হাসান গোর্কি : “বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে, সাগর তীরে পাহাড় ঘিরে
মেঘ গুড়গুড় বৃষ্টি নামে,পাতার ভিড়ে পাখির নীড়ে”
এ’ ধরণের একটা ছড়া আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম। ঠিক কতদিন আগে থেকে বৃষ্টি ঝমঝম শব্দে ঝরে সেটা আমরা জানি না। তবে ঘরের চালে টিন ব্যবহার শুরু হবার আগে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হতো না। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে বৃষ্টির বর্ণনায় এই শব্দের প্রয়োগ নেই। এমনকি এখন থেকে মাত্র এক শতাব্দী কাল আগেও ছিলনা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর \
আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর?” (মেঘদূত, মানসী)
ক্লাসে শিক্ষক এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছেন, “ঘোড়ার ডাক কে প্রচলন করেন?”
ছাত্র — “স্যার, ঘোড়া প্রাচীনকাল থেকেই ডাকতো। কেউ প্রচলন করেনি।”

বৃষ্টির শব্দ বা ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করতে হয়েছিল কিনা সেটা আমরা জানি না। কিন্তু অঙ্ক হিসেবে ‘০’ এর প্রচলন যে জটিল একটা কাজ ছিল সেটা আমরা শুনেছি। স্কুলে আমাদের গণিত শিক্ষক একদিন বললেন, “ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট শূন্য আবিষ্কার করেন? সভ্যতার ইতিহাসে এটা ছিল এক যুগান্তকারী আবিস্কার। “মনে মনে ভাবলাম এটা কোন আবিষ্কারের জিনিস হলো নাকি! ১ থেকে ৯ পর্যন্ত অঙ্কযেভাবে হিসাবে এসেছে ‘০’ ও সেভাবে আসতে সমস্যা কোথায়! অনেক বয়স হলে পরে সমস্যাটা অল্প করে বুঝেছি। কী বুঝেছি সেটা এই গল্প থেকে বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ড্রইং শিক্ষক ছাত্রদের ছবি আঁকতে বললেন- তিনটা ঘোড়া মাঠে ঘাস খাচ্ছে। ছাত্রদের সবাই ছবি এঁকে জমা দিলো। এক ছাত্র সাদা পৃষ্ঠা জমা দিলো। শিক্ষক বললেন, “এখানে ঘোড়া কোথায়?” ছাত্র- “বাড়ি চলে গেছে।” শিক্ষক- “তাহলে ঘাস কোথায়?” ছাত্র- “ঘোড়ারা খেয়ে ফেলেছে।” এটা একটা প্রচলিত কৌতুক। কিন্তু শুরুর অধ্যায়ে গণিতে সব কিছুর অনুপস্থিতি বুঝানো এই সাদা পৃষ্ঠার পাঠোদ্ধার করার মতোই জটিল ছিল।

আর্যভট্ট পদবাচ্যের আকারে সংখ্যা উপস্থাপনের একটি নিজস্ব পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। সেখানে সংখ্যাকে শব্দের আকারে উপস্থাপন করা হতো। ব্যঞ্জনবর্ণগুলোকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন অঙ্ক হিসেবে। আর স্বরবর্ণগুলোকে ব্যবহার করেছিলেন অঙ্কগুলোর অবস্থান নির্দেশক হিসেবে। এটাই ছিল দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থার শুরু। স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় গাণিতিক প্রক্রিয়াগুলোর বিন্যাস কেমন হবে তার মূল সূত্র ছিল এখানেই। এখন আমরা যে ডেসিমেল পদ্ধতি ব্যবহার করি সেটা শূন্যের আবিস্কার থেকে। ভারত থেকে ধারণাটা আরব গণিত বিদরা নিয়ে যান ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এর অনেক পর শূন্যের ব্যবহার আরবদের কাছে শেখে ইউরোপ। তবে দশমিক পদ্ধতির ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয় ইউরোপেই। ১৫৮৫ সালে বেলজিয়ান গণিত বিদ সিমন স্টেভিন এই পদ্ধতির প্রচলন করেন।

শূন্য (বা শূন্যের সমতুল্য ধারণা) কে আর্যভট্ট ‘খ’ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। এটা বর্ণমালার ‘খ’ নয়। ‘খ’ অর্থ আকাশ, খগ, খেচর, খদ্যোত, যা আসলে শূন্যতাকে বুঝায়। যেমন, ৪৯৯ অর্থ (৪+খ+খ)+(৯+খ)+( খ+৯)। শূন্যস্থান জ্ঞাপক ‘খ’-ই আজকের ‘শূন্য’। গণিতে মানহীন একটা অঙ্কের যে প্রয়োজন আছে সেটা আর্যভট্ট-ই প্রথম বুঝেছিলেন। তার ধারণায় শূন্য হচ্ছে পূর্ণসংখ্যার সেট সদস্য এবং অ-ঋণাত্মক পূর্ণসংখ্যার সেট সদস্য। সহজ ভাবে বলা যায় শূন্য হচ্ছে -১ এবং ১ এর মধ্যবর্তী একটি সংখ্যা। অঙ্ক হিসেবে শূন্যের (‘০’) সাথে অন্যদের পার্থক্য হলো, শূন্য ধণাত্মক, ঋণাত্মক কোনটিই নয়, বরং তাকে অঋণাত্মক বলা চলে। যেমন আমরা যদি বলি রহিম ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ নয়, তাহলে তা এটা নিশ্চিত করে না যে সে নেতিবাচক মানসিকতার মানুষ। বড় জোর বলা যেতে পারে সে অ-ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ। যেমন ইংরেজি অঢ়ড়ষরঃরপধষ অর্থ রাজনীতির বিষয়ে অনাগ্রহী। কিন্তু সে রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ বা শত্রুতাপূর্ণ নাও হতে পারে। শূন্য দ্বারা কোন সংখ্যাকে ভাগ করলে কী পাওয়া যায় তা অ-সংজ্ঞায়িত। আবার শূন্য একটি ধণাত্মক সংখ্যা নয় কিন্তু এর অসীম সংখ্যাক ভাজক আছে। এ রহস্যের শেষ নেই, যেমন শেষ নেই বিজ্ঞান ও দর্শন শাস্ত্রে শূন্যের ধারণা-রহস্য।

পদার্থবিদ্যায় ‘শূন্য’ বলতে আমরা বুঝি সবকিছুর অনুপস্থিতি। যদি একটা কক্ষের সব আসবাবপত্র বের করে ফেলা হয় তাহলে কি কক্ষটাকে শূন্য বলা যাবে? না, কক্ষটাতে বায়ু আছে। ফলে সেটা শূন্য নয়। পাম্প দিয়ে বায়ু বের করে ফেলা হলে কি কক্ষটাকে শূন্য বলা যাবে? না, বলা যাবে না। কক্ষের মধ্যে তখন জানালা দিয়ে যে আলো ঢুকছে সেটা কিছু অতি পারমাণবিক কণা দিয়ে গঠিত। এমনকি সব দরজা জানালা বন্ধ করে নিশ্ছিদ্র করা হলেও ঘরটাকে শূন্য বলা যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শূন্যস্থান হলো, স্থান ও সময়ের একটি এলাকা যেখানে পদার্থের সব উপাদান শূন্য। এটি শক্তি ও ভ্রামকশূন্য একটি এলাকা। তার মানে স্থানটিকে সবরকম পদার্থকণা, এমনকি তরঙ্গ থেকে মুক্ত থাকতে হবে যা শক্তি ও ভ্রামক তৈরি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে মহাশূন্যও পুরোপুরি শূন্যস্থান নয়। সেখানেও প্রতি ঘন মিটারে গড়ে একটি পদার্থ কণার অস্তিত্ব আছে। এমনকি ইন্টার গ্যালাক্টিক স্পেসে প্রতি ঘন মিটারে ১০-৬টি পদার্থ কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তার অর্থ আমাদের ঘরটাও শূন্য নয়। মহাবিশ্বেও পরম শূন্য স্থান বলে কিছু না থাকার কথা।

পরম শূন্য তো সবকিছুর অনস্তিত্ত¡। তা থেকে কি কিছু তৈরি হতে পারে? উপরের আলোচনা থেকে আমরা এটা বুঝেছি যে বিগ ব্যাং এর পর যে স্পেস তৈরি হয়েছে সেটা পরম শূন্য নয়। যে শূন্য থেকে মহাজগৎ উদ্ভূত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে সেটার সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। বিষয়টা এভাবে বোঝা যাক- মহাবিশ্বের সব গ্রহ, নক্ষত্র, ব্ল্যাক হোল, পদার্থ কণা-কণিকা বিলুপ্ত হয়ে গেলো। এতে আলোর সকল উৎসেরও বিলুপ্তি ঘটলো। থেকে গেলো শুধু গভীর- নিকশ অন্ধকার। ‘থেকে গেলো’ বলা হলো আপাতত বোঝার জন্য। আসলে কিছুই থাকলো না। ধরুন আপনি প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছেন। আপনার সাথে আপনার দীঘল মায়াবী ছায়াটাও হাঁটছে। এসময় আপনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তখন কি ছায়াটা থেকে যাবে? যে উত্তরটা আমরা জানি এবার সেটা মহাজগতের সকল আলোর অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে বুঝতে পারবো পরম শূন্য দেখতে কেমন হবে।

পুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স প্রাঙ্গনে অবস্থিত আর্যভট্ট বরাহমিহির- এর ভাস্কর্য

আবারও সেই একই সমস্যা- ‘দেখতে কেমন হবে’ প্রশ্নটার মধ্যে একটা অস্তিত্তে¡র ধারণা আছে। আমার নানাবাড়ির পেছনের জঙ্গলে প্রাচীন একটা বট গাছ ছিল। আমরা বিশ্বাস করতাম ঐ গাছে পেত্নী থাকে। পেত্নীরা দেখতে কেমন তা নিয়ে আমাদের আগ্রহের সীমা ছিল না। কিন্তু যারা পেত্নীতে বিশ্বাস করে না তাদের কাছে প্রশ্নটাই অবান্তর। একইভাবে আলো ও অন্ধকারের যুগপৎ অনুপস্থিতির চিত্রটা কেমন হবে সে প্রশ্নটাও অর্থহীন। বিষয়টা বোঝার জন্য আরও একটা সহজ পদ্ধতি আছে। আপনি বেগুনি, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল (ও এদের মিশ্রণে তৈরি হয় এমন কোন রঙ) এবং সাদা, কালো বাদ দিয়ে একটা রঙ কল্পনা করতে চেষ্টা করে দেখুন; ব্যর্থ হবেন। আমাদের অনুভূতিগুলোর (ভালবাসা, স্নেহ, রাগ, অভিমান, সহানুভুতিৃ) বাইরে এমন একটা অনুভূতির কথা কল্পনা করুন যা এদের মতোই সুপ্রত্যক্ষ ও বিশিষ্ট। সেটাও সম্ভব নয়। এর কারণ, আমরা যে স্পেস-টাইম ডাইমেনশনে বাস করি তার বাইরের কোন কিছু আমরা ভাবতে পারি না। পরম শূন্য আমাদের প্রত্যক্ষণের বাইরের একটা দশা, যেখানে স্পেস- টাইম ছিলনা।

সময় ছিল না সেটা না হয় মেনে নেওয়া গেলো, কিন্তু স্পেস না থাকে কীভাবে! তাহলে বিগ ব্যাং কোথায় ঘটেছিল? বিগ ব্যাং এর আগে মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শূন্য। শূন্য আয়তনের কোনকিছুর জন্য স্পেস দরকার হয় না। যেমন আপনার ঝুড়িতে ১০টা বোমা আছে। এগুলোর জন্য স্পেস দরকার হবে। কিন্তু যদি আপনার কাছে ‘০’ টি বোমা থাকে তাহলে তার জন্য স্পেস দরকার হবে না। তখন আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বোমার (‘০’ সংখ্যক) বিস্ফোরণ কোথায় ঘটেছিল (যদি ঘটে থাকে) তাহলে আপনার উত্তর হবে ‘শূন্য আয়তনের কোন স্পেসে’। আর এই শূন্য আয়তনের কোন স্পেস বলতে একটা বিন্দু-ই বুঝায়। জ্যামিতিতে বিন্দু বলতে এমন কিছুকে বুঝায় যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নেই, কিন্তু অবস্থিতি আছে। আমরা এভাবে বুঝতে চেষ্টা করতে পারি- শূন্য আয়তনে পুঞ্জীভূত থাকা অসীম শক্তির বিস্ফোরণে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য কোন স্থান বা কালের দরকার হয়নি। এই দশাকেই বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। এই ব্যাখ্যায় মন না ভরলে আমরা এভাবেও ভাবতে পারি — বিগ ব্যাং ঘটেছিল মহাবিশ্বের সবখানে, কারণ যে বিন্দুটি বিস্ফোরিত হয়েছিল তখন সেটাই ছিল মহাবিশ্ব।

(এই ভিডিও দেখলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে-https://www.youtube.com/watch?v=9hxOMw-7aTM)
ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে শূন্যতার ধারণা- জগত-সংসার একটা মায়ার রাজত্ব, সবকিছু শূন্যতায় লীন। বৌদ্ধ ধর্ম মতে শূন্য-ই একমাত্র সত্য, তা থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি ঘটেছে এবং সবকিছুর বিনাশ- বিলুপ্তি ঘটবে শূন্যে। পাশ্চাত্য দর্শনের অন্যতম প্রধান শূন্যবাদী দার্শনিক ফেডারিক নীটশে এই ধারণাতেই বিশ্বাস করতেন।
নাগার্জুন ছিলেন গৌতম বু্দ্েধর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী বৌদ্ধ দার্শনিক। ‘প্রজ্ঞা পারমিতা সুত্র’ সম্পর্কিত দর্শনের স্রষ্টাও মনে করা হয় তাকে। তার মতে পরমতত্ত¡ বর্ণনাতীত, যা অনেকটা শূন্য তত্তে¡র সমার্থক। শূন্যবাদী বেশিরভাগ ভারতীয় দর্শনে মনে করা হয় জড়জগৎ ও মনোজগৎ উভয়ই মিথ্যা, কারণ জ্ঞাতা, জ্ঞেয় এবং জ্ঞান এই তিনটি বিষয় পরস্পর নির্ভরশীল; এর যে কোন একটার যদি অস্তিত্ব না থাকে তাহলে বাঁকিগুলোও অস্তিত্বহীন। ভৌত জগত বা মনোজগতে আমরা যা কিছু প্রত্যক্ষ করি বা অনুভব করি তার সবই মিথ্যা, স্বপ্নের মতো অলীক। বাংলা লোকগীতিতেও শূন্য তত্তে¡র ধারণা এসেছে বারবার
“মন ভেবে ভেবে বল
কি পাবি তুই মিছে এই সংসার-
শূন্য থেকে শুরু সবই, শূন্য শুধু সার।”

আমরা আগেই বুঝেছি, ভৌত সবকিছুর অনুপস্থিতির দশাকে ‘শূন্য’ বলে বুঝতে হয়। আলাদা করে শূন্যের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। প্রথম দিকের আলোচনায় আমরা দেখেছি ‘০’ একটা বাস্তব সংখ্যা। আবার আলোচনার মাঝামাঝিতে দেখেছি ‘শূন্যস্থান’ একটা সাপেক্ষ ধারণা। তার অর্থ কোনকিছু সাপেক্ষ হলেই অবাস্তব নয়। যেমন আমাদের ছায়া হলো আমাদের শরীর দিয়ে তৈরি প্রতিবন্ধকতার ফলে সৃষ্ট আলোর অনুপস্থিতির অঞ্চল। কিন্তু এই দশাকে আমরা অবাস্তব বলি না। একইভাবে পরম শূন্য অবস্থাও বাস্তব। কিন্তু তা প্রত্যক্ষণ-যোগ্য নয়।
পাশ্চাত্যের নিহিলিজমের সাথে ভারতীয় শূন্যবাদের বড় পার্থক্য থাকলেও উদ্দেশ্য অর্থে দুটি ধারণার মিল আছে। নিহিলিজম হচ্ছে একটি দার্শনিক মতবাদ, যা মনে করে জীবনের পরম কোন উদ্দেশ্য নেই। ফলে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসে পার্থিব কল্যাণ থাকলেও কোন পরম সুবিধা নেই। অস্তিত্বহীনতা-ই সবকিছুর পরম গন্তব্য। বেশিরভাগ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন মহাবিশ্বের উদ্ভব একটা দৈব ঘটনা। গ্রহ-নক্ষত্র, প্রাণী-উদ্ভিদের সৃষ্টি- বিবর্তন এর ধারাবাহিকতা। এখানে উচ্চতর কোন উদ্দেশ্য নেই। বিষয়টা এরকম হয়ে থাকলে তা খুব-ই হতাশার। আজ থেকে দুইশ’ বছর পর আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে আমের বোল আসবে, লোকজন কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাবে, যমুনার চরে কলাগাছের পাতায় বাতাস খেলা করবে, ঢাকার শপিং মলগুলোতে ইদের কেনাকাটায় ভিড় জমবে। সেসময় আমরা এখানে থাকবো না। বুদ্ধি হবার পর থেকে এই হতাশা মানুষের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। প্রাচীন গুহাচিত্রগুলোতে মানুষ পাথর কেটে তার কৃতকর্ম ও গন্তব্যের ছবি আঁকতে চেষ্টা করতো। মরে যাবার পর অপার, গহীন, অন্তহীন কোন শূন্যতাকে মাথায় নিলে অবর্ণনীয় এক হতাশায় ডুবে যেতে হয়। সেকারণে পরপারে অনন্ত জীবন বা পুনর্জন্মের ধারণা এসেছে।

আমাদের বাড়ি থেকে রেললাইন ধরে এক কিলোমিটার পশ্চিমে হেঁটে গেলে একটা ব্রিজ পাওয়া যায়। ব্রিজের গালিতে দুইটি শিমুল গাছ ছিল। আমি স্কুলের ছাত্র থাকাকালে প্রায়-ই ঐ ব্রিজে একা একা যেতাম। অনেকটা সময় একা কাটাতাম। ফাল্গুন মাসে গাছ দুটিতে অজস্র লাল ফুল ফুটতো। এই দৃশ্য দেখলে আমার মন ভালো না হয়ে খারাপ হতো। বিষণ্ণতাটা কতো গভীর ছিল সেটা আমি এখনও মনে করতে পারি। তখন আমি কিশোর। কারণটা গুছিয়ে চিন্তা করতে পারতাম না। এখন বুঝি ফুলগুলো ক’দিনের মধ্যেই ঝরে যাবে, অবচেতন মনে এই দুঃখের অনুরণন হয়তো ছিল। যদিও এটা খুব সস্তা একটা ভাবনা। আমরা খেয়াল করলে দেখবো আমাদের সবার মধ্যে এই ভাবনা কাজ করে। অনুমান করি, এরকম অনুভূতির মুখোমুখি আপনিও জীবনে বহুবার হয়েছেন। এর কারণ, আমরা আমাদের জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বকে মানতে পারি না। তখনই শূন্যতার বোধ ঘিরে ধরে। হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাস শেষ হয়েছে এভাবে, ”মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে, একঘেয়ে কান্নার সুরের মতো সে-শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে। জামগাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা-হা করে উঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কি বিপুল বিষন্নতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবেছি।”

তত্ত¡কথা বেশি হয়ে গেলো! কোন সমাধানও পাওয়া গেলো না। একটা ঘটনা আর একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক— আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক অসীম কুমার দাশ ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন। এক মাস পর দেখলাম তিনি ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “চলে এসেছেন কেন?” তিনি বললেন, “জীবনটা আসলে যাপন করার জন্য। একে কঠিন করার মানে হয় না। রাজশাহীকে মিস করি। ওখানে সব শূন্য শূন্য লাগে।” এ ঘটনায় তো সমাধান নেই! তিনি এক শূন্যতা থেকে আরেক শূন্যতায় এসে ডুব দিয়ে শান্তি পাচ্ছেন। শূন্যতার সংকট নির্মূল করা দরকার। হ্যাঁ, সেটা এই গল্পে পাবেন— এক শিক্ষক তার ছাত্রকে বললেন,
“তুমি গণিতে কাঁচা। বাসায় ভালো করে প্রাকটিস করবে।”

ছাত্র বলল,
“স্যার, আমি অঙ্কমেলাতে পারিনা, কিন্তু সমাধান বের করতে পারি।”
“সেটা কেমন?”
“আমি যে রাশিকে মেলাতে পারি না সেটাকে ‘০’ দিয়ে গুণ করে দেই। তাতে অঙ্কটা-ই আর থাকে না। সমস্যাও চলে যায়।”
hassangorkii@yahoo.com
এপ্রিল ২৩, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।