হাসান গোর্কি : সঞ্জিব পুরোহিত: নৈতিকতার উৎস কী বলে আপনার মনে হয়?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমার বিশ্বাস, নৈতিকতার ধারণা এসেছে ধর্ম বিশ্বাস থেকে। চুরি করা, মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা যে খারাপ এই ধারণা আমরা ধর্মগ্রন্থগুলো থেকেই পেয়েছি। অন্যের অসহায়ত্বে সমব্যথী হওয়া, কারো কষ্ট লাঘবে উদ্যোগ নেওয়া, বিচার ও বণ্টনে নিরপেক্ষ থাকা, অর্পিত দায়িত্বের ক্ষেত্রে নিজে দায়িত্বশীল থাকা— এসবের নির্দেশনা ও উপদেশ আমরা ধর্ম গ্রন্থগুলো থেকেই পেয়েছি।
সঞ্জিব পুরোহিত: তাহলে পৃথিবীতে ধর্ম গ্রন্থ আসার আগে কোনো নৈতিকতার ধারণা ছিলনা?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমি ধর্মগ্রন্থের কথা বলতে চাইনি। ধর্মের কথা বলতে চেয়েছি। গ্রন্থ আসার আগেও পৃথিবীতে ধর্ম ছিল। আপনি প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছেন। আপনি জানেন, বুদ্ধিমান হয়ে ওঠার সময়টাতে প্রাচীন মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক ঐ গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ থেকে ২০০ জন। এদের দলপতি এদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কল্পিত দেবতার ভয় দেখাতেন। সেই দেবতারা বাস করতেন পাহাড়ের চূড়ায় বা বড় কোনো বৃক্ষে অথবা কোনো হ্রদে। দলপতি বলতেন, তুমি খারাপ কিছু করলে দেবতা সেটা দেখতে পাবেন, মিথ্যা বললে তিনি সেটা শুনতে পাবেন, এমনকি মনে মনে খারাপ কোনো পরিকল্পনা করলেও সেটা তিনি জানবেন। ভালো কিছু করলে তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন, আর খারাপ কিছু করলে শাস্তি দেবেন।
সঞ্জিব পুরোহিত: এই গল্পের প্রয়োজনীয়তা বোঝা গেলো। এবং নৈতিকতার উৎপত্তির শুরুটাও বোঝা গেলো। আসলে আমার প্রশ্ন ছিল, নৈতিকতার উৎস কী? ঐ দলপতির উদাহরণ দিয়েই বলি, কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক সেটা ঐ দলপতির মাথায় এলো কোথায় থেকে?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এটা ঈশ্বর তার মাথায় প্রেরণ করেছেন। আর তিনি তা তার অনুসারীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনার কথা অনুযায়ী সকল দলপতি-ই ছিলেন একজন করে ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ। আবার বলছেন, তিনি সেই নৈতিকতার বোধ অনুসারীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন একই নৈতিকতার বোধ তার দলের অন্য সদস্যদের মধ্যে কম করে হলেও ছিল। দলপতির নির্দেশনা পাবার আগে থেকেই কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেটা তারা অনেকটাই বুঝতো (তাদের মেধা অনুযায়ী)। আমি জানতে চাচ্ছি প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে নৈতিকতার বোধ থাকে সেটা কোথায় থেকে আসে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলেছেন যে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নৈতিকতার বোধ থাকে। আসলে কোনো মানুষ নৈতিকতার বোধ নিয়ে জন্মায় না। দেখুন একটা শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে নৈতিকতা-অনৈতিকতা বিষয়ে কোনো ধারণা রাখে না। সে ভালো-মন্দ না বুঝে-ই আগুনে হাত দেয়, জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন ফেলে দেয়, গ্লাস ভাঙে, মিথ্যা কথা বলে, ফ্রিজ খুলে চুরি করে আইসক্রিম খায়। এই কাজগুলো যে ভালো নয় সেটা বাবা-মা বুঝিয়ে দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে তার মধ্যে নৈতিকতার ধারণা তৈরি হতে থাকে। প্রত্যেক বাবা-মা তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের লিখিত বা অলিখিত উৎস থেকে নৈতিকতার ধারণা পেয়ে থাকে।
সঞ্জিব পুরোহিত: একটা শিশু ভালভাবে কথা বলতে বা বুঝতে শেখার আগেই যদি তার সামনে আপনি অন্য একটা শিশুকে বা একটা বেড়ালকে পেটান তাহলে সেটা সে পছন্দ করবে না। আপনি যদি আপনার স্ত্রী/স্বামীকে চিৎকার করে গালিগালাজ করেন তাহলে শিশুটি আপনাকে অপছন্দ করবে। আপনি আমাকে বলুন, এই কাজগুলো যে ভালো নয় এই ধারণা শিশুটি কোথায় পেলো?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এটা তার রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তী ক্রিয়া। আপনি একটা বেড়ালের সামনে কেউকে পেটালে বা চিৎকার করে ধমক দিতে থাকলে বেড়ালটাও চাইবে এই অবস্থার অবসান হোক। আপনার এই কাজটাকে ঐ বুদ্ধিহীন প্রাণীটাও অপছন্দ করবে।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন এই রিফ্লেক্স কোন শিক্ষণের অংশ নয়। কিন্তু এটাই তার নৈতিকতার প্রাথমিক উৎস। এমন কিছু প্রাকৃতিক উপাদান আমাদের মস্তিষ্কে থাকে যা ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করতে পারে। যা নিজের জন্য ক্ষতিকর তা একই বৈশিষ্ট্যের অন্যদের জন্যও যে ক্ষতিকর হবে সেটা আমাদের মস্তিস্ক বুঝতে পারে। এবং অন্যকে এই ক্ষতির মধ্যে ফেলা বা পড়তে দেওয়া যে ভালো নয় সেই উপলব্ধি-ই নৈতিকতার উৎস। বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নৈতিকতার ধারণা পরিপক্ক হয়। নৈতিকতার ধারণা তৈরিতে ধর্মীয় এবং সামাজিক শিক্ষণের ভূমিকা আছে সেটা আমি মানছি। তবে আমি বলতে চাচ্ছি, এটা মানুষের অনুভূতির সামস্টিক রূপ। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষের নৈতিকতার বোধ একত্রিত হয়ে নৈতিকতার ধর্মীয় এবং সামাজিক শিক্ষণ তৈরি করেছে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এতক্ষণে আপনার বক্তব্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে, যদিও এর সাথে আমি একমত নই। বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে হয়তো আপনি বুঝবেন। আমাদের প্রত্যেকের সম্পদের মালিক হবার ইচ্ছা আছে। নিরাপত্তা বজায় রেখে চুরি করা সম্ভব হলে পরিশ্রম ছাড়াই সম্পদের মালিক হওয়া যায়। এরকম একটা সুপ্ত ইচ্ছা আমাদের মনেও আছে। আপনার ধারণা মতো অনুভূতির সামস্টিক রূপ-ই যদি নৈতিকতার মানদণ্ড তৈরি করে তাহলে তো চুরি করাও একটা নৈতিক কাজ বলে স্বীকৃতি পেতো।
সঞ্জিব পুরোহিত: সব ইচ্ছা নৈতিক নয়। কোনটা কল্যাণকর আর কোনটা অকল্যাণ বয়ে আনে সে রায় আমরা মস্তিষ্ক থেকে পাই।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: তাহলে বলুন, মস্তিস্ক সেটা কোথায় পায়?
সঞ্জিব পুরোহিত: প্রকৃতি থেকে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি গতদিনের আলোচনায় বলেছিলেন প্রকৃতি ‘বøাইন্ড এন্ড পারপাসলেস’।
সঞ্জিব পুরোহিত: ‘অন্ধ’ অর্থ চৈতন্যশূন্য নয়। আমি ‘বøাইন্ড’ বলেছিলাম উদাসীন অর্থে। যেমন ধরুন একটা পিঁপড়া বা শিমুল গাছের চৈতন্যের সাথে আমাদের চৈতন্যের কোন মিল নেই। তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পারি না। ফলে আমরা পরস্পরের প্রতি উদাসীন। আমরা প্রকৃতির অংশ বলে তার সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। কিন্তু যোগাযোগের ভাষাটা আমরা জানি না। প্রকৃতিতে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের উপাদান আছে। সেসব আমাদের শরীরেও আছে। আমাদের মস্তিষ্ক সবগুলো উপাদানকে বিশ্লেষণ করে ভালো-মন্দের ধারণা তৈরি করে। প্রকৃতি এখানে কোনো পক্ষ নয়। সে জৈব সত্তার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কেবলমাত্র এক গুচ্ছ অপরিবর্তনীয় ও নিরপেক্ষ বিধি ধারণ করে যেগুলো কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া শতভাগ অন্ধভাবে কাজ করে। ১৯৮৪ সালে এডওয়ার্ড ও. উইলসন তাঁর লেখা বায়োফিলিয়া নামে একটা বইয়ে দাবি করেছিলেন যে, প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একটা অন্তর্গত প্রবণতা মানুষের মধ্যে আছে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: তিনি কি স্পিরিচুয়াল যোগাযোগের কথা বলেছেন?
সঞ্জিব পুরোহিত: না। তিনি সেকুলার হিউম্যানিস্ট ছিলেন। প্রকৃতিবাদীও। তাঁর গবেষণার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল পিঁপড়া। বিজ্ঞানী মহলে তিনি ‘পিঁপড়া মানব’ বলেও পরিচিত ছিলেন।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: যদি আমরা ধরে নেই প্রকৃতি থেকে সব ধরণের উপাদান নিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক নৈতিকতার বোধ তৈরি করে তাহলে সেই আগের প্রশ্নটা আবার এসে যায়। নিজের জন্য ভালো (যেমন চুরি করা, বা মিথ্যা বলে দায় এড়ানো) কিন্তু অন্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে আমাদের নৈতিকতার বোধ গঠিত হয় না কেনো?
সঞ্জিব পুরোহিত: আমাদের নিজেদের যখন কিছু চুরি যায় বা কেউ যখন আমাদের কাছে মিথ্যা বলে তখন আমরা বুঝি যে কাজগুলো ভালো নয়। অন্যের কিছু চুরি করার সময় বা তার কাছে মিথ্যা বলার সময় কাজগুলো যে অনৈতিক সেটা বুঝে-ই করি। সেকারণে এগুলো গোপনে করি। এভাবে অন্যের জন্য ক্ষতিকর কিছু করা যে অনৈতিক সেটা আমরা বুঝতে পারি।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমাদের নৈতিকতার বোধ পুরোপুরি আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি হয়। এতে ঐশ্বরিক কোন উপাদান বা অনুপ্রেরণা থাকে না!
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনাকে আগেই বলেছি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারার মতো মেধা আমার নেই। তাই নৈতিকতায় ঐশ্বরিক উপাদান আছে কিনা সেটা আমি বুঝবো না। আমাদের মস্তিষ্কে কীভাবে নৈতিকতার বোধ তৈরি হয় সে বিষয়ে আমার ধারণা বলি। এটা তৈরি হয় অন্য আর দশটা অনুভূতির মতো করে। যেমন আপনি দেখলেন একজন বৃদ্ধ রিকশা চালককে এক যুবক পেটাচ্ছে। এই চিত্রটা আপনার মস্তিষ্কে যাবার পর আপনার মস্তিষ্কের সেলে রক্ষিত তথ্যগুলো এটাকে বিশ্লেষণ করবে এবং সিদ্ধান্ত দেবে — মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া কষ্টের, রিকশা চালক যে চিৎকার করছে সেটা শারীরিক কষ্ট থেকে করছে, লোকটা বৃদ্ধ এবং তার শারীরিক শক্তি কম, যুবকটা যে অপরাধে বৃদ্ধকে মারছে সেটা প্রহৃত হবার মতো অপরাধ নয়, বয়সের কারণে যে সন্মান পাবার কথা সেটা থেকে বৃদ্ধ লোকটা বঞ্চিত হয়েছে। অতএব যুবকের কাজটা অনৈতিক।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি বলছেন মস্তিষ্কের সেলে আগে থেকেই নৈতিকতার ধারণা রক্ষিত থাকে। ব্যাপারটা আসলে সেরকম নয়। শিশু যখন বড় হতে থাকে তখন সে পরিপার্শ্বের মানুষদের কাছে থেকে নৈতিকতার ধারণা নিয়ে তার মস্তিষ্কের সেলে সংরক্ষণ করে। আর পৃথিবীতে প্রথম শিশু বা মানবের মস্তিষ্কে নৈতিকতার ধারণা রোপণ করেছেন ঈশ্বর। আপনি যদি বলেন, ‘আন-আইডিন্টিফাইড ন্যাচারাল ল’, (যার কিছু অংশ স্বাভাবিকভাবে আমাদের মস্তিস্কেও আছে) নৈতিকতার বোধ তৈরি করেছে তাহলে অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যেও এটা থাকার কথা ছিল। কিন্তু আপনি দেখুন বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়। বড় উদ্ভিদ ছায়া তৈরি করে গুল্ম বা ছোট উদ্ভিদের বেঁচে থাকাকে অসম্ভব করে তোলে।
সঞ্জিব পুরোহিত: নৈতিকতার বোধ মানুষের মাথায় বপন করা হয়েছে, নাকি মস্তিষ্কে সেটা জন্ম নিয়েছে সেটা নিশ্চিত হবার উপায় নাই। আর আপনি যে বলছেন প্রাণীদের নৈতিকতার বোধ নাই- সেটাও ঠিক নয়। এক প্রাণী অন্য প্রাণীকে খাচ্ছে- এটা নৈতিকতার লঙ্ঘন নয়। আবার এর কিছু বিপরীত চিত্রও আছে। হরিণ আক্রান্ত হলে জলহস্তী কোন লাভের আশা না করেই তাকে বাঁচায়। সিংহ হরিণের সদ্যজাত সন্তানকে না খেয়ে লালন পালন করে, এরকম আমরা ডকুমেন্টারিতে দেখেছি। কুকুর অনেক সময় নিজের জীবন বাজি রেখে প্রভুর জীবন বাঁচায়। সকল প্রাণীর মধ্যে-ই তাদের বুদ্ধির স্তর অনুযায়ী কিছু নৈতিকতা কাজ করে। বৃক্ষের কোন দৃশ্যমান নৈতিকতার বোধ নাই। ঊর্ধ্বতন কোন চৈতন্য বা নৈতিকতার বোধ তাদের থেকে থাকলে সেটা আমরা বুঝবো না।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: যে উপাদানগুলো দিয়ে প্রাণীদের নৈতিকতা তৈরি হয় সেগুলো বিপুল বা অসীম পরিমাণে প্রকৃতিতে আছে। তাহলে আপনার কথা অনুযায়ী প্রকৃতির একটা নৈতিকতার বোধ থাকার কথা যা আমাদের মতো, কিন্তু পরিমাপে অসীম বা অকল্পনীয়রকম বিশাল। তাহলে প্রকৃতি ঝড়- জলোচ্ছ¡াস- ভূমিকম্প দিয়ে মানুষ ও উদ্ভিদ ও অন্য প্রাণীদের মারছে কেন!
সঞ্জিব পুরোহিত: এ প্রসঙ্গে সম্ভবত আমরা আগে কথা বলেছি। আসলে প্রকৃতির কোন নৈতিকতার বোধ নাইÑ প্রকৃতিতে কিছু বিধি আছে যা সব সময় নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। এতে কেউ উপকৃত হয়, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেকটোনিক প্লেটের সংযোগ রেখার ওপরে থাকা অঞ্চলগুলোতে ভূমিকম্প হয়। এটা ঐ অঞ্চলের মানুষদের প্রতি প্রকৃতির ইচ্ছাকৃত কোনো বিরূপতা বা বিদ্বেষের ফল নয়। নদীবাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত অঞ্চলগুলোতে ভালো ফসল উৎপাদন হয়। এটা ঐ অঞ্চলগুলোর মানুষদের প্রতি প্রকৃতির বিশেষ কোনো আশীর্বাদ বা উদারতা নয়। আমাদের শরীরের লোহিত রক্ত কণিকা রোগ প্রতিরোধের কাজ করে। শরীরে কোনো রোগ জীবাণু ঢুকে পড়লে তারা তাকে আক্রমণ করে। এর অর্থ কোনো এক ধরণের চৈতন্য তাদের মধ্যেও কাজ করে। তাদের কাজ বা চৈতন্য সম্পর্কে আমরা কিছু জানতে পারি না। তারাও জানে না কার কল্যাণে তারা জীবাণুদের আক্রমণ করছে। একই অবয়বের মধ্যে বসবাস করে লোহিত রক্ত কণিকা এবং মানুষের চৈতন্য যেমন আলাদা তেমনি একই কাঠামোর মধ্যে থেকেও মানুষ ও প্রকৃতির চৈতন্য ভিন্ন এবং পরস্পরের জন্য অপ্রবেশ্য।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: ধর্মগ্রন্থগুলোতে নৈতিকতার ধারণার যে সন্নিবেশ ঘটেছে তার উৎসও কি মানুষের মস্তিষ্ক?
সঞ্জিব পুরোহিত: আমার তা-ই মনে হয়। খেয়াল করে দেখুন আমরা যা ভাবি তা-ই ধর্ম ও দর্শনে পাই। অগ্রসর চিন্তার মানুষদের পক্ষে বিষয়গুলোকে অনেক গুছিয়ে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে বলে তাকে হয়তো ঐশ্বরিক মনে হচ্ছে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: নৈতিকতার উৎস মানুষের মস্তিষ্ক হয়ে থাকলে পৃথিবীর সব অঞ্চলে নৈতিকতার ধারণা এক রকম হতো। খেয়াল করে দেখুন ইউরোপ- আমেরিকার মানুষ সংক্ষিপ্ত পোশাক পরাকে অনৈতিক মনে করে না। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ খোলামেলা পোশাককে অনৈতিক মনে করে। পৃথিবীর কিছু অঞ্চলের মানুষ প্রকাশ্যে প্রাণী হত্যা (যেমন গরু জবাই করা) অপরাধ মনে করে বাকি অংশের মানুষ সেরকম ভাবে না। এই পার্থক্য এসেছে প্রধানত নৈতিকতার ধর্মীয় উৎস থেকে।
সঞ্জিব পুরোহিত: এগুলো মৌলিক পার্থক্য নয়। খেয়াল করে দেখুন নগ্নতার প্রতি মানুষের অনীহা আছে। সংস্কৃতির পার্থক্য ভেদে তার মাত্রায় পার্থক্য ঘটে। প্রাণী হত্যার কথা বলেছেন। এটা কেউ-ই পছন্দ করে না। আপনি একটা ঘোড়া জবাই করতে গেলে সেটা বুঝবেন। আপনি চেষ্টা করে দেখুন একটা বেড়াল জবাই করতে পারেন কিনা। আমরা যে প্রাণীদের মাংস খাই তাদের হত্যা করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একটা ছোট শিশুর সামনে গরু জবাই করে দেখুন সে ভয় পাবে। বিষয়টাকে অস্বাভাবিক মনে করবে। কিন্তু যে সংস্কৃতিতে সে বড় হচ্ছে সেখানে এই ঘটনার চর্চা একটা স্বাভাবিক বিষয় হলে সে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনার ব্যাখ্যার কোনো দুর্বল দিক আছে কিনা সেটা আমি জানি না। তবে আমার ধারণা, নৈতিকতার অবশ্য-ই একটা ‘স্পিরিচুয়াল বেজ’ আছে যা অজ্ঞাত কোনো মধ্যমে আমাদের সাহায্য করছে।
সঞ্জিব পুরোহিত: ‘ধারণা’র সাথে যখন ‘অবশ্য-ই’ লাগিয়ে দেবেন তখন আলোচনার সমাপ্তি টানা-ই আমাদের জন্য উত্তম কাজ হবে!
hassangorkii@yahoo.com. রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।