হাসান গোর্কি : সিদ্ধার্থ ঋষিন: এই মহাবিশ্বের উদ্দেশ্য কী বলে আপনার মনে হয়?
সঞ্জিব পুরোহিত: হলি স্ক্রিপচারগুলো থেকে আমরা যা পাই তার বাইরে গিয়ে যদি কিছু বলতে বলেন তাহলে অনুমান করে বলতে হবে। তারচেয়ে বরং বলা ভালো আমরা বিষয়টা জানি না। আর যদি আমার ব্যক্তিগত ধারণা জানতে চান তাহলে বলবো, মহাবিশ্বের কোনো উদ্দেশ্য নেই।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: তাহলে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, গ্রীষ্ম-বর্ষা, আলো-অন্ধকার, দুঃখ-আনন্দ, কুঁড়ি-কিশলয়, ভূভাগ- মহাকাশ, জন্ম-মৃত্যু- এতো সব কিছু আছে কেনো? যেমন ধরুন, মাতৃগর্ভে একটা ভ্রূণের উদ্দেশ্য শিশু। শিশুর উদ্দেশ্য পূর্ণাঙ্গ মানব।
সঞ্জিব পুরোহিত: আচ্ছা, এবার পূর্ণাঙ্গ মানবের উদ্দেশ্য বলুন।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: পুণ্য অর্জন করে মৃত্যু বরণ করা, যাতে স্বর্গে যাওয়া যায়।
সঞ্জিব পুরোহিত: স্বর্গ বলে কিছু আছে সেটা আমরা নিশ্চিত হবো কী করে? গত দিনের আলোচনায় তো বলেছিলেন, আপনি অন্ধভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: হ্যাঁ, বলেছি। স্বর্গেও অন্ধভাবে বিশ্বাস করি। আসলে বিশ্বাসের জন্য কোনো যুক্তি বা প্রমাণের দরকার নেই। কিছু বিশ্বাস আমাদের সত্তার এতো গভীর থেকে উৎসারিত যে তাকে সত্য মানার জন্য প্রমাণ লাগে না। Dr. Wayne Dyer এর লেখা Your Sacred Self বইয়ের রূপক-কাহিনী Conversation in the Womb – A Parable of Life After Delivery পড়েছেন?
সঞ্জিব পুরোহিত: না। আপনি কি সংক্ষেপে সেটা আমাকে বলবেন?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এখানে পুরোটা দেখুন- এক মায়ের গর্ভে দুই জমজ বাচ্চা ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে:
১ম বাচ্চা: তুমি কি প্রসবের পরের জীবনে বিশ্বাস করো?
২য় বাচ্চা: অবশ্যই, কেন নয়! প্রসবের পর অবশ্যই কিছু থাকতে হবে। এরকম হতে পারে যে পরে আমরা কী হবো এখানে তার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
১ম: দূর বোকা! প্রসবের পর কোনো জীবন নেই। সেই জীবন কী ধরণের হবে?
২য়: আমি জানি না। কিন্তু সম্ভবত এখানকার চেয়ে সেখানে বেশি আলো থাকবে, আমরা পা দিয়ে হাঁটবো, মুখ দিয়ে খাবো এবং আমাদের অন্য কিছু অনুভূতি থাকবে যেগুলো আমরা এখানে বুঝতে পারছি না।
১ম: এটা উদ্ভট ধারণা। হাঁটা অসম্ভব। আর মুখ দিয়ে খাওয়া? হাস্যকর! আমাদের পুষ্টি ও অন্য যা কিছু দরকার তা সরবরাহ করে নাভিরজ্জু। কিন্তু এটি খুব-ই ছোট। অতএব, প্রসবের পরের জীবন যৌক্তিকভাবেই বাতিল হয়ে যায়।
২য়: আমি মনে করি সেখানে কিছু আছে এবং হতে পারে যে আমাদের এখানকার থেকে সেটা আলাদা। নাভিরজ্জুর সেখানে দরকার-ই হবে না।
১ম: নিরর্থক! পরে যদি আবার একটা জীবন থেকে-ই থাকে তাহলে সেখান থেকে কেউ ফিরে এসে সেটা কখন-ই বলেনি কেন?
২য়: সেটা আমি জানি না। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আমরা সেখানে মা-র সাথে মিলিত হবো এবং তিনি আমাদের যত্ন নেবেন।
১ম: মা? তুমি কি সত্যি-ই মা-তে বিশ্বাস করো? এটা হাস্যকর। মা যদি থেকেই থাকেন তাহলে তিনি এখন কোথায়?
২য়: তিনি আমাদের ঘিরে আছেন। আমরা তাকে দিয়ে পরিবেষ্টিত। আমরা তাঁর-ই। আমরা তাঁর মধ্যে বাস করি। তিনি ছাড়া এই জগৎ অস্তিত্বময় থাকতো না।
১ম: তাকে আমি দেখি না। সুতরাং, এটাই একমাত্র যুক্তিযুক্ত চিন্তা যে তিনি নেই।
২য়: যদি তুমি নীরব থাকো, মনোযোগ দাও এবং শোনো তাহলে তুমি তাঁর উপস্থিতি অনুধাবন করবে, তাঁর দয়ার্দ্র কণ্ঠস্বর শুনবে।
সঞ্জিব পুরোহিত: শুনতে খুব-ই ভালো লাগলো। এই গল্প থেকে আপনি কি কোনো বার্তা দিতে চাচ্ছেন?
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/06/Bk-15.jpg?resize=774%2C500&ssl=1)
সিদ্ধার্থ ঋষিন: হ্যাঁ, ঐ শিশুরা যেমন মায়ের গর্ভে বসে মা এবং বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্ব বুঝতে পারছে না, তেমনি আমরাও ঈশ্বর এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব বুঝতে পারছি না।
সঞ্জিব পুরোহিত: ‘শিশুরা’ বলছেন কেনো! দ্বিতীয় শিশু তো অনুমান করে সব-ই বুঝে ফেলেছে। মা ইলিশের পেটে গড়ে ৫ থেকে ১২ লক্ষ ডিম থাকে। ধরুন, এদের দুজন কথা বলছে:
১ম ডিম: আচ্ছা, আমাদের জীবন কি এই অন্ধকার গহŸরেই শেষ হয়ে যাবে?
২য় ডিম: আমার মনে হয় আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আমরা বিশাল এক স্রোতস্বিনীতে যাবো। নার্সিং গ্রাউন্ডে মা আমাদের পরিচর্যা করবেন। আমরা ডিম থেকে বের হয়ে বাচ্চা হবো। বড় হবো। এরপর এক সময় আমাদের মাকে জেলেরা ধরে নিয়ে যাবে। মানুষ মাকে রান্না করে খাবে। পরে আমরা বড় হলে আমাদেরও জেলেরা ধরে নিয়ে যাবে এবং রান্না করে খেয়ে ফেলবে। আমাদের প্রকৃত জীবন সেটাই।
১ম ডিম: ‘স্রোতস্বিনী’ ‘মা’ ‘তরল’ ‘পান’ ‘সাঁতার’ ‘সেপ্টেম্বর-অক্টোবর’, ‘নাসিং গ্রাউন্ড’, ‘জেলে’, ‘রান্না’, ‘জীবন’ এই শব্দগুলোর কোনো টির অর্থ-ই আমি বুঝিনি।
২য় ডিম: যদি তুমি নীরব থাকো, মনোযোগ দাও এবং শোনো তাহলে তুমি মা-র উপস্থিতি অনুধাবন করবে, তাঁর দয়ার্দ্র কণ্ঠস্বর শুনবে। বাকি শব্দগুলোর অর্থ তুমি কিছুদিন পর জানবে।”
আমার প্রশ্ন হলো Dr. Wayne Dyer-র গল্পের দ্বিতীয় বাচ্চা এবং আমার গল্পের দ্বিতীয় ডিম এই বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হলো কীভাবে? যে অনুমানের সম্ভাবনা কয়েক মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বা প্রায় শূন্য তা দ্বিতীয় বাচ্চা এবং দ্বিতীয় ডিমের মস্তিষ্কে এলো কেন? এরকম অনুমান তো শুধু দ্বিতীয় ঈশ্বরের পক্ষে-ই করা সম্ভব। আমার মনে হয়, Dr. Wayne Dyer এবং ড. সঞ্জিব পুরোহিতের মস্তিষ্কের বাইরে গল্প দুটোর কোনো সারবত্তা নেই!
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনার গল্পটিও চমৎকার, যা একটা স্বপ্নের জগত তৈরি করে আমাদের পারমার্থিক তৃষ্ণা (spiritual thirst) মেটায়।
সঞ্জিব পুরোহিত: “রাজ স্বপ্নে অর্থ নাই, যতো মাথা খুঁড়ি।” ‘অর্থ’ বলতে আমি উদ্দেশ্য বুঝাতে চাচ্ছি। চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন সবাই নিজের মতো আছে। ধূলিকণা, প্রস্তরখণ্ড, চাঁদ, পৃথিবী, আপনালয়ে উদাসীন।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: ধূলিকণা আমাদের পৃথিবীকে একটা ভৌত কাঠামো দিয়েছে, চাঁদ রাতের অন্ধকারে আমাদের পথ দেখায়, পৃথিবী প্রাণীদের আবাসস্থল।
সঞ্জিব পুরোহিত: চাঁদ উদিত হয় বলে আমরা পথ দেখি; আমাদের পথ দেখানোর জন্য সে উদিত হয়, এটা কল্পনাবিলাস। আমাদের পথ দেখানোর জন্য চাঁদ উদিত হলে শুক্লপক্ষ থাকতো না। সৌরজগতের বাকি ৮টি গ্রহের কাজ কী? ইউরেনাসের ২৭, বৃহস্পতির ৬৭, শনির ৫৫টি উপগ্রহের কাজ কী? এগুলো তো বিশাল অপচয় ছাড়া কিছু-ই নয়!
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এগুলোতে কোনো সুদূর অতীতে হয়তো প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো অথবা ভবিষ্যতে কখনও উদ্ভব ঘটবে। অথবা এগুলো শুধু-ই এই সৌরমণ্ডলের অলঙ্করণ। আমরা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে ঘরে আলোর প্রয়োজন মেটাই। কেউ কেউ ঝাড়বাতি ঝুলাই, যা আলোর প্রয়োজন মেটানোর সাথে সম্পর্কিত নয়। স্নানের জন্য আপনার দুই বালতি জল-ই যথেষ্ট। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আপনি দুই একর জমির ওপর পুকুর তৈরি করে সেখানে ঘাট বেঁধে রেখেছেন। এটাকে অপচয় বলা যাবে। কিন্তু আপনি যদি অসীম পরিমাণ জমির মালিক হয়ে থাকেন তাহলে তা থেকে এক একর, এক ট্রিলিয়ন একর বা লক্ষ কোটি ট্রিলিয়ন একর জুড়ে একটা পুকুর খুঁড়লে আপনার জমির পরিমাণ কমবে না, সমান-ই থাকবে। ঈশ্বরের হাতে অসীম পরিমাণ পদার্থ আছে, তাঁর ক্ষমতাও অসীম। সেকারণে তিনি অনেকটা খেয়ালের বসে এসব তৈরি করতে থাকেন।
সঞ্জিব পুরোহিত: বিষয়টা কি এরকম হতে পারে না যে মহাবিশ্বের এই বিশাল প্রান্তর জুড়ে কার্যকর আমাদের বোধের অতীত কোনো বিধি-ই সবকিছু সৃষ্টি করেছে এবং চালাচ্ছে?
সিদ্ধার্থ ঋষিন: অনেক কিছু-ই হতে পারে। কিন্তু কী ঘটে থাকার সম্ভাবনা বেশি তা বুঝতে গেলে আমাদের কিছু দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করতে হবে। যেমন সহজ একটা প্রশ্ন করি- আমরা কোথায় থেকে এসেছি?
সঞ্জিব পুরোহিত: আমরা এসেছি মায়ের গর্ভ থেকে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: মায়ের গর্ভে কোথায় থেকে এসেছি?
সঞ্জিব পুরোহিত: বাবা-মা’র শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট ফর্ম করেছে; সেখান থেকে শিশু হয়ে আমরা পূর্ণাঙ্গ মানবের রূপ নিয়েছি।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: জনাব পুরোহিত, আমি নিশ্চিত যে আপনি আমার সাতে মস্করা করছেন। আপনি জানেন, আমি আপনার কাছে ভ্রূণ তত্তে¡র শিক্ষা চাইনি। আমি জানতে চেয়েছি ঐ ভ্রূণের মধ্যে যে আত্মা অধিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা কোথায় থেকে এসেছে।
সঞ্জিব পুরোহিত: আপনার প্রশ্নে আপনি ‘আত্মা বলে একটা কিছু আছে’ এই ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে আমার কাছে জানতে চাচ্ছেন সে কোথায় থেকে এসেছিল। আমি তো বলিনি যে আত্মা বলে কিছু আছে! আসা না আসার প্রসঙ্গ আসছে কেন! আত্মা বলে কিছু আছে কিনা সেটা আমি জানি না।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: এটা আমি বিশ্বাস করি, কারণ আমি তার উপস্থিতি টের পাই।
সঞ্জিব পুরোহিত: ব্যাকটেরিয়া, বাবুই পাখি, শিম্পাঞ্জি-ও হয়তো তাদের জৈবিক সত্তার উপস্থিতি টের পায়।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: তাদের এই জৈবিক সত্তাকে যদি আমরা আত্মা বলি তাহলে সমস্যা কোথায়?
সঞ্জিব পুরোহিত: আমি বিলিনি সমস্যা আছে। আমরা বাসের নাম দেই ‘মায়ের দোয়া’। বাস তো লোহা, টিন, কাঠ দিয়ে তৈরি। আর ‘দোয়া’ তো অশরীরী কিছু। জৈবিক সত্তাকে ‘আত্মা’ বলে মেনে নিলে বরং বিতর্কের অবসান হয়। একটা জৈব- রাসায়নিক সংগঠনের চেতন কার্যপ্রণালীকে আপনি যে নামেই-ই ডাকুন তাতে আধিদৈবিক বা স্পিরিচুয়াল কিছু এসে ভর করবে না।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: স্পিরিচুয়াল কিছু যে আছে সেটা আমি আপনাকে দেখাতে পারবো না। আর যা আমাদের ইন্দ্রিয় সীমায় আসে, সংজ্ঞা অনুযায়ী তা স্পিরিচুয়াল নয়। ভালোবাসা, দুঃখ, ক্ষোভ, সৌন্দর্যবোধ, সহমর্মিতা— এই বোধগুলোর প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তা কোথায় থাকে তা আমরা দেখতে পাই না।
সঞ্জিব পুরোহিত: এগুলো আমাদের মস্তিষ্কে থাকে। প্রত্যেক ধরণের বোধের জন্য আলাদা হরমোন আছে। ওষুধ খেয়ে আপনি আপনার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন থিয়ানাইন বা গ্লুটাথিয়ন ক্যাপসুল খেলে আপনার সুখের অনুভূতি তৈরি হবে। আবার চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে আপনার সব অনুভূতিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা যাবে। আমাদের অনুভূতির ধরণ স্পিরিচুয়াল হলে তার তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারার কথা। প্রকৃতির সবকিছুতে ভৌত বিজ্ঞান কাজ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্পিরিচুয়াল মানুষ বাস করে ভারত উপমহাদেশে। এ অঞ্চলে একর প্রতি ধানের উৎপাদন জাপানের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। সবচেয়ে কম স্পিরিচুয়াল মানুষ যে দেশগুলোতে বাস করে তার শীর্ষ পাঁচে আছে জাপান। মন্ত্র জপ করে ফুঁ দেওয়ার চেয়ে ধান উৎপাদনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জমিতে প্রয়োজনীয় জল, সার, কীটনাশক, প্রয়োগ করা।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনি বারবার কিছু স্থুল উদাহরণের দিকে চলে যাচ্ছেন। মন্ত্র জপ করার সাথে আমি স্পিরিচুয়ালিটিকে মেলাইনি। প্রাণের ক্ষুদ্রতম ইউনিট কোষকে আপনি শুধু-ই একটা জৈব যৌগ ভাবছেন। ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। কোষেও প্রাণের নমুনা আছে। এরা জীবদেহের গঠন, বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ ও বংশগতিমূলক তথ্য বহন করে। মানুষের শরীরের কোষকেন্দ্রে যে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে তা ডিএনএ-র রাসায়নিক অণু দিয়ে গঠিত। প্রত্যেক ক্রোমোজোমে একটা করে ডিএনএ অণুর দীর্ঘ শৃঙ্খল থাকে, যা জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। ডিএনএ অণুর বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন বংশগতীয় বৈশিষ্ট্যের বাহক। এই বংশাণু (জিন) গুলো কীভাবে এবং বিশেষত কেনো (আবার বলছি ‘কেনো’) বংশগতির নির্দেশ ধারণ করে তা বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়। এমন হতে পারে যে এটা একটা স্পিরিচুয়াল অর্ডার। আমি কম্যান্ড বা আদেশ অর্থে ‘অর্ডার’ বলছি।
সঞ্জিব পুরোহিত: লুই পাস্তুর মত প্রকাশ করেছিলেন যে, জীবন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হতে পারে। তাঁর এই তত্ত¡ ‘generatio spontanea’ হিসেবে পরিচিত। পরে (১৬৬৮ সালে) ফ্রানসেস্কো রেডির একটি পরীক্ষা থেকে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। আবার দেখুন কিছু ভাইরাসের আরএনএ জিনোম আছে, কিন্তু ভাইরাসকে ‘জীবন্ত প্রাণ’ হিসেবে ধরা হয় না।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: আমরা আলোচনার সূচনা বিন্দু থেকে বহু ক্রোশ সরে এসেছি। আপনি বলেছিলেন মহাবিশ্বের কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমাদের চেনা প্রকৃতি ও প্রাণেরও উদ্দেশ্য নেই। এরকম একটা ভৌত ঘটনার উদাহরণ দিন যেখানে আমরা উদ্দেশ্য দেখতে পাই না।
সঞ্জিব পুরোহিত: উদ্দেশ্য নেই সেটা আমি দাবি করতে পারি না; আমি আপনার কথার পৃষ্ঠে ঝোঁকের বসে ওরকম বলেছি। আমি বলতে চাই প্রকৃতি ও প্রাণের যে কোনো উদ্দেশ্য আছে তার অনুধাবনযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। আর উদ্দেশ্য আছে বলে আপনি যে দাবি করছেন তার ভিত্তি আপনার অনুমান। এই অনুমান ভুল না সঠিক সেটা আমরা জানি না। আমি দুটি ঘটনা বলি; আপনি তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করুন- (১) এই মুহূর্তে আর্কটিক গেøসিয়ার থেকে এক মিলিয়ন টনের একটা বরফখণ্ড ভেঙে পড়লো, (২) ঢাকার রাস্তায় দুই বছরের একটা শিশু মায়ের কোল থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হলো।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: বরফখণ্ডটা ভেঙে পড়ে আর্কটিক সাগরে পানির যোগান বাড়ালো। শিশুর মৃত্যু সকল মায়ের সচেতনেতা বৃদ্ধি করলো, যাতে ভবিষ্যতে এরকম দুর্ঘটনার মাত্রা কমে যায়।
সঞ্জিব পুরোহিত: জল জমে-ই তো বরফ হয়েছে। জল না জমলে তো উদ্দেশ্য আগে-ই সফল হয়ে থাকতো। শিশু মৃত্যুর একটা যুক্তিও আপনি দিলেন। এগুলোকে বলা হয় চক্রাকার যুক্তি (সার্কুলার লজিক), যারা পরস্পরকে প্রত্যয়ন করে। আপনারা বিশ্বাস করেন হনুমান সূর্য গিলে ফেলেছিল। আপনাকে যখন জিজ্ঞেস করা হবে সেটা আপনি জানলেন কী করে তখন আপনি বলবেন, “এটা রামায়নে লেখা আছে।” আবার যদি জিজ্ঞেস করা হয়, রামায়ন যে সত্য বলছে সেটা কীভাবে নিশ্চিত হলেন, তখন আপনি বলবেন, “ঋষি বাল্মীকি স্বয়ং রামায়নে এটা লিখেছেন।” আর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাল্মিকী যে সত্য লিখেছেন সেটা নিশ্চিত হলেন কী করে, তখন আপনি বলবেন, “তিনি যে সত্য লিখেছেন সেটা তো রামায়নে-ই বলা আছে। তাছাড়া ‘মহাভারতে’ও মহাবীর হনুমানের কাহিনী একইভাবে এসেছে।” খেয়াল করে দেখুন এখানে আপনার সবগুলো যুক্তি-ই পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখে।
সিদ্ধার্থ ঋষিন: চক্রাকার বা বক্রাকার কোন যুক্তিতে আমি যেতে চাই না। কারণ, দিনশেষে যুক্তিগুলোও এক ধরণের বিশ্বাস। আমার মনে হয় অসীম মহাবিশ্ব, আমাদের চেনা রহস্যেঘেরা প্রকৃতি, মানুষ, ক্ষুদ্র অণুজীব, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, গোলাপের পাপড়ি, মেঘমালা, বহতা নদী, শিশুর হাঁসি, মায়ের মুখ, ঈগল, পদ্ম গোখরো, তন্দ্রা, বৃষ্টিপাত- সবকিছুর উদ্দেশ্য আছে, যা আমাদের অজ্ঞাত কোনো কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়।
সঞ্জিব পুরোহিত: অপূর্ব ভাবনা। অকারণ যুক্তি না খুঁজে আপনার মতো করে বিশ্বাস করতে পারলে সকলের জন্য-ই তা অনেক সুখকর হতো।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।