Home কলাম প্রান্তরে তেপান্তরে-৩৫ : “চাঁদ মামার বাড়িতে”

প্রান্তরে তেপান্তরে-৩৫ : “চাঁদ মামার বাড়িতে”

হাসান গোর্কি : “হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু-সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার…”
(কুড়ি বছর পরে, জীবনানন্দ দাশ)

সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের চাঁদে যাওয়াটা সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঘটনা। বিষয়টা আমাদের কাছে বিস্ময়কর লাগে না একারণে যে এটা আমরা অসংখ্যবার শুনেছি। আজ থেকে এক হাজার পর পৃথিবীর সকল টেক্সট বইয়ে হয়তো এটাকে আধুনিক মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা বলে লেখা হবে। আজকের যুগের বড় খেলনা আকৃতির বিমান তৈরি করে উইলবার রাইট ১৯০৮ সালের ৮ই আগস্ট প্রথম মানুষ হিসেবে সফলভাবে আকাশে ওড়েন। এর মাত্র ৬১ বছরের মাথায় মহাকাশযান নিয়ে মানুষ চাঁদে পৌঁছে যায়। ‘মানুষ চাঁদে গেছে’ কথাটা আমরা সহজে বলি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু অবিশ্বাস্য যা কিছু মানুষ করেছে সেই তালিকার শীর্ষে থাকার কথা ‘চন্দ্র ভ্রমণ’। এই যাত্রার বাধা-বিপত্তি, দুঃসাধ্যতার দিকগুলো অতিক্রম করে কীভাবে মিশনটা সফল করা হয়েছিল সেসব জানলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩৮৪,৩৯৯ কিলোমিটার। এই দূরত্বটা বড় বাধা ছিল না; সমস্যা ছিল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার মতো শক্তিশালী যান তৈরি করা। তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল পৃথিবী ও চাঁদের আহ্নিক ও বার্ষিক গতির সাথে নিখুঁতভাবে তাল মেলাতে পারে এমন একটা হিসাব বের করা যা একটা মহাকাশযানকে নিরাপদে চাঁদে নামিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে পারবে। কাজটা যে কঠিন ছিল তা আমরা সাধারণ অনুমান থেকেই বুঝতে পারি।

শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কে আগে চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। এতে সোভিয়েতরাই অনেক সময় পর্যন্ত এগিয়ে ছিল। তারা ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক’ উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ যাত্রায় প্রথম মাইলফলক স্পর্শ করে। এর দুই বছরের মাথায় ১৯৫৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারা লুনা-২ নামের মনুষ্যবিহীন এক মহাকাশযানকে চাঁদে পাঠাতে সক্ষম হয়। লুনা-২ চাঁদের পৃষ্ঠে একটা ধাতু ফলক ছুঁড়ে দেয় এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার আগে কিছু অস্পষ্ট ছবি পাঠায়। পৃথিবীর বাইরে কোন গ্রহ বা উপগ্রহে মানুষের তৈরি কোন বস্তু পৌঁছে যাবার ঘটনা এটাই প্রথম। এরপর সোভিয়েতরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়- ইউরি আলেক্সেইভিচ গ্যাগারিন ভস্টক নভোযানে করে ১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল, পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেন। তিনি-ই ছিলেন মহাকাশে ভ্রমণ করা প্রথম মানুষ।

এর পরের ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। ১৯৬৬ থেকে ’৬৮-র মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাঁদের পৃষ্ঠে সাতবার রোবোটিক মহাকাশযান পাঠায়। এর মধ্যে পাঁচটি সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে ও নিশ্চিত করে যে চন্দ্রপৃষ্ঠ নভোযান নামানোর জন্য উপযোগী; অর্থাৎ এর ধূলির স্তর এতটা গভীর নয় যে তাতে মহাকাশযান ডুবে যেতে পারে। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৬৮, এপোলো ৮ এর অভিযাত্রী ফ্রাঙ্ক বোরম্যান, জেমস লাভেল এবং উইলিয়াম অ্যান্ডার্স চন্দ্রের কক্ষপথে প্রবেশ করেন এবং চাঁদকে কাছে থেকে দেখে ফিরে আসেন। ১৯৬৯-র মে মাসে এপোলো-১০ অন্য তিন নভোচারীকে নিয়ে মাত্র ১৫ কিলোমিটার উপর দিয়ে চাঁদ প্রদক্ষিণ করে ফিরে আসেন। স্বপ্নের অভিযাত্রায় মানুষ প্রথম চাঁদে অবতরণ করেছিল ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সালে। চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটা প্রথম মানুষ ছিলেন নিল এলডেন আর্মস্ট্রং; দ্বিতীয় ব্যক্তি এডউইন-ই-অল্ড্রিন। যে যানে করে তারা এই অভূতপূর্ব মিশনে গিয়েছিলেন, মিলিয়ন বছরের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া সেই যানের নাম এপোলো-১১। এপোলো হলো গ্রিক ও রোমক পুরাণে নিরাময়, ধনুর্বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পকলা, জ্ঞান, পশুপালন ও সূর্যালোকের দেবতা। এপোলো জিউসের পুত্র। তার আরেক পরিচয় হলো তিনি এবং অরণ্যের দেবতা আর্টেমিস যমজ ভাই-বোন। এপোলো ১২ অলিম্পিয়ান ডিইটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন। সেকারণে-ই হয়তো চন্দ্র অভিযানের মিশনের নাম ‘এপোলো’ রাখা হয়েছিল।

যাত্রার প্রাক্কালে জ্বালানি ট্যাঙ্ক সহ এপোলো-১১-র উচ্চতা ছিল ৩৬৩ ফুট, যা স্ট্যাচু অব লিবার্টি থেকে ৫৮ ফুট বেশি। যে রকেটটি এপোলোকে বয়ে নিয়ে গেছে তার নাম স্যাটার্ন ভি। জ্বালানি ভর্তি অবস্থায় এর ওজন ছিল ৬.৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ২৯০০ টন। উড়ে ওঠার সময় এটা যে থ্রাস্ট তৈরি করেছিল তার পরিমাণ ৭.৬ মিলিয়ন পাউন্ড, যা ১৬০ মিলিয়ন বা ১৬ কোটি হর্স পাওয়ারের সমান। জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রেল ইঞ্জিন ‘বিগ বøজ’ এর ক্ষমতা ৮৫০০ হর্স পাওয়ার। স্যাটার্ন ৫ ছিল এরকম ১৮,৮০০ রেল ইঞ্জিনের সমান শক্তিশালী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরী পরমাণু শক্তিচালিত ‘জেরাল্ড আর ফোর্ড’ এর ক্ষমতা ২ লাখ ৮০ হাজার হর্স পাওয়ার, যা স্যাটার্ন-৫ এর ক্ষমতার ৫৭০ ভাগের এক ভাগ। উড্ডয়নের জন্য রকেটটিতে ৮৯ লরি তরল অক্সিজেন, ২৮ লরি তরল হাইড্রোজেন এবং ২৭ রেলকার ভর্তি কেরোসিন ভরতে হয়েছিল। যাত্রার শুরুতে প্রতি সেকেন্ডে ১৮ টন জ্বালানি পুড়ে রকেটটি ২ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে ৪২ মাইল উচ্চতায় পৌঁছে যায় এবং ঘন্টায় ৬১৬৪ মাইল গতি অর্জন করে। এসময় শূন্য হয়ে যাওয়া জ্বালানি ট্যাঙ্ক প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলে দেওয়া হয়।

এর পরের স্তরে ৬ মিনিট নতুন ট্যাঙ্কের জ্বালানি পুড়িয়ে মহাকাশযানটিকে নিয়ে যাওয়া হয় ১০৯ মাইল উচ্চতায়। তখন তার গতি দাঁড়ায় ঘন্টায় ১৫,৬০০ মাইল। তৃতীয় ধাপে আড়াই মিনিট জ্বালানি পুড়িয়ে মহাকাশযানটির গতি তোলা হয় ১৭,৪০০ মাইল এবং এই গতিতে এটি দেড় বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হবার ২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট পর চতুর্থ ধাপের জ্বালানি পুড়িয়ে ৬ মিনিটে যানটিকে ঘন্টায় ২৫,৩১৯ মাইল গতি দেওয়া হয়। এটি-ই পৃথিবীর মুক্তিবেগ। ফলে যানটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে চাঁদের দিকে (ছবিতে নিচের মোটা রেখা বরাবর) চলতে থাকে এবং ৭৬ ঘন্টায় ২,৭৬,০০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে।

আমরা খেয়াল করলে দেখবো, পৃথিবী থেকে চাঁদের দিকে এপোলোর গতিপথ পুরোপুরি সোজা নয়। পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণনরত অবস্থা থেকে বের হবার সময় যে বিচ্যুতি ঘটেছে সেটাই মহাকাশযানটিকে কিছুটা বাঁকা পথে চাঁদের দিকে নিয়ে গেছে। এই বিচ্যুতির পরিমাণ কত হবে সেটা আগে থেকেই হিসাব করে রাখা হয়েছিল। এই হিসাবে ০.০০১% ভুল হলেও মহাকাশযানটি চাঁদে না পৌঁছে মহাশূন্যে হারিয়ে যেতো। পৃথিবী থেকে যখন এটি যাত্রা করে তখন চাঁদ যেখানে ছিল যানটিকে সেদিকে না চালিয়ে ৩ দিন পর চাঁদ তার কক্ষপথে যেখানে পৌঁছাবে সেদিকে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই হিসাবে সামান্যতম ভুল হলেও এপোলোকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। ছবিতে পৃথিবী থেকে এপোলো-১১-র যাত্রার সময় চাঁদের অবস্থান দেখা যাচ্ছে (সব থেকে নিচে গড়ড়হ ধঃ ষধঁহপয লেখা অবস্থানে)।

চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মোটামুটি ছয় ভাগের এক ভাগ। ফলে তার মুক্তি গতিও পৃথিবীর ছয় গুণ কম। এপোলো-১১ কে চাঁদের কক্ষপথে ঢোকার জন্য উল্টো দিকে জ্বালানি পুড়িয়ে গতি কমাতে হয়েছে। জুলাই ১৯, গ্রিনিচ মান সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে নভোচারীরা তাদের অবতরণের জন্য আগে থেকে নির্ধারিত স্থানটি দেখতে পেলেন। আগের মিশনগুলো থেকে পাঠানো ছবি ও ভিডিও চিত্রে এই জায়গাটিকে তুলনামূলক সমতল দেখা গিয়েছিল। স্থানটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সি অব ট্রাংকুয়েলিটি’ — প্রাশান্তির পারাবার। জুলাইয়ের ২০ তারিখ, গ্রিনিচ মান সময় দুপুর ১ টায় আর্মস্ট্রং ও অল্ড্রিন চন্দ্রতরী ‘ঈগল’-এ প্রবেশ করলেন এবং চাঁদে অবতরণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিলেন। বিকেল ৫ টা ৪৪ মিনিটে তারা মুলযান ‘কলম্বিয়া’ থেকে ‘ঈগল’কে পৃথক করলেন। মাইকেল কলিন্স ‘কলম্বিয়া’য় থেকে গেলেন। পৃথক হওয়ার পর আর্মস্ট্রং কৌতুক করে চিৎকার করলেন, “এই যে দেখো ঈগলের পাখা আছে।”

ঈগল নামতে শুরু করলে আর্মস্ট্রং ও অল্ড্রিন লক্ষ করলেন তারা অবতরণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছানোর ল্যান্ডমার্কগুলো নির্ধারিত সময়ের ২ থেকে ৩ সেকেন্ড আগে পার হয়ে যাচ্ছেন। ‘ঈগল’ যখন চন্দ্রপৃষ্ঠথেকে মাত্র ১৮০০ মিটার উচুতে তখন মিশন কন্ট্রোল সেন্টারের কম্পিউটারেও এই ত্রুটি ধরা পড়লো এবং বিপদ সংকেত বেজে উঠলো। প্রত্যেকটি সেকেন্ড তখন গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জ্যাক গারম্যান গাইডেন্স অফিসার স্টিভ বেলসকে ‘ঈগলে’র অবতরণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে বললেন এবং এটি নিরাপদ বলে তাকে আশ্বস্ত করলেন। অবতরণের পুরো প্রক্রিয়াটা হিউস্টনে নাসার সদর দপ্তরে বসে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বিজ্ঞানীদের একটা বড় দল। আবার তারা যে ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন – বিষয়টা তেমনও নয়। পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল কম্পিউটারাইজড। সেটা ঠিক মতো কাজ করছে কিনা বিজ্ঞানীরা তা-ই তদারকি করছিলেন। তিন নভোচারীর কাজ ছিল মূলত কম্পিউটারের কাছে পাওয়া নির্দেশ অনুসরণ করা। মুলযান থেকে চাঁদে অবতরণ করার সময় ঈগল যাতে আলতোভাবে মাটি স্পর্শ করে সেজন্য বিপরীত দিকে জেট চালিয়ে গতি কমিয়ে আনার ব্যবস্থা ছিল, যেমন এর আগের ৫ টি মনুষ্যবিহীন যানকে নাসার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে বসেই চাঁদের মাটিতে সফলভাবে নামিয়েছেন। সবকিছু সেভাবেই চলছিল।

আর্মস্ট্রং এবার লক্ষ করলেন হিউস্টনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র তাদের যেখানে নামাতে যাচ্ছে সেটা একটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে ছড়িয়ে থাকা পাথুরে ভূমি। ঐসব বড় পাথরখণ্ডের ওপর নামলে ঈগল ধ্বংস হয়ে যাবে বা কাঁত হয়ে গেলে পরে আর উড়তে পারবে না। বিশেষ মুহূর্তে ঈগলের আধা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতা মিশন কমান্ডার আর্মস্ট্রং এর হাতে ছিল। যানটিকে বিমানের মতো চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ১২০ সেকেন্ডের জ্বালানি মজুত ছিল। চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে ১২০ ফুট উপরে পৌঁছে আর্মস্ট্রং পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হাত থেকে ঈগলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিলেন এবং প্রথম পাওয়া যে কোন নিরাপদ স্থানেই অবতরণের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মুহূর্তের ভগ্নাংশে এই সাহসী সিদ্ধান্ত না নিলে ঈগল হয়তো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে পড়ে ধ্বংস হয়ে যেতো। আর্মস্ট্রং যখন বৈমানিকদের মতো ঈগল চালিয়ে অবতরণ করাতে যাচ্ছেন তখন দেখলেন নির্বাচিত নতুন ক্ষেত্রটিও একটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।

তিনি আরও কিছুটা এগিয়ে গেলেন। ততোক্ষণে তার নভোযান নেমে এসেছে চন্দ্রপৃষ্ঠের ১০০ ফুটের মধ্যে। তখন ঈগলের কাছে ৯০ সেকেন্ডের জ্বালানি আছে। মোটামুটি দুই কিলোমিটার দূরে তিনি একটা সমতল ভূমি দেখতে পেলেন এবং অনুমান করলেন সেখানে পৌঁছার মতো জ্বালানি আছে। সমতল ভূমির উপরে পৌঁছে তিনি দেখলেন ইঞ্জিনের বাতাসে চাঁদের ধূলিকণা উড়ে উঠে চারিদিক ধূসর করে তুলেছে। এপোলো-১১ যখন চাঁদের মাটি স্পর্শ করলো তখন ঈগলের ট্যাঙ্কে মাত্র ২৫ সেকেন্ডের ( অল্ড্রিনের ভাষ্য অনুযায়ী ১৫ সেকেন্ডের) জ্বালানি অবশিষ্ট ছিল। এর অর্থ আর ৩০ বা ২০ সেকেন্ড পর অবতরণ করতে চেষ্টা করলে মিশন ব্যর্থ হতো এবং দুই নভোচারীর প্রাণ চলে যেতো। অল্ড্রিন এক সাক্ষাৎকারে অবতরণের সময়ের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন সেটা এই ভিডিওতে পাওয়া যাবে— https://www.youtube.com/watch?v=9HvG6ZlpLrI
আর্মস্ট্রং ঈগলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়ার পর থেকে প্রায় দেড় মিনিট পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বিজ্ঞানীরা অন্ধকারে ছিলেন। ঈগল চাঁদের মাটি স্পর্শ করার পর আর্মস্ট্রং বললেন, “হিউস্টন। হিউস্টন ট্রাঙ্কুয়ালিটি বেস হিয়ার, দ্য ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড।” পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ থেকে ভেসে আসা এক দুঃসাহসী সতীর্থের কণ্ঠস্বর! হিউস্টনে তখন বিকেল ৪ টা ১৭। দীর্ঘ প্রস্তুতি সেরে চাঁদে নামার প্রায় ছয় ঘন্টা পর হিউস্টন সময় রাত ১০ টা ৩৯ মিনিটে আর্মস্ট্রং ঈগলের দরজা খুললেন। চাঁদে তখন কেবল সকাল হয়েছে। চাঁদের মাটিতে পা রেখে তিনি বললেন, “That’s one small step for [a] man, one giant leap for mankind.” তিনি ‘a’ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে সেদিনের বেশিরভাগ সংবাদপত্রে ‘a’ কে স্কয়ার ব্রাকেটে রেখে সংবাদ ছাপা হয়েছিল। ১৯ মিনিট পর বাজ অলড্রিন চাঁদের মাটিতে পা দিলেন। তারা দুইজন মিলে চাঁদের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পুঁতে দিলেন, পরস্পরের ছবি তুললেন এবং ২১ কেজি মাটি ও পাথর ব্যাগে ভরে নিলেন। আর্মস্ট্রং নিজের ছোট একটা ব্যাগে চাঁদের মাটি ভরে নিজের পকেটেও নিয়েছিলেন। ফিরে আসা মহাকাশযান যদি হারিয়ে যায় তাহলে যাতে এই নমুনাটুকু অন্তত থাকে; সেজন্য এই ব্যবস্থা।
তারা অবতরণ ক্ষেত্রে একটা ধাতু ফলক রেখে আসলেন যাতে লেখা ছিল: “এখানে পৃথিবী নামের গ্রহ থেকে আসা মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়েছিল— জুলাই, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দÑ আমরা এসেছিলাম মানব জাতিকে অভিন্ন শান্তির সুতোয় বাঁধতে।” সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। হোয়াইট হাউসে বসে তিনি হিউস্টনের মাধ্যমে নভোচারীদের সাথে কথা বললেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভসের প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিতে সেই ঐতিহাসিক ফোন কলের রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। লিংক— https://www.archives.gov/presidential-libraries/events/centennials/nixon/exhibit/nixon-online-exhibit-calls.html। মার্কিনীরা সবকিছুতে কৌতুক করতে ভালবাসে। একজন সাংবাদিক চাঁদের মানুষদের সাথে ফোনে কথা বলার অনুভূতি জানতে চাইলে নিক্সন বলেছিলেন, “এটা খুব-ই উত্তেজনাকর ছিল। আমার হাত পা কাঁপছিল, তবে সেটা মানুষের চাঁদে যাবার ঘটনায় নয়; লং ডিসটেন্স টেলিফোন বিলের ভয়ে!”

অল্ড্রিন চাঁদের মাটিতে হাঁটাহাঁটি করেছেন ১ ঘন্টা ৩৩ মিনিট। আর আর্মস্ট্রং কাটিয়েছেন প্রায় আড়াই ঘন্টা। ৭ ঘন্টা ঘুমানো সহ মোট ২১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট তারা চাঁদে অবস্থান করেন। সকালে অবতরণ করে এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পরও নভোচারীরা কিন্তু সকাল-ই দেখতে পাচ্ছিলেন। কারণ চাঁদের এক দিন পৃথিবীর সাড়ে ২৯ দিনের সমান। চাঁদের এক একটি দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য ৩৫৪ ঘন্টা করে। অর্থাৎ চাঁদে সন্ধ্যা হওয়া দেখতে গেলে নভোচারীদের সেখানে পৃথিবীর ১৫ দিন ও ১৪ রাতের সমান সময় অপেক্ষা করতে হতো। এবার ফিরে আসার পালা। হিউস্টন সময় ২১ জুলাই দুপুর ১ টা ৫৪ মিনিটে ঈগল চন্দ্রপৃষ্ঠ ত্যাগ করে, কলম্বিয়ার সাথে মিলিত হয় এবং পৃথিবীর উদ্দেশে রওনা হয়। ২৪ জুলাই দুপুর ১২ টা ৫০ মিনিটে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে তিন নভোচারীকে বহন করা স্পেসশিপ। এরপর ১৯৭২-র ডিসেম্বর পর্যন্ত নাসা আরও পাঁচবার চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে। ছয় বারে মোট ১২জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে হেঁটে এসেছেন। এপোলো ১৫, ১৬ এবং ১৭-র নভোচারীরা চাঁদে গাড়ি চালিয়ে ঘুরেছেন যথাক্রমে ১৭, ১৬ ও ২২ মাইল। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে এপোলো-১৩ কে মাঝ পথ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক— যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বাংলাদেশের তিন মহাকাশ বিজ্ঞানী একটা রেস্টুরেন্টে বসে কফি খাচ্ছেন।

রাশিয়ান বিজ্ঞানী: আমরা লুনাখোদ প্রোগ্রাম আবার চালু করে চাঁদে যাবার পরিকল্পনা করছি।
আমেরিকান বিজ্ঞানী: আমরা তো চাঁদে গিয়েছি ছয় বার। তাও সেটা পঞ্চাশ বছর আগে। এখন মঙ্গল গ্রহে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী: মঙ্গল যাত্রা খুব কঠিন কিছু নয়। আমাদের প্রতিবেশী ভারতও সেখানে যান পাঠিয়েছে। আমরা সূর্যে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
রাশিয়ান ও আমেরিকান বিজ্ঞানী: সূর্যে তো মাটি নেই; ল্যান্ড করবে কোথায়! তাছাড়া সূর্যে পৌঁছার বহু আগেই তোমার মহাকাশযান পুড়ে বাষ্প হয়ে যাবে।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী: না, সে সমস্যা হবে না। আমরা রাতে ল্যান্ড করবো।
hassangorkii@yahoo.com
মে ১৯, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।

Exit mobile version