হাসান গোর্কি : যুক্তিবিদ্যায় মনে করা হয় প্রকৃতির সব ঘটনা কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ। সব ঘটনার একটা কারণ থাকে এবং কারণ ছাড়া কোন ঘটনা ঘটে না। যেমন ট্রেনের ইঞ্জিন তার পেছনে সংযুক্ত বগিগুলোকে টেনে নিয়ে যায়। এটা একটা কাজ। এর পেছনের কারণ হলো, জ্বালানিকে শক্তিতে রূপান্তর করার প্রযুক্তি ইঞ্জিনে যুক্ত আছে। ধরা যাক কোথাও ভ‚মিধ্বসে ৫০ জন মানুষ মারা গেলো। আমাদের ভাষায় অকাজ হলেও পদার্থবিদ্যার ভাষায় এটা একটা কাজ। এর পেছনে ক্রিয়াশীল কারণ হলো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ। পাহাড়ের যে অংশটি দুর্বলভাবে যুক্ত থাকে বা নিচের স্তরের সহায়তা হারায় সেই অংশকে মাধ্যাকর্ষণ টেনে নামায়। আজ থেকে মাত্র আড়াইশ বছর আগেও ঘূর্ণিঝড়ের কারণ ভালো করে ব্যাখ্যা করা যেতো না। এখন আবহাওয়াবিদরা এর কারণ বলতে পারেন। গ্রীষ্মকালে নিরক্ষীয় অঞ্চলের বায়ু উত্তপ্ত হয়ে গেলে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য উভয় গোলার্ধের শীতল বায়ু নিরক্ষরেখার দিকে অগ্রসর হয় এবং ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করে। এভাবে আমাদের চারপাশে যা কিছুই ঘটছে তার বেশিরভাগের-ই কার্যকারণ সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই।
পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এটা একটা ঘটনা। পদার্থ বিদ্যার ভাষায় এটা কাজ নয়। পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ বল ও সূর্যের মহাকর্ষীয় বলে সৃষ্ট কেন্দ্রাভিগ বলের মান সমান বলে পৃথিবী এই দুই বলের লব্ধির দিকে চলে, যা একটা উপবৃত্তের আকার নেয়। এখানে মোট ক্রিয়াশীল বলের পরিমাণ শূন্য এবং (ফলে) কাজের পরিমাণ শূন্য। যাহোক, এই ঘটনাটির পেছনে কী কারণ ক্রিয়াশীল? বিজ্ঞানীদের ধারণা সৌরজগত সৃষ্টির সময় নিজ অক্ষের ওপর ঘূর্ণায়মান সূর্য থেকে উত্ক্ষিপ্ত খণ্ডগুলো মহাকর্ষ বলের কারণে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। এদের মধ্যে যাদের কেন্দ্রাতিগ বল ও কেন্দ্রাভিগ বলের মান সমান হয়ে যায় তারা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। যাদের কেন্দ্রাতিগ বলের মান কম হয় তারা আবার সূর্যের মধ্যে গিয়ে পড়ে যায়। যাদের কেন্দ্রাতিগ বলের মান বেশি হয় তারা নিয়ন্ত্রনহীনভাবে সৌরজগতের বাইরে চলে যায়। কার্যকারণ সম্পর্কের অন্য উদাহরণ, প্রাণ সৃষ্টির পারম্পর্য। পৃথিবীতে যে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে তার পেছনের কারণ হলো প্রয়োজনীয় মৌলের উপস্থিতি এবং সূর্য থেকে উপযুক্ত দূরত্ব। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই দূরত্বকে বলা হয় ‘গোল্ডিলক জোন’। প্রাণের উদ্ভব এবং টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন আলো, বায়ু, পানি ও তাপমাত্রার সহনীয় অবস্থা। পৃথিবীপৃষ্ঠে গড় তাপমাত্রা ১৩.৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভূত্বকে রয়েছে প্রচুর পানি। সূর্য থেকে যে তাপ ও আলো পৃথিবীতে পৌঁছে তা-ও উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জন্য সহনীয়। শুক্র গ্রহে এই কারণগুলোর একটিও নেই। ফলে সেখানে প্রাণের উদ্ভব ঘটেনি। তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশেরও কারণ পাওয়া গেলো; কার্যকারণ সূত্র এখানেও কার্যকর সেটা বোঝা গেলো। তবে কার্যকারণ খুঁজে পেতে কখনও আমরা বিভ্রান্ত হতে পারি। এটা বিধির দোষ নয়। আমাদের বোঝার ভুল।
ধরুন, আপনি বাসার দরজায় তিনটা তালা দিয়ে প্রত্যেকটাতে সিল গালা করে ইদের ছুটিতে বাড়ি গেলেন। ফিরে এসে টেবিলে একটা মিষ্টির প্যাকেট দেখতে পেলেন। আপনি নিশ্চিত যে বাসায় কেউ ঢুকতে পারার সম্ভাবনা নেই। তালাগুলোর সিলগালা আগের মতোই অক্ষত ছিল। জানালাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। আপনার মনে হতে পারে বিষয়টা ভৌতিক। আমার মনে হতে পারে ঐশ্বরিক। পুলিশের মনে হতে পারে এটা অপরাধ জগতের কারো কাজ। যদি এই মিষ্টির প্যাকেটের উত্সের সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে আমরা ধরে নেবো যে বিষয়টা আধিদৈবিক। এই ধরে নেওয়াটা ভুল হতে পারে। ধরা যাক বিষয়টা এমন- পাশের ফ্ল্যাটের দেওয়ালে খুব নিখুঁত একটা গুপ্ত দরজা আছে। অথবা সেটা আছে মেঝে বা ছাদে। ঐ দরজা খুলে আপনার ফ্লাটে প্রবেশ করে কেউ ঐ মিষ্টির প্যাকেটটা রেখে গেছে। ঐ দরজার কথা যদি কখনই জানা না যায় তাহলে ঘটনাটা আমাদের কাছে ভৌতিক-ই থেকে যাবে। ইসরাইলী গোয়েন্দারা বিভিন্ন সময় এমন কিছু গুপ্ত হত্যা ঘটিয়েছে যা তারা প্রকাশ করে না দিলে সেগুলোকে জিনের কাজ বলে মনে হতো। এখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও মানুষের ওপর জিনের ‘আছর’ কমে এসেছে। এধরণের রোগীদের এখন মনঃচিকিত্সকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডেভিড কপারফিল্ডের একটা বিখ্যাত যাদু আছে। একটা লোহার সিন্দুকে ভরে তাকে নায়াগ্রা ফলস এ ফেলে দেওয়া হয়। দুই দিন পর তিনি লোকালয়ে এসে হাজির হন। যতক্ষণ আমরা টেকনিকটা না জানি ততোক্ষণ এটা যাদুবিদ্যা। কৌশলটা খুব সহজ- যে স্টেজে উনি যাদু দেখান সেই স্টেজের পাটাতনে একটা দরজা থাকে। সিন্দুকটা এমনভাবে তৈরি যে এর তলা খোলা যায়। সিন্দুকটা ঐ দরজার ওপরে বসানো হয়। কপারফিল্ড সিন্দুকে ঢুকে গেলে সেটাকে যখন শেকল দিয়ে পেঁচিয়ে তালা লাগানো হয় ততোক্ষণে তিনি নিচের দরজা খুলে স্টেজের ভেতরে ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়ে যান; এবং পোশাক পাল্টে নিজের বাসায় গিয়ে বসে থাকেন। আমাদের কাছে ঘটনাটা অলৌকিক মনে হয়। আমাদের মাথায় আছে সিন্দুকের দরজা একটা এবং স্টেজের পাটাতনে কোন গেট থাকে না। এই পূর্ব ধারণা-ই আমাদের বিভ্রান্ত করে।
তবে অ-ভৌত (স্পিরিচুয়াল অর্থে) জগতে কার্যকারণ সূত্র একইভাবে কাজ করে না। একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে একটা মাটির হাঁড়িতে সজোরে আঘাত করলে সেটা ভেঙে যাবে। যতবার পুনরাবৃত্তি করা হোক একই ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু আমার কোন বন্ধু যদি আমাকে দশ বার গালি দেয় প্রত্যেকবার একই ফল হবে না। প্রথম বার আমিও তাকে গালি দিতে পারি। দ্বিতীয় বার আমি ক্রোধ সংবরণ করে চুপ করে থাকতে পারি। তৃতীয় বার আমি তার গালিকে উপেক্ষা করতে পারি। এটা বিপরীত ক্রম অনুসরণ করেও ঘটতে পারে। আমরা এখানে কারণের সাথে কাজের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি না। যদি তার গালির জবাবে আমিও প্রতিবার গালি দিতাম বা উপেক্ষা করতাম তাহলে বুঝতে পারতাম কার্যকারণ সম্পর্ক এখানেও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কাজ করছে।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/04/Bk-003-4.jpg?resize=696%2C348&ssl=1)
আবার ধরুন, আপনি আপনার গ্রামের বাড়ির জানালা দিয়ে কোন এক বর্ষায় কচুরিপানা ভর্তি একটা জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণে ডুবে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন, পায়ে চলা মেঠো পথ, ফসলের মাঠ;- “যেনো মেঘলা আকাশ উল্টো হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে।” তখন আপনার মনে পড়লো কৈশোরে আপনি বন্ধুদের সাথে পাকুড় গাছ থেকে এই পুকুরে লাফিয়ে পড়ে উল্লাস করতেন। পরের বছর একই জানালায় বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আপনার মনে পড়তে পারে নেপালে বেড়াতে গিয়ে আপনি একটা পাহাড়ি রেস্টুরেন্টে এক বৃদ্ধ মেক্সিকান দম্পতির সাথে কফি পান করেছিলেন। তার পরের বছর মনে পড়তে পারে এক পূর্ণিমায় আকাশভাঙা বরফপাতে মন্ট্রিয়েল শহরটা কেমন অপার্থিব দেখাচ্ছিল সেই দৃশ্য। পরিবেশকে যদি আমরা কারণ ধরি এবং কার্যকারণ নীতিকে অভ্রান্ত বলে ধরে নেই তাহলে পরের দুই বারও আপনার পুকুরে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য মনে হবার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে সেরকম ঘটেনি। তার অর্থ ‘কারণ’ আপনার কাজের ওপর একই রকমভাবে কাজ করেনি। তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে একই কারণ অ-ভৌত জগতে অজ্ঞাত কারণে ভিন্ন ফল দিতে পারে।
কার্যকারণ বোঝার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের ভুল ব্যাখ্যাও কিছুটা সমস্যা তৈরি করে। তথ্য ঘেঁটে দেখলে আমরা দেখবো ১০ তলার ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া ১০০ জন মানুষের ৯৯ জন-ই মারা যায়। এই হিসাব থেকে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই যে এই উচ্চতা থেকে পড়ে গেলে কেউ বেঁচে থাকবে না; তাই বেঁচে যাওয়া একজনের ক্ষেত্রে অলৌকিক কোনো কিছু কাজ করে। বছর দুই আগে ঢাকার বনানীতে একটা বহুতল ভবনে আগুন লেগে গেলে জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে বেশ ক’জন লোক নিচে পড়ে মারা যায়। এক লোক ১১ তলার জানালা দিয়ে বের হবার পর হাত ফসকে কয়েক ফ্লোর নিচের রাবারে মোড়ানো বিদ্যুত সংযোগের তারের ওপর পড়ে। সেখান থেকে নিচে গিয়ে টিভি ক্যাবলের ওপর পড়ে। সবশেষে একটা মাইক্রোবাসের ছাদে পড়ে হেঁটে চলে যায়। দৃশ্যটা আমি টিভিতে দেখেছি বলে আমার কাছে অলৌকিক লাগেনি। কিন্তু ঘটনাটা যদি আমি কারো মুখে শুনতাম বা পত্রিকায় পড়তাম এবং বর্ণনায় যদি ঐ ক্যাবলের অংশ বাদ থাকতো তাহলে আমিও সেটাকে অলৌকিক মনে করতাম। ঘটনাটার চরিত্র মানুষ না হয়ে একটা চেয়ার হলে সেটা আর অলৌকিক মনে হতো না। গাছের মগডাল থেকে খড়ের গাদায় পড়ে একটা পাকা আম অক্ষত অবস্থায় আমাদের হাতে এলে আমাদের কাছে অলৌকিক লাগে না; কিন্তু এরকম ঘটনা একটা শিশুর ক্ষেত্রে ঘটলে অলৌকিক মনে হয়। কারণ সেক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যুক্তিবিদ্যা ও পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করি।
যুক্তিবিদ্যা ও পরিসংখ্যানকে অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে অপরিহার্য মনে করা হলেও জ্ঞানতত্তে¡ এদের অবস্থানকে বেশ নিচের দিকেই দেখা হয়। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ৩০ ট্রিলিয়ন (৩০,০০০,০০০,০০০,০০০) ডলার; মাথাপিছু ৬০,২২৫ ডলার। বাংলাদেশের ঋণ ২৬ (২৬,০০০,০০০,০০০) বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু ১৬০ ডলার। বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা দ্বিগুণ কিন্তু ঋণের পরিমাণ ১১৫৩ গুণ বেশি। বিশ্বে ঋণ গ্রহীতা রাষ্ট্রের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নম্বরে, বাংলাদেশের অবস্থান ৭৯ নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হিসেব অনুযায়ী সেদেশে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের বাড়িঘর নেই; তারা ফুটপাথে ঘুমায়। বাংলাদেশে কত মানুষ গৃহহীন তার স্পষ্ট হিসেব নেই। বিবিসি বাংলা ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, “ঢাকার ফুটপাথে কুড়ি হাজারের মত মানুষ বাস করে যাদের ঘরবাড়ি নেই। ঢাকার বাইরে এরকম আরও ১০ হাজার মানুষ আছে যারা ফুটপাথে ঘুমায়।” ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৪,৭৬৭টি । আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা ১১,৬৮২টি। ঈঘইঈ-র সর্ব সা¤প্রতিক প্রতিবেদন (America’s dirty little secret: 42 million people are suffering from hunger) অনুযায়ী ৪ কোটি ২০ লাখ মার্কিন নাগরিক ক্ষুধার সাথে লড়াই করছে। তাদের প্রতি ৭ জনের ১ জন প্রতি রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়। বাংলাদেশে ক্ষুধার সাথে লড়াই করছে ২ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ। এই পরিসংখ্যান থেকে মনে হতে পারে বাংলাদেশের অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভালো। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আমরা সবাই জানি। একারণে বলা হয়ে থাকে মিথ্যা দুই প্রকার- ১। সাদা মিথ্যা ২। পরিসংখ্যান।
উপরে দেওয়া পরিসংখ্যান মিথ্যা নয়; তবে ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে কে কীভাবে এটাকে দেখবে তার ওপর নির্ভর করবে বাস্তব অবস্থার কতটা প্রতিফলন তাতে ঘটে। আমি যখন বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে যুক্তি দেবো তখন মার্কিন নাগরিকদের মাথা পিছু আয়ের অঙ্ক (৬০,০০০ ডলার) এবং জিডিপি (২২,৯৩৯,৫৮০ মিলিয়ন ডলার) যে বাংলাদেশের নাগরিকদের তুলনায় যথাক্রমে ১৬ গুণ এবং ৫৬ গুণ বেশি সেটা উল্লেখ করবো না। খেয়াল করে দেখুন আমি উপরের প্যারায় যে তথ্যগুলো দিয়েছি সেটা বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে তর্ক করার জন্য বাছাই করা। আমরা যদি ঐ তথ্যগুলোকে কেন্দ্র করে যুক্তির লড়াই করে যাই তাহলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের উপরে বসানো যাবে বা কমপক্ষে পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে। এর অর্থ, পরিসংখ্যান ও যুক্তি সত্যে পৌঁছাতে সব সময় অবধারিতভাবে সহায়ক নয়। এই দুটি শাস্ত্রের অপপ্রয়োগের অনেক সুযোগ আছে। যুক্তিবিদ্যায় এই অপপ্রয়োগের নাম লজিক্যাল ফ্যালাসি (কুযুক্তি, কুতর্ক বা হেত্বাভাস)। যেমন- যুক্তি : “ছাগলের দাড়ি আছে> দাড়িযুক্ত ছাগল চতুষ্পদ প্রাণী> রবীন্দ্রনাথের দাড়ি আছে। সিদ্ধান্ত: অতএব দাড়িযুক্ত রবীন্দ্রনাথ হয় চতুষ্পদ প্রাণী।”
বিশ্বাসে ভর করে ভুল বা আরোপিত কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রবণতা- প্রচলন বেশ ব্যাপক। ল²ী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। শারদীয়া দুর্গোৎসব ছাড়াও ল²ী শস্য-সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলীতে ল²ীর পূজা হয়। রবি শস্যের ভালো ফলন হলে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষরা মনে করেন এটা তাদের পুজার ফসল। কোন বছর ফলন খারাপ হলে তারা ধরে নেন তাদের নিবেদনের গভীরতায় ঘাটতি ছিলো। এভাবে যে কার্যকারণ স্থাপন করা হয় সেটার ভিত্তি বিশ্বাস। তবে সব বিশ্বাস-ই অর্থহীন নয়; কার্যকারণ সম্পর্ক না থাকলেও তা কিছু কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। অন্যের অমঙ্গল কামনা করলে নিজের অমঙ্গল হয়- এই বিশ্বাসে কার্যকারণ না থাকলেও (থেকে থাকলে সেটা আমরা বুঝি না) কিছু কল্যাণ আছে।
ভৌত জগতের কার্যকারণকেও নিত্য ও ধ্রুব মানার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। ব্ল্যাক হোলের ‘ঘটনা দিগন্ত’ (Event horizon) পার হলে পদার্থ বিদ্যার কোন বিধি কাজ করে না। একটা কামানের গোলা বা ধরা যাক পৃথিবীটাকেই যদি একটা ব্ল্যাক হোলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাদের কারণ ও কার্য বিলুপ্ত হবে। ধরে নেওয়া যাক যে, মানুষের আধ্যাত্মিক অনুভূতি (স্পিরিচুয়াল ফিলিং) বলে একটা কিছু আছে। সেরকম ক্ষেত্রে কোন মানুষকে ব্ল্যাক হোলে ঢুকিয়ে দিলে সে অদ্ভুত, স্থবির, নিশ্চল একটা অনুভূতির মধ্যে প্রবেশ করবে। তার চিন্তা সামনে বা পেছনে যেতে পারবে না; কারণ সেখানে সময় থেমে আছে। কার্যকারণের উপস্থিতিহীন এক ভয়ানক অনড়, অস্পন্দ স্থবিরতায় সে আটকে থাকবে অনন্ত সময়। এমাইনো এসিড থেকে জৈব যৌগ, এক কোষী প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, বহুকোষী প্রাণী, এপ হয়ে হোমো সেপিয়েন্স-এ রূপান্তরের যুক্তিপূর্ণ ও বোধগম্য ব্যাখ্যা আছে। রূপান্তরের প্রত্যেকটা স্তরে কার্যকারণের উপস্থিতি বোঝার সুযোগ আছে। সবগুলো ঘটনা ঘটেছে দৈব চয়নের ভিত্তিতে। এরকম না ঘটে অন্য কিছুও ঘটতে পারতো। মানুষ সাপের মতো চিকন দুই কিলোমিটার লম্বা একটা প্রাণী হতে পারতো। তাতেও কার্যকারণ নীতি ব্যাহত হতো না। প্রকৃতি স্বয়ম্ভু হলে কার্যকারণ তার অংশ। সেক্ষেত্রে দৈবতারও একটা ব্যাখ্যা মেলে। কিন্তু কিছু একটা সমস্যা থেকে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে একেবারে ‘শূন্য’ থেকে। এখানে কাজ আছে, কারণ নেই। তাহলে ‘কার্যকারণ’ বিধির উত্পত্তিও হয়েছিল মহাবিশ্বের যাত্রা শুরুর পর? নাকি শূন্য নিজেই আদি কারণ?
hassangorkii@yahoo.com
এপ্রিল ১৫, ২০২২। রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।