হাসান গোর্কি : [ইচক দুয়েন্দে ও সিদ্ধার্থ ঋষিন আমার খুব পছন্দের দু’জন মানুষ। তাদের অনেক গুণগ্রাহীর মধ্যে আমিও আছি। তাঁরা বাস করেন যথাক্রমে রাজশাহী ও কোলকাতায়। এই লেখায় তাদের নাম ব্যবহার করেছি। কথাগুলো তাদের নয়। তবে তাদের কথা ও যুক্তির ধরণ অনেকটাই এরকম। লেখার বিষয়বস্তুর ধারণা দিয়েছে আমার ভাগ্নে শামসুল আবেদিন তরফদার।]

সিদ্ধার্থ ঋষিন: আপনার লেখা ‘টিয়াদুর’ পড়লাম। আমার একটা পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করতে চাই।
ইচক দুয়েন্দে: জনাব, আমি আপনাকে উত্সাহিত করছি।
সিদ্ধার্থ: পর্যবেক্ষণটা নেতিবাচক।
ইচক: হর্ষ প্রকাশ করছি। আপনি বলুন।
সিদ্ধার্থ: গল্পগুলো দুর্বোধ্য। তাঁরা পরস্পরের সীমানায় ঢুকে পরে নিজেদের ছত্রখান করে ফেলে এবং দিনশেষে কোন বার্তা দেয় না।
ইচক: আপনি মহান! আপনি ঠিক বুঝেছেন। আমি গল্প লিখেছি কী ঘটে সেটা বলার জন্য। আমি তো উপদেশ দিতে চাইনি। আমি তো নবী নই! ধরুন, একটা বাস উল্টে ৫ জন মানুষ মরে গেলো। আমি মিথ্যা করে লিখিনি যে বাসটা ঢাকায় চলে গেলো, বা কোন মানুষ মরে যায়নি।

সিদ্ধার্থ: আপনি পুরোপুরি ঠিক বলেননি। আপনার বর্ণনায় দ্বৈততা আছে। আপনার লেখা পড়লে বুঝতে পারা যায় না যে ঘটনাটা আসলে ঘটেছে, নাকি ঘটেনি।
ইচক: আপনার এই পর্যবেক্ষণ আমি মেনে নিচ্ছি। আমার লেখায় দ্বৈততা আছে, ত্রৈততাও আছে। আপনি বলেছেন, আমার লেখা পড়লে বুঝতে পারা যায় না যে ঘটনাটা আসলে ঘটেছে, নাকি ঘটেনি। জনাব, আপনি বলুন, ‘ঘটনাটা আসলে ঘটেছে, নাকি ঘটেনি’ সেটা আমি যদি বুঝতে না পারি তাহলে কী করবো? আমি তো আগেই বলেছি আমি নবী নই। আমার কাছে এই জগতটাই অস্পষ্ট।
সিদ্ধার্থ: সেক্ষেত্রে ঐ ঘটনার বর্ণনা করতে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
ইচক: এই উপদেশ আমি পালন করতে চাই না। আমি চাই, আমার মতো করে কিছু বলা বা না বলার প্রথাকে আপনি সন্মান করুন। আমি যা বিশ্বাস করি তা আমাকে বিশ্বাস করতে এবং প্রচার করতে দিন অথবা প্রচার না করার স্বাধীনতা দিন। আমিও আপনাকে সেটা করতে দিতে চাই।

সিদ্ধার্থ: উত্তম প্রস্তাব। এরকম হলে ভালো হতো। তবে তাতে কিছু সমস্যা থেকে যায়। আপনি জানেন, পৃথিবীতে ‘ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি’ নামে একটা সংগঠন আছে। সারা পৃথিবীতে এর শাখা আছে; বাংলাদেশেও আছে। এই সংগঠনের সদস্যরা বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল। তারা এই ভুল তথ্য প্রচার করছে এবং অন্যদের বিভ্রান্ত করছে। আপনি কি তাদের মত প্রকাশের এই স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন?
ইচক: হ্যাঁ। আমি সমর্থন করি। কারণ এটা তাদের চিন্তার ভিন্নতা এবং তা অন্যের কাছে প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করছে। এই স্বাধীনতা তাদের শান্তির কারণ হচ্ছে। যাদের কাছে তারা এই ধারণাটা প্রচার করছে তাদের খুব কম সংখ্যক-ই সেটা বিশ্বাস করছে। এই বিশ্বাস থেকে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম; আপনি যদি বলেন ‘শূন্য’, সেটাও মেনে নিতে রাজি আছি। আমি চিন্তিত থাকতাম যদি এটা কুফল উত্পাদন করতো। পৃথিবী যে শূন্যে ভাসমান একটা গোলাকার বস্তু তার প্রমাণ বিভিন্নভাবে-ই পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা জানি এক সময় পৃথিবীকে সমতল ভাবা হতো। পৃথিবী যে গোল এবং সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এই সত্যটা এসেছে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিরুদ্ধে ভিন্নমত আকারে। ব্রুনো জীবন দিয়ে এটা প্রচার করতে না পারলে সত্য জানতে আমাদের আরও দেরি হতো। যে চারটি অপরাধের অভিযোগে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয় তার একটি ছিল – ‘এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়’-এই ধারণা পোষণ ও প্রচার করা। পুরো মধ্যযুগ জুড়ে বিজ্ঞানীদের কোনো কথা বাইবেলের বিপরীতে গেলে তাদের জীবনে নির্যাতন নেমে আসতো। ভিন্নমতের প্রচার বন্ধ করে দিলে তো আপনি আবার সেই পবিত্র অ্যাপস্টেল এর যাজকীয় অনুশাসনের যুগে ফিরে গেলেন এবং এপোস্টোলিক কনস্টিটিউশনগুলির রায় অন্যের মাথায় চাপিয়ে দিলেন। আমি বলতে চাচ্ছি সংখ্যাতীত ভিন্নমত থাকুক। তার মধ্যে থেকে যেটা সাক্ষ্য ও যুক্তির বিচারে উত্তীর্ণ হবে সেটা টিকে থাকবে।

সিদ্ধার্থ: আমি বলতে চেয়েছি, সমতল পৃথিবীর ধারণা পোষণ ও প্রচার করার স্বাধীনতা জরুরি নয়। ধরে নিলাম, ক্ষতির পরিমাণ এতোটাই কম যে তা অগ্রাহ্য করা চলে। তাহলে আমরা অন্য একটা উদাহরণ দেখি যেখানে ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং তার প্রচার কিছু ক্ষতি বয়ে এনেছিল। আপনার নিশ্চয়ই পিপলস ট্যাম্পলের কথা মনে আছে। জিম জোনস্ ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়াতে পিপল’স টেম্পলের একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন এবং জিম নিজেকে মসিহা বা নবী বলে দাবি করা শুরু করেন। তিনি নিজেকে গৌতম বুদ্ধ ও যিশু খ্রিস্টের মতো মহাপুরুষ বলে দাবি করেন এবং একসময় খ্রিস্টান ধর্ম, কম্যুনিজম এবং সোশ্যালিজম মিশিয়ে এক অদ্ভুত ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে গায়ানার চলে যান। বিশাল পরিত্যক্ত একটি জঙ্গলের গহীন এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তিনি প্রচার করেন যুক্তরাষ্ট্র যে কোন সময় তাদের আক্রমণ করতে পারে। এর একটা সমাধানও তিনি বের করে ফেলেন- গণ আত্মহত্যা। ১৮ নভেম্বর, ১৯৭৮ জিম জোনসের অডিও টেপের মাধ্যমে দেওয়া নির্দেশে আত্মহত্যা করে ৭০ জন ধর্মগুরু সহ ৯১৮ জন। এদের মধ্যে বেশ কিছু শিশু ছিল, যাদের সায়ানাইড ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হয়। আপনি আর আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমরা পত্রিকায় পড়েছিলাম ঘটনাটা। সাপ্তাহিক বিচিত্রা একটা বড় প্রতেবেদন করেছিল, যতটুকু মনে আছে আনন্দবাজারও করেছিল। মনে আছে আপনার?
ইচক: জনাব ঋষিন, এই কাহিনি অবতীর্ণ হবার কারণ বলুন। এই ঘটনার বর্ণনা আমাদের আলোচনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে সেটা বুঝতে চাই।

সিদ্ধার্থ: আমি কিছুটা হতাশ হলাম ড. দুয়েন্দে। আপনি বলেছেন যে কোন মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা কল্যাণকর। এই ঘটনায় জিম তার স্বাধীন মত পোষণ ও প্রকাশের মাধ্যমে অকল্যাণ বয়ে এনেছেন।
ইচক: দেখুন, আমি কিন্তু বলিনি সকল ভিন্নমত কল্যাণকর। প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোর মধ্যেও অকল্যাণ আছে। সব অকল্যাণ বিজ্ঞান, দর্শন, লোকাচারের ছাঁকনিতে আটকা পড়ে যায়। অকল্যাণের ভয়ে যদি কোন কর্তৃপক্ষ মানুষদের কথা বলতে বারণ করে দেয় তাহলে সভ্যতার অগ্রগতি শ্লথ হয়ে যাবে। আমরা যদি ধরে নেই সেটা কোন সুউচ্চ জ্ঞানবান কর্তৃপক্ষের আদেশ তাহলেও ফলাফল একই হবে। আপনি যখন প্রশ্বাস টানেন তখন বাতাসে ভাসমান কিছু ব্যাকটেরিয়া আপনার ফুসফুসে ঢুকে যায়। সেকারণে কি আপনি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দেবেন!

সিদ্ধার্থ: ব্যাকটেরিয়ার কথা যখন বললেন তখন একটা উদাহরণ দেখুন। ব্লাক ডেথ বা কালো মড়কে ১৩৪৬-‘৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এতে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা যায়। সেসময় প্রচার করা হয়েছিল যে এই রোগের উত্পত্তি মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে। বাণিজ্য জাহাজে বসবাস করা ইঁদুরের মাধ্যমে এই রোগ ইউরোপ ও ভুমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশসমুহে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্ট জন্মের আগে থেকে মানুষ মনে করতো, প্লেগ ছড়ায় দূষিত বাতাসের মাধ্যমে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার বড় অংশ জুড়ে এখনও মানুষ এরকম বিশ্বাস করে। জীবাণু তত্ত¡ আবিষ্কারের আগে এই তত্ত¡কে বলা হতো ‘মায়াজমা’। গ্রিক ভাষায় ‘মায়াজমা’ শব্দের অর্থ ‘খারাপ বাতাস’। ছোটবেলায় আমি মাঝে মাঝে ‘খারাপ বাতাস’-এ আক্রান্ত হতাম। মা বলতেন সাপের বাতাস লেগেছে। মন্দির থেকে মন্ত্র পড়া তেল নিয়ে আসতেন। যাহোক, যা বলছিলাম, উনবিংশ শতকের শেষে এসে আবিস্কৃত হয়, প্লেগের জন্য এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া দায়ী, যার নাম ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস। এদের বাহক মাছি আর উকুন, খারাপ বাতাস বা ইঁদুর নয়। তাই, ভিন্ন মত প্রচার করতে দিলে তা মাঝে মাঝে বড় অকল্যাণ বয়ে আনে।
ইচক: আপনি এখানে কোনটিকে ভিন্নমত বলছেন?

সিদ্ধার্থ: খারাপ বাতাস বা ইঁদুরকে দায়ী করা। এটা ছিল কিছু মানুষের কল্পনা। তারা সামাজিকভাবে শক্তিশালী ছিল এবং এই ভুল কথাটা ছড়িয়ে দিয়েছিল।
ইচক: খুব সম্ভব আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে। সেসময় সামাজিকভাবে স্বীকৃত প্রধান মত ছিল ইঁদুর-ই প্লেগের বাহন। আমি ব্লাক ডেথের সময়ের কথা বলছি। কোন ভিন্নমত তখনও আসেনি। পাস্তুর ইনিস্টিটিউটে ব্যাকটেরিয়াবিজ্ঞানী আলেক্সঁদ্র ইয়েরসাঁ ১৮৯৪ সালে “ই. পেস্টিস” ব্যাকটেরিয়াটি আবিষ্কার করেন এবং দাবি করেন যে এই ব্যাকটেরিয়া প্লেগের জন্য দায়ী। এটাই ভিন্নমত, যা দিন শেষে মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। আপনি ‘ভুল ধারণা’ এবং ‘ভিন্নমত’ এক করে ফেলছেন। একটা ‘ভুল ধারণা’ও অনেকদিন টিকে থাকতে পারে। যেমন পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব তত্ত¡ কয়েক হাজার বছর টিকে ছিল। যতদিন টিকে ছিল ততদিন সেটা প্রধান ধারণা হিসেবে-ই ছিল। বর্তমানে আবিস্কৃত বিশ্ব তত্তে¡র সাথে তুলনা করে আমরা যদি সেটাকে ভিন্নমত বলতে চাই তাহলে ভুল করা হবে। তুলনার ক্ষেত্রে ভুতাপেক্ষতা (রেট্রোস্পেকটিভিটি) দেওয়ার সুযোগ নাই।

সিদ্ধার্থ: আমি আপনার কাছে আরও নৈর্ব্যক্তিক ধারণা আশা করছি যা অভিলক্ষ্য বা বিষয়মুখী। আরও সহজ একটা উদাহরণ দেখুন। আমি ছোটবেলা থেকে পবিত্র রামায়নের উধৃতিতে রুদ্র অবতার হনুমানের গল্প শুনে এসেছি। তিনি ছিলেন ভীষণ চঞ্চলমতি। তিনি ফলাহারে আসক্ত ছিলেন। ছোটবেলায় একদিন তিনি সূর্যকে ফল ভেবে খেয়ে ফেলেন। দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং শিশু হনুমানের ওপর বজ্র নিক্ষেপ করে সূর্যকে উদ্ধার করেন। হনুমানের পালক পিতা ছিলেন পবন দেব। তিনি রেগে গিয়ে জগত বায়ুরুদ্ধ করে দেন। প্রাণীকুল প্রলয়ের প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং অবশেষে ব্রহ্মার বিশেষ আশীর্বাদে তারা রক্ষা পায়। এই বিশ্বাস ধারণ ও প্রচার করার মধ্যে তো কোন কল্যাণ নেই! আপনি কি এই বিশ্বাসের প্রচারকে অনুপ্রাণিত করতে চান?
ইচক: আপনি একটা নতুন শব্দ নিয়ে এলেন— ‘অনুপ্রাণিত করা’। শুরু থেকে আমি বলে এসেছি, আমাদের উচিত কোন ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশের অধিকারকে সন্মান করা; আপনি বড়জোর ‘অনুমোদন করা’ বলতে পারেন এই শর্তে যে আপনি ‘নন-অথরিটারিয়ান’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রত্যয়টিকে দেখছেন। এবার হনুমানের গল্পের বিষয়ে বলি। এধরণের সব গল্প-ই প্রতীকি। অনুসারীরা এসব থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রেষণা পেয়ে থাকে। আমরা কেন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম যে এসবে ‘কল্যাণ নেই।’ আমি-ভূত, পেত্নী এবং রাক্ষস-খোক্কসে বিশ্বাস করি। হাদির মোড়ে পদ্মার খাড়িতে একটা রাক্ষস থাকে। আমি দেখিনি; কিন্তু লক্ষণ পেয়েছি। আপনি কি আমাকে এই বিশ্বাস ত্যাগ করতে বলেন? আমার শান্তি ভঙ্গ করে আপনার লাভ কী! আপনি রাক্ষস মানেন না। কিন্তু পুজা ঋষিন (আপনার আত্মজার কথা বলছি। রিয়েলি এ সুইট বেবি। আই লাভ হার।) তার ল্যাপটপে রাক্ষসদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আবার দেখুন আপনার দেশের সিংহ ভাগ মানুষ হনূমানের অলৌকিক সব কীর্তিকে মানে। ইরসো-র মঙ্গলগ্রহে যান পাঠানোর উদ্যোগ কি তাতে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? আমাদের পড়া উপন্যাসের চরিত্রগুলো, গ্রীক মিথের দেবতারা, রোম জাগানো রাক্ষসের গল্পের প্রোটাগনিস্ট, ভালুকের হাতে বন্দী হওয়া বুদ্ধিমান মাসা- এরা কেউ-ই আমাদের নিকট আত্মীয়দের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সিদ্ধার্থ: জয় গুরু! আপনার বাক্য চাতুর্য থেকে মুক্তির আশা করি না। এবার বারানসিতে এলে আমার বাড়ির পাশের খাড়িতে একটা খোক্কসের সন্ধান দিয়ে যাবেন। মতের প্রকাশকে আপনি গঙ্গার প্রবাহের মতো অবারিত দেখতে চান। এটা আপনার নিজস্ব মত যা আপনি যত্ন করে আগলে রেখেছেন, যেমন আপনি যে শহরে বাস করেন সেটাকে আগলে রেখেছেন ‘শহর রক্ষা বাঁধ’ দিয়ে। আমি বলতে চাই মত প্রকাশের ক্ষেত্রেও এরকম কিছু ‘বাঁধ’ থাকা উচিত। নাহলে অপরীক্ষিত, ভ্রান্ত বা দুর্বল ধারনা/মত জনমানসকে বিভ্রান্ত করবে এবং অকল্যাণ বয়ে আনবে। যেমন সতীদাহের মতো অমানবিক আচার ভারতীয় সমাজে কয়েক সহস্রাব্দ চালু ছিল। এই অমানবিক আচারের ধারণা, প্রকাশে শুরুতেই বাধা দিলে সেইসব নিরীহ নারীকে পুড়ে মরতে হতো না।
ইচক: আমি আগেই বলেছি ভিন্নমতগুলো থেকে কল্যাণকরগুলো সমাজ ছেঁকে নেবে। এটা দুঃখজনক যে ১৮২৯ সালে বেন্টিং আইন পাশ করার আগে সেটা শুরু হয়নি। এমনকি সেটা বিলুপ্ত হতে ঊনিশ শতকের শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন যদি কেউ পতিদাহ প্রথা চালুর পক্ষে মত প্রকাশ করতে চায় তাহলে আমি তাকে সেটা প্রকাশ করতে দেওয়ার পক্ষে আছি। মানুষকে পুড়িয়ে মারা যে খারাপ কাজ সেটা সমাজ জেনে গেছে। তাই আশা করতে দোষ নেই যে পতিদাহ-র ধারণা মানুষ গ্রহন করবে না। আপনি শহর রক্ষা বাঁধের কথা বলছিলেন। আমি এই বাঁধের পক্ষে। আমরা কিন্তু নদীর প্রবাহকে বাধা দেইনি। নদীর ঘোলা জল যাতে আমাদের ঘরে ঢুকে না যায় তার জন্য এটা একটা আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ। আপনি যদি মনে করেন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা ‘ঘোলা মত’ আপনার মনের ঘরে ঢুকে আপনাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে এবং আপনার অকল্যাণ সাধনের সম্ভাবনা তৈরি করছে তাহলে আপনিও তাতে আত্মরক্ষামূলক ‘বাঁধ’ নির্মাণ করে ফেলুন। আপনার স্ফেয়ার অব ডোমেইন আপনি রক্ষা করুন। কিন্তু ভুলেও ফারাক্কার মতো বাঁধ দেবেন না যা প্রকৃতির প্রবাহকে বাধা দেয়।

সিদ্ধার্থ: আপনি মানবেন যে কোন আলোচনায় আমরা কেউ যদি বৌদ্ধিক শ্রেয়তার (ইনটেলেকচুয়াল সুপিরিয়রিটি) কৌশলী প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাধিকার নিয়ে বসি তখনও ভিন্ন মতের অবদমন ঘটে। আমাদের ডিকশনারিতে প্রাধিকারের অন্য অর্থ লেখা আছে- ‘ঠাকুরালী।’ এই আলোচনায় যদি আপনি বুদ্ধি ও জ্ঞান দিয়ে আমার ভিন্নমতকে পরাভূত করে থাকেন তাহলে সেটা আমি বুঝবো না। আমি এখনও বিশ্বাস করছি যে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় যৌক্তিক স্তরে কোন এক ধরণের বাধা থাকা উচিত।
ইচক: শেষের বাক্যটা আপনার মত। আপনি যখন এটা পোষণ ও প্রকাশ করছেন তখন আমার দিক থেকে অনুমোদন, উত্সাহ, সম্মতি ও শ্রদ্ধা রেখে জিজ্ঞেস করছি, আমরা কোনটাকে যুক্তি বলে বুঝবো? যৌক্তিক স্তরের নির্ধারক কে হবে? রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি-মানস, দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম নাকি তর্ক শাস্ত্র?
সিদ্ধার্থ: উত্তরটা এক শব্দে বলি- ‘সবগুলো-ই’।
ইচক: আমরা যদি যথার্থ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাই তাহলে তাদের কাজ কী হবে? তারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণটা আরোপ করবেন? কোন মত প্রকাশিত হবার আগেই তারা কীভাবে বুঝবেন সেটা ক্ষতিকর নাকি কল্যাণকর হবে?
সিদ্ধার্থ: আপনি জানেন এভাবে প্রশ্ন করতে থাকলে আলোচনাটা শেষ হবে না। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
ইচক: ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।হাসান গোর্কি