হাসান গোর্কি : সিদ্ধার্থ ঋষিন: সংবাদপত্রে পড়লাম সুন্দরবনে এক বাওয়ালি তার ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিল। সে গাছে উঠলে বাঘ তার শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে গহিন জঙ্গলের দিকে যেতে থাকে। বাওয়ালি বাঘকে লাঠি নিয়ে আক্রমণ করে। বাঘ ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে লোকটাকেই ধরে নিয়ে যায়। কী সাংঘাতিক আত্মত্যাগ!
ইচক দুয়েন্দে: হ্যাঁ, খবরটা আমিও পড়েছি। এরকম ঘটনা প্রাণী জগতেও ঘটে। কয়েকদিন আগে ইউ টিউবে একটা ভিডিয়ো দেখলাম। কেউ একজন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের কোন এক পর্ব থেকে কেটে ফেসবুকে দিয়েছে — একটা হরিণ শাবক নদী পার হচ্ছিল। একটা কুমির তাকে তাড়া করেছে। মা হরিণ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুমিরের সামনে গিয়ে সাঁতার বন্ধ করে দিলো। কুমির মা-হরিণটাকে খেয়ে ফেললো। বাবু হরিণ সাঁতরে তীরে উঠে গেলো।
ঋষিন: ঘটনা দুটি একরকম নয়। মানুষ যা কিছু করে তার সব-ই কয়েকটি সুশৃঙ্খল ও পর্যায়ক্রমিক চিন্তন-প্রক্রিয়া পার করে করে। সে কাজটার প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ এবং নিরাপত্তার স্তর বিশ্লেষণ করে করা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে লোকটা ঝুঁকি নেওয়া উপযুক্ত মনে করেছে। অন্যদিকে আবেগতাড়িত মা-হরিণ নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে সন্তানকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে লোকটা ব্যবহার করেছে তার আবেগ, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তা। মা-হরিণ ব্যবহার করেছে আবেগ ও প্রবৃত্তি।
ইচক: ঐ ভিডিয়োতে আমি যেটা দেখলাম মা-হরিণ নিজেকে কুমিরের মুখে তুলে দিয়েছে যাতে কুমিরটা বাবু-হরিণকে ছেড়ে দেয়। এটা নিজেকে বিসর্জন দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু ছিল বলে মনে হয়নি। মানুষ ও অন্য প্রাণীর আবেগ-অনুভূতি একই রকম। পার্থক্যটা ডিগ্রীতে। এই হরিণ-শাবক তার মাকে হারানোর বেদনা বেশিদিন মনে নাও রাখতে পারে। কিন্তু বাওয়ালির ছেলে হয়তো ঘটনাটা সারাজীবন মনে রাখবে। আমি একটা বিষয় বুঝিনি, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন অন্য প্রাণীরা শুধু প্রবৃত্তি (instinct) দিয়ে চলে?
ঋষিন: ঠিক তা-ই। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি গ্রীষ্মকালে গঙ্গার জল শুকিয়ে গেলে গাংচিল পাড়ের মাটি খুঁড়ে বাসা বাঁধে। পাখি-বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের এভাবে গৃহ নির্মাণের পদ্ধতি মিলিয়ন বছরের পুরনো। এর অনেক পরে যাত্রা শুরু করে মানুষ ১৪৫ তলা বিল্ডিং তৈরি করে ফেলেছে। আর গাংচিল ছোট খাটো একতলা একটা বিল্ডিং বানাতে পারেনি। কোকিল তার সুরেলা কন্ঠে একটা গান বাঁধতে পারেনি।
ইচক: আমরা ভাবছি প্রাণীরা শুধু-ই প্রবৃত্তি দিয়ে চলে। ব্যাপারটা সেরকম নয়। আসলে মানুষের তুলনায় অন্য প্রাণীদের বুদ্ধির স্তর এতোটা কম যে সেটাকে আমরা ‘প্রবৃত্তি’ বলে ভ্রম করি। আমি নিজে টিউবওয়েল চেপে গরুকে জল পান করতে দেখেছি। সেদিন দেখলাম একটা টিয়া পাখি ট্যাপ খুলে গোসল করছে। যতবার বন্ধ করে দেওয়া হয়, ততোবার সে ঠোঁট দিয়ে ট্যাপ খোলে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটা তার চিন্তার ফল; প্রবৃত্তি নয়। আপনাকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ প্রচারিত একটা ভিডিয়ো দেখাই
(https://www.youtube.com/watch?v=ciBw_2RotwI&t=8s)। মুম্বাই রেলস্টেশনে এই কুকুরটি কয়েক মাস যাবৎ তার মালিকের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে। মালিক যে মারা গেছে সেটা সে জানতো না।
ঋষিন: হ্যাঁ, ভিডিয়োটি আমি দেখেছি। মালিক বিকেলের দিকে ট্রেনে ফিরতো। কুকুরটা অভ্যাসবশত বিকেলের ট্রেনগুলো চেক করতো। এখানে তার বুদ্ধিমত্তা কাজ করেনি। কাজ করেছে স্মৃতি ও অভ্যাস। আর গরু ও টিয়াপাখির ক্ষেত্রে কাজ করেছে তাদের বীক্ষণ ও অনুকরণ। তারা মানুষকে যা করতে দেখেছে সেটা অনুসরণ করেছে। এগুলো তাদের নিজের বুদ্ধি থেকে উদ্ভাবিত কাজ নয়।
ইচক: মানুষ যা করে সেটাও তার বীক্ষণ ও অনুকরণ। সামান্য একটা চাকা তৈরি করতে মানুষ এক লাখ বছরের বেশি ব্যয় করেছে। প্রতœতত্ত¡বিদদের ধারণা ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে প্রথম চাকার ব্যবহার শুরু হয়। গোলাকৃতি কোন বস্তুকে যে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সেটা মানুষ আগে থেকেই জানতো। বানর, শিম্পাঞ্জি, গুবরে পোকা- এরাও এই কৌশল জানে। কিন্তু এই কৌশলকে বহুমুখী করে ব্যবহার করার জন্য যে বুদ্ধির দরকার সেটা তাদের নেই। এর আগে থেকে মানুষ প্রাকৃতিক উৎস, যেমন বজ্রপাত, থেকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা আগুনের ব্যবহার জানতো। ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল দিয়াশলাই আবিষ্কার করেন। কিন্তু এর বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কিছুকাল আগে, ১৯১১ সালে- যখন একটি আমেরিকান কোম্পানি ফসফরাস ও গন্ধকের একটি নির্বিষ যৌগ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। সকল প্রাণীর অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ এক সাথে শুরু হলেও মানুষ এগিয়ে গেছে। প্রাইমেট থেকে মানুষ এসেছে ৬০ লাখ বছর আগে। তখন থেকে তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়তে শুরু করেছে, এখনও হয়তো সেটা অব্যাহত আছে।
ঋষিন: এটা বহুল চর্চিত ইতিহাস। জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যদি প্রাইমেট থেকে মানুষ এসেও থাকে তাহলে সেটা ছিল একটা বড় পরিবর্তন। সেটা ঘটলো কেনো?
ইচক: আমি এটাকে ছোট পরিবর্তন বলিনি। প্রাইমেট থেকে শিম্পাঞ্জি, ওরাং ওটাং ও গরিলার বিবর্তনও বড় পরিবর্তন। এর চেয়ে বহুগুণ বড় পরিবর্তন এক কোষী প্রাণীর বহু কোষী প্রাণীতে রূপান্তর।
ঋষিন: বিবর্তন তত্ত¡ দিয়ে আমরা মানুষ এবং অন্য প্রাণীর জৈবিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যা করতে পারি। কিন্তু অনুভূতির জটিল স্তরকে বুঝতে পারি না। যেমন মানুষের ভালবাসা, ঘৃনা, লোভ, ক্রোধ, স্বজ্ঞা পুরোপুরি জৈবিক নয়; বরং অনেকাংশে-ই চেতনাগত।
ইচক: এই বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য প্রাণীরও আছে। শুধু স্তরটা ভিন্ন। স্তর বলতে আমি ডিগ্রী বুঝাচ্ছি।
ঋষিন: আমি বিষয়টা আরও সহজ করে দিই। ধরুন, আপনি একটা সমুদ্রের পাড়ে বসে আছেন। সামনে সীমাহীন নীল জলরাশি। বহুদূর থেকে ছুটে এসে উচ্ছ¡সিত ধবল-ফেনিল ঢেউয়ের দল আপনার পায়ের কাছে গম গম শব্দে ভেঙে পড়ছে। তখন আপনার যে অনুভূতি হবে সেটা কোন রিফ্লেক্স নয়। এর সাথে আপনার অনেক কল্পনা মিশে যাবে। অনেক ভিন্ন চিন্তা যোগ হবে। প্রিয় মানুষের কথা মনে পড়তে পারে, অতীতের ভালো মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়তে পারে। আপনি তো অনেকবার নেপালে ট্রেকিং এ গেছেন। একবার আপনার সাথে আমিও ছিলাম। দেউরালিতে আমরা একটা কাঠের বাংলোতে রাত্রিযাপন করেছি। আপনি আর আমি দুই হাজার ফুট খাড়া ঢালের ওপর ঝুলে থাকা বারান্দায় বসে ছিলাম। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ ছিল। আপনি বললেন গিবাসের চেয়ে ওয়েনিং মুন আপনার বেশি পছন্দ। আপনি ইউ টিউবে পিটার হিমেলম্যানের ওয়েনিং মুন গানটা শুনছিলেন। আমিও বিমোহিত হয়ে শুনছিলাম। সে সময় আপনার অনুভূতি কেমন ছিল জানি না। আমার মনে হচ্ছিল আমি এমন একটা সত্তা যে শরীরের বাইরে বাস করছি।
ইচক: আপনি মহান! সেই স্বপ্নময় সময়গুলো আপনি কতোটা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রেখেছেন! এই কল্পনাবিলাসে সুখ আছে, তবে বাস্তবতা নেই। এই কর্কশ কথাটা আমি বলছি একারণে যে আপনি আমাদের সে সময়ের অনুভূতিগুলোকে সত্তার অস্তিত্বের সাক্ষ্য হিসেবে আলোচনার উপাদানে যোগ করতে চাচ্ছেন। আপনি জানেন, সঙ্গীতের ধ্বনি আপনার কর্ণছত্র, কর্ণকুহর, কর্ণপটহ, মেলিয়াস, ইনকাস, কর্ণপটহ ও স্টেপিস হয়ে অন্তঃকর্ণ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং সবশেষে তা মস্তিষ্কের কোষে পৌঁছে যায়। মস্তিস্ক মেলোডি রিড করতে পারে। ফলে আপনি শান্তি পান। শরীরের বাইরে বাস করা একটা কল্পনাবিলাস। মন বা চেতনা বলে আলাদা কিছু নেই। থাকলে আপনি ঘুমন্ত অবস্থায়ও গান শুনে শান্তি পেতেন। আমাদের কোন অনুভূতি-ই শরীর নিরপেক্ষ নয়। সব অনুভূতির জন্য দায়ী হরমোন আছে। অনুভূতি বায়বীয় কিছু নয়। আমরা যদি দেখতাম কোন মানুষের মাথার মধ্যে কলিজা আছে, কিন্তু তার সব অনুভূতি ঠিকঠাক কাজ করে তাহলে নিশ্চিত হতাম যে অশরীরী সত্তা বলে কিছু আছে।
ঋষিন: আমি বলিনি যে চেতনা বা চিত্ত, যাকে আমরা সংবেদী সত্তা বলি তা আমাদের জৈবিক কাঠামোর বাইরে থাকে। ধরুন আপনি ড্রইং রুমের দেওয়ালে টানানো মোনালিসার ছবি দেখছেন। তার রহস্যময় অভিব্যক্তিটি সুখ, দুঃখ নাকি বিদ্রুপের তা বুঝতে চেষ্টা করছেন। এর জন্য আপনার দর্শনেন্দ্রিয়ের দরকার হবে, ছবিটির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের জন্য মস্তিষ্কের সেলের সাহায্যের দরকার হবে। কিন্তু তা থেকে আনন্দ-দুঃখ-বেদনার অনুভূতি পাবার জন্য চিত্তের দরকার হবে।
ইচক: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আমাদের জৈবিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে অতীন্দ্রিয়, লোকোত্তর বা বোধাতীত একটা কিছু অস্তিত্বময় থাকে এবং তা-ই আমাদের চিন্তার জগত নিয়ন্ত্রণ করে?
ঋষিন: হ্যাঁ, সেরকম হতে বাধা কোথায়? ধরুন আপনার গ্রামবাসী একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে একজন অধ্যক্ষ নিয়োগ দিলো। কলেজ তো তিনি-ই চালাবেন।
ইচক: স্থূল উদাহরণ। গ্রামবাসী মানুষ। অধ্যক্ষও মানুষ। গ্রামবাসী যদি অধ্যক্ষ হিসেবে একটা অদৃশ্য জিন নিয়োগ করতো তাহলে আপনার উদাহরণ ঠিক ছিলো। কোন মানুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত হবার আগেই তারা জীবন্ত সত্তা। তারা ততোক্ষণে জৈব যৌগের স্তর পার হয়ে এসেছে। জাইগোটে রূপান্তরিত হবার পর তারা জীবনের একটা পূর্ণাঙ্গ এককের মতো কাজ করতে শুরু করে। তারা অধ্যক্ষ ডাকতে যাবে কেনো? শূন্য থেকে চিত্ত নামের কাল্পনিক একটা শক্তিকে কিসের প্রয়োজনে ডেকে আনবে? প্রথম কথা হলো, চিত্ত ছাড়াই প্রাণীদের আচরণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। চিত্তকে আপনি হয়তো জীবাত্মা বলে পরিচিত ধারণার সাথে মেলাচ্ছেন। আত্মা বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেটা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আর থেকে থাকলেও সেটা শতভাগ নিষ্ক্রিয় একটা কিছু।
ঋষিন: আমি চিত্তের আলোচনায় থাকতে চাই। আমরা যা চিন্তা করি তা শুধুই জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া হবার কথা নয়। যেমন ধরুন আপনি আপনার রাজশাহী শহরের বাড়িটা ভেঙে একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোর বানাতে চান এবং পদ্মা পাড়ের যে টং দোকানে আপনি বৈকালিক ভ্রমনের সময় চা পান করেন তার মালিকের ছোট মেয়ের জামাইকে একটা রিকশা কিনে দিতে চান। খেয়াল করে দেখুন এসময় আপনি কাজগুলো করা উচিত কি, উচিত নয় সে বিষয়ে নিজের সাথে কথা বলেছেন। সেটা অনেকটা অন্য একজনের সাথে আলোচনা করার মতো-ই। আমি বলতে চাচ্ছি, এই চিন্তন প্রক্রিয়া শুধু-ই জৈব- রাসায়নিক বিক্রিয়া হবার কথা নয়।
ইচক: আপনি বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমরা নিজের সাথে কথা বলি। তাহলে তো আমাদের মধ্যে দুটি চিত্ত আছে, যারা পরস্পর কথা বলে। আসলে আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়া একটা জৈব- রাসায়নিক বিক্রিয়া ছাড়া কিছু-ই নয়। বিক্রিয়াগুলোর ফলাফল ধারাবাহিকভাবে আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে। প্রয়োজন হলে এই ফলাফলগুলোর মিথস্ক্রিয়া নতুন ফলাফলের জন্ম দেয়। ঐ চায়ের দোকানে সময় কাটানোর সময় দোকানীর পরিবারের যে দুর্দশা আমি প্রত্যক্ষ করেছি সেটা আমার মস্তিষ্কে সংরক্ষিত আছে। আমি যখন বাড়িতে বসে আছি তখন সংরক্ষিত বিভিন্ন তথ্য এলোমেলোভাবে সক্রিয় হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীগুলো সক্রিয় হবার সম্ভাবনা বেশি। ঐ দোকানীর দুর্দশার ঘটনা যদি বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে তাহলে মস্তিষ্কের যে কোষগুলোতে তা জমা আছে তারা সক্রিয় হবে। আমার ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে, দোকানী সৎ, গরীব ও আর্থিক অনুদান পাবার উপযুক্ত, মানুষকে সাহায্য করা ভাল কাজ — এই তথ্যগুলো অন্য কিছু কোষে সংরক্ষিত আছে। এই কোষগুলোর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া (অন্য কথায় জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া) নতুন ফলাফলের জন্ম দেবে। সেটা হলো দোকানীর মেয়ের জামাইকে রিকশা কিনে দেওয়ার ইচ্ছা।
ঋষিন: একমত হতে পারছি না ড. দুয়েন্দে। আপনি বললেন, “মানুষকে সাহায্য করা ভাল কাজ — এই তথ্য আমাদের মস্তিষ্কে সংরক্ষিত আছে।”এই নৈতিকতার বোধ আমাদের মস্তিষ্কে এলো কীভাবে? আমরা কিছু কাজকে কল্যাণকর মনে করি, যেমন সত্য বলা, সহানুভূতিশীল থাকা, অন্যকে সাহায্য করা, এসব। আবার চুরি করা, মিথ্যা বলা, কাউকে খুন করা আমাদের দৃষ্টিতে অকল্যাণকর। আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বলছি। আপনি যদি বলেন, এটা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে তাহলে ভুল হবে। দুই বছরের শিশুর সামনে যদি একটা মানুষকে জবাই করা হয় বা কেউ যদি তার কাছে ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে যেতে থাকে তাহলে সে তা পছন্দ করবে না। আপনি যদি তার সামনে হাতুড়ি দিয়ে টেলিভিশন ভেঙে ফেলেন, আর্থিক ক্ষতির বিষয় না বুঝেই সে তা অপছন্দ করবে।
ইচক: আপনি চিত্তের আলোচনায় থাকতে চেয়েছিলেন। এখন প্রসঙ্গের বাইরে চলে গেলেন।
ঋষিন: না। আমি প্রসঙ্গেই আছি। নৈতিকতাবোধের উৎস যদি আমরা জানতে পারি তাহলে চিত্তের উপস্থিতির একটা পরোক্ষ প্রমাণ অন্তত পাওয়া যাবে।
ইচক: কয়েকদিন আগে জন ডি. কনোরের লেখা ন্যাচারাল ল এন্ড এথিক্যাল নন- নিউট্রালিজম শিরোনামে একটা আর্টিকেল পড়লাম। উনি বলতে চেয়েছেন প্রকৃতিতে একটা ‘আনআডেন্টিফাইড ল’ বিরাজ করে। সেটা-ই আমাদের নৈতিকতা বোধের উৎস। আমারও সেরকম-ই মনে হয়। প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে প্রকৃতি নিজেই তার নিজের তৈরি আইন মেনে চলে। আমরা যদি কোন নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দেই তাহলে তার জলধারা সমভূমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়বে। যদি কোন বৃক্ষের জন্য আড়াল তৈরি করি তাহলে সে ফাঁকা জায়গা খুঁজে সেই পথে তার পত্র-পল্লবকে সূর্যের আলোর দিকে ছড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করবে। আমরাও প্রকৃতির অংশ, তাই আমরাও এই সর্বব্যাপ্ত নিয়মের অংশ। প্রকৃতি থেকে যে উপাদানগুলো নিয়ে আমাদের শরীর বা জৈবিক সত্তা গঠিত হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটা-ই কিছু কিছু নিয়মের বাহক। আর তারা যখন একটা ইউনিট হিসেবে কাজ করে তখন প্রকৃতির কিছু নিয়ম তাতে থেকে যায়। এভাবে দেখলে নৈতিকতার বোধ প্রকৃতি থেকেই এসেছে।
ঋষিন: আপনি সম্ভবত স্ববিরোধী কথা বললেন। আপনি বলেছিলেন ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধ্বস, মহামারী, ভূমিকম্প—এসব অন্ধভাবে ঘটে। এতে প্রকৃতির কোন উদ্দেশ্য থাকে না। আমি যতটুকু জানি আপনি প্রকৃতিকে অন্ধ (ব্লাইন্ড) মনে করেন। এখন বলছেন অন্ধ প্রকৃতি থেকেই নৈতিকতার বোধ আসে!
ইচক: আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে। মোটামুটি ৩০ হাজার যন্ত্রাংশ জোড়া দিয়ে একটা গাড়ি বানানো হয়। যন্ত্রাংশগুলোর একটাও নিজে চলতে পারে না। কিন্তু এগুলো যখন এক সাথে কাজ করে তখন গাড়িটি রাস্তায় চলতে পারে। আমি বলেছি প্রকৃতিতে আমাদের নৈতিকতার বোধ সহ সব অলক্ষ্য বা দর্শনাতীত অনুভূতির উপাদান আছে। তারা যখন একটা সংগঠন (প্রাণী বা উদ্ভিদ) তৈরি করে তখন তাতে উপাদানের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নৈতিকতার বোধ তৈরি হয়। একারণে বাঘ ও মানুষের নৈতিকতার বোধ এক রকম নয়।
ঋষিন: বুঝতে আপনারও ভুল হচ্ছে হয়তো। যে উপাদানগুলোর ক্ষুদ্র সমাবেশ মানুষের অনুভূতি তৈরি করে তাদের সীমাহীন বা বিশাল সমাবেশ হলো প্রকৃতি। তাহলে প্রকৃতি অন্ধ কেন? তার নিজেরও তো অনুভূতি থাকার কথা।
ইচক: হতে পারে প্রকৃতিরও অনুভূতি আছে কিন্তু সেটা এতোটা উদাসীন, নৈর্ব্যক্তিক, কৌতূহলশূন্য, এবং অপক্ষপাতী যে তা কোন কিছুকে স্পর্শ করে না।
ঋষিন: এটা আপনার অনুমান।
ইচক: হ্যাঁ। এটা অনুমান। তবে উদঘাটিত হবার আগে সব সত্যের পেছনে কিছু অনুমান থাকে। তাদের একটা সত্য হয়। সে সত্যটা খুঁজতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
ঋষিন: আপনি কি ক্লান্ত? আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করতে চাচ্ছেন?
ইচক: আপনার অনুমান সঠিক হয়েছে।
hassangorkii@yahoo.com
মে, ২৮, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।