হাসান গোর্কি : পরম বা সর্বাতীত (ইংরেজি ‘ultimate’ অর্থে) একটা কিছুর অস্তিত্ব যে আছে বুদ্ধি বিকশিত হবার পর থেকে সেটা মানুষ অনুমান করে আসছে। কিছু কিছু ‘পরম’এর আপাত সন্ধান মানুষ পেয়েছে। যেমন আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। এটা পরম গতি। কোনো কিছুর গতি এর চেয়ে বেশি হতে পারে না। আমরা যদি আলোর গতিতে এক কেজি ওজনেরও একটা পাথর ছুঁড়ে দেই তাহলে তার ভর হবে অসীম। বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। আর ঐ গতিতে ছুঁড়লে পাথরটা তার ভৌত কাঠামো হারাবে। সে শক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে। পরম গতির মতো পরম স্থিতিও অর্জন অসম্ভব। এখন যদি পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে সূর্যের সাথে পৃথিবীর গতি অব্যাহত থাকবে। গ্যালাক্সির মধ্যে সূর্যের গতি বন্ধ করে দেওয়া হলে গ্যালাক্সির সাথে পৃথিবীর গতি চালু থাকবে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির গতি বন্ধ করে দেওয়া হলে অন্য গ্যালাক্সির সাথে তার দূরত্ব বেড়ে যাওয়া অব্যাহত থাকবে। অর্থাত অন্য গ্যালাক্সিগুলো থেকে এমনকি গ্যালাক্সিগুলোর বাইরে থেকে মিল্কিওয়েকে গতিশীল দেখাবে।

মিল্কিওয়ে বাদে অন্য গ্যালাক্সিগুলোকে বিলুপ্ত করে দেওয়া গেলে কি মিল্কিওয়েকে স্থির বলা যাবে? না। কারণ, কোনো কিছু স্থির কিনা তা নির্ণয় করার জন্য সাপেক্ষতার দরকার হয়। যেমন আপনার টেবিলে রাখা ল্যাপটপ আপনার টেবিলের সাপেক্ষে স্থির। তাহলে এরকম সাপেক্ষতার অন্য একটা উদাহরণ বের করার চেষ্টা করা যাক যেখানে মহাজাগতিক কোনো বস্তুকে স্থির দেখাবে। ধরা যাক, মহাবিশ্বে মিল্কিওয়ে এবং এন্ড্রোমিডা ছাড়া কোনো গ্যালাক্সি নেই এবং এদের গ্রহ-নক্ষত্রের কোনো গতি নেই। গ্যালাক্সি দুটি পরস্পর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে মহাশূন্যে ভেসে আছে। তাহলে কি এরা স্থির? এরা পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির। কিন্তু প্রান্তহীন মহাশূন্যের সাপেক্ষে এরা স্থির এবং গতীশীল উভয়ট-ই সত্য। একটা ট্রেন ঢাকা থেকে ছেড়ে বগুড়া যেতে থাকলে ট্রেনের কাছে বগুড়ার দূরত্ব কমতে থাকবে, আর ঢাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে। কিন্তু ট্রেনটি যদি শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে এবং এর যাত্রা শুরুর স্থান এবং গন্তব্য অসীম দূরত্বে থাকে তাহলে তাকে স্থির ও গতীশীল বলা সমান কথা।

তাপমাত্রার সর্বোচ্চ কোনো সীমা নেই। অর্থাত কোনো পদার্থের তাপমাত্রা যতো সম্ভব বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধু তার আকারের পরিবর্তন হবে। কিন্তু পরম উচ্চ তাপমাত্রা কত সে হিসাব বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। তবে তারা এর নিম্ন সীমা বের করেছেন : -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মহাবিশ্বের কোথাও এই তাপমাত্রার সন্ধান পাওয়া যায়নি বা পরীক্ষাগারেও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে এর চেয়ে কম তাপমাত্রা যে থাকা সম্ভব নয় সেটা বিজ্ঞানীরা তাত্তি¡কভাবে বুঝেছেন। তার অর্থ এটা তাপমাত্রার পরম নিম্ন সীমা। অ্যারিস্টটল ও তার সামসময়িক দার্শনিক এপিকুরাসের মতে স্থান এবং সময় দুটোই ছিল পরম। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যায় মনে করা হতো, বাইরের কোনো অনুষঙ্গ দিয়ে প্রভাবিত হওয়া ছাড়াই ‘সময়’ নিজে এবং নিজের মধ্যে সুষম গতিতে প্রবাহিত হয়। নিউটন তাঁর ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা গ্রন্থে দাবি করেছিলেন, “সময়ের প্রকৃতি ধ্রুব, বাস্তব এবং গাণিতিক”। আইনস্টাইন তাঁর অপেক্ষবাদে বললেন, এই তিনটি ধারণার সবগুলোই আপেক্ষিক- “পরম স্থান, পরম কাল এবং পরম ভর বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই”। খেয়াল করে দেখুন সময় বিষয়ে আমাদের মাথায় কিন্তু এখনও ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার ধারণা শক্তভাবে ভর করে আছে।

ক্ষুদ্র ও বৃহত অস্তিত্তে¡র ক্ষেত্রেও পরম বলে কিছু পাওয়া যায় না। পরমাণু ভাঙলে যে অতি পারমাণবিক কণাগুলো পাওয়া যায় সেসব ভাঙলে তরঙ্গ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অতি পারমাণবিক কণা হলো প্রোটন, নিউট্রন এবং মেসন, যারা একাধিক কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত (কোয়ার্ক নিজেও একটা অতিপারমানবিক কণা)। ধরুন আপনার বাসায় একটা ভূত এসে প্রতি রাতে রান্না করে যায়। এক রাতে আপনি তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে দেখলেন যে সে আপনার হাতের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। ক্ষুদ্রতম অংশে বিভক্ত হবার পর পদার্থও তার চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য হারায়। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এই ভূতের মতো আচরণ করে, তরঙ্গে পরিণত হয়, যার কোনো পরিমাপ করা যায় না। সেকারণে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, মহাবিশ্ব একটা কোয়ান্টামীয় ক্ষেত্র ছাড়া কিছুই নয় এবং ভৌত জগতের অস্তিত্বে থাকা না থাকার সম্ভাবনা সমান (আমার আর্টিকেলগুলোতে ‘ভৌত জগত’ শব্দগুচ্ছটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আশা করি পাঠক এটা জানেন যে এর অর্থ ‘physical world’ যার সাথে ভৌতিকতার সম্পর্ক নেই)। এই অনুচ্ছেদের সারমর্ম হলো, পরম ক্ষুদ্র বলে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।

এখন দেখা যাক পরম বৃহত বলে কিছু থাকা সম্ভব কিনা। বিজ্ঞানীরা বলছেন পরম বৃহত বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়; কারণ তা আকারে অসীম হবে এবং তাতে অসীম সংখ্যক বিধিও থাকবে যেগুলো সমন্বিত হয়ে ভৌত অস্তিত্বে থাকার কারণ নেই। আর যদি বিধিগুলো সমন্বিত হয়ে কোনো একীভূত ও সমরূপ ক্ষেত্র (unified field) তৈরি করে তাহলে তা একটা সসীম ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। অসীম কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব যদি তার কোনো ভৌত অস্তিত্ত¡ না থাকে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রস্তাবনা (মহাবিশ্ব একটা কোয়ান্টামীয় ক্ষেত্র) যদি ঠিক হয় তাহলে মহাবিশ্ব অসীম হতে তাত্তি¡ক কোনো বাধা নেই। সেক্ষেত্রে আমরা পরম বৃহত এর সন্ধান পাই। হোমো সেপিয়েন্স মানব গোষ্ঠীর সামাজিকায়নের কালে কোনো অখণ্ড বা ‘পরম’ সত্তার ধারণা ছিল না। তারা পাহাড়, হ্রদ, বৃহৎত বৃক্ষ, চন্দ্র, সূর্যকে ভিন্ন ভিন্ন শক্তির আধার বলে মনে করতো। এই প্রবণতা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিরান্ডারথালদের মধ্যেও ছিল। কোনো সত্তার পরমতা বিষয়ে প্রথম বিশ্বাসের পুরোধা ছিলেন রানী নেফারতিতি। ১৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি প্রচলিত সকল দেব দেবীদের ক্ষমতার ধারণার বিপক্ষে এক ‘পরম ঈশ্বরের’ ধারণা প্রচার করেন। এতে ফারাও আখেনাতেনও সমর্থন যুগিয়েছিলেন। তিনি নিজের নামে একটা শহরও তৈরি করেছিলেন, যেখানে শুধু ‘পরম’ ঈশ্বরের প্রার্থনা করা হতো। ইতিহাসবিদরা এই বিশ্বাসকে ‘আতেনবাদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নেফারতিতির মৃত্যুর পর এই ধারণা এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তবে ‘পরম’ কোনো সত্তার অস্তিত্ত¡ বিষয়ে কৌতূহল সব সময়-ই ছিল। যেমন, প্লেটো একটা পৌরাণিক কাহিনীকে নির্ভর করে তার সৃষ্টিবাদ তৈরি করেছিলেন। এই কাহিনী অনুসারে আদিতে একটা অপূর্ণ (এবং সম্ভবত মন্দ) সত্তার অস্তিত্ব ছিল। ‘ঐশ্বরিক পূর্ণতা’ তা অতিক্রম করেছে এবং ‘পরমতা’ লাভ করেছে। প্লেটো এই ধারণা বিবৃত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ডায়ালগ টিমেয়ুসে। এই তত্ত¡কে ডিমিয়ার্জ (গ্রীক ভাষায় দিমিউর্গে) বলা হয়। এটাকে অসম্পূর্ণ মনে করা হয় একারণে যে, যা কোনো কিছু অতিক্রম করে আসে তা সময়বদ্ধ, ফলে পরম নয়। সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস ভারতে বসবাস করার সময় ১৯১২ সালে তার বিখ্যাত উপন্যাস সিদ্ধার্থ লেখেন। সিদ্ধার্থ নামক এক যুবক ও তার বন্ধু গৌতমের আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা এবং তার ঈশ্বর বিষয়ক দর্শন এই উপন্যাসের উপজীব্য। সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে, তার আস্তানায় সময় কাটায়, বিয়ে করে সংসার যাপন করেন এবং পুনরায় গৃহত্যাগ করে এক ঘাটের মাঝির সাথে শেষ জীবন কাটিয়ে দেয়। সেসময় সে উপলব্ধি করে ‘পূর্ণতা’-ই ঈশ্বর। সে উপলব্ধি করে নদীর জল বৃক্ষ, গুল্ম, বায়ু প্রবাহ, চাঁদ, ধূলিকণা, আনন্দ, বেদনা, আকাশ, প্রকৃতি — সবকিছুর মধ্যে একটা একীভবনের ধারা আছে, একটা ঐক্যের সুর আছে; এবং এই ‘পূর্ণতা‘-ই ঈশ্বর। ‘পূর্ণতা’-ই পরম।

আব্রাহিমিক ধর্মগুলোতে ঈশ্বর সবকিছুর ওপরে বিরাজমান। ‘সবকিছু’ অর্থ ‘মহাবিশ্বের সকল কিছু’। সৃষ্ট সবকিছু থেকে তিনি আলাদা। আসমান এবং জমিন তৈরি করার পর তিনি ‘ইস্তওয়া’ করেছেন, অর্থাত উচ্চাকাশে আসীন হয়েছেন। মেন্ডীয় মতবাদেও এই ধারণার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। “The Great Treasure” বইয়ে কায়েস আল-সাদি লিখেছেন, “মেন্ডীয় মতবাদের নীতিগুলো হলো: একমাত্র মহান ঈশ্বর ‘হাইয়ি রাব্বি’র প্রতি বিশ্বাস, সকল কিছু যাঁর পরম সম্পত্তি; তিনি সমস্ত বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, তাঁর শক্তির মাধ্যমে আত্মা গঠন করেছেন এবং এটিকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে মানবদেহে স্থাপন করেছেন। তাই তিনি আদম ও হাওয়াকে (বাইবেলীয় নথিতে ‘ইভ’) সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা হলেন প্রথম পুরুষ ও নারী।” বাহাই ধর্মে ঈশ্বরকে আদি ও সৃষ্টিহীন সত্তা মনে করা হয় যিনি সমস্ত অস্তিত্বের উত্স। কিন্তু এক্ষেত্রে সৃষ্ট বস্তু তাঁর অস্তিত্বের অন্তর্গত কিনা সেটি স্পষ্ট নয়। জরথুস্ত্রবাদে ঈশ্বরকে পরম জ্ঞানী মনে করা হলেও সৃষ্টি থেকে তাঁকে আলাদা মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মে স্রষ্টা পরম সত্তা কিনা সেটা বুঝতে পারা যায় না। চিণ্ময়বাদ, অদ্বিতীয়বাদ, সর্বেশ্বরবাদ, আস্তিক্যবাদ এধরণের বেশকিছু মতবাদের সমারোহ হলো বেদান্তবাদ। এই মতবাদ অনুযায়ী ব্রহ্মা পরম সত্তা নন। আদি সৃষ্টিকর্তা হলেন বিষ্ণু যিনি জড় জগতে চেতনা স্থাপন করেন।
প্রকৃতিবাদীরা যে ‘পরম’ সত্তার কথা বলছেন তা কার্যত জড়। যে চেতনার অস্তিত্বের কথা তারা বলেন সেটা সর্বব্যাপী, অনাদি এবং উদ্দেশ্যশূন্য। একটা বীজ থেকে একটা বৃক্ষের বেড়ে ওঠা, কোনো সরোবর বা পাহাড় থেকে উত্পন্ন হয়ে একটা নদীর সমুদ্র অভিমুখে বয়ে চলা, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্ররাজির বিচরণকে তারা একটা প্রাকৃতিক নিয়মের অন্ধ ও লক্ষ্যহীন (blind and purposeless) অনুসরণ ছাড়া কিছু মনে করেন না। তাদের কাছে প্রকৃতি হলো পরম সত্তা। বৌদ্ধ ধর্ম মতে মহাজগত চলছে পাঁচটি নিয়ম অনুসরণ করে। এগুলো হলো চিত্ত নিয়ম, রীত নিয়ম, বীর্য নিয়ম, ধর্ম নিয়ম ও কর্ম নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মগুলোর স্রষ্টা বা নিয়ন্তা বলে কোনো সত্তার অস্তিত্ত¡ বৌদ্ধ দর্শনে স্বীকার করা হয়নি। প্রকৃতিবাদীদের সাথে এই দর্শনের অনেকটা মিল আছে। এবার ‘পরম’ বিষয়ক আলোচনার সমাপ্তি টানার চেষ্টা করা যাক।

‘পরম’ বলে কিছু থাকা কি সম্ভব? যদি বলা হয় ‘সম্ভব’ তাহলে প্রথম সমস্যা দেখা দেয় এর গতিশীলতার ব্যাখ্যা করা। ‘পরম’ থাকলে তার (তাঁর) শুরুর বিন্দু থাকে না। সেক্ষেত্রে আমরা জগত ও সময়ের যে প্রবাহমানতা দেখতে পাই তার ব্যাখ্যা থাকে না। এরিস্টটল মনে করতেন যে, কোনো কিছু গতিশীল হবার জন্য একটা প্রাইম মুভারের দরকার হয়। অর্থাত কোনো কিছুই গতি পাবে না যতক্ষণ না গতিশীল কোনো কিছু তাকে ধাক্কা দেয়। আবার শুরুর বিন্দু যদি না থাকে তাহলে এই প্রবাহমানতা অন্তহীন হবার কথা। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র একটা ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে- মহাবিশ্বের এই প্রবাহমানতা জিওডেসিক। এর সহজবোধ্য উদাহরণটি আমাদের হাতের কাছেই আছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের কোনো শুরু বা শেষ বিন্দু নেই। আবার যে কোনো বিন্দুকে-ই আমরা শুরু বা শেষ বিন্দু মনে করতে পারি। যে কোনো দিকে সোজা হাঁটতে থাকলে আমরা শুরুর বিন্দুতে-ই ফিরে আসবো।

মহাকর্ষ বল কেন কাজ করে সে বিষয়ে কাজ করার সময় আইনস্টাইন আকস্মিকভাবেই একটা বড় আবিষ্কারের পথ পেয়েছিলেন। তিনি দেখলেন মহাশূন্যকে আমরা যেমন সমতল ভাবি সেটা আসলে সেরকম নয়। বরং স্থান হলো বক্র। মহাকর্ষ বল আসলে স্থানের বক্রতা। একটা সহজ উদাহরণ থেকে বিষয়টা বুঝতে পারা যাক। আমরা যদি একটা চাদরের চার কোনা চারটি খুঁটিতে বেঁধে তার ওপর এক কেজি ওজনের একটা পাথর রাখি তাহলে সেটা চাদরের মাঝখানে গর্তের মতো তৈরি করে স্থির হবে। ঐ চাদরের ওপর এখন যদি একটা মার্বেল রাখা হয় তাহলে সেটা ঐ পাথরের দিকে গড়িয়ে যাবে। এবার ভাবুন, স্থান (মহাশূন্য) একটা চাদর। পৃথিবী একটা ভারি বস্তু। তাকে আমরা ঐ চাদরের ওপর ছেড়ে দিলাম। তাহলে সে তার ভরের কারণে স্থান (মহাশূন্য) কে তার দিকে বাঁকিয়ে ফেলবে। এই চাদরের ওপর কোনো কিছু (যেমন চাঁদ, কৃত্রিম উপগ্রহ,) কে ছেড়ে দিলে তা শূন্যের বক্র তল বেয়ে পৃথিবীর দিকে চলে যাবে বা যেতে চাইবে। এই প্রবণতাকে আমরা মাধ্যাকর্ষণ বলে ভ্রম করি। সময়ের বক্রতার কারণও একই। বিশেষ আপেক্ষিক তত্তে¡র পর আইনস্টাইন আরও কিছু যুগান্তকারী তত্ত¡ গঠন করেন যার একটি হলো সময়ের বক্রতা।

আলোচনায় ‘পরমতা’ সমস্যার যে সমাধান পাওয়া গেলো না সেটা আপনার মতো আমিও বুঝেছি। তাহলে এই দীর্ঘ আলোচনার অর্থ কী ছিল? উদ্দেশ্য ছিল এটা বোঝা যে কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দর্শনের দ্বারস্থ হতে হয়- হোক সে উত্তর সাক্ষ্যশূন্য, ধোঁয়াটে বা দ্ব্যর্থক। জার্মান দার্শনিক কান্ট তাঁর ‘নু মেনা’ তত্তে¡ দাবি করেন যে, মূল সত্তা হিসেবে বস্তুকে জানা সম্ভব নয়। মূল সত্তা হিসেবে বস্তুর অস্তিত্ত¡কে স্বীকার করে তিনি বলেন, বস্তুর অ-দৃষ্ট সত্তাকে কখনও জানা যায় না। ‘অ-দৃষ্ট’ এখানে ‘যা দেখা যায় না’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষ তার জ্ঞান সূত্র ব্যবহার করে শুধু ভৌত জগতের বহিরাবরণ বুঝতে পারে। তাহলে কি কান্ট বস্তুর অ-দৃষ্ট সত্তাকে, ‘পরম’ বলে মেনেছিলেন? শব্দচয়ন থেকে সেরকম মনে করা চলে। এর বিপরীত ধারণাও আছে। সরদার ফজলুল করিম তাঁর দর্শনকোষ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা- ৩১) লিখেছেন, “দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদ অজ্ঞেয়বাদকে অসার বলে অভিহিত করে। আধুনিক দ্ব›দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবক্তাদের অন্যতম হচ্ছেন ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। তিনি তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এন্টি ডুরিং- এ অজ্ঞেয়বাদকে খণ্ডন করেছেন। তাঁর মতে মানুষ বস্তুকে আদৌ জানতে পারে কিনা এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাবার দিন শেষ হয়ে গেছে। কারণ, মানুষ বস্তুকে শুধু তাত্তি¡কভাবেই জানছে না; বাস্তবভাবে সে বস্তুকে স্পর্শ করছে, বিশ্লেষণ করছে, তার অন্তর্নিহিত বিধি-বিধানকে জানছে এবং জ্ঞাত সেই বিধানকে প্রয়োগ করে বস্তুকে সে নতুনভাবে গঠনও করছে। এর পরে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের অবকাশ থাকে না।”

hassangorkii@yahoo.com

জুলাই ১৮, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।