Home কলাম প্রান্তরে তেপান্তরে-২২ : পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার

প্রান্তরে তেপান্তরে-২২ : পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার

হাসান গোর্কি : পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতা অর্জন করা যে কঠিন সেটা আমি ছোটবেলার এক ঘটনায় বুঝেছিলাম। আমি মাঝে মাঝে একা একা দাবা খেলতাম। বোর্ড সাজিয়ে একবার সাদা গুটি আর পরের বার কালো গুটির চাল দিতাম। সবসময়ই দেখতাম, কিছুক্ষণের মধ্যে আমি মনে মনে একটা পক্ষ নিয়ে ফেলেছি এবং সেই পক্ষের হয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চাল দিচ্ছি। অন্য পক্ষের হয়ে কিছুটা দুর্বল বা সাধারণ আত্মরক্ষামূলক চাল দিচ্ছি। নিরপেক্ষ থাকার প্রতিজ্ঞা নিয়ে খেলা শুরু করি এবং প্রতিবারই একটা পক্ষপাতিত্ব দিয়ে তা শেষ হয়। এ অবস্থা থেকে বের হবার জন্য আমি টেবিলের দুদিকে দুটি চেয়ার রাখলাম। এক চেয়ারে বসে সাদা গুটির চাল দিতাম। পরে উঠে গিয়ে টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে কালো গুটির পক্ষে চাল দিতাম। লক্ষ্য, যখন যার পক্ষে চাল দিচ্ছি তার প্রতি যেন পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত ও মনযোগী থাকি। এতে অবস্থার কোন উন্নতি হলো না।

ধরা যাক, কিছুক্ষণ খেলার পর সাদার পক্ষে খুবই চাতুর্যপূর্ণ একটা চাল দিয়ে ফেললাম। এবার কালোর হয়ে চাল দিতে বিপরীত দিকের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। নিরপেক্ষ হলে প্রথমেই আমার সাদা গুটির বুদ্ধিদীপ্ত চালটিকে প্রতিহত করার কৌশল বের করার চিন্তা মাথায় আসতো। কিন্তু আমার মনে হতো এতো দূরবর্তী ও সূ² চাল যে কালোর মাথায় আসবেই তা নিশ্চিত কেন! আমি তখনই মনে মনে অন্য কাউকে কালো গুটির মালিক বানিয়ে ফেলতাম এবং ভাবতাম, সে আমার এই কৌশলী চালটা ধরতে পারেনি। তখন কালোর পক্ষে সাধ্যের পুরোটা দিয়েই একটা বুদ্ধিদীপ্ত চাল দিতাম; কিন্তু লক্ষ রাখতাম তাতে যেন সাদার পক্ষে আগে দেওয়া আমার চাতুর্যপূর্ণ চালটির কোন ক্ষতি না হয়। এভাবে যথারীতি কোন একটা পক্ষের প্রতি অনুরাগ ও অন্য পক্ষের প্রতি বিরাগ নিয়ে খেলা শেষ হতো। আমার ধারণা এরকম ঘটনা অন্য সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। কারণ মানুষ পক্ষপাতশূন্য নয়। প্রকৃতির অংশ হলেও মানুষের পক্ষে প্রকৃতির মতো পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতা অর্জন করা সম্ভব নয়।

মানব-মহামানব, সাধু-সন্ন্যাসী, ধনী-দরিদ্র, শিশু-বৃদ্ধ —যে কেউ আগুনে হাত দিলে তা পুড়ে যাবে। আগুন শিশুকে মায়া করে বা সাধুকে ভক্তি করে ছেড়ে দেবে না। কারণ প্রকৃতি চলে তার অন্ধ নিয়মে। প্রকৃতি কীভাবে উদ্দেশ্যশূন্য এবং অন্ধ (পারপাসলেস এন্ড ব্লাইন্ড) সেটা আমরা প্রান্তরে তেপান্তরে-০৯ (ওয়াচমেকার এনালজি) ও প্রান্তরে তেপান্তরে-১৩ (নৈতিকতার সীমা) তে কিছুটা আলোচনা করেছি। প্রকৃতিতে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, ধার্মিক- নিধার্মিক, যে কেউ নিয়ম মেনে বীজ বপন করলে তা থেকে বৃক্ষ, বিটপ, গুল্ম বা শস্যের জন্ম হয়। সুনামি, ভূমিকম্প, বজ্রপাত, ভূমিধ্বস, বন্যা, মহামারিতে যারা মারা যায় ধর্ম–বর্ণ, বৈভব-দারিদ্র্য, বিশ্বাস-অবিশ্বাস নির্বিশেষে সবাই এক। প্রকৃতির এই অন্ধ নিরপেক্ষতার শিকার হয় উদ্ভিদ ও প্রাণীক‚লও। দাবানলে বন পুড়ে যায়, খাদ্য বা পানির অভাবে বন্য প্রাণীরা মরে যায়। ঝড়ে পাখি মরে, বন্যায় পিঁপড়াদের আবাস ডুবে যায়।
নিরপেক্ষতা বলতে আমরা বুঝি পক্ষসমূহের প্রতি সমান আচরণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এটার চর্চা করা কঠিন। কারণ নিরপেক্ষ আচরণ করতে পারার প্রথম শর্তই হলো চিন্তার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ হওয়া। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে নির্মোহ হওয়া প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। একটা সহজ উদাহরণ থেকে বিষয়টা সহজে বুঝতে পারা যাবে। সকল ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। শুধু তা-ই নয় খুব দূরবর্তী ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের প্রত্যেকের কাছে নিজের ধর্মই একমাত্র বৈধ এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুমোদন প্রাপ্ত ধর্ম। নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি বর্ণ সন্দেহাতীতভাবে সত্য এবং অর্থপূর্ণ। আমরা জানি পরস্পরবিরোধী তথ্য বা ধারণাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক একটি সত্য হতে পারবে। ধরা যাক এপোলো-১১ এ করে চাঁদে অবতরণকারী নভোচারীর সংখ্যা পত্রিকা ‘ক’ লিখেছে ২ জন, ‘খ’ লিখেছে ৪ জন, ‘গ’ লিখেছে ৫ জন। এই তথ্যগুলোর মধ্যে সর্বাধিক একটি অর্থাৎ ‘ক’ পত্রিকার রিপোর্টটি সত্য। ‘খ’ ‘গ’ ভুল লিখেছে; তাদের আংশিক সত্য হবারও সুযোগ নাই। আমাদের বিবেচনাবোধ নিরপেক্ষভাবে কাজ করলে এরকম হবার কথা ছিল না। ধরে নেওয়া যাক যে বিশ্বাসের ব্যাপারটা আলাদা; সেখানে যুক্তি প্রয়োগের সুযোগ নাই। কিন্তু আমাদের জীবন ঘনিষ্ঠ আচারের ক্ষেত্রে যুক্তি প্রয়োগের সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা আছে। সেক্ষেত্রে আমরা কী করি?

রাজনীতি আমাদের জীবন-জীবিকার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একটা উপাদান। কোন রাজনৈতিক দর্শন ভাল লাগলে আমরা সেই দলকে সমর্থন করি। এতে নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয় না। কারণ দর্শনের ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের কাছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়াকর্মকে শত্রুতা ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। আমার পছন্দের দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কর্মসূচিকেই আমি গ্রহণ করি না। যেমন, আমি মনে করি সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখল করে, বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে জিয়াউর রহমান খুব বড় অন্যায় করেছেন। এজন্য তার প্রতি আমার অশ্রদ্ধা থাকার যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার প্রাপ্য সন্মান দিতেও মনে মনে আমি একশত ভাগ কুণ্ঠিত। চিন্তার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ হলে তো আমার এই কুণ্ঠা থাকার কথা ছিল না।
বিএনপি সমর্থক আমার এক মেধাবী বন্ধুর গভীর বিশ্বাস যে জিয়াউর রহমান ঘোষণা না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। অতি বাম এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিশ্বাস মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ; তার তৈরি করা আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলেছেন ‘মুজিব’। আমার গভীর বিশ্বাস ‘বঙ্গবন্ধুর’ একক ও অবিসংবাদিত নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি সহ যাদের কথা বললাম তাদের সবাই মোটামুটি বিবেচনাবোধ সম্পন্ন মানুষ বলে পরিচিতরা মনে করে। তাহলে আমাদের এই বিবেচনায় আকাশ পাতাল ভিন্নতা কেন! ৯ কোটি মানুষের কাছে যিনি খলনায়ক, বাকি ৯ কোটি মানুষের কাছে তিনি মহামানব হন কী করে! তাহলে তো বুঝতে হয় প্রকৃত নিরপেক্ষতা বলতে কিছু নেই। ব্যাপারটা হয়তো সেরকমই।

বিবেচনাবোধ তৈরি হয় মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবার, সমাজ, পরিপার্শ্ব থেকে। তাই নিরপেক্ষতার মানদণ্ডও মানুষ ভেদে ভিন্ন হয়। যেমন কেউ যদি মুসলিম লীগের অখন্ড পাকিস্তান নীতির প্রতি অনুরাগ নিয়ে বেড়ে উঠে থাকে তাহলে তার নিরপেক্ষ বিচারে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী এবং ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকাকে শত্রুতা মনে হবে। কেউ যদি দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদ, কম্যুনিজম, শ্রেণিহীন সমাজ এসব শুনতে শুনতে বড় হয় তাহলে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিমগ্ন থাকা লোকদের রাজনৈতিক দর্শনকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করার প্রবণতা তার মধ্যে তৈরি হবে না। এই দ্বিতীয় পক্ষের মানুষদের বিবেচনায় কম্যুনিস্টরা সৃষ্টিকর্তার অনুমোদনের বাইরে গিয়ে পৃথিবীতে মানুষের আত্মার জন্য ক্ষতিকর কাজ করছে এবং তাদের নরকবাস নিশ্চিত করছে। নীতিশাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থগুলোতে আমরা নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বনের তাগিদ পাই। কিন্তু তার কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় আছে ।

মহাভারতের কাহিনিতে ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন হস্তিনাপুরের রাজা। তিনি গান্ধাররাজ (বর্তমান কান্দাহার) সুবলের কন্যা গান্ধারীকে বিয়ে করেন। সিন্ধু নদের পশ্চিম তীর থেকে প্রায় পুরো আফগানিস্তানের রাজা ছিলেন সুবল। বিপুল শৌর্য-বীর্য, শিক্ষা-সৌকর্য নিয়ে বেড়ে ওঠা রাজকুমারী গান্ধারী ছিলেন অনমনীয় নৈতিকতার প্রতীক। তাদের শত পুত্রের একজন দুর্যোধন কপট কৌশলে পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত ও দ্রৌপদীকে ভরা সভায় অপমান করেন। গান্ধারী এতে নিজ পুত্র দুর্যোধনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাদের পুত্র দুর্যোধনকে পরিত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সে অনুরোধের কোন ফল হয় না। তিনি বলেন,
“পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,
তাই তারে ত্যজিতে না পারি — আমি তার
একমাত্র। উন্মত্ত-তরঙ্গ-মাঝখানে
যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ তারে কোন্ প্রাণে
ছাড়ি যাব?”
(গান্ধারীর আবেদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
উত্তরে গান্ধারী বলেন,
“মাতা আমি নহি? গর্ভভারজর্জরিতা
জাগ্রত হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ¡সিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
শাখাবন্ধে ফল যথা সেইমত করি
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি
দুই ক্ষুদ্র বহুবৃন্ত দিয়ে — লয়ে টানি
মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী,
প্রাণ হতে প্রাণ? তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।” (গান্ধারীর আবেদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এখানে মাতা তার অপরাধী পুত্রের শাস্তি চাচ্ছেন। এটা নিরপেক্ষতার একটা ধ্রুপদী কিন্তু কেতাবী (বুকিস) উদাহরণ। এরকম হলে ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবে এটা অর্জন করা অসম্ভবের কাছাকাছি। একারণে পিতার আদালতে পুত্রের বা পুত্রের আদালতে পিতার বিচার হয় না। এছাড়াও বিচারক যদি কোন আসামীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে মানসিক কষ্ট অনুভব করবেন বলে মনে করেন তাহলে তিনি “বিব্রত বোধ” করে বিচারকার্য থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে পারেন। অর্থাৎ এটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাতেও নিরপেক্ষতা নির্মোহ, সাবলীল বা যান্ত্রিক নয়। ব্যক্তি মানুষের নিজের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণগুলোর অন্যতম হলো উদ্বর্তনের আকাঙ্ক্ষা বা প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে থাকার ইচ্ছা। এই ইচ্ছা পূরণ করতে আমরা সবচেয়ে ভাল খাবারটা খেতে চাই, সবচেয়ে ভাল জায়গায় বাস করতে চাই, সবচেয়ে উপযুক্ত সঙ্গীর খোঁজ করি। এটা নির্দোষ পক্ষপাতিত্ব। অন্য প্রাণীরাও এটা করে। কিন্তু নিজের প্রতি মানুষের পক্ষপাতিত্ব অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা।

গ্রিক পুরাণের নারসিসাস নামের শিকারির গল্পটা কমবেশি আমরা সবাই পড়েছি। নদী দেবতা চেপিসাস ও মৎস্যকন্যা লিরিওপির সন্তান সুদর্শন নারসিসাস একদিন শিকারে গিয়ে এক স্বচ্ছ জলাধারে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বিমোহিত হলো এবং প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে গেল। সে বুঝতে পারেনি এটা তার নিজের প্রতিবিম্ব। এক সময় অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সেখানেই তার মৃত্যু হলো। বাস্তবে নারসিসাস নামের শিকারির মতো আমরাও নিজের সৌন্দর্য আর সক্ষমতার অতিশায?িত অনুভূতি বা নিজের প্রতি যুক্তিহীন নিমগ্নতা নিয়ে থাকি। আমরা সবাই নিজেকে সুন্দর মনে করি না! কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন মানুষটির সাথে চেহারা পরিবর্তনের কোন সুযোগ দেওয়া হলে স্বাভাবিক চেহারার কেউ-ই সেটা গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। আমার জানা সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটি যদি তার বুদ্ধির সবটুকু আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে আমার বুদ্ধিটুকু নিয়ে যেতে চায় তাহলে আমি রাজী হবো না। আমি নামক এই সত্ত¡ার প্রতি এই অন্ধ পক্ষপাতিত্বই নিরপেক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষের জন্য অন্তরায়।

গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণ হলো আমরা গোষ্ঠীর অংশ এবং একটা অভিন্ন স্বার্থে আবদ্ধ। আবার সেই একই কথা। এটা আমাদের উদ্বর্তনের আকাঙ্ক্ষার সাথে জড়িত। ধরা যাক আমাদের লোকালয়ে একটা বাঘ বাস করে। সে চরম ক্ষুধার্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আমরা কিন্তু তার ক্ষুধা মেটানোর জন্য আমাদের একটা সন্তানকে তার সামনে দিয়ে দেবো না। আমরা বড়জোর হন্যে হয়ে একটা ছাগল খুঁজতে থাকবো। গৃহপালিত হাঁস ক্ষুধার্ত হলে আমরা তাদের শামুক খেতে দেই। শামুকের প্রাণ সংহার করতে আমরা সংকোচ অনুভব করিনা। হাঁসের প্রাণ বাঁচানো বা ক্ষুধা নিবারণের জন্য আমরা উদ্গ্রীব একারণে যে তাদের খেয়ে আমরা আমাদের প্রাণ বাঁচাই।

তার অর্থ মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, প্রকৃতি মিলিয়ে সার্বজনীন বা পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতা অর্জন আসলে দুরতিক্রম্য একটা পথ। পরিবেশ ও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষার যে আন্দোলন গত অর্ধ শতাব্দীকালে জেগে উঠেছে তা থেকে অনুমান করা বোকামি হবে যে পক্ষপাতহীনভাবে এই গ্রহের স্বতঃপ্রবৃত্ত মূল্যকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমরা আসলে চাই পৃথিবীকে আমাদের নিজেদের জন্য ফলদায়ক (রিওয়ারডিং) রাখতে। ‘বাসযোগ্য’ বলে যে শব্দটা আমরা ব্যবহার করি সেটা শুধু মানুষের জন্য। অর্থাৎ আমাদের স্বপ্ন পৃথিবীটা মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত থাকবে। প্রকৃতির মতো নির্মোহ নিরপেক্ষতা (ব্লাইন্ড নিউট্রালিটি) মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়; আর অসম্ভব বলে কাম্যও নয়। সম্পাদকের বেঁধে দেওয়া শব্দ সংখ্যা অতিক্রম করার আগেই পাঠকের জন্য একটা রিডল বলা যাক। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত এক আসামীকে পুলিশের এক সিপাহী পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে অন্য জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আজ রাতে তার ফাঁসি কার্যকর হবে। রাস্তার পাশে একটা বাস দাঁড়ানো । ভেতরে স্কুলগামী ৫০ জন শিশুকে রেখে ড্রাইভার চা খেতে নেমেছে। কোন এক শিশু হ্যান্ড ব্রেকে টান দেওয়ায় বাসটা ধীর গতিতে চলতে শুরু করেছে। সামনে ৫০০ ফুট গভীর খাদ। খাদে পড়লে ৫০ শিশুর মৃত্যু নিশ্চিত। আশপাশে এমন কিছু নেই যা দিয়ে বাসটাকে থামানো যায়। সিপাহী বুদ্ধি করে ডান্ডা বেড়ি লাগানো আসামীকে ধাক্কা দিয়ে বাসের সামনের চাকার নিচে ফেলে দিলো। সামনের চাকা পার হয়ে গেলেও পেছনের চাকা আটকে গেলো আসামীর শরীরে। সে মারা গেল। বাসের শিশুরা রক্ষা পেলো। এই ঘটনায় সিপাহীর বিচার হলো। প্রথম বিচারক নিয়ম বহির্ভূতভাবে আসামীকে হত্যার অপরাধে সিপাহীকে আজীবন কারাদণ্ড দিলেন । দ্বিতীয় বিচারক দায়িত্ব পালনের সময় বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিলেন । তৃতীয় বিচারক পরিস্থিতি বিবেচনায় কল্যাণকর সিদ্ধান্তের জন্য তাকে বেক্সুর খালাস দিলেন । চতুর্থ বিচারক ৫০ শিশুর জীবন রক্ষা করায় সিপাহীকে ২০ লক্ষ টাকা অর্থ মূল্যে পুরস্কৃত করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দিলেন। প্রশ্ন : এই চার বিচারকের রায়গুলোর মধ্যে পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল কোনটি? আর এর কোনটিই যদি নিরপেক্ষ না হয়ে থাকে তাহলে কী রায় দিলে তা নিরপেক্ষ হতে পারতো?
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা

Exit mobile version