হাসান গোর্কি : মহানুভবতার উদাহরণ খুঁজতে গেলে আমরা তা মহামানবদের জীবনী থেকে খুঁজি। কিন্তু আমি জীবনে এমন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি যেখানে খুব সাধারণ মানুষ বিস্ময়কররকম মহানুভব ছিলেন। প্রান্তরে তেপান্তরের বেশিরভাগ পর্বে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখছি। সেগুলো সদয় সম্পাদকের টেবিল পেরিয়ে ছাপাও হয়ে যাচ্ছে। এতে আমি খুশি। আমি চাই আমাদের ধারণা ও বিশ্বাসগুলোকে আমরা আটপৌরেভাবে বুঝি।
আমার মেজো আপা ১৪ বছর আগে মোটর নিউরোন রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। শরীরের উপরের অংশ অল্প নড়াচড়া করে। কাউকে চিনতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না। অল্প করে ঠোঁট নাড়ান। আমার ভগ্নিপতি আপাকে তিন বেলা খাইয়ে দেন, গোসল করান, সকল ধরণের পরিচর্যা করেন। টিভি চালালে আপা টিভির দিকে তাকিয়ে থাকেন। দুলাভাইয়ের ধারণা আপা টিভির অনুষ্ঠানগুলো পছন্দ করছেন। সেকারণে তিনিও ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি দেখেন। অসুস্থ হবার আগে আপা যে অনুষ্ঠানগুলো পছন্দ করতেন সেগুলোই নিরলসভাবে চালাতে থাকেন দুলাভাই। আপা ফুটবলের খুব ভক্ত ছিলেন। বিশ্বকাপ বা এধরণের বড় কোন টুর্নামেন্ট হলে সেটাও তিনি স্থবির হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা আপাকে দেখাতে থাকেন। তার সাথে এক বিছানায় ঘুমান। গত ১৪ বছরে তিনি হাতে গোনা কয়েকদিন কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ির বাইরে গেছেন। এই ঘটনাটা বিখ্যাত কারো জীবনে ঘটে থাকলে আমরা হয়তো তা পাঠ্যপুস্তকে পড়তাম।
আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মওলা বকস। বিয়ে করেননি; স্কুলের পাশে একটা বাসায় একা থাকতেন। ব্যক্তি জীবন বলতে কিছু ছিলনা; সারাদিন স্কুলের কাজে বা ছাত্রদের দেখাশোনার কাজে ব্যয় করতেন। তার বাসার পাশেই আমাদের বাসা। অষ্টম শ্রেণির স্কলারশিপ পরীক্ষার আগে উনি ভোর তিনটায় এসে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। আমার ঘরের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যেতো। একদিন ভোর চারটার দিকে দেখলাম উনি জানালার বাইরে হাঁটাহাঁটি করছেন; দেখছেন আমি পড়াশোনা করছি কিনা। একবার স্কুলের সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রাখা বাইনোকুলার, টেলিস্কোপ সহ বেশ কিছু শিক্ষা সরঞ্জাম চুরি হয়ে গেল। স্কুলে একজন নৈশ প্রহরী ছিল। কিন্তু মওলা বকস স্যার তার বাসা ছেড়ে স্কুলের বারান্দায় বিছানা পেতে ঘুমাতে শুরু করলেন। এবং মরে যাবার আগে দীর্ঘ দিন তিনি এভাবে স্কুল পাহারা দিয়েছেন।
স্কুল জীবনে আমি বরাবর ক্লাসে প্রথম হয়েছি। সেকেন্ড হতো বেলায়েত। সে পরীক্ষায় ভালো করতে চাইতো; কিন্তু কখনও আমাকে অতিক্রম করতে চাইতো না। অষ্টম শ্রেণির স্কলারশিপ পরীক্ষার আগে আমি বগুড়া জেলা স্কুলের শিক্ষকদের দেওয়া বাংলা এবং ইংরেজির কিছু নোট জোগাড় করে নিয়ে এলাম। সেগুলো আমি লুকিয়ে রাখলাম যাতে বেলায়েতের চোখে না পড়ে। কারণ সে আমাদের বাসায় প্রতিদিন একবার আসে। বার্ষিক পরীক্ষার সাধারণ গনিতে আমি একটা জ্যামিতি প্রশ্নের উত্তর ‘অথবা’সহ দিয়ে ফেলেছিলাম। ‘অথবা’র উত্তর দিলে সেটা গণনায় নেওয়া হয় না। তার অর্থ আমি ১০০-তে ৯০ এর উত্তর দিয়েছি। এবং বসে বসে রিভাইস করছি। পেছন থেকে বেলায়েত সেটা লক্ষ করেছে। সে আমাকে বারবার খোঁচা দিচ্ছে দেখে শিক্ষক এসে ধমক দিয়ে তার খাতা নিয়ে গেলেন। বেঞ্চ থেকে উঠে যাবার আগে সে আমাকে বলে গেল যে ৮ নম্বর প্রশ্নের উত্তর আমি ‘অথবা’ সহ লিখেছি। আমি দ্রুত সেটা কেটে দিয়ে ৯ নম্বরের উত্তর দিলাম। আমার এই ১০ নম্বর কাটা গেলে বেলায়েত পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যেতে পারতো। এটা একটা ক্ষুদ্র ঘটনা কিন্তু মহানুভবতার পরিমাপে অনেক বড়। সে খুব দরিদ্র পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত মানুষ। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে সে ব্র্যাকে চাকরি শুরু করেছিল। আমার বিয়ের পরদিন ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় বেলায়েত মারা গেছে। আমি একটা পিক আপ ভ্যান ভাড়া করে ওর মৃতদেহ নিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম।
আমার এক বন্ধুর কথা বলে আমার অভিজ্ঞতার অংশ আপাতত শেষ করি। আমি কলেজ অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভ- কোডাতে যোগ দেওয়ার সময় ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিল চয়ন। অল্প দিনে তার সাথে আমার ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। চার মাস পর আমি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেলাম। চয়ন তার কাজের গতি একটুও কমিয়ে দিলো না। বরং বেশিরভাগ কাজ সে-ই করতো। দিনশেষে কৃতিত্বটা আমার ঝুড়িতে জমা হতো। দুই বছর পর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে আমার পদাবনতি হলো। অধক্ষ্যা তার কক্ষে ডেকে আমাকে বুঝিয়ে বললেন কেন এই পদাবনতি আমার কৃত অপরাধের জন্য ন্যূনতম শাস্তি। আমি দ্বায়িত্ব হস্তান্তর পত্র লিখলাম। স্বাক্ষর করে চয়নকে দিলাম। তাকে স্বাক্ষর করে দ্বায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। আমি দেখলাম চয়ন অশ্রু সংবরণ করতে চেষ্টা করছে। সে আমার চিঠিটা হাতে নিলো না। পরবর্তী এক সপ্তাহ সে গোপনে প্রতিষ্ঠান প্রধান (চেয়ারম্যান স্যার) সহ প্রভাবশালী সকলের সাথে কথা বলেছে আমাকে তার বিভাগীয় প্রধান পদটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সঙ্গত কারণে সে সফল হয়নি। পরবর্তী এক বছর আমি তার অধীনে চাকরি করেছি এবং তার মতো হতে চেষ্টা করেছি।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2022/02/Bk-3-8.jpg?resize=688%2C682&ssl=1)
খেয়াল করলে দেখবো যে আমাদের সবারই এরকম কিছু মহানুভব মানুষের সাথে পরিচয় আছে। ঘটনা ছোট বলে তাদের মহানুভবতা অলক্ষ্যে থেকে যায়। বিপরীতক্রমে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ক্ষুদ্রতাগুলো ঢাকা পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমার কাছে মহামানব না হলেও কমপক্ষে অতিমানব তো বটেই। তিনি তার বিস্ময়কর নেতৃত্ব গুণে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে খোন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধ বিরতি এবং বহুপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব মন্ত্রী পরিষদে তুলেছিলেন। এটি ছিল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব। তাজউদ্দীন আহমদ সেটা সরাসরি নাকচ করে দেন। কারণ তিনি জানতেন বঙ্গবন্ধুর প্রাণ সংহার না করতে পাকিস্তানের ওপর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বড় ধরণের চাপ আছে। বিশেষত এ ধরণের উদ্যোগের বিপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া কঠোর হুঁশিয়ারিকে খুব সহজে পাকিস্তান অগ্রাহ্য করবে এরকম তিনি মনে করেননি। আর যদি বঙ্গবন্ধুকে তারা ফাঁসি দিয়ে দেয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ভাগ্য ফেরাতে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সেই দুর্ভাগ্যকেও মানতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। একটি জাতির অভ্যুদয়ের জন্য বঙ্গবন্ধু নিজেও তো তার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন! গণমানুষের মুক্তির কথা ভেবে সে ঝুঁকি তাকে নিতে হয়েছে।
দেশে ফেরার পর যখন বঙ্গবন্ধু জানলেন খোন্দকার মোশতাক তার জীবন বাঁচাতে মরিয়া ছিলেন আর তাজউদ্দীন আহমদ তার বিরোধিতা করেছেন তখন হয়তো তিনি আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষদের মতো ভাবাবেগ দিয়ে বিষয়টা বিবেচনা করেছেন— যদিও তিনি তাঁর অপার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এটা নিশ্চিত বুঝেছিলেন যে তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। এরপর বঙ্গবন্ধু মোশতাককে ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে নিয়ে আসেন এবং প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া, স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদ পেছনে পড়ে যান। এর পরের ঘটনা আরও দুঃখজনক। যতদূর জানা যায় পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থ ব্যবস্থা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের মত পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরির যে উদ্যোগ বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন সেটা তাজউদ্দীন আহমদ মেনে নেননি। এক সময় বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে পদত্যাগ করতে বলেন। এটা বিশ্বাস করাই উচিত যে এর বাইরেও কোন সমাধান বঙ্গবন্ধু বের করতে পারতেন। কারণ ২৩ বছর সংগ্রামের জীবনে পক্ষ বিপক্ষের এত বড় বড় মানুষদের যিনি বশীভূত করেছেন তাঁর পক্ষে তাঁর একসময়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচরকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাজউদ্দীন আহমদ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর সকল শ্রদ্ধা ধরে রেখে অনুগত ছিলেন এবং এই আনুগত্যের কারণেই প্রাণ দিয়েছেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে সংকটটা তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আহত আবেগ থেকে। হয়তো সবার অলক্ষ্যে মহানুভবতায় তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।
বিবিসির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বিশ্বকবিই নন, একজন মনিষীও। তার লেখায় চিরায়ত বাঙালি মনস্তত্ত¡ ও দর্শনের যে প্রকাশ ঘটেছে তা অনবদ্য, অনির্বচনীয়। কেউ কেউ বলে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমান নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি, ড. রাশবিহারী ঘোষ ও রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। তাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্য ছিল। স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে লর্ড হার্ডিঞ্জকে স্মারকলিপি দেন ১৮ বার । রবীন্দ্রনাথ এই সময় মৌন ছিলেন। মৌনতাকে স্মারকলিপির স্বপক্ষে সম্মতি হিসেবে ধরে নিলে বাঙালি সমাজের শ্রেষ্ঠ এই মনিষীর মধ্যেও আমরা অতি অল্প করে হলেও ক্ষুদ্রত্বের সন্ধান পাবো।
মহানুভবতার কথায় ফিরে আসি। বিল গেটস তার সম্পদের একটা বড় অংশ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাহার, অপুষ্টি দুরীকরনে ব্যয় করেন। তিনি এভাবে উইল করে মারা যাওয়ার ২০ বছরের মধ্যেই তার উপার্জিত সম্পদের ৯৫ শতাংশ দাতব্য তহবিলে চলে যাবে। ব্যক্তিজীবনে তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন। মার্কিন ধনী ব্যবসায়ী চাক ফিনি ১৯৮২ সালে গোপনে দাতব্য কাজ চালাতে একটি সংস্থা চালু করেন। দীর্ঘ ৩৮ বছর তিনি গোপনে দান করে গেছেন। ২০২০ সালে ৮৯ বছর বয়সে তিনি তার সকল সম্পদ (৬৮ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা) বেশ কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে দিয়ে আশ্রমে বাস করছেন। বাংলাদেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি তার নামে প্রতিষ্ঠিত একটা ফাউন্ডেশনে দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই বড় মহানুভতার খবরগুলো আমরা পেতে থাকি কারণ এগুলো মানব কল্যাণে বড় অবদান রাখে। কিন্তু ক্ষুদ্র গন্ডিতে বাস করা মানুষদের মহানুভবতা মানের বিচারে এর সমকক্ষ হতে পারে।
খুব ছোট ছোট প্রাত্যহিক জীবনাচারে এসবের প্রকাশ থাকতে পারে। আমার এক বন্ধুর কাছে স¤প্রতি শোনা একটা গল্প বলা যাক। বন্ধুর নাম বলছি না; ধরা যাক তার নাম ‘লিটু’ আর লিটুর বন্ধুর নাম লাকি। লাকি বাজারে গেছে। লিটু তার সঙ্গে গেছে। লিটু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। লাকি অস্বচ্ছল। লাকি শখের বসে ৪০০০ টাকায় একটা বোয়াল মাছ কিনে কেটে কুটে ব্যাগে নিয়েছে। রিক্সায় ওঠার সময় লিটু বলেছে, “মাছটা ভাল কিনেছিস।” লাকি রিক্সা থামিয়ে একটা পলিব্যাগ কিনে অর্ধেক মাছ জোর করে লিটুকে দিয়ে দিয়েছে। না নিলে লাকি মনঃক্ষুণ্ণ হয় সেটা ভেবে লিটুও নিয়েছে। এটা একদিনের ঘটনা। কিন্তু লাকি এ ধরণের কাজই করতে থাকে। তার পকেটে ৫০ টাকা থাকলে বন্ধুদের আড্ডায় সব টাকা চায়ের বিল দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। দামী সিগারেট পকেটে রাখে। নিজে কমদামীটা পান করে। কোন বন্ধুর চাকরির ইন্টারভিউ থাকলে সে স্যুট প্যান্ট পরে বন্ধুর আগে ভেনুতে গিয়ে হাজির হয় তাকে সঙ্গ দেওয়া বা মনোবল জোগানোর জন্য। কিছুটা ছন্নছাড়া, পরিকল্পনাহীন মনে হলেও তার এই স্পিরিটের মূল্য আছে। আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই এই মহানুভবতাও বড়দের মতোই মূল্যবান। বিল গেটসের সমান টাকা থাকলে সে-ও হয়তো তার মতো সবটা দান করে দিতো।
আমার ছোটবেলায় এলাকায় প্রায় দিগম্বর একটা পাগল এসেছিল। সে দোকানে দোকানে চকোলেট এবং বিস্কিট ভিক্ষা করতো এবং শিশুদের দেখলে দিয়ে দিতো। আমরা কখনও তাকে এসব খেতে দেখিনি। সে কী খেয়ে বাঁচতো সেটা জানি না। এবার শেষ গল্প- আমি জীবনের প্রথম চাকরি পেয়েছি। আগামীকাল যোগ দিতে হবে। একটা ভালো ঘড়ি হাতে থাকা দরকার। ঢাকা নিউমার্কেটের উল্টো দিকে গাউসিয়া মার্কেটের সাথে ঘড়ির দোকানে গিয়ে ৫০০ টাকায় একটা ঘড়ি কিনলাম। ৫০০ টাকার একটা নোট দিলাম। দোকানী আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে কানে কানে বললো, “নোটটা জাল। এটা অন্য কোথাও দেবেন না। বিপদ হবে।” আমি সেটা দ্রæত পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। তাকে বললাম, “আমার কাছে আর ৩০ টাকা আছে। আমি ঘড়ি নেবো না।” আমি চলে আসার সময় দোকানী ডেকে বললো, “ঘড়িটা নিয়ে যান। টাকা দিতে হবে না।” আমি ঘড়িটা নিয়ে এলাম। সাদা ডায়াল সিল্ভার কালার রিকো। প্রথম মাসের বেতন পাবার পর ৫০০ টাকা পকেটে নিয়ে ঐ দোকানে গেলাম। সে টাকাটা নিলো না। আমার কাছে কুড়ি টাকা নিয়ে চা- সিঙ্গারা আনালো। এভাবেই মহানুভবতা নামের গুনটা হয়তো কমবেশি ছড়িয়ে আছে আমাদের সবার মধ্যেই। সবচেয়ে মহানুভব মানুষটা হয়তো সবচেয়ে দরিদ্রদের কাতারে বাস করে। সেই ভিক্ষুককে আমরা চিনি না যে ভিক্ষা করে একটা রুটি এনে অর্ধেকটা পাশের ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়।
প্রথম আলো প্রতি বছর একজন করে সাদা মনের মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে; তাদের জীবনী বিস্ময়কররকম মহানুভবতায় পূর্ণ — কেউ সারাজীবন বৃক্ষ রোপণ করেছেন, কেউ সাইকেল চালিয়ে বাড়ি বাড়ি বই বিতরণ করে জীবন পার করে দিয়েছেন, কেউ নিজের সব সম্পদ ব্যয় করে দরিদ্র শিশুদের জন্য স্কুল তৈরি করে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। আমরা টিভির খবরে দেখেছি ঢাকার একজন নারী করোনা রোগীদের জন্য স্কুটি চালিয়ে বাড়ি বাড়ি অক্সিজেনের সিলিন্ডার পৌঁছে দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি চাকরি ছেড়েছেন। শ্বশুর-‘শাশুড়ির সম্মতি আদায় করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তাকে। স¤প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক নারী ডাক্তারের খবর দেখেছি। তিনি সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। অবসর সময় ফুটপাথে শুয়ে থাকা ছিন্নমূল শিশু ও বৃদ্ধদের চিকিৎসা করেন, তাদের পরিচর্যা করেন— নখ কেটে দেন, গোসল করান, পরিস্কার করে দেন ময়লা শরীর। তাহলে তো আমরা ভাবতেই পারি মহানুভবতার কোন শ্রেণিভেদ নেই— মাদার তেরেসা, বিল গেটস আর এই নারী চিকিৎসক মহানুভবতার বিচারে সমান।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।