসার আগে ঢাকায় তার খুব ব্যস্ত সময় কেটেছে। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স শেষ করার পর ভারতীয় দূতাবাসে কিছুদিন চাকরিও করেছে সে। বয়স ও ব্যস্ততা বাড়ার কারণে মামাবাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন-স্বপ্ন দিনগুলোর টান এক সময় ফিকে হয়ে এসেছিলো তার কাছে। সাউদার্ন কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটির ডরমেটরি থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হবার সময় শিলার খুব মনে পড়ছিলো মামাবাড়ির কথা। ক্রিস্টমাসের ছুটির অনেকটা সময় মামাবাড়িতে কাটাতে পারলে ভালো হয়। যদিও ভয় ছিলো, সেই ছোটবেলার ডিসেম্বর মাস কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে! সব তো এক সময় শেষ হয়ে যায়। ছয় বছর আগে শেষবার মামাবাড়ি যাবার সময় শিলা দেখেছে রাস্তার দু’পাশে অনেক নতুন বাড়ি উঠেছে, কারখানা, ওয়ার্কশপ, জনাকীর্ণ রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান গড়ে উঠেছে। পায়ে চলা যে পথটা পাড়ি দিতে বড় জোর চার পাঁচ জন পথচারীর সাথে দেখা হতো সে পথটা উঁচু হয়েছে, পিচঢালা প্রশস্ত পথ। উপচে পড়া যানবাহনের ভিড়ে অচেনা দেখাচ্ছিল পথটাকে।
গত সামারে ডিপার্টমেন্টের স্টাডি ট্যুর ছিলো বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী হোয়াইট ক্লিফ অব দ্য মুন- এ। এ’রকম নির্জন জায়গা শিলা কখনও দেখেনি। ডিনার শেষে রিসোর্টের বাইরে সমুদ্রের দিকে মুখ করে সাজানো বেঞ্চে বসে সহপাঠীদের সাথে গল্প করছিলো শিলা। চারিদিকে অভূতপূর্ব নীরবতা। শান্ত সমুদ্রের পানিতে চাঁদের আলো পড়ে অস্পষ্ট আলোর প্লাবন তৈরি করেছে। ক্ষয়ে যাবার সময় চাঁদের দশাকে মনে হয় কৃষ্ণপক্ষ বলে। নামটা বেশি ভালো হয়নি। ইংরেজিতেও এটা ভালো শোনায় না- ওয়েনিং মুন। আজকের দশাকে বলে ওয়েনিং গিবাস। ফুল মুনের পর পাঁচ দিন অতিবাহিত হয়েছে। শুধু গিবাস বললে ভালো হতো। শব্দটার মধ্যে তিরোহিত হবার, বা সমাপ্তির লক্ষণ নেই। এটা একটা কল্পনা মাত্র সেটা শিলা জানে। ধ্বনির নিজের কোনো অর্থ থাকে না। ধ্বনিটা যা বুঝায় দিনশেষে সেটাই তার অর্থ।
শিলার খুব জানতে ইচ্ছে করলো মরে যাবার পর কী ঘটে? আমরা কোথায় যাই? পৃথিবীর সমুদ্র, পাহাড়, বনানী, মরুভুমি, প্রান্তর-তেপান্তর জুড়ে বা অনন্ত নক্ষত্ররাজি, গ্রহ-গ্রহাণু সজ্জিত এই মহাবিশ্বের কোনো এক কোনে কি আমাদের জায়গা হবে না! ডেভিড বø্যাককে এটা জিজ্ঞাসা করা যায়। শিলার মিডিয়া এনালাইসিস কোর্সের ইনসট্রাক্টর ডেভিড। সবকিছুর একটা সমাধান আছে তার কাছে। সমাধানগুলো ভুল না শুদ্ধ সেটা জানা সহজ নয়; কিন্তু আপাত সন্তুষ্টির জন্য যথেষ্ট। শিলা তার পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো,
* আচ্ছা ডেভিড বলো তো, যে জীবন এতো ক্ষণস্থায়ী, যা আমাদের প্রতি মুহূর্তে বিলুপ্তির দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমরা ঠিক আগের মুহূর্তের আনন্দ বেদনার কোনোটিকেই ছুঁতে পারছি না- সেটাকে বহন করার যথার্থতা কী?
এই অদ্ভুত ও আকস্মিক প্রশ্নে বিচলিত বা বিস্মিত না হয়ে সে বললো,
* সময়ের ক্ষুদ্রতম ইউনিটও বিভাজ্য। যেমন একটা সেকেন্ডকে এক কোটি ভাগে ভাগ করা সম্ভব। একশ’ কোটি ভাগে, হাজার বা লক্ষ কোটি ভাগেও তাকে বিশ্লিষ্ট করা সম্ভব। এমনকি এক সেকেন্ডকে অনন্ত সংখ্যক ভাগেও বিভক্ত করা যায়। তার অর্থ এই আপাত ক্ষুদ্র সময়টার বিস্তৃতিও মহাকালের মতো। আমরা আমাদের জীবনের সত্তর বা একশ’ বছরের সাথে তুলনা করছি বলে এটাকে সীমিত মনে হচ্ছে। তুমি তোমার ভালোলাগার মানুষটির হাত ধরার প্রথম মুহূর্তটিকে এক সেকেন্ড না ভেবে মহাকালের সমান ভাবতে পারো।
শেষ অংশটা ডেভিড স্বগতোক্তির মতো করে নিজের ভাষায় বললো,
* “ন্যু দে নুভেন্দে অয়েবেø সম দি আ-দ্যা”- উপস্থিত মুহূর্তটি উপভোগ করো, কারণ এটাই তুমি।
এ’রকম যান্ত্রিক ব্যাখ্যা শিলা শুনতে চায়নি। তার মনে হলো, মরে যাবার পর একটা অজ্ঞাত, প্রান্তহীন, বোধের অতীত গভীর অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। তখনও আজকের মতো আকাশে চাঁদ উঠবে, প্যাসিফিক আইল্যান্ডের কোনো এক নির্জন অরণ্যে জংলি গোলাপ ফুটবে, রকি মাউন্টেইনের গা বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ শীতল জলের ধারায় স্যামনের ঝাঁক খেলা করবে, কুয়াকাটায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখতে যাবে অনেক পরে পৃথিবীতে আসা মানুষরা। সে তাদের অংশ হতে পারবে না। সে বললো,
— তুমি আমাকে বলো, মরে যাবার পর কী ঘটে? আমরা কোথায় যাই?
– মরে যাবার পর আমাদের শরীর মাটিতে মিশে যাবে। আমাদের সমাহিত করা হবে বা দাহ করা হবে। আমাদের দেহভস্ম বা দেহাবশেষের উপরে যে গুল্ম জান্মাবে সেটার শেকড় আমাদের শরীরের অবশেষ তাদের শরীরে শুষে নেবে। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়বে প্রাণে উদ্ভিদে, জলে, মাটিতে, বাতাসে। এভাবে আমরা বেঁচে থাকবো অনন্তকাল- অথবা যতক্ষণ না আমাদের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া পরমাণুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
শিলার ভালো লাগতে শুরু করলো। তার মনে হলো গুল্মটি পত্র পল্লব বিস্তার করে ঐ অরণ্যে চোখ মেলে তাকাবে; সে বৃষ্টির জলের ধারায় স্নান করার সময়, আজকের মতো রাতের রুপালি চাঁদের আলোয় পুস্প বিকশিত করার সময়, অলস দুপুরে পাখিদের সাথে সখ্য গড়ার সময় সে এবং অন্য মৃত মানুষেরা, সেই গুল্মের শেকড়, কান্ড, পাতায় প্রবাহিত থাকবে। ঐ গুল্মের ফল খেয়ে যে পাখি প্রাণ বয়ে নিয়ে যাবে তার শরীরে ভর করে মৃতরা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে। এভাবে প্যাসিফিক থেকে আটলান্টিক, আরব সাগর তীরবর্তী কোনো বনে, জনপদে। সে নিজেকে প্রশ্ন করলো, তাহলে কি প্রাণ এবং প্রাণহীনতার মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নাই? পার্থক্যটা তৈরি হয় আমাদের দেখার ভুলের কারণে? তাহলে জীবন কি শুধুই একটা সংগঠন যা গড়ে ওঠে শরীরকে আশ্রয় করে আর সেখানে কিছু অনিবার্য ঘটনাপ্রবাহ থাকে এবং শরীর অন্য কিছুতে রুপান্তরিত হয় ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতা সহ? তাহলে কি কিছুই থেমে যায় না?” ডেভিডের কথাগুলো শিলার মনে আছে। এ’রকম করে বিশ্বাস করতেও ভালো লাগে তার। এরপর থেকে শিলার প্রায়ই জানতে ইচ্ছে করে নলিতা দীঘির পদ্মগুলো কি এখনও মহামায়ার অস্থি মজ্জার নির্যাস শুষে কালো জলের ওপর মাথা নাড়ায়?
শিলা ঢাকা গিয়ে বেশ আয়োজন করে মামাবাড়ি গেলো। টাঙ্গাইল থেকে মৌ, ঢাকা থেকে মিঠু, রত্না, জয়া আর বিপু এলো। মামাবাড়ির সামনে অনেকগুলো আম গাছ ছিলো। বড় আম গাছটা কেটে ফেলা হয়েছে। ছোটবেলায় এই গাছগুলোর নিচে ওরা কলাপাতার ঘর বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে রান্না বাড়ি খেলতো। ঢাকায় চলে যাবার দিন শিলা গাছগুলোর প্রত্যেকটির কাছে গিয়ে আলাদা করে বিদায় নিতো। বলতো,
* এই! আমি চলে যাচ্ছি দেখে তোমার মন খারাপ? বলো, কোনো মন খারাপ নেই। আমি তো আবার আসবো!
মাঝে মাঝে ছড়াও শোনাতো,
ক্স আমের গাছে আমরা থাকি
শরের গাছের শাড়ি,
আঁধার হলে আসবে সবাই
এই আমাদের বাড়ি।
এটা ভূতদের ছড়া। মর্মার্থ হলো ভূতরা দিনের বেলা শরের গাছে থাকে। রাতে আম গাছে এসে ঘুমায়। কারণ, এটাই তাদের আসল নিবাস। ছড়াটার দুর্বল গাঁথুনি থেকে অর্থটা উদ্ধার করা না গেলেও প্রজন্ম পরম্পরায় এভাবেই শিশুরা জেনে এসেছে।
দুপুরের খাবার রান্না হতে আরও কিছুক্ষণ বাঁকি। এ বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার অংশটা শিলার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে। প্রত্যেক বেলা একটা করে ছোট উৎসবের মতো। শিলা কাজিনদের সবাইকে সাথে নিয়ে নলিতা দীঘির পাড়ে গেলো। ঘাটের সিঁড়িগুলো ভেঙে পড়েছে। এখানে কেউ আর স্নান করতে আসে বলে মনে হয় না। পুকুর পাড়ে অজস্র ধারায় বনতুলসী, কাকমাচি, ঢোলকলমি, হেলেঞ্চা, সর্পগন্ধা জন্মেছে। ঘাটের পশ্চিমে একটা শৌচাগার ছিলো। শ্যাওলা জমে সেটাকে একটা চতুষ্কোণ পাথুরে উদ্ভিদের মতো দেখাচ্ছে। এর পাশেই একটা কাঠ বাদামের গাছ। এক যুগ আগে যেমন ছিলো ঠিক সে’রকম আছে। বড় হয়নি। এর উত্তর দিকে ঝুলে পড়া বড় ডালটায় রেখাদি গলায় রশি পেঁচিয়ে ঝুলে ছিলেন। শিলা সে দৃশ্য দেখেনি।
সে ঢাকা থেকে আসার পর দেখেছে দিদিকে বাড়ির উঠোনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। শিলার কান্না পায়নি একটুও। যে দুঃখে মানুষের কান্না পায় এটা তার থেকে বেশি বা ভিন্ন কিছু ছিলো। পরিপার্শ্বের সবকিছু অচেনা লাগছিলো তার। এতো মানুষ, কান্না, কোলাহল ছাপিয়ে রেখাদির মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিলো, মৃত্যু এতোটা সত্য হলে এতোটা বাস্তব হতো না। এর অন্য কোনো অর্থ আছে। দাদিমার মৃত্যুর সময় শিলার বয়স ছিলো দশ বছর। তখনও তার কান্না পায়নি। মৃত্যুর পর থেকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা সে গভীর করে দেখেছে। রেখাদির মৃত্যু তার দেখা এ’রকম দ্বিতীয় ঘটনা। দিদি তার স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক বিপুল সরকারকে পছন্দ করতো । দিদি বলতো,
* জানিস শিলা, আমি একদিন নিজেই মরে যাবো।
শিলা কখনও ভয় পায়নি। কারণ, এটা সে কখনও বিশ্বাস করেনি। শিলার প্রায়ই মনে হয় কথাটা বিশ্বাস করলে হয়তো তার কিছু করার থাকতো। এটা ভেবে তার কষ্ট লাগে। কষ্টটা তীব্র নয় কিন্তু এর একটা দীর্ঘ, অমোচনীয়, চেপে থাকা ধরণের রেশ আছে। মামাবাড়ি গেলে তার মনে হতো এই বৃক্ষ-বন, লতা-পাতা, জল-জঙ্গলের সাথে দিদি মিশে আছে। এটা শুধু বিশ্বাস ছিলো এমন নয়। সে উপলব্ধি করতো। ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময় বৈশাখের কোনো এক দুপুরে শিলা নলিতা দীঘির ঘাটের সিঁড়িতে একা এসে বসেছিলো। শ্যাওলা মেশা অস্বচ্ছ সবুজাভ জলে তাকিয়ে সে দেখলো, রেখাদি লম্বা চুল ছড়িয়ে জলের তলায় সাঁতার দিয়ে চলে যাচ্ছে। দৃশ্যটা এখনও শিলার মনে আছে।
ডেনমার্ক আসার পর প্রথম কয়েক মাস শিলা বাস করেছে কোপেনহেগেন শহরের গ্যামেল কোজে এলাকায়, ইউনিভার্সিটি থেকে ট্রেন বাস মিলিয়ে দুই ঘন্টার দূরত্বে। এখান থেকে বাল্টিক সাগরটা পাড়ি দিলেই ওপারে লিথুনিয়া। ওখানে মাশা থাকে — যে মাশার কাহিনী রেখাদি বলেছিলো। লিথুনিয়ায় বিস্তীর্ণ তৃণভূমি আছে, বল্গা হরিণ আছে। জার সম্রাটরা অপরাধীদের এখানে নির্বাসন দিতেন। শিলার লিথুনিয়া যেতে ইচ্ছা করে। শিলা ভাবে পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে একবার সে সোভিয়েত রাজ্যগুলোতে ঘুরতে যাবে; যদিও তার প্রায়ই দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছা করতো তখন। সে তার বাসার কাছে শহরের সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে গিয়ে বসে থাকতো মাঝে মাঝে। এখান থেকে সরাসরি ট্রেনে এয়ারপোর্ট চলে যাওয়া যায়। তারপর প্লেনে চেপে বসলে ব্যাংকক হয়ে ঢাকা। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ডরমেটরিতে থাকে ডেনিস ভাষায় সেটার নাম ‘ইংলে নাভ’। ইংরেজিতে এঞ্জেলস হাব। অর্থাৎ দেবদূতদের আবাস। নামটা শিলার খুব ভালো লাগে। ডরমেটরিতে ঢোকার সময় সে প্রতিবারই পাথরে খোদাই করা সাইনবোর্ডটির দিকে তাকায়। মনে মনে ইংরেজিতে অনুবাদ করে- এঞ্জেলস হাব।
বন্ধের দিনগুলোতে শিলা প্রায়ই ফিয়ালেডপারকেন- এ যায়। একা একা বেঞ্চে বসে সময় কাটায়। পার্কটা শহরের উপকণ্ঠে হলেও গভীর অরণ্যের মতো গাছপালায় পূর্ণ। একাকিত্ব উপভোগ করার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন। জীবনানন্দ দাশ কোনো এক কবিতায় লিখেছিলেন “এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন।” পার্কে বসে থাকার সময় শিলা প্রায়ই মনে মনে এই পঙক্তিটি আবৃত্তি করে। ডরমেটরি থেকে হাঁটার দূরত্বে মেরি অব দ্য রোজারি চার্চেও যায় সে। জেসাসের মূর্তি, ফুল দিয়ে সাজানো বেদি, ভারি পর্দা ঝুলানো বড় জানালা, জনমানবহীন চার্চের নৈঃশব্দ্য তাকে একটা অপার্থিব জগতের প্রশান্তি এনে দেয়। ছোটবেলায়ও এ’রকম একটা প্রশান্তির সময় ছিলো শিলার।
ঘুম থেকে উঠে মা প্রতিদিন ঠাকুর ঘরে গিয়ে পুজা দিতেন। সন্ধ্যায় মা যখন ধুপ ও প্রদীপ জ্বালাতেন তখন শিলার মনে হতো পৃথিবীর সব কালিমা, সব অন্ধকার, সব পঙ্কিলতা দূরে চলে যাচ্ছে। শিলার মনে আছে নারায়নগঞ্জের ঐ শহরতলীতে তখনও খড়ির চুলায় রান্না হতো। সন্ধ্যার আকাশটা ধোঁয়া, ধুলি, কখনও কুয়াশায় মিশে কেমন যেন ধুসর আর ¤øান হয়ে উঠতো। পিডবিøউডি কলোনির মাঠ থেকে গোল্লাছুট খেলে শিলা ছোট বোন পৃথাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতো। এসে দেখতো মা পুজার আয়োজন করছেন। শুরুতে মা তামার পাত্র থেকে নিজের এবং ঠাকুরের মাথায় জল ছিটাতেন, মাটির ডেলার ওপর ঘট বসাতেন, ঘটে সিঁদুর দিয়ে মাঙ্গলিক বজ্রচিহ্ন এঁকে তার ওপর বেজোড় সংখ্যক আম পাতা রাখতেন, পাতার ওপর তেল ও সিঁদুরের ফোঁটা দিতেন। কখনও কখনও একটা হরিতকি ফুল এবং কিছু দূর্বা ঘাসও রাখতেন ঐ ঘটের ওপর। এরপর চোখ বন্ধ করে স্তোত্র জপতেন,
* ল²ীস্তং সর্বদেবানাং যথাসম্ভব নিত্যশঃ
স্থিরাভাব তথা দেবী মম জন্মনি জন্মনি
বন্দে বিষ্ণু প্রিয়াং দেবী দারিদ্র্য দুঃখনাশিনী
ক্ষীরোদ সম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষ বিলাসিনী।
শিলার মনে হতো, মা-র এই আকুল করা দুঃখ নাশের আবেদন নারায়ণের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে আর ল²ীর চারটি হাত ধর্ম, কর্ম, অর্থ ও মোক্ষ বিলিয়ে দিচ্ছে এই পুরা জনপদে।
চার্চের ফাদার শিলাকে ফোন করেছে। এবারের ক্রিস্টমাস উপলক্ষ্যে যারা মাউন্ট ট্যাম্পল দেখতে জেরুজালেম যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছে তাদের তালিকায় শিলাও আছে। তাকে চব্বিশ ডিসেম্বরের মধ্যে কোপেনহেগেন ফিরতে হবে। অনেক কাঙ্ক্ষিত এই ভ্রমণের সুযোগটা তার নিতে ইচ্ছা করছে না। সে মামাবাড়ি আরও কয়েকটা দিন থাকতে চায়। বিপুল সরকারের স্ত্রীকে দেখতে ইচ্ছা করছে তার। পরদিন সকালে কাজিনদের কাউকে সাথে না নিয়ে সে একাই বিপুল সরকারের বাড়িতে চলে গেলো। বাড়িটা সে চিনতো। রেখাদির সাথে অনেক বার গিয়েছে। দিদি প্রাইভেট পড়ার সময় তাকে বাইরে খেলাধুলা করতে হতো। পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিলো না শিলার।
উঠোনে পৌঁছার পর শিলা দেখলো একজন ত্রিশোর্ধ মহিলা বারান্দায় বসে কলমি শাক বাছছে। মহিলা তাকে চিনতে পারার কথা নয়। বিপুল সরকার বেরিয়ে এসে অনেক যতœ করে শিলাকে ঘরে নিয়ে গেলো। পেয়ারা, চা, বিস্কিট খেতে দিল। যে চেয়ারে বসে দিদি প্রাইভেট পড়তো, শিলা দেখলো সেটা নেই। সেখানে একটা সোফা পাতা হয়েছে। শিলা নিজের আসন ছেড়ে সেই সোফায় গিয়ে বসলো। দেয়ালে কোনো একটা শিশুর আঁকা চিত্রকর্ম। এক ফ্রেমে নৌকা, তালগাছ, খড়ের গাদা, গৃহস্ত বাড়ি, আকাশে উড্ডীন বিমান, মেঠোপথ, গ্রাম্য বধু সব আছে। নৌকার চেয়ে মাঝির আকৃতি কয়েক গুন বড়। শাল কাঠের একটা শো-কেস— ভেতরে থালা বাসন, ওপরে ফ্রেমে বাঁধাই করা সপরিবার পাহাড়পুর ভ্রমনের একটা ছবি। বিপুল সরকার জানতে চায় ডেনমার্কে সব মানুষ ধনী কিনা, তারা ভাত খায় কিনা, তার ছেলে বড় হলে সেদেশে পড়তে যেতে পারবে কিনা, এসব। শিলার বেশিক্ষণ এখানে থাকতে ইচ্ছা করলো না। সে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। উঠোনে দাঁড়িয়ে বিদায় নেওয়ার সময় বিপুল সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
* আপনার বাসায় বড় একটা দা আছে?
* হ্যাঁ, আছে। দা দিয়ে কী করবে?
* আমি এই জাম্বুরা গাছের একটা ডাল কেটে নেবো। মামাবাড়িতে পুঁতে রাখব। গাছ হবে।
* আশ্চর্য! তুমি জানো না ডাল পুঁতে তো গাছ হয় না! তুমি চাইলে বরং তোমাকে একটা চারা জোগাড় করে দেবো।
এরপর শিলা হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে বিপুল সরকারের স্ত্রী যে বটি দিয়ে শাক কুটছিলো সেটা কেড়ে নিলো এবং উঠোনের জাম্বুরা গাছেটার মোটা একটা ডালে কোপাতে শুরু করলো। বিস্মিত বিপুল সরকার এবং তার স্ত্রী আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার শুরু করে দিল। বটির মুখ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ডাল কাটছে না। কিন্তু শিলা থামছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেলো শিলা। এক সময় ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে। তার মাথাটা অবশ লাগছে। সে মামাবাড়ির দিকে হাঁটছে। এই গ্রামের নাম শেকলতলা। শেকলের মতো লম্বা গ্রাম। অন্য মাথায় মামাবাড়ি। গ্রামের পূব দিকে শীতলক্ষ্যার পাড় পর্যন্ত শর্ষে ফুল ফুটে আছে। শিলা সেদিকে তাকিয়ে হলুদ চাদরের মতো একটা কিছু দেখতে পাচ্ছে। শিলা লক্ষ করলো তার পেছনে গ্রামের শিশু কিশোররা হাঁটছে। তার মনে হলো রাস্তাটা যেখানে দক্ষিণে মোড় নেওয়ার কথা সেখানে পূব দিকে ঘুরে গেছে। সেটা মেনে নিলো শিলা। কিন্তু বাড়ি পৌঁছা খুব সহজ হলো না তার জন্য। পা কাঁপছে। পিপাসা পেয়েছে। কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের পোল্ডার বাঁধের ওপরের সাদা বিল্ডিংটা এতোক্ষণে নজরে আসার কথা। সেটা দেখা যাচ্ছে না। অবশেষে কাজিনরা খুঁজতে বের হয়ে শিলাকে পেয়ে গেলো মামাবাড়ির অল্প কিছুটা দূরে। তার সোয়েটার এবং স্যান্ডেলটা পাওয়া গেলো না।
ঘটনা জেনে মামা-মামি আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। সব কাজ ফেলে মামি শিলার পায়ে পায়ে ঘুরছেন। গোসল করে, দুপুরের খাবার খেয়ে শিলা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। কোপেনহেগেন থেকে ক্যাথরিন ফোন করেছে। সে চায়না থেকে পড়তে এসেছে ডেনমার্কে। ওর আসল নাম ইএং শিয়াও শি। উচ্চারণ করা কঠিন। সে যখন তার নাম বলে তখন ‘শ’- র সাথে ‘জ’ ধ্বনির অদ্ভুত একটা মিশ্রণ থাকে। আবার ‘ইএং’ এর অনুস্বরের উচ্চারণ এতো নাতিদীর্ঘ যে সেটা অনুসরণ করা কঠিন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সে নিজের নাম রেখেছে ক্যাথরিন। চাইনিজ প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রী এটা করে। এমনকি ক্লাসের শিক্ষকরাও এই অদ্ভুত বিকল্পটি বেছে নিতে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করেন। ক্যাথরিন তার রুমমেট। নিঃসঙ্গ বোধ করছে সে। শিলা প্লেনের টিকেট পরিবর্তন করে আগেই ফিরে জেরুজালেম যেতে চায় কিনা জানতে চায় ক্যাথরিন। শিলা আজ সকালের ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না। তার মাথা অবশ লাগছে। ঝিমুনি আছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তার। ক্যাথরিনকে সে শুধু বললো ছুটি শেষ হবার আগেই সে চলে যাবে।
জয়া ঘুমায় শিলার সাথে। অন্য সময়ও পিছু ছাড়তে চায় না। সে এবার ইডেন কলেজে বোটানিতে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। ছোট মামার একমাত্র মেয়ে জয়া। সে শিলার পাশে শুয়েছে। কিন্তু শিলার ইচ্ছা করছে জয়া উঠে যাক। এই রুমে কেউ না থাকুক। সে আরাম করে একা ঘুমাতে চায়। এই বাসার দেড় তলায় একটা স্টোর রুম আছে। এটা এক ধরণের পরিত্যক্ত একটা কক্ষ। ছোটবেলায় শিলা ঝেড়ে মুছে এই কক্ষের দখল নিতো। একবার মৌকে সাথে নিয়ে ঐ রুমে রাত্রি যাপনের উদ্যোগও নিয়েছিলো শিলা। কিন্তু বাড়ির সবাই শুয়ে পড়ার পর একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হলে এই বীর শিশুরা নেমে এসেছিলো। দুঃসাহসিক অভিযানটা সফল হয়নি। শিলার ঐ রুমে গিয়ে ঘুমাতে ইচ্ছা করলো। গিয়ে দেখলো ভাঙা চেয়ার টেবিলে রুমটা পূর্ণ। জয়ার পাশে শুয়েই দীর্ঘ একটা ঘুম দিয়ে যখন শিলা উঠল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মামি তেল পিঠা বানাচ্ছেন। মামা ছোটবেলার মতো লটারি করে পিঠা বিতরণ করছেন। রেখাদি থাকলে এই পিঠা উৎসবের মজাটাই অন্যরকম হতো। লটারিতে পিঠা জেতার পর দিদি যেভাবে চিৎকার করতো তাতে মনে হতো যে জগতের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি এই মুহূর্তে তার হাতে এসে গেলো।
রাতেও জয়ার সাথে বরাবরের মতো এক রুমে থাকতে হলো শিলার। এ বাড়িতে শিলার একা ঘুমানোর অধিকার কখনই অর্জিত হয়নি। অধিকার খর্ব হবার ঘটনাটা খুব ছোট বেলার। মামাবাড়ি বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করতে বরাবরই রেখাদি এবং অন্য কাজিনদের সাথে ঘুমাতো শিলা। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় সে পরপর কয়েকদিন গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলো। পরে পুরোহিত ডেকে অনেক তন্ত্র-মন্ত্র করে বিষয়টার নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। বড় হবার পর এই ঘটনার একটা ব্যাখ্যাও খুঁজে পেয়েছে শিলা। এটা ছিলো আসলে সমনেমবলিজম। সে মাকে ছেড়ে কখনও ঘুমাতো না। কখনও অন্য কারো সাথে ঘুমাতে গেলে ঘুমাতে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে মাকে বলে যেতো। যে কয়দিন সে মা-কে না বলে ঘুমাতে গেছে সে কয়দিনই এই ঘটনা ঘটেছে। ঘুমের মধ্যে তার অবচেতন মনে জমে থাকা মাকে বলে আসার ইচ্ছাটা কাজ করেছে। ফলে সে ঘুমন্ত অবস্থায়ই দরজা খুলে বেরিয়ে মার কাছে যেতে চেষ্টা করেছে। এই তত্ত¡ ব্যাখ্যা করে একটা আলাদা রুমে ঘুমানোর অধিকার পাওয়া যাবে না। মামা-মামির কাছে শিলা এখনও ছোটই আছে।
জয়া খুব আহ্লাদি। সবার কাছে স্নেহ-ভালোবাসা পেতে চায়। আজ সে শিলাদির কাছে চুল বেঁধে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শিলার ঘুম আসছে না। তাতে সমস্যা নাই। সে জানে কীভাবে নিজেকে ঘুমিয়ে দিতে হয়। ‘মাইন্ডস ইন ইউনিসন’-র সেলফ হিপনোসিস সেশনÑ ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো শিলা। তারপর চোখ বন্ধ করে বললো,
* শিলা, তোমার ঘুম পাচ্ছে!
– তোমার চোখে তন্দ্রা, ভারি হয়ে যাচ্ছে তোমার চোখের পাতা!
– তোমার অপূর্ব, প্রশান্ত চোখজোড়া গভীর কালো আর সবুজ ঘুমের আবরণে ঢেকে যাচ্ছে ৃ
ঘুম আসছে না। শিলা চোখ খুলে দেখলো, এবার নিজেকে অচেনা লাগছে তার। দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করে ডান হাতের দিকে তাকালো সে। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। এই হাতটিকে সে চিনতে পারছে না। বাম হাত। না, চিনতে পারে না। এই চিরচেনা অঙ্গ দু’টিকে তার নিজের বলে মনে হচ্ছে না। বুঝতে পারছে না এদের সাথে তার সম্পর্ক কী! শিলা আবার চোখ বন্ধ করে বললো,
* শিলা, তোমার ঘুম পাচ্ছে!
তোমার চোখে তন্দ্রা
এবার কালো আর সবুজের একটা অদ্ভুত মিশ্রণ চোখ বুজে দেখতে পাচ্ছে শিলা। সেটা তরল অথবা বায়বীয় পদার্থের মতো। সে বুঝতে পারলো তার ঘুম এসে যাচ্ছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শিলা ছটফট করছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। সে চোখ খুলে দেখলো আয়নার প্রতিবিম্বটা নিজের গলা টিপে ধরেছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। সে চাচ্ছে প্রতিবিম্বটা তার গলা ছেড়ে দিক। কিন্তু ছাড়ছে না। শিলার গোঙানিতে জয়ার ঘুম ভেঙে গেলো। শিলার দিকে তাকিয়ে জয়া চিৎকার করে বলছে,
* এই শিলা আপু এ কী করছো তুমি!
খাটের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে জয়া। সে দেখলো শিলাদি দুই হাতে তার নিজের গলা টিপে ধরেছে। দুই হাতের প্রায় আধা ইঞ্চি লম্বা নখগুলো সে বসিয়ে দিয়েছে নিজের কণ্ঠনালি বরাবর। গলার নরম মাংস ফুটো হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। পরনের জামাটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে।