হাসান গোর্কি : এখন থেকে বছর পনেরো আগে আমি ঢাকার খিলক্ষেতে একটা ফ্ল্যাটে একা থাকতাম। সেসময় আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। খিলক্ষেতের পেছনে একটা শহর রক্ষা বাঁধ আছে। অফিস থেকে ফিরে বিকেলে ঐ বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটতাম। বছর খানেক পরিচিত কারো সাথে আমার দেখা হয়নি। তখন আমি একটা নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছি। এই অফিসের কেউ আমার পূর্ব পরিচিত ছিল না। সেল ফোনটাও বন্ধ ছিল। মাঝে মাঝে নিউমার্কেটে আসতাম। নীলক্ষেত থেকে পাঁচ টাকা করে ১০-২০টা রিডার্স ডাইজেস্ট কিনতাম। পেছনের একটা দোকানে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ভালো সংগ্রহ ছিলো। আমি মাঝে মাঝে সেগুলো কিনতাম। ঐ দোকানের মালিকের সাথে এক সময় ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। আমি দোকানের মধ্যে বসে বই পড়তাম বা ক্রেতাদের বই খুঁজে দিয়ে সাহায্য করতাম। মালিকের নাম রউফ। উনি একদিন তার বাসায় আমাকে দাওয়াত করলেন। আগা মসীহ লেনে তার শতাব্দী প্রাচীন দ্বিতল ভবনে গিয়ে দেখলাম তিনি একা থাকেন। তার বাবা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মারা গেছেন। ভদ্রলোক বিয়ে করেননি। বাসার কেয়ারটেকার রান্না করে দেয়। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাবার আগে তার সাথে গল্প করছিলাম। এক সময় জিজ্ঞেস করলাম,
– এতো বড় একটা বাসায় একা থাকেন, আপনার নিঃসঙ্গ লাগে না?

– বাবা-মা মারা যাবার পর ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেছে। (এরপর হেসে বললেন) তাছাড়া এ’বাড়িতে তো আমি পুরোপুরি একাও থাকি না। আমার বেডরুমের দেয়ালে দুটি টিকটিকি থাকে, কয়েকটা ইঁদুরকেও ঘোরাফেরা করতে দেখি। রান্না ঘরে শ’খানেক তেলাপোকা থাকে, পুরো বাসায় পিঁপড়াও থাকে হাজার কয়েক।

তিনি মজা করার জন্য বললেও আমার অন্য কারণে ভালো লাগলো। আমার শোবার ঘরের দেওয়ালে দুটি বড় আকৃতির সবুজ রঙের টিকটিকি বাস করতো এবং প্রতি রাতে ওদের দেখে আমার নিঃসঙ্গতা কাটতো। ভাবতাম, এই প্রাণীগুলোর পূর্বপুরুষ হয়তো এ অঞ্চলেই বাস করতো এখানে মানব বসতি গড়ে ওঠার আগে থেকে। এক সময় মানুষ বাড়িঘর তৈরি করলে প্রাণীদের অনেকে সেখানে বাস করতে শুরু করে। এরা তাদের বংশধর; আমি এখানে আগন্তুক।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সূর্যকে প্রদক্ষিণরত আদি ধূলিকণা ও গ্যাসের পুঞ্জ ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর সৃষ্টি হয় এখন থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে। আর প্রাণের আবির্ভাব ঘটে মোটামুটি ৩৫০-৪০০ কোটি বছর আগে। বেস্টলাইফ ম্যাগাজিন (আগস্ট, ২০১৫) প্রাচীনতম ত্রিশ প্রাণীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনাসহ একটা তালিকা ছেপেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তালিকাটা তৈরি করা। তালিকা অনুযায়ী, পৃথিবীতে টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীদের তালিকায় এক নম্বরে আছে সাইনোব্যাকটেরিয়া । এদের আদি প্রাণের সামসময়িক মনে করা হয়। এরা পৃথিবীতে বাস করছে সাড়ে তিনশ’ কোটি বছর ধরে। এরপর আছে সিনোফোরা (এক ধরণের জেলি ফিস)। সাত সমুদ্রে এরা সাঁতরে বেড়াচ্ছে ৫২ কোটি বছর ধরে। সী- স্পঞ্জ, ব্রাসিওপড (এক ধরণের শামুক) ও কেন্নো টিকে আছে বিগত ৫০ কোটি বছর ধরে। এলিফ্যান্ট শার্ক- ৪০ কোটি, তেলাপোকা- ২৫ কোটি, চিংড়ি- ২২ কোটি, কচ্ছপ ও গিরগিটি- ২০ কোটি, পিঁপড়া- ১২ কোটি, প্লাটিপাস-১১ কোটি, মৌমাছি- ১০ কোটি, কুমির, সজারু, ব্যাঙ- ৫ কোটি, উকুন- ২ কোটি, ও সারস- ১ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে।

আর হোমো সেপিয়েন্সদের উদ্ভবকে যদি পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের সময় ধরা হয় তাহলে সেটা ঘটেছে দুই থেকে তিন লাখ বছর আগে। আর মানুষের আদি পুরুষ পৃথিবীতে এসেছে মোটামুটি ৫০ লাখ বছর আগে। এই যে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী আগেভাগেই পৃথিবীতে এসে বসে আছে এর পেছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করেছে সেটা আমরা জানি না। উকুনের প্রথম আবাস মেয়েদের চুল নয়। মানুষ পৃথিবীতে আসার ১ কোটি ৯৮ লাখ বছর আগে থেকে তারা পৃথিবীতে বাস করছে। মৌমাছি পৃথিবীতে এসেছে আমাদের চেয়ে ২১ কোটি ৯৮ লক্ষ বছর আগে। তার অর্থ পৃথিবীতে মৌমাছির উত্পাদিত মধু ৯৯.৯৯% সময় নষ্ট হয়েছে বা অন্য প্রাণীরা খেয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে পছন্দ করি পৃথিবীর সৃষ্টি বা উদ্ভব হয়েছে আমাদের জন্য। তাহলে আমরা লেট কামার কেনো? হ্যাঁ, সম্রাট দরবারে আসেন সবার শেষেই।

এবার দেখা যাক সম্রাট তার পৃথিবী নামক সাম্রাজ্যের কতটুকু তার অধিকারে রাখেন। পৃথিবীতে মোট ভূমির পরিমাণ ১৯৬.৯ মিলিয়ন বর্গমাইল। এই ভুমির মাত্র ১% এলাকায় মানুষ বাস করে। বাঁকি ৯৯% এলাকায় আছে নদী-হ্রদ, অরণ্য-সমতল, পাহাড়-মরুভূমি। পৃথিবীতে ৯ লাখ প্রজাতির পোকা-মাকড় বাস করে যাদের চিহ্নিত করা গেছে। ধারণা করা হয় যে পোকা-মাকড়ের মোট প্রজাতি ৩ কোটি এবং মোট সংখ্যা ১০ কুইন্ট্রিলিয়ন বা ১০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০টি। অর্থাত ১ জন মানুষের বিপরীতে ১২৫ কোটি পোকা-মাকড় আছে। পৃথিবীতে মানুষের তুলনায় শুধু পিঁপড়ার সংখ্যা-ই ১০ লাখ গুণ বেশি। আর তাদের বায়োমাস (জৈববস্তু) পৃথিবীতে বসবাসকারী ৭৯০ কোটি মানুষের জৈববস্তুর ওজনের সমান।

পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা অনুমান করা হয় ৫x১০৩০ বা ৫,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০.০০০.০০০টি। এতো বড় সংখ্যাটা মাথায় নেওয়া কঠিন। দুই-একটা উদাহরণ দেখা যাক- ব্যাকটেরিয়া যে জৈববস্তু (বায়োমাস) তৈরি করে তা পৃথিবীর তাবত উদ্ভিদ ও প্রাণীর জৈববস্তুপুঞ্জকেও অতিক্রম করে। আপনি যদি আপনার বাড়ির পেছন থেকে চা চামচে ১০ গ্রাম মাটি তুলে নেন তাহলে তাতে মোটামুটি ৪০ কোটি ব্যাকটেরিয়া থাকবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষের অন্ত্রে ৩০০-৫০০ প্রজাতির প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া থাকে। এর মানে পৃথিবীতে যতো মানুষ আছে তার ১২,৫০০ গুণ ব্যাকটেরিয়া বাস করে আমাদের প্রত্যেকের ইন্টেস্টাইনে। এদের ৯০-৯৫% উপকারী ব্যাকটেরিয়া। সেক্ষেত্রে আমরা ভাবতে পারি সৃষ্টির সেরা জীবের অন্ত্রে বসে এরা তাদের সেবা করছে। কিন্তু বানর, শিম্পাঞ্জী, কুকুর, তিমি, সাপ, উটপাখি- এদের সবার অন্ত্রেই ব্যাকটেরিয়ারা একই কাজ করছে। ফলে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবার সুবিধাটুকু এই তথ্য থেকে নেওয়া যাচ্ছে না।

কিছু তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জীব বিজ্ঞানীদের অনুমান, পৃথিবীর মহাসমুদ্রগুলোতে ৩.৫ ট্রিলিয়ন (৩,৫০,০০০,০০০,০০০) সংখ্যক মাছ (যাদের ওজন ১ কেজির বেশি) রয়েছে, । এই সংখ্যা পৃথিবীতে মানুষের মোট সংখ্যার ৪৪ গুণ। পৃথিবীতে সব মিলিয়ে ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি পাখি আছে। এর মধ্যে চড়ুই প্রজাতির পাখির সংখ্যা এক হাজার কোটি। অর্থাত চড়ুইদের সংখ্যা মানুষের চেয়ে ২১০ কোটি বেশি। নিমাটোড পর্বের প্রাণীরা লম্বা, সরু, নরম দেহবিশিষ্ট, উপাঙ্গহীন, ও অমেরুদণ্ডী। কৃমি জাতীয় এই প্রাণীদের অনেকেই বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে বাস করে। আবার মাটিতে বা জলজ পরিবেশেও মুক্তভাবে বাস করে। এদের বেশিরভাগকেই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। এদের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকম বড়- প্রত্যেক মানুষের বিপরীতে এই পর্বের ৫৭ বিলিয়ন (৫৭০০ কোটি) প্রাণী পৃথিবীতে বাস করে।

পৃথিবীর সকল বহুকোষী প্রাণী একটা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও জটিল জীবনের একক। তারা মানুষের মতো খাদ্যগ্রহণ করে, রেচন-নিঃসরণের মাধ্যমে সেই খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করে চলাফেরা করে, চিন্তা করে, সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। তারা বংশ বিস্তার করে, প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার উপায় খুঁজে বের করে। মানুষের মস্তিষ্ক অন্যদের তুলনায় শক্তিশালী। মানব মস্তিষ্কের অনন্য গুণ হলো এর সৃষ্টিশীলতা। অন্য প্রাণীদের সাথে মানুষের মৌলিক পার্থক্য এটাই। এর বাইরে প্রাণী হিসেবে আমাদের আর কোন বিশেষত্ব নেই। প্রকৃতির এই বিশাল প্রান্তর জুড়ে যে ট্রিলিয়ন- ট্রিলিয়ন প্রাণী বাস করছে তাদের আমরা কীভাবে দেখবো? ইঁদুর, তেলাপোকা বা একটা জলহস্তীর জীবন কি একটা মানুষের জীবনের চেয়ে কম মুল্যবান? আমাদের কাছে তা-ই। কিন্তু একটা তেলাপোকার কাছে তার জীবন আমার জীবনের চেয়ে বেশি মুল্যবান। আমাদের ধারণা গবাদি পশু সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের খাদ্য হিসেবে। এই খবরটা তারা জানতে পারলে কোন গৃহপালিত গবাদি পশুকে আটকে রাখা যাবে না। প্রাণী হিসেবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি অন্য প্রাণীদের কাছে নেই। সকল প্রাণীর কাছেই পৃথিবীতে অন্যদের উপস্থিতি কম গুরুত্বপূর্ণ।

বাঘের কাছে কেঁচোর উপস্থিতির কোন মূল্য নেই; কিন্তু খাদ্য হিসেবে বনে হরিণ থাকাটা তার কাছে জরুরি। সকল প্রাণী-ই হয়তো মনে করে প্রকৃতিতে যা কিছু আছে তা শুধু তাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ সাধনের জন্য আছে। হরিণের ধারণা হতে পারে গাছের কচিপাতা তার জন্য তৈরি হয়। গাছ যে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের খাদ্য যোগাড় করতে পাতা বের করে সেটা হরিণের ভাবার সুযোগ নেই। আবার বাঘকে দেখলে হরিণদের মনে হতে পারে তাদের অকল্যাণ করাই বাঘের কাজ। তার মাংস না পেলে বাঘের বাবুরা যে না খেয়ে মরে যাবে সেটা নিয়ে হরিণ চিন্তিত নয়। এভাবে সকল প্রাণীর কাছে তাদের উপযোগিতা ও বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব কি মানুষের ক্ষেত্রে বেশি? আমরা সেরকম বিশ্বাস করতেই পছন্দ করি, যেমন অন্য প্রাণীরাও করে।

সাড়ে তিন বা চার বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর আলো হাওয়াতে বাস করে আসা প্রাণীদের চেয়ে আমরা নিজেদের সুপিরিয়র ভাবছি আসলে একটা ভ্রান্ত বীক্ষণ থেকে। আমাদের ধারণা আমরা পুরো প্রকৃতির দখল নিয়ে ফেলেছি। এই দখলের ধারণাটা কেমন তা একটা সহজ কল্পনা থেকে বুঝতে চেষ্টা করা যাক- আমি এক খণ্ড জমি কিনে সেখানে ধান চাষ করলাম এবং সময়মতো ফসল ঘরে তুলে নিলাম। কিন্তু এটাই সব নয়। একই সময় ঐ জমি থেকে কেঁচো, বিভিন্ন প্রজাতির পোকা-মাকড়, পতঙ্গ-পাখি তাদের আহার্য- আশ্রয় সংগ্রহ করেছে। তাদের সংখ্যা কয়েক লক্ষ বা কোটির ঘরে হতে পারে। আমি যে ধান পেয়েছি তা দিয়ে একটা সংসারের কিছুদিনের আহার জুটবে। কিন্তু ঐ প্রাণীদের পরিবার গঠন, সন্তান উত্পাদন-লালন-পালন সহ পুরো একটা জীবন চক্র হয়তো পূর্ণ হবে ফসল মাঠে থাকার তিন বা চার মাস সময়ের মধ্যে। আর অণুজীবদের প্রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ঐ মাঠে যে বিশাল কর্মযজ্ঞময় উত্সব মুখরতা চোখে পড়বে তা দেখে আমি হতাশ হয়ে যাবো। নিজের অর্জনকে আংশিক, অপ্রতুল, অসম্পূর্ণ ও তুচ্ছ মনে হবে।

প্রাচীন পৃথিবীর একটা দৃশ্যকল্পের কথা ভাবা যাক- পৃথিবীর সবগুলো খাল, বিল, নদী, নালা, হ্রদ, সমুদ্রে বিপুল সংখ্যক মাছ, জলচর প্রাণী; বন-বনানীতে রঙ-বেরঙের পাখি-পতঙ্গ, পশু; সমতলে কোটি কোটি গবাদি পশু ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশে চাঁদ উঠছে, অলস শুভ্র মেঘের দল নীল দিগন্ত পাড়ি দিচ্ছে লক্ষ্যহীন, নদীতে জোয়ার-ভাটা হচ্ছে, আকাশ আঁধার করে বৃষ্টি নামছে, রঙধনু উঠছে, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ ডাকছে, দখিণা বাতাসে জংলি ফুলের ঘ্রাণ-পরাগরেণু ভেসে যাচ্ছে, ঘাস্ফুলের শিশির বিন্দুতে সূরে‌্যর সাত রঙা আলো পড়ছে। তখন সারা পৃথিবীতে কোন রাস্তা নেই, পায়ে চলা মেঠো পথ নেই, ইট-পাথরের, কোন ঘর নেই। শহর-নগর, বন্দর- গ্রাম, লোকালয়, বাস, নৌকা, বিমান নেই। সর্বোপরি কোন মানুষ নেই। আজ থেকে ১০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীটা এরকম ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। এরকম একটা পৃথিবী ছিল কেন? সেটা চলছিল কেন? আমরা যেখানে ছিলাম না সেখানে উদ্দেশ্য কী ছিল? এই পৃথিবীর উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার সাথে আসলে হয়তো আমাদের সম্পর্ক নেই। সেটা ছিল স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে মূল্যবান ও উদ্দেশ্যহীন। এখনও তা-ই আছে। হয়তো মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী পৃথিবীর জন্য আলাদা করে মূল্যবান নয়। আবার মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর জন্য ঈশ্বর/ প্রকৃতি আলাদা কোন সুবিধা দেয়নি। বুদ্ধি, শারীরিক শক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করে যে প্রাণী যতোটা পারে সুবিধা নিচ্ছে।

দার্শনিক পল কার্টজ এক নিবন্ধে (“Darwin Re-Crucified: Why Are So Many Afraid of Naturalism?”) বলেছেন, “প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য সর্বোত্তম উপাদান হলো ‘বস্তুর নীতি’ যার মধ্যে আছে ভর, শক্তি এবং সায়েন্স কমিউনিটি দ্বারা স্বীকৃত ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মগুলো। আবার, প্রকৃতিবাদের সত্তাতাত্তি¡ক অন্বীক্ষা (ontological inference) অনুযায়ী আত্মা, ডেইটি এবং ভূতরা সত্য নয় এবং প্রকৃতিতে এসবের কোণ ‘উদ্দেশ্য’ নেই। এই ধারণা মেনে নেওয়া হলে আমরা পৃথিবীতে কেন আছি তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেটা হলো, মানুষ সহ সকল প্রাণীর উদ্ভব, বিকাশ, বিবর্তন, টিকে থাকা বা বিলুপ্ত হওয়া ভৌত কার্যকারণ সম্পর্কে আবদ্ধ। সেক্ষেত্রে আমরা পৃথিবীর মালিকানা বা নিদেনপক্ষে জীব জগতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারি তখন-ই যখন প্রকৃতিতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীদের থেকে আমরা এগিয়ে থাকবো।

কিন্তু সত্য এটাই যে মানুষ এক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রাণীর চেয়ে পিছিয়ে আছে। বুদ্ধি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ প্রকৃতির অনেক বিরূপতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা অনেকটা নদীতে বাঁধ দিয়ে বন্যার পানি থেকে ঘর বাঁচানোর মতো। এটা তো আসলে প্রকৃতিতে টিকে থাকা হলো না, আত্মরক্ষা করা হলো মাত্র। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। পিঁপড়ারা এক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। ঝড়-সাইক্লোন, মহামারী- অতিমারী, অতিবৃষ্টি -অনাবৃষ্টি, যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ, শৈত্যপ্রবাহ-দাবদাহ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে পিঁপড়াদের নিজস্ব জ্ঞান ও পদ্ধতি আছে যার সবটুকু-ই প্রাকৃতিক। ফলে প্রকৃতিকে মোকাবিলা করার জন্য এসবের কার্যকারিতাও বেশি।

পৃথিবীতে প্রাণী হিসেবে মানুষ কি তাহলে অনন্য নয়? হ্যাঁ, অবশ্য-ই অনন্য- অন্য সকল প্রাণীর মতো; মশা, টিয়া পাখি বা ইলিশ মাছের মতো মানুষও অনন্য। আর পৃথিবীর মালিকানা? এই গল্প থেকে তার ধারণা পাওয়া যাবে- ধরুন আপনি আধা জলমগ্ন এক খণ্ড জমির মালিক। আমি ঐ জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা দিয়েছি। আমরা মাসে একবার আদালতে হাজির হই। সালিশ বৈঠক করি। আমাদের লাঠিয়াল বাহিনী মাঝে মাঝে মারামারি করে। আমরা যখন এসব করছি তখন কিন্তু সাপ, ব্যাঙ, জোঁক, কেচো, শিং মাছ, পোকা- মাকড়ৃ সেখানে নির্বিঘ্নে বাস করছে, জলকেলি করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। দখল ও ভোগ সূত্রে তারাই ঐ জমির আসল মালিক। আর আমরা দুই জন কল্পনায় মালিক সেজে যুদ্ধ করছি। রাশিয়া পুরো ইউক্রেন দখল করে নিলে ইউক্রেনের পোকা-মাকড়দের কোন সমস্যা নেই। এতো বড় একটা ঘটনা যে ঘটে গেছে সেটা তারা জানতেই পারবে না। আসল মালিক কখনও বিচলিত হয় না।
hassangorkii@yahoo.com
এপ্রিল ২৯, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।