হাসান গোর্কি : হাসান সাহেবের প্রতিবেশী কামাল সাহেবের ছেলে জামাল স্কুলে ভর্তি হবার আগেই পড়তে শিখেছে। অংক করতে পারে। বাংলা-ইংরেজি লিখতে পারে। স্ত্রী বললেন
—কামাল সাহেবের ছেলে খুব মেধাবী।
—মেধাবী হলে কী হবে, স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না।
জামাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলো। স্ত্রী বললেন
—জামাল তো ভর্তি হয়ে গেলো!
—ভর্তি হলে কী হবে, পরের ক্লাসে উঠতে পারবে না।
জামাল প্রথম হয়ে পরের ক্লাসে উঠলো। স্ত্রী বললেন
—জামাল তো প্রথম হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠে গেলো!
—এসব তো যে কেউ-ই পারে। দেখো, সে এসএসসি পাশ করবে না।
এসএসসি পরীক্ষায় জামাল বোর্ডে প্রথম হলো। স্ত্রী বললেন
—জামাল তো বিস্ময়কর ফল করেছে!
—এসএসসি কোন বিষয় নয়। আসল পরীক্ষা হলো এইচএসসি। সেটার ওপর নির্ভর করে কে উচ্চ শিক্ষা নেবে আর কে নেবে না।
এইচএসসি পরীক্ষায় জামাল বোর্ডে প্রথম হলো। স্ত্রী বললেন
—দেখো তো কী অবস্থা!
—তুমি দেখবে সে কোথাও ভর্তি হতে পারবে না।
জামাল বুয়েটে ভর্তি হলো। স্ত্রী বললেন
—অসহ্য! তোমার কোন কথাই ঠিক হচ্ছে না।

—বুয়েটে ভর্তি হওয়া যতো সহজ, পাশ করা ততো সহজ নয়। সেখানে কোন নকল চলে না, বুঝলে!
জামাল বিভাগে প্রথম হলো। স্ত্রী বললেন
—আর কতো!
—পাশ করাই কী সব! আসল সাফল্য চাকরি পাওয়াতে। ধৈর্য ধরো এবং দেখো কী ঘটে! এই ছেলে বেকার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। তুমি সিনেমায় দেখোনি!
জামাল বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলো। স্ত্রী বললেন
—জামাল চাকরি পেয়েছে।
—চাকরি হলেও সে বেতন পাবে না।

সমালোচনার শাব্দিক অর্থ হলো কোন বিষয় বা ব্যক্তির ভুল-শুদ্ধ, ভালো-মন্দ দিকের পক্ষপাতহীন আলোচনা। কিন্তু আমাদের ব্যবহারিক জীবনে শব্দটা নিন্দার সমার্থক হয়ে গেছে। প্রোপাগান্ডা বা বিদ্বেষমূলক তথ্য বিকৃতিকেও আমরা সমালোচনার মধ্যে ধরে নিচ্ছি। উপরের গল্পে হাসান সাহেব যেটা করেছেন সমালোচনার নামে আমরাও অনেকটা তা-ই করি। শুরুতে একটা বহুল চর্চিত ‘সমালোচনা’র উদাহরণ দেওয়া যাক — খালেদা জিয়া (দেশের সবচেয়ে বড় পদে জনগণ যাকে তিন বার নির্বাচিত করেছে) এক জনসভায় বলেছিলেন, “আপনারা পদ্মা সেতুতে উঠবেন না। এই সেতু নি¤œ মানের সামগ্রী দিয়ে বানানো হচ্ছে।” পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাক্কলিত খরচের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে চার গুণ। সমালোচকরা ধারণা দিচ্ছেন ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যয় বাড়িয়ে এর একটা বড় অংশ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন প্রকৌশলী, আমলা এবং রাজনীতিবিদরা। এটা বর্তমান সময়ের একটা খুব জনপ্রিয় বিশ্বাস। এ ব্যাপারে কোন এক সাংবাদিককে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ ইউ টিউবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার বিশ্লেষণ— “ভিয়েতনাম বা এই ধরণের দেশে পদ্মা সেতুর মতো সেতু নির্মাণে ব্যয় হয় কিলোমিটার প্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা। যদি আপনি ধরেন পদ্মা একটা বিশেষ চরিত্রের নদী। সারা পৃথিবীতে পদ্মার মতো আর কোন নদী নেই, পৃথিবীতে পদ্মা নজিরবিহীনৃ তাহলে এর দ্বিগুণ টাকা খরচ হবে, ১৫০০ কোটি! পদ্মা এখন পার কিলোমিটার খরচ দেখাচ্ছে ৫০০০ কোটি টাকা। এই যে আমাদের ঘরের পাশে ভারত। কোলকাতা। সেখানে ভুপেন হাজারিকা সেতুৃ সেটা ৯ কিলোমিটার। পুরো সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ১০০০ কোটি রুপি। আর আমাদের ৬ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু ৩০,০০০ কোটি টাকা। এই টাকাটা কার!”
২০১৬ সালে ২.৮ কিমি লম্বা অকল্যান্ড বে ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। পুরনো ব্রিজের পাশে নতুন ব্রিজ নির্মাণের ব্যয় এটা। প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার। নির্মাণ কাজ শুরু করার পর তা ২৫০০% (অর্থাৎ ২৫ গুন) বেড়ে ৬.৫ বিলিয়ন হয়।

(এই লিংকে বিস্তারিত দেখুন- https://en.wikipedia.org/wiki/San_Francisco%E2%80%93Oakland_Bay_Bridge) ।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে ৪০০% বা চার গুন। যারা পৃথিবীতে বসে মঙ্গল গ্রহে যান নামায় তাদের হিসেবে যদি এত গরমিল থাকে তাহলে আমাদের থাকাটা অস্বাভাবিক কেন? পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যা হলো- ২০০৭ সালে প্রকল্প শুরুর সময় এটা ছিল সড়ক সেতু। রেল যুক্ত করার পর ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০,০০০ কোটি টাকা। দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের জন্য চায়নার এক্সিম ব্যাংক থেকে আলাদা প্রকল্পের আওতায় ঋন পাওয়ার কথা ছিল। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ব্যয় সেতুর মুল প্রকল্পে যুক্ত হয়। এর সাথে পাইলিং ও নদী শাসনে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩২,০০০ কোটি টাকা।

ভুপেন হাজারিকা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সাথে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের তুলনাকে নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন “হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা”। তাদের বক্তব্য এটা অসম তুলনা। ভুপেন হাজারিকা সেতুর বেশিরভাগ পিলার শুকনা মাটি খুঁড়ে পোঁতা হয়েছে। ঐ সেতুর পাইল লোড মাত্র ৬০ টন। সেখানে পদ্মা সেতুর পাইল লোড ৮ হাজার ২০০ টন। ভারতের ওই সেতুর একেকটি পিলার ১২০ টনের। আর পদ্মা সেতুর একটি পিলার ৫০ হাজার টনের যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রিশ তলা ভবনের চেয়েও একশ ফুট উঁচু। দুই পক্ষের ব্যাখ্যার এই গড়মিল কেন সেটা আমরা বুঝবো না; বুঝতে গেলে যে কারিগরি জ্ঞান থাকতে সেটা আমাদের নেই। পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সেতুর কারিগরি দিক ও নির্মাণ ব্যয় বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ব্যাখ্যাটা ঠিক ছিল কিনা সেটা বুঝতে গেলে তার ব্যাখ্যার একটা সমালোচনা দরকার হবে এমন কারো কাছে থেকে যিনি বিষয়গুলো বোঝেন। ব্রিজের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ হলে খরচ দ্বিগুণ হবে এটা অর্বাচীন উপসংহার।

শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়, টক শোতে বলা হয়। অনেকে এই ঘটনাকে মিথ্যা বলে মনে করেন। শেখ কামালের বন্ধু সালমান এফ রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমাদের বন্ধুদের কারো গাড়ি ছিল না। আমার বাবা আমাকে একটা নতুন গাড়ি কিনে দিলেন। কামাল সহ আমরা কয়েক বন্ধু রাত আনুমানিক ১২ টায় ঘুরতে বের হলাম। সেসময় দেশে গণবাহিনীর উৎপাত ছিল। টহল পুলিশ আমাদের তাড়া করলে আমরা ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের চত্ত¡রে ঢুকে পড়লাম। তাদের গুলিতে কামাল সহ আমরা অল্প আহত হলামৃ আপনাকে বুঝতে হবে রাতের বেলা ব্যাংক ডাকাতি করা যায় না। এটা দিনে করতে হয়। রাতে করতে গেলে ব্যাংকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভল্ট ভাঙতে হবে। এটা করতে গেলে সাথে করে বড় একটা লেদ মেশিন নিয়ে যেতে হবে। এর আগে রক্ষীদের পরাস্ত করতে হবে”। কাদের সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সে (শেখ কামাল) এটা করতে যাবে কেন! সে চাইলে তো ব্যবসায়ীরাই তার বাসায় বস্তা ভড়ে টাকা দিয়ে আসতো।” আমরা কার কথা বিশ্বাস করবো?

তারেক জিয়া বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়েছে। পরে দেখা গেলো আদালতে তার বিরুদ্ধে দুই কোটি টাকা পাচারের মামলা হয়েছে। প্রমাণ না থাকায় আদালত সে মামলাও খারিজ করে দিয়েছে। দেশে আরও একটা মুখরোচক সমালোচনা চালু আছে। কোন এক সংসদ সদস্য বিষয়টা জাতীয় সংসদেও তুলেছেন। তার বক্তব্য, জিয়াউর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের চর। যুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনীর মেজর বেগ তাকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো এই গভীর তত্ত¡টা আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে কে? চিঠিটা তার হাতে এলো কীভাবে? মুজিব নগর সরকার তার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে জেড ফোর্স গঠন করে তাকে একটা স্বতন্ত্র সেক্টরের দায়িত্ব দিলেন কেন? বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব দিলেন কেন? তাহলে এটা কি কুৎসা, নাকি সমালোচনা?

তারেক জিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের একটির শীর্ষ নেতা। তিনি বলেছেন (আরও অনেকেই বলেন), “শেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র, অসহায় মানুষকে ফেলে রেখে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং পাকিস্তানে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন।” তার মতে এটা ছিল ‘অদূরদর্শী দায়িত্বহীন’ আচরণ। এব্যাপারে তোফায়েল আহমদের বক্তব্যের সার কথা এরকমÑ “বঙ্গবন্ধু পালাবেন কেন! তিনি তো এর আগেও ৩২ বার গ্রেফতার হয়ে ১২ বছর কারাবাস করেছেন। আর অখন্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে যখন জনগণ নির্বাচিত করেছে তখন তিনি পালিয়ে যাবেন! তিনি তো আগে থেকে জানতেন না যে ২৫ মার্চ রাতে (২৬ মার্চ) পাকিস্তানীরা যুদ্ধ শুরু করবে। কেউ-ই সেটা জানতো না। যুদ্ধটা ঘটে যাবার পর উল্টোদিক থেকে সময়টাকে ভাবা হচ্ছে। আর তিনি যদি পালিয়ে ভারতে চলে যেতেন তাহলে এখন বলা হতো ভীরু মুজিব ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো যুদ্ধ না করে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়েছিলেন।”

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ে বিবর্তনবাদ একটা শক্তিশালী ধারণা বা বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত¡ যা জীবের (প্রাণী ও উদ্ভিদের) গঠন ও বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরির্তনকে বুঝায়। জীনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে, এমনকি নতুন প্রজাতিরও উদ্ভব ঘটতে পারে। এই পরিবর্তন এতোটা ধীর গতিতে ঘটে যে একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখার জন্য কয়েক মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। আবার প্রাণীদের অঙ্গসাংস্থানিক ও জিনগত সাদৃশ্যগুলো দেখে ধারণা করা যায় যে সকল প্রাণীই এসেছে এক সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে। যেমন প্রাইমেট থেকে আসা মানুষ ও শিম্পাঞ্জীর ডিএনএ এর প্রায় ৯৮% মিল আছে। জীব বিজ্ঞানের তত্ত¡গুলোর মধ্যে বিবর্তনবাদকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন। অন্য কথায় সবচেয়ে বেশি অসমালোচিত জীব-বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ এটি। এই তত্তে¡র সমালোচনা আছে খুবই কম। তবে কিছু বিরোধিতা আছে। সেটা বিজ্ঞানীদের তুলনায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে বেশি। নিও-ক্লাসিসিস্ট মুভমেন্টের সাথে থাকা মানুষেরা জীবনকে অলৌকিক ক্ষমতাধরের নকশা (ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন) হিসেবে মনে করে। তারা মনে করে এ মহাজগতের সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে কোনো বুদ্ধিমান ঈশ্বরের দ্বারা। এ পর্যন্ত ঠিক আছে; কারণ এটা একটা ধারণা। কিন্তু বিবর্তনবাদের সমালোচনা যখন আমরা করতে যাই তখন কীভাবে করি তার একটা অভিজ্ঞতা বলি-
অধ্যাপক কবির চৌধুরী আমাদের একটা ক্লাসে বলছিলেন, “মানুষ বৈচিত্র্যময় বিবর্তনের পথ বেয়ে আজকের সভ্যতায় পৌঁছেছে।” তিনি কথা শেষ করার আগেই আমাদের এক ক্লাসমেট দাঁড়িয়ে গেলো। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললো, “স্যার আপনি বলুন, কোন বানরটা থেকে কোন মানুষটা সৃষ্টি হয়েছে! সারা পৃথিবী থেকে একটা উদাহরণ দেখান।” তিনি তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কথা বলেন কষ্ট করে, থেমে থেমে। স্যারকে বিস্মিত, বিহ্বল এবং কিছুটা ভীত দেখালো। তিনি দাঁড়িয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে থাকলেন। তারপর আমাদের সহপাঠীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি আসলে সভ্যতার বিবর্তনের কথা বলছি। প্রাণী জগতের বিবর্তন নিয়ে তোমার কোনও আগ্রহ থাকলে আমি তা মেটানোর জন্য উপযুক্ত নই। আমি প্রাণীবিদ্যা বা জীববিদ্যা পড়িনি।” এরপর তিনি তার মুল প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। অধ্যাপক কবির চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম সারা দেশের বিদ্বান মানুষরা কেন তাকে শ্রদ্ধা করেন, কেন তার নামটা এতো বড়। আমি ঐ ক্লাসের শিক্ষক থাকলে হয়তো বলতাম, “বানর থেকে মানুষের উৎপত্তি এটা বিবর্তনবাদের কোথাও বলা হয়নি। তুমি বিবর্তনবাদের ‘ব’ জানোনা। তোমার উচিৎ অন্তত প্রাথমিক পড়াশোনা করে তারপর সমালোচনা করা।” এখানে তিন জনের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা লক্ষ করুন- আমার সহপাঠী বিবর্তনবাদের গ্রহণযোগ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করছে অজ্ঞতা থেকে, আমি তার সমালোচনা করছি অসহিষ্ণুতা থেকে আর অধ্যাপক কবির চৌধুরী বিজ্ঞ মানুষ বলে সমালোচনা করা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।

তাহলে কি জীববিজ্ঞান না পড়ে বিবর্তনবাদের সমালোচনা করা অথবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান না পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করা অনুচিত হবে? না, অনুচিত হবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যদি আমরা খুব বেশি করে শ্রদ্ধা করি তাহলে আমরা আমাদের সীমিত বিদ্যায় যা বুঝি তার সব-ই প্রকাশ করতে পারা উচিৎ। ধারণাগুলো যদি ভুল হয় তাহলে অন্য কেউ ভুলটা ধরিয়ে দেবে। আর আমাদের মতো ভুল ধারণা নিয়ে যারা বসে ছিল তারাও শুদ্ধটা জানতে পারবে। তবে সমালোচনাকে অর্থবহ করতে এবং তা থেকে ভালো ফলাফল পেতে বিষয়বস্তুর ওপর যথেষ্ট ধারণা থাকা ভালো। নাহলে কিছু বিপত্তিও ঘটতে পারে।

ব্রæনো যখন (১৫৫১ সালে) দাবি করলেন পৃথিবী গোলাকার, আমাদের দেখতে পাওয়া মহাবিশ্বের মতো আরও মহাবিশ্ব আছে, সূর্য একটা নক্ষত্র, তখন রোমান ক্যাথলিক গির্জা থেকে তার এই ধারণার বিরোধিতা করা হলো। জিওভাননি মচেনিগো নামে এক ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম ও ঈশ্বরে বিরোধিতার অভিযোগ আনলো। ধর্মপ্রাণ মানুষদের সমালোচনার চাপে ১৫৯২ সালের ২২ মে ব্রুনোকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আজ থেকে ৬২২ বছর আগে (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬০০) তাকে রোমের রাস্তায় খুঁটির সাথে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।
গ্যালিলিও ছিলেন একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গনিতজ্ঞ ও দার্শনিক। ডায়ালগ কনসারনিং দ্য টু চিফ ওয়র্ল্ড সিস্টেম্স বইয়ে সূর্য কেন্দ্রিক জগতের ধারণা প্রকাশ করার অপরাধে রোমের আদালত ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে অভিযুক্ত করে। পূর্ববর্তী ধ্যান-ধারণা শপথের মাধ্যমে পরিত্যাগের শর্তে তাঁকে লঘু দন্ড দেওয়া হয়- তাকে সিয়েনায় বছর খানেক (১৬৩২-’৩৩) একঘরে জীবন কাটাতে হয়। মৃত্যুর (১৯৪২) আগে পর্যন্ত মুক্ত থাকলেও তিনি উদ্যমহীন হয়ে পড়েন যদিও ১৬৩৮ সালে তিনি নিউ সায়েন্সেস এবং ডায়াগ্রামা নামে দুটি বই লিখেছিলেন। ব্রুনো- গ্যালিওলিও, দুজন-ই ছিলেন তৎকালীন অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত অযাচিত সমালোচনার শিকার। যুগে যুগে ব্যাপারটা এরকম-ই ছিল। বর্তমান সময়ে আমাদের জানাশোনার মধ্যে আমার ধারণায় সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সমালোচনার শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েও, শুধু কুচুটে (ইন্ট্রিগুইং) সমালোচনার শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে তিনি খল নায়ক। তাহলে কি আমরা সমালোচনা করা বন্ধ করে দেবো? না। সেটা করা হলে অগ্রগতির সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেনো হাসান সাহেবের মতো করে সমালোচনা না করি।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।