হাসান গোর্কি : এরিস্টটলের ‘গোল্ডেন মীন’ এর বাংলা করা হয়েছে ‘সুবর্ণ মধ্যক’। এই দর্শনের মূল কথা একই বিষয়ে দুটি চরমপন্থী মতবাদের মাঝামাঝি অবস্থান; অর্থাত, কোনকিছু গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। এরিস্টটল মনে করতেন, সকল ক্ষেত্রে এই মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা কল্যাণকর। এটা সুগুণ (‘ভার্চু’) ও সুনীতি। অন্যপক্ষে যা ‘চরম’ তা-ই কদভ্যাস, অত্যয়, খুঁত। প্লেটো তার “রিপাবলিক” গ্রন্থে সাম্যবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, “সক্রেটিস শেখান কীভাবে একজন মানুষকে গড় নির্বাচন করতে হবে এবং যতদূর সম্ভব উভয় পক্ষের চরমতা এড়াতে হবে।” প্রকৃতিতেও মধ্যপন্থার চর্চা আছে। প্রকৃতিক দুর্যোগে নিরাপত্তার কথা ভেবে পিঁপড়া সবসময় কিছু খাদ্য সঞ্চয় করে রাখে। কিন্তু এটা এক বছরের প্রয়োজনের সীমা ছুঁয়ে ফেললে তারা খাদ্য সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। এসময় তারা আবাসন সংস্কার করে, নতুন খাদ্য ক্ষেত্রের জরিপ করে, এমনকি অলস সময়ও কাটায়। বাঘ একা থাকে এবং একা শিকার করে। তবে বাচ্চারা ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সাথে থাকে। বাঘদের এলাকার মালিকানা বিষয়ে অলিখিত ঐক্যমত্য আছে। তারা অন্যের এলাকায় শিকার করতে যায় না। কিন্তু কোন এলাকায় বাঘের সংখ্যা কমে গেলে বা বেড়ে গেলে তাদের এলাকার আয়তনের পুনর্বিন্যাস ঘটে।
ধরা যাক, ‘ক’ এলাকার যে বাঘটি বাস করতো সে মরে গেলো। তখন ‘গ’ ‘ঘ’ ও ‘ঙ’ এলাকার বাঘরা ‘ক’ এলাকাকে ভাগ করে নেয় এবং নিজেদের এলাকার সাথে যুক্ত করে। আবার ধরা যাক, ‘ক’ এলাকার বাঘিনী দুই সন্তানের জন্ম দিলো। তখন ‘গ’ ‘ঘ’ ও ‘ঙ’ এলাকার বাঘরা তাদের এলাকার কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, যাতে ‘ক’ এলাকার বাঘিনী কিছু অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ পায়। বনের রাজা সিংহ একটা মহিষ শিকার করার পর সতীর্থ ও সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে খায়। শিকারের মাংস যে কয়দিন খাওয়ার যোগ্য থাকে সে কয়দিন সিংহ কোন শিকার করে না; এমনকি সামনে দিয়ে কোন সহজ শিকার হেঁটে গেলেও না। পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলে। এরা কেন্দ্রাতিগ বল ও কেন্দ্রাভিগ বলের সাম্য রক্ষা করে চলে বলে এদের লব্ধির দিক একটা উপবৃত্তাকার পথ নেয়। এটাই তাদের কক্ষপথ। বলের সাম্য কোন কারণে ভেঙে গেলে এরা কক্ষচ্যুত হয়ে যাবে।
কিন্তু ‘সুবর্ণ মধ্যক’ সব সময় যে ভালো কাজ দেবে তার নিশ্চয়তা নাই। ধরা যাক ১০০০ জন সৈন্য শত্রু এলাকায় প্যারাসুট জাম্প করবে। কমান্ডার তাদের শত্রু সৈন্যদের সমাবেশ থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে নামিয়ে দেবেন এবং আগে থেকে মোতায়েন করা আর্টিলারির সহায়তায় অগ্রসর হবার নির্দেশ দেবেন। এটা মধ্যপন্থা। আবার ধরা যাক, কমান্ডার ঝুঁকি নিয়ে ২০০ সৈন্যকে শত্রু পক্ষকে সমাবেশের মধ্যে নামিয়ে দিলেন। তারা সেখানে আতঙ্ক তৈরি করলো। বাঁকি ৮০০ সৈন্যকে বাইরে নামিয়ে দিলেন। তারা আতঙ্কিত শত্রু সৈন্যদের ঘেরাও করে যুদ্ধ শুরু করলো। এটা চরমপন্থা। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের এই কমান্ডারের জয়ী বা পরাজিত হবার সম্ভাবনা আছে। তাই মধ্য বা চরমপন্থার কোনটি ‘সুবর্ণ’ সেটা এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। আর একটা উদাহরণ দেখুন- আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারতকে আক্রমণ করে। ভারতের নৌ-বাহিনী ৪ ডিসেম্বর কয়েকটি দ্রুতগামী ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট নিয়ে করাচি বন্দর আক্রমণ করে বেশ কিছু যুদ্ধ জাহাজ, তেলের ট্যাঙ্কার, বন্দরের তেলের ডিপো, অস্ত্রাগার ধ্বংস করে দেয়। তারা এই অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন ট্রাইডেন্ট’। সেসময় করাচি ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদর দপ্তর ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। এই আক্রমণের পর পাকিস্তানের পক্ষে সমুদ্র পথে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী ১২ দিনের যুদ্ধে অপারেশন ট্রাইডেন্টে’র বড় প্রভাব পড়ে। ভারতীয় নৌবাহিনীর চিফ অব দ্য নেভাল স্টাফ এডমিরাল এস এম নন্দ যুদ্ধ শেষে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, “এটা ছিল চরম বাজি। একটাও মিসাইল ছোঁড়ার আগেই পাকিস্তানের আধুনিক বিমান বাহিনীর আক্রমণে আমাদের পুরো বহর নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতো। ভগবান সহায়, সেরকম কিছু ঘটেনি।” আগ্রহী পাঠক এই লিঙ্ক থেকে অপারেশন ট্রাইডেন্টে’র ভিডিও দেখতে পারেন-(https://www.youtube.com/watch?v=7CwiEsaZZF)।
২৭ জুন ১৯৭৬, এয়ার ফ্রান্সের একটা বিমান তেল আবিব থেকে এথেন্স হয়ে প্যারিস যাবার পথে প্যালেস্টাইনি গেরিলারা ২৪৮ জন যাত্রী সহ সেটিকে ছিনতাই করে এন্টেবি (উগান্ডা) নিয়ে যায়। বিমানের প্রায় ৯০% যাত্রী ছিল ইসরায়েলি। উগান্ডার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন ছিনতাইকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ইসরাইলে বন্দী ৪০ জন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দী অপর ১৩ জন বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে ছিনতাইকারীরা সকল জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ইসরায়েলি সরকার সে পথে না গিয়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এক অভিযানের পরিকল্পনা করে। চারটি বিমানে ১০০ জন কমান্ডো চার হাজার মাইল দূরে গিয়ে এন্টেবি বিমানবন্দরে হামলা করে সকল জিম্মিকে মুক্ত করে আনে। অভিযানে তাদের কমান্ডার লে. কর্নেল যোনাথন নেতানিয়াহু নিহত হন (তিনি ছিলেন প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বড় ভাই)। এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা (বন্দী মুক্তির মাধ্যমে সমাধান) অবলম্বনের চেয়ে চরমপন্থা ইসরাইলের জন্য ভালো ফল বয়ে এনেছে। বিমান ছিনতাইও একটা চরমপন্থা। এক্ষেত্রে এটা প্যালেস্টাইনিদের জন্য খারাপ ফল নিয়ে এসেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ওয়ারশ জোট ভেঙে যায়। ন্যাটো টিকিয়ে রাখার স্নায়ুযুদ্ধকালীন বাস্তবতা তিরোহিত হবার পরও তা স¤প্রসারিত হতে থাকে। বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। কিছুদিন আগে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে রাশিয়া সেটাকে তার নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে ইউক্রেন আক্রমণ করে। যুদ্ধে রাশিয়া জয়ী হলে তার চরমপন্থা এক্ষেত্রে জয়ী হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। রাশিয়া পিছু হটলে বিপরীতটা সত্য হবে। এখানে রাশিয়ানদের জন্য মধ্যপন্থা বলে যা ছিল তার সবটাই তারা পার হয়ে এসেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের বক্তব্য সত্য হলে ন্যাটো পাঁচ বার স¤প্রসারণ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করেছে এবং এখন রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছে গেছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী ন্যাটোর এই কাজ হয়তো চরমপন্থা নয়। কিন্তু তাদের যে মধ্যপন্থা রাশিয়াকে চরমপন্থা বেছে নিতে বাধ্য করেছে সেটাকে ‘সুবর্ণ মধ্যক’ বলাও ঠিক হবে না।
আসলে মধ্যপন্থা বলতে আমরা কী বুঝবো সেটাও নির্ধারণ করা সহজ নয়। কখনও কখনও এক পাক্ষিকভাবে মধ্যবিন্দু নির্বাচন করা যায় না। ধরা যাক ঢাকা থেকে রাজশাহীর দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটার। উভয় দিক থেকে একটা করে ট্রেন ৫০ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে রওনা দিলে তারা ঠিক তিন ঘণ্টা পর ঢাকা এবং রাজশাহী থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে পরস্পরের মুখোমুখি হবে। কিন্তু রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনের গতি যদি ৪০ কিলোমিটার/ঘণ্টা ও ঢাকা ছেড়ে আসা ট্রেনের গতি ৫০ কিলোমিটার/ঘণ্টা হয় তাহলে তাদের মুখোমুখি হবার সময় ও স্থান নির্ভুলভাবে বের করা যায় না। হিসেব করলে তাদের মিলিত হবার সময় পাওয়া যায় ৩.৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩ (ইনফিনিটি পর্যন্ত) ঘণ্টা। আর রাজাশাহী ও ঢাকা থেকে থেকে দূরত্ব পাওয়া যায় যথাক্রমে ১৩৩. ৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩ (ইনফিনিটি পর্যন্ত) কিলোমিটার ও ১৬৬.৬৬৬৬৬৬৬৬ কিলোমিটার। অর্থাত গাণিতিক হিসেবেও অসম গতিতে চলমান দুটি বস্তুর সাপেক্ষ অবস্থান বের করা সম্ভব নয়।
কখনও কখনও চরমপন্থা কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারে। তার অর্থ এটা নয় যে এটা ভালো কিছু। ধরুন, জনতা এক ব্যক্তিকে পকেটমার সন্দেহে পেটাচ্ছে। আপনি কোনভাবে জানেন যে জনতার অনুমান ভুল। আপনি লোকটিকে মারপিট করতে তাদের নিষেধ করলেন। তারা শুনলো না। আপনি তাদের শারীরিকভাবে বাধা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। এরপর আপনার পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন এবং ফোন করে পুলিশ ডাকলেন। পুলিশ পৌঁছার পর গুরুতর আহত লোকটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠালো। এক্ষেত্রে মারমুখী জনতাকে নিষেধ করা ও বাধা দেওয়া ছিল মধ্যপন্থা। আপনি এই দুটি পন্থা প্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়েছেন। গুলিবর্ষণ করা ছিল চরমপন্থা। এটি প্রয়োগ করে আপনি একজন নিরীহ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বিপরীত একটা ঘটনাও ঘটতে পারতো। জনতা ভুল বুঝে আপনাকেও মেরে ফেলতে পারতো। গুলিবর্ষণ করার কাজটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ‘সুবর্ণ মধ্যক’ তত্ত¡ থেকে আমরা যে উপদেশ পাই তা অনুসরণ করলে গুলিবর্ষণ করার মতো চরমপন্থা অবলম্বন করা আপনার উচিত হয়নি।
জাপানীদের বিশ্বাস পৃথিবীর কেন্দ্র হচ্ছে ফুজি পর্বতে। আবার তিব্বতিদের বিশ্বাস পৃথিবীর কেন্দ্রের অবস্থান কৈলাস পর্বতে। গ্রীকরা বিশ্বাস করতো অলিম্পাসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাইটিকাস থেকে পৃথিবীর সব প্রান্ত-বিন্দুর দূরত্ব সমান। প্রাচীনকালে পৃথিবীকে সমতল বা চাকতির মতো ভাবা হতো। এখন আমরা জানি যে কোন গোলকের পৃষ্ঠদেশের কোন কেন্দ্র থাকে না। কোন একটা ঘটনাকে সরলরৈখিক না ভেবে যদি আমরা গোলকের পৃষ্ঠদেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ভাবি তাহলে তার ‘সুবর্ণ মধ্যক’ বের করা কঠিন হবে। ধরুন, ‘ক’ এর শত্রু ‘খ’। ‘গ’ এদের দুজনের-ই বন্ধু। ‘খ’-র সাথে বন্ধুত্ব ত্যাগ করার শর্তে ‘ক’, গ এর সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চায়। আবার ‘ক’-র সাথে বন্ধুত্ব ত্যাগ করার শর্তে ‘খ’, ‘গ’-র সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চায়। এক্ষেত্রে ‘গ’, ‘ক’-র দাবি মানতে পারে, ‘খ’-র দাবি মানতে পারে অথবা দুইজনের দাবিই প্রত্যাখ্যান করতে পারে। এই তিন পদক্ষেপের সবগুলি-ই চরমপন্থা। ‘গ,’ এর বাইরে কিছু করতে পারবে না। তাই ‘সুবর্ণ মধ্যক’ যে সব সময় খুঁজে পাওয়া যাবে এমন নয়। আবার খুঁজে পাওয়া গেলেও সেটা যে চরমপন্থার চেয়ে বেশি কার্যকর হবে সেটাও বলা যায় না।
আমরা বাস্তব জীবনে যে সকল ঘটনার মুখোমুখি হই তার বেশিরভাগ-ই অ-সরল। ধরা যাক, আমার কোন নিকট আত্মীয় অপহৃত হয়েছে। অপহরণকারীরা ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে মুক্তি দিতে চায়। আমি (১) পুরা টাকা দিতে রাজি হতে পারি, (২) ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারি, (৩) ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাবের পাশাপাশি পুলিশকে জানাতে পারি, (৪) কোন টাকার প্রস্তাব না দিয়ে অপহরণকারীদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিতে পারি। সংজ্ঞা অনুযায়ী আমরা এখানে ২ ও ৩ কে মধ্যপন্থা এবং ১ ও ৪ কে চরমপন্থা ধরতে পারি। এই পন্থাগুলোর মধ্যে কোনটি বেশি ফলপ্রসূ হবে সেটা আমরা নিশ্চিত করে অনুমান করতে পারি না; অপহরণকারীদের বৈশিষ্ট্যের ওপর তা নির্ভর করবে।
অপসূর দশায় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব অনুসূর দশার তুলনায় ৫০ লাখ কিলোমিটার বেশি থাকে।
‘সুবর্ণ মধ্যকে’র সুফল বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু পন্থাটা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে যে অস্পষ্টতা তৈরি হয় তা থেকে বের হওয়া সবসময় সহজ নয়। সূর্য তার নিজ কক্ষপথে ঘন্টায় আট লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। অর্থাত এর কক্ষপথীয় দ্রুতি সেকেন্ডে ২১৭ কিলোমিটার। পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় সূর্যের সাথে একই দূরত্ব অতিক্রম করে। এটা করতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষার জন্য পৃথিবীকে একটা উপবৃত্তাকার (প্যারাবোলা) পথে চলতে হয়। এটাই পৃথিবীর কক্ষপথে টিকে থাকার জন্য ‘সুবর্ণ মধ্যক’। সূর্য স্থির হলে পৃথিবীকে এই অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হতো না; তখন সে এক নিখুঁত বৃত্তাকার পথে চলতে পারতো। আমাদের জীবনের ঘটনাপ্রবাহও সরল রেখায় চলে না। আবার প্রত্যেক মানুষের বক্রতার ধরণে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য আছে। তাই প্রত্যেকের ‘মধ্যপন্থা’ অন্যদের থেকে আলাদা হবে। আমাদের সবার মধ্যে একটা পরিমাপক আছে। আমরা সেটা যদি ব্যবহার করি তাহলে আমাদের চলার জন্য জ্ঞানতত্তে¡র সকল শাখাকে তা অতিক্রম করতে পারে। ছোট মুখে বড় কথা বলা হয়ে গেল! কিন্তু একথাটা বলার জন্য-ই এতো দীর্ঘ এই বিরক্তিকর আলোচনা চালিয়ে এসেছি।
আমাদের চোখ একটা কমপ্লেক্স অপটিক্যাল সিস্টেম যা আলোকে ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল ইমপালসে রূপান্তর করে মস্তিষ্কের নিউরোন সেলে পাঠায়। ফলে চোখ যে বস্তু থেকে আলো গ্রহণ করে সেটাকে আমরা দেখতে পাই। কোন বস্তু থেকে বিচ্ছুরিত আলোর পরিমাণ বেশি হলে ডায়াফ্রাম সংকুচিত করে এবং কম হলে ডায়াফ্রাম স¤প্রসারিত করে প্রয়োজনীয় মাত্রার আলো রেটিনায় ফেলি যাতে আমরা বস্তুটির যথার্থ প্রতিরূপ দেখতে পাই। এটা আমাদের শরীরে ঘটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অবস্তুগত বিষয় ও চিন্তার ক্ষেত্রেও বিষয়টা প্রায় একইরকম। কেউ আমাদের গালি দিলে বা প্রশংসা করলে আমরা আমাদের ‘মনের ডায়াফ্রাম’কে ছোট-বড় করে ধারণযোগ্য বা প্রয়োজনীয় অংশটুকু ভেতরে ঢুকতে দেই। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ক্ষেত্রেও একই ডায়াফ্রাম’ ব্যবহার করি।
‘সুবর্ণ মধ্যক’ বা ‘গোল্ডেন মিন’ নির্বিবাদ জীবন যাপনের জন্য সর্বোত্তম পন্থা এ নিয়ে দ্বিমত কম। কিন্তু কোনটি ‘সুবর্ণ মধ্যক’ সেটা আমাদের নির্ধারণ করে দেবে কে? আসুন নিচের ঘটনা থেকে তার উত্তর পেতে চেষ্টা করি- ১৮৬১ সালে আমেরিকার সাতটি দাসরাজ্য আমেরিকান ইউনিয়ন বর্জন করে ‘কনফেডারেট স্টেটস অব আমেরিকা’ গঠন করলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৮৬১ সালের এপ্রিলে কনফেডারেট ফোর্স, ফোর্ট সামটারের উপর গোলাবর্ষণ করে। সাউথ ক্যারোলিনার এই দুর্গটি ইউনিয়ন বাহিনীর জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লিংকন চিন্তিত হয়ে সমমনা অন্য অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। একদিন নৈশভোজে সৈন্যদের সাথে থাকা এক ধর্মযাজক আব্রাহাম লিংকনকে বলেলেন, “মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আসুন, আমরা বিশ্বাস রাখি এবং প্রার্থনা করি যে এই দুঃসময়ে মহান ঈশ্বর আমাদের পক্ষে থাকবেন।” লিংকন বললেন, “আমি জানি, ঈশ্বর সব সময় চান ন্যায়ানুগ, সত্যনিষ্ঠ ও সর্বোত্তম কাজটি জিতে যাক। তিনি কারো পক্ষে থাকেন না। তাই, বরং আসুন, আমরা সবাই প্রার্থনা করি, এই জাতিটা যেন সব সময় ঈশ্বরের ইচ্ছাকে জিতিয়ে দিতে পারে।”
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।