হাসান গোর্কি : মানুষের অনেক গুণাবলীর মতো নৈতিকতার সীমাও অস্পষ্ট। কোন একটা কাজের কোন বিন্দুটা অতিক্রম করলে তা অনৈতিকতার সীমায় পৌঁছে যায় সেটা নির্ধারণ করা কঠিন। এর জন্য আমাদের বোধের গভীরতায় ঘাটতি যতটা দায়ী প্রকৃতির নিয়ম তার চেয়ে কম দায়ী নয়। ধরা যাক আখাউড়া থেকে কুমিল্লা এবং বেলোনিয়ার দিকে দুটি রেল লাইন ১৫ ডিগ্রি কোণে বেরিয়ে গেছে। বেলোনিয়ার দিকের লাইন পুরোপুরি সচল আছে; কিন্তু সেদিকে এখন আর ট্রেন চলে না। আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতীর চালক। আখাউড়া জংশন পার হবার পর আপনার কুমিল্লার দিকে যাবার কথা। কিন্তু আপনি দেখলেন যে এই রেল ট্রাকের ওপর ১০০ জন মানুষ বসে রোদ পোহাচ্ছে। ট্রেনের গতি এত বেশি যা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটবে এবং ট্রেন লাইনের ওপরে বসা লোকদেরও মাড়িয়ে যাবে। ট্রেনটা এমনভাবে তৈরি যে আপনি ইচ্ছা করলে সেটাকে বেলোনিয়ার দিকে নিরাপদে চালিয়ে দিতে পারেন। আপনি লক্ষ করলেন বেলোনিয়ার রেল ট্রাকে ১ জন লোক রোদ পোহাচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? ১ জন মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে ১০০ জনের জীবন বাঁচানো ভালো সেটা অন্য সবার মতো আপনিও বোঝেন। কিন্তু আপনি বেলোনিয়ার ট্রাকে ট্রেন চালিয়ে দিলে যে ব্যক্তি মারা যাবে তার কোন দোষ বা দায় নেই। কারণ, ঐ ট্রাকে ট্রেন যাবার কথা নয়। তাই এক্ষেত্রে আপনি নিরীহ ১ জন মানুষকে নিজ দায়িত্বে মেরে ফেলছেন। কুমিল্লার ট্রাকে ট্রেন গেলে যে ১০০ জন মারা পড়বে তাদের দায় আছে। বড় অপরাধ না করলেও তাদের ভূমিকা ছিল দায়িত্বহীন। সিডিউল অনুযায়ী এসময় ট্রেনটা এই লাইনেই আসার কথা; এটা জানা তাদের নিজেদের প্রতি দায়িত্বশীলতার অংশ। আপনি যদি নিয়ম মেনে ১০০ জনের ওপর দিয়ে ট্রেনটা চালিয়ে দেন তাহলে তার দায় আপনার নয়; কিন্তু ১টা পরিবারের পরিবর্তে ১০০টা পরিবারকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আপনি মনোবেদনায় ভুগবেন। তাহলে আপনি কোনটা করবেন?

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্ক, কোপেনহেগেন থেকে মৌ দাশ আমাকে একটা ধাঁধাঁ পাঠিয়েছে- আপনি একটা ফেরিতে করে নদী পার হচ্ছেন। আপনার ফেরিতে ৫০০ মানুষ আছে। এক কিলোমিটার দূর দিয়ে অন্য একটা ফেরি চলছে। সেটাতে ৫০০ মানুষের মধ্যে আপনার বাবা-মা-ভাই-বোন আছে। আপনার হাতে একটা রিমোট ডিভাইস আছে যা দিয়ে আপনি ঐ ফেরিটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারেন। ঐ ফেরিটাতেও এরকম একজন আছে যার বাবা-মা-ভাই-বোন আপনার ফেরিতে আছে এবং সে একই ডিভাইস দিয়ে আপনার ফেরিটা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে। আমাদের দুজনকেই বলা হলো এক মিনিটের মধ্যে ফেরি দুটিতে রাখা বোমা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে দুটিই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে আপনারা যদি এক মিনিট পূর্ণ হবার আগে অন্য ফেরিটা ধ্বংস করে দেন তাহলে আপনার ফেরি বেঁচে যাবে। অন্য ফেরির লোকটাও যদি আপনার ফেরিটা ধ্বংস করে দেয় তাহলে তার ফেরিটা বেঁচে যাবে। আপনি যদি অন্য ফেরিটা উড়িয়ে দেন তাহলে ৫০০ মানুষের সাথে আপানার নিকট আত্মীয়রা মারা যাবে। আপনি যদি নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং অন্য ফেরির লোকটা আপনার ফেরি উড়িয়ে দেবে এই আশায় বসে থাকেন তাহলেও বিপদ কাটে না। এমন হতে পারে যে একইরকম আশা করে ঐ ফেরির লোকটাও অপেক্ষা করতে থাকবে, কারণ সে তার বাবা-মাকে নিজ হাতে মেরে ফেলতে চায় না। উভয়-ই নিষ্ক্রিয় থাকলে আপনারা দুইজন এবং আপনাদের নিকট আত্মীয়সহ এক হাজার মানুষ মারা যাবে। এক্ষেত্রে আপনি কী করবেন?
(ধাঁধাঁ দুটির উত্তর মনে মনে ভেবে রাখুন; পরবর্তী অনুচ্ছেদ্গুলো পড়ার পর উত্তরগুলো মিলিয়ে নেবেন।)

উপরের কল্পিত দুটি ঘটনায় যে কোন সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক তা অনিবার্যভাবেই অকল্যাণ বয়ে আনবে। তার অর্থ নৈতিকতার একটা বিশ্বজনীন মানদণ্ড পাওয়া কঠিন যা যে কোন পরিস্থিতিতে প্রশ্নাতীতভাবে কল্যাণ নিশ্চিত করে। যে খাদ্য চক্রে পৃথিবীতে প্রতিদিন অসংখ্য প্রাণীর কষ্টকর মৃত্যু হয় আমাদের নৈতিকতার ধারণায় তা এতটাই সাবলীল এবং সংকোচহীনভাবে অনুমোদিত যে বড়শিতে উঠে আসা মাছ যখন শ্বাসকষ্টে লাফায় তখন আমরা খুশি হই। অ্যামাজনীয় অববাহিকার সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী হলো করুবো স¤প্রদায়। মূলত শিকারি এই জনগোষ্ঠী জঙ্গলের অনেক গভীরে গম্বুজ আকৃতির ( ছবিতে ঠিক আমাদের দেশের খড়ের গাদার মত দেখায়) ঘরে বাস করে। সিডনি প্যাসুয়েলো এবং পল রাফায়েল নামে দুজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক তাদের ভ্রমণ কাহিনিতে লিখেছেন, ‘করুবো’রা পশু ধরে আনার পর হত্যা করার সময় তাদের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আমাদের দেশের মুরংরা গাছ থেকে ফল পেরে আনার আগে গাছের অনুমতি নেয় এবং দুঃখ প্রকাশ করে। নৈতিকতার দায়মুক্তি পেতে এগুলো এক ধরণের আত্মতৃপ্তিমূলক কাজ। এগুলো ঐ পশু বা ফলের কাছে পৌঁছায় কিনা আমরা জানিনা; তবে মানুষদের সান্ত¡না দেয়। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে সান্ত¡না দেওয়া বা পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না আমরা এমন ঘটনার মুখোমুখি প্রায়-ই হই।

২০০৭ এর সিডরের সময় এক পরিবারের স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে তাদের খড়ের ঘরের চালে বসে সমুদ্রের দিকে ভেসে যাচ্ছিল। ঐ মহিলা তার দুগ্ধপোষ্য ছেলের হাত ধরে রেখেছিল। লোকটা দুই মেয়ের হাত ধরে ছিল। এক সময় পানিতে ভিজে খড়ের চাল ডুবে যেতে থাকলে সে তার স্ত্রীকে বলেছে, “ছেলেকে ছেড়ে দে। নাহলে তুই-ও বাঁচবি না।” ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী কিছুক্ষণ টিকে ছিল। পরে লোকটাও ভেসে গেছে। ঐ মহিলা পরে গণমাধ্যমে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছে। নৈতিকতার প্রচলিত ধারণায় নিজে বাঁচার জন্য সন্তানদের বিসর্জন দেওয়ার এই ঘটনাকে উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ কোনটিই মনে করা কঠিন।

আরও একটা সহজ উদাহরণ থেকে নৈতিকতার সীমারেখা বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরুন, আপনি গভীর রাতে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন। এসময় ফুটপাতে একজন লোককে পড়ে যেতে দেখলেন। আপনি তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিলেন। রাস্তার স্পীড লিমিট ৮০ কিলোমিটার। গুরুতর অসুস্থ এই হার্টের রোগীকে যতো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে তার বেঁচে যাবার সম্ভাবনা ততো বাড়বে। রাস্তায় যানবাহন কম। আপনি গাড়ির গতি বাড়িয়ে ১০০ করলেন। এতে আইন ভঙ্গ করা হলো, কিন্তু তাতে নৈতিকতার খুব একটা ব্যত্যয় করা হলো না। আপনার মনে হবে একজনের জীবন বাঁচানোর জন্য এতটুকু আইন ভঙ্গ করা চলে। এই ব্যাখ্যায় বেশিরভাগ মানুষের সম্মতি থাকবে। আপনি রোগীর অবস্থা চিন্তা করে গতি বাড়িয়ে ১২০ করলেন। এটা কি নৈতিক হলো? উত্তরটা হয়তো ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ এর মাঝামাঝি। রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হলো। মরিয়া হয়ে গতিটা বাড়িয়ে ১৪০-১৬০ করলেন। এখন মনে হচ্ছে আপনি নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করেছেন। কারণ আপনি আপনার নিজের, রোগীর এবং রাস্তায় চলাচলকারী অন্য গাড়িতে থাকা মানুষদের জীবনের জন্য হুমকি তৈরি করেছেন। তাহলে এখন বলুন ৮০ থেকে ১৬০-এর মধ্যে ঠিক কোন বিন্দুতে (৯৪, ১১৮, ১৪৫) আপনি নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করেছেন? এরকম একটা বিন্দু বের করা কঠিন। আবার আপনি যে বিন্দুটি বের করবেন (যদি করেন) চালকের আসনে থাকলে আমি হয়তো তার থেকে ভিন্ন কোন বিন্দু বের করতাম।

স্কুলে পড়তে আমরা ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্রের প্রাকটিক্যাল ক্লাস করতাম। জঙ্গল থেকে ব্যাঙ ধরে নিয়ে এসে লবণ খাইয়ে প্রথমে তাকে অজ্ঞান করতাম। এরপর চার হাত পায়ে পিন ফুটিয়ে ট্রেতে অপারেশন করতাম। চামড়া কেটে পেটের নাড়িভুঁড়ি উন্মুক্ত করতাম। এসময় ব্যাঙটা জীবিত থাকতো। প্রাকটিক্যাল ক্লাস শেষে তাকে নর্দমায় ফেলে দিতাম। কাজটা কি নৈতিকতার বিচারে ভাল ছিল? আমার এক ক্লাসমেট প্রাকটিক্যাল ক্লাস করার সময় বলেছিল, “মানিক, (এটা আমার নিক নেম) ব্যাঙরা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী হলে তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে পেট কেটে পরিপাকতন্ত্র দেখতো।” একটা প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই শিক্ষা আমার কাজে না লাগলেও যারা পরবর্তীতে ডাক্তার হয়েছেন তাদের কাজে লেগেছে। তারা অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। তাহলে কাজটা নৈতিক! আবার এই ঘটনাকে যখন আমরা নৈতিক ভাবছি তখন এটা নিশ্চিত করছি যে একটা ব্যাঙের জীবন একজন মানুষের সুস্থতার চেয়ে কম মূল্যবান। এটা কি একটু অনৈতিক শোনাচ্ছে না?

প্রকৃতি অন্ধ। ন্যায়ানুগতার স্বতঃপ্রবৃত্ত উপস্থিতি কোথাও নাই। থাকলেও সেটা আমরা দেখি না। নীতিশাস্ত্রে নৈতিকতার পরিসীমা আলোচনায় বহুল ব্যবহৃত একটা প্রশ্ন এরকম- ধরুন আপনার বাবা-মা একসাথে পানিতে ডুবে যাচ্ছে। আপনি একটা নৌকা নিয়ে তাদের উদ্ধার করতে গেলেন। নৌকাটা এত ছোট ছিল যে আপনি একজনকে উদ্ধার করতে পারবেন। আপনি কাকে উদ্ধার করবেন? আপনি যাকেই উদ্ধার করেন, অন্যজনকে গুরুত্ব কম দেওয়ার দায়ে আপনাকে অভিযুক্ত করা যাবে। সেটা অনুচিত। কারণ, আসলে সমস্যাটা আপনার নৈতিকতার নয়। প্রকৃতির অন্ধ (ব্লাইন্ড অর্থে) নিয়মের দায় আপনার কাঁধে চাপানো হচ্ছে। এই বিপদের সময়ও প্রকৃতি দুইজনের নৌকায় তিনজনকে উঠতে দিচ্ছে না। সেটা করতে দিলে আপনি বাবা-মা দুজনকেই উদ্ধার করতেন, কারণ তাদের দু’জনকে আপনি সমান ভালবাসেন। আবার ধরা যাক, উপার্জন-অক্ষম অনাহারক্লিষ্ট এক ব্যক্তি রাতে আপনার ঘরে ঢুকে চুরি করে ভাত খেয়েছে। এই ব্যক্তির ক্ষুধা তৈরি হবার জন্য প্রকৃতি দায়ী, ক্ষুধা নিবারণ না করার জন্য তার আত্মীয়, সমাজ ও রাষ্ট্র দায়ী। তাহলে কি তার নৈতিকতার সংকট আছে? হ্যাঁ, জীবন বাঁচাতে গিয়ে চুরি করে অল্প হলেও সে নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করেছে। পরের অনুচ্ছেদে সক্রেটিসের মৃত্যুর ঘটনা থেকে আমরা সেটা বুঝবো।

সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নৈতিকতার ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে তিনি তরুণ স¤প্রদায়কে বিপথগামী করেছেন, দেব-দেবীদের মর্যাদাহানি হয় এমন তত্ত¡ প্রচার করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন পেলোপনেশীয় যুদ্ধে স্পার্টা ও তার মিত্রবাহিনীর কাছে এথেনীয় সাম্রাজ্যের হেরে যাওয়ার জন্য শাসকদের সমালোচনা করার কারণেই তাকে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে।

জাঁক-লুই ডেভিড এর আঁকা সক্রেটিসের হেমলক পানের মুহূর্ত

আদালত সক্রেটিসকে নিজের জন্য একটা শাস্তি প্রস্তাব করতে বলেছিল। সক্রেটিস খুব ক্ষুদ্র অঙ্কের একটা জরিমানা প্রস্তাব করেছিলেন। এতে বিচারকরা অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। তারা চাচ্ছিলেন সক্রেটিস অন্তর্র্বতী নির্বাসন বা কিছু সময়ের জন্য আত্ম-অন্তরিন দণ্ডের প্রস্তাব করবেন। কিন্তু সক্রেটিস অপরাধ না করে কোন শাস্তি ভোগ করার মাধ্যমে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া অনৈতিক মনে করেছিলেন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবার পর সক্রেটিস জেলখানায় ছিলেন ৩০ দিন। ক্রিটো ( জাঁক-লুই ডেভিড এর কল্পনায় আঁকা এই চিত্রকর্মে কমলা পোষাকের যে ব্যক্তি সক্রেটিসের পা ধরে বসে আছেন) ছিলেন তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য। তিনি সক্রেটিসের পলায়নের সব ব্যবস্থা করে একদিন তাকে তা জানালেন। সক্রেটিস বললেন,
—“আমি মানুষকে ন্যায়-নীতি, সত্য ও সৌন্দর্যের শিক্ষা দেই। আমি নৈতিকতার প্রচলিত রীতি বিসর্জন দিতে পারি না। আমি এই দণ্ড ভোগ করতে প্রস্তুত আছি।”
ক্রিটো বললেন,
—“আপনাকে যে দন্ড দেওয়া হয়েছে তা ন্যায়ানুগ নয়! আদালতে আপনি সেটা বলেছেন।”
—“হ্যাঁ, সেটা আমি বলেছি। কিন্তু বিচারকরা আমার সাথে একমত হননি। আমি কীভাবে নিশ্চিত হই যে আমার অনুধাবন-ই চুড়ান্ত? আমি আমার মতামত দিয়েছি। আদালত আমার সাথে একমত হলে আমি নিশ্চিত হতাম যে আমার ধারণা শুদ্ধ। আমি যদি এখন পালিয়ে যাই তাহলে সেটা নৈতিকতার পরিপন্থী হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত সেটাই নৈতিকতা যতক্ষণ না তা নতুন ধারণা দিয়ে যথাযথভাবে প্রতিস্থাপিত হয়।”

সক্রেটিসের এই ঘটনা নৈতিকতার একটা ধ্রুপদী উদাহরণ। একটা মানদণ্ড। এটা শতভাগ মেনে চলতে গেলে পৃথিবীর সব মানুষকে ‘সক্রেটিস’ হতে হবে। তাই বাস্তবে নৈতিকতার ধারণা নীতিহীনতার সাথে অধিক্রমণমূলক (ওভারল্যাপিং)। কিছুদিন আগে সুন্দরবনের দস্যুদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই দস্যুদের মধ্যে মানুষ হত্যাকারীও ছিল। সরকার এদের পুনর্বাসনের জন্য আর্থিক সহায়তাও করেছে। এটাকে অনৈতিক বলতে হবে। আবার ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাকে বিবেচনায় নিয়ে কেউ এই উদ্যোগকে ‘নৈতিক’ বললেও ভুল হবে না। এভাবে অনেক ক্ষেত্রেই নৈতিকতার সীমারেখায় অধিক্রমণ ঘটবে। কিন্তু তার ভারসাম্য কীভাবে রক্ষিত হতে পারে সে বিষয়ে একটা গল্প বলে আজকের লেখা শেষ করি-
এক ব্যক্তি মিয়ামি থেকে লস এঞ্জেলস যাবেন। সকাল ১০ টায় ফ্লাইট। ভোর ৬ টায় তার বাসার নাইটগার্ড এসে তাকে পরের ফ্লাইটে যেতে অনুরোধ করলো। ভদ্রলোক কারণ জানতে চাইলেন। নাইট গার্ড বলল, সে রাতে স্বপ্ন দেখেছে যে ফ্লাইট এস ইউ-০০৭, যেটাতে ভদ্রলোকের যাবার কথা, সমুদ্রের পানিতে পড়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক এই গল্পে গুরুত্ব না দিয়ে যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন নাইটগার্ড এসে তার পা ধরে বসলো। তিনি যাত্রা বাতিল করলেন। ফ্লাইট এস ইউ-০০৭ সত্যি সত্যি সমুদ্রে পড়ে গেল। পরদিন ঐ ভদ্রলোক নাইটগার্ডকে ডেকে তার জীবন বাঁচানোর জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন, ১০ হাজার ডলার পুরস্কার দিলেন এবং দায়িত্বের অবহেলা করে রাতে ঘুমানোর জন্য তিরস্কার করার পর তার হাতে চাকুরিচ্যূতির পত্র ধরিয়ে দিলেন।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।