হাসান গোর্কি : আমাদের মস্তিষ্কে রক্ষিত বিশ্বাস, ধারণা, তথ্য, অনুমান, অনুধাবন, চিন্তা দিয়েই আমরা নতুনগুলোকে নিরীক্ষা করে গ্রহণ বা বাতিল করি; ফলে প্রায়শ ভুল করি। আবার অনেক সময় রিফ্লেক্স (প্রতিবর্তী ক্রিয়া) থেকেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমি এরকম অনেক ঘটনার মুখোমুখি হই যেখানে প্রতিপক্ষের যুক্তি ও তথ্যের নির্ভুলতাকে পাশ কাটিয়ে জোর করে নিজের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে ফেলি। আমার বন্ধুরা সেটা জানে এবং মাফ করে দেয়। যারা আমার মতো পূর্ব-ধারণা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ভুল-শুদ্ধ যাচাই করেন তাদের জন্য এই লেখা।

ছোটবেলায় ঢাকা চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়ে গরুর মতো দেখতে একটা প্রাণীর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে সাইনবোর্ডে লেখা পরিচিতি পড়ছিলাম। বাংলায় ‘লেখা নু-হরিণ’। অবিকল গরুর মতো দেখতে একটা প্রাণী হরিণ হতে যাবে কেন! ইংরেজিতে লেখা Wildebeest; লক্ষ করলাম, Wild এবং Beast দুটি বানান-ই ভুল। তাছাড়া শব্দ দুটি একসাথে লেখা হয়েছে। আলাদা করে শুদ্ধ বানানে লিখলে অর্থ হবে ‘বন্য পশু’। আমাদের বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমার বড় ভাই। তাকে বিষয়টা জানালাম। তিনি বললেন, তথ্য ঠিক আছে। বড় ভাই স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার পান্ডিত্য তখন আমাদের পুরো পরিবারে অনুপ্রেরণার উৎস। তার অনুমোদন ভুল হবার কথা নয়।
কিন্তু সদ্য উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহন শুরু করা বালকের পক্ষে এই অদ্ভুত, অসংলগ্ন নামটি মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। বাংলাদেশের ডায়েরি থেকে প্রায় দেড়শ দেশের রাজধানীর নাম মুখস্ত করেছি। চেকোশ্লোভাকিয়ার ডেল কেবলিচ যে ঘাস খেয়ে ১০৫ বছর বেঁচে ছিলেন সে তথ্যও এই বই পড়ে জেনেছি। এভাবে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি বিষয়ে যে আস্থা তৈরি হয়েছে তা চেপে রাখাই তখন দায়। আমি বগুড়া ফিরে একদিন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলাম। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ‘ড’ সিরিজের বই বের করে দেখলাম, প্রাণীটির নাম আসলেই Wildebeest এবং এটা একটা এন্টিলোপ, অর্থাৎ হরিণের একটা প্রাজাতি। এরা বাস করে মূলত আফ্রিকার পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে। এই আবিস্কারে আমার খুশি হবার কথা কিন্তু আমি দুঃখিত হলাম, কারণ আমার বিচারবুদ্ধি এতে মার খেয়েছে।

অন্য একটা গল্প- সোভিয়েত রাশিয়ার সেনাবাহিনীর এক স্কুলে কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণ চলছে। মেজর সদ্য যোগ দেওয়া ক্যাডেটদের আক্রমণ পরিকল্পনা বুঝাতে গিয়ে বোর্ডে একটা ত্রিভুজ এঁকে বললেন, “এটা একটা সমকোণী ত্রিভুজ। এর লম্ব ও ভূমি সংলগ্ন কোণের মান ১০০ ডিগ্রি। এর তিন কোণের সমষ্টি ১৯০ ডিগ্রি। তাহলে অন্য দুটি কোণের মান কত?” একজন ক্যাডেট বলল, “স্যার, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি তো দুই সমকোণ অর্থাৎ ১৮০ ডিগ্রি!” মেজর ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যাডেটকে ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। পরদিন তিনি ক্লাসে ঢুকে বললেন, “গতকাল আমি ভুল বলেছিলাম। আসলে ১০০ ডিগ্রিতে পানি ফোটে।” সোভিয়েত সেনাবাহিনী নিয়ে এরকম আরও অনেক কৌতুক চালু আছে। তবে মেজর প্রথম যে তথ্য দিয়েছিলেন সেটাও ভুল ছিল না। ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৯০ ডিগ্রিও হতে পারে।

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রীক গণিতবিদ অটোলিকাস প্রথম দাবি করেন যে উত্তল বা অবতল ক্ষেত্রের ওপর আঁকা ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল এবং কোণগুলোর মান যথাক্রমে বেশি ও কম হবে। পরে ম্যানিলাস নামে অন্য এক গ্রীক গণিতবিদ এর সমীকরণ বের করেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, সান জুয়ান এবং পোর্টোরিকোকে সরলরেখায় যুক্ত করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামে একটা ত্রিভুজ কল্পনা করা হয়। জাহাজ ও বিমান হারিয়ে যাবার অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে এই ত্রিভুজকে ঘিরে। এই ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি ১৮২ ডিগ্রি। ভূপৃষ্ঠ একটা উত্তল ক্ষেত্র। এর ওপরে আঁকা যে কোন ক্ষেত্রের কোণগুলোর মান কোন সমতল ক্ষেত্রের (যেমন টেবিল, কাগজ) ওপর আঁকা ক্ষেত্রের চেয়ে বড় হবে। তবে টেবিলটা যদি ভারত বা এশিয়া মহাদেশের সমান হয় তাহলে তারও উপরিতল ভূপৃষ্ঠের মত উত্তল হবে এবং তার ওপর আঁকা ক্ষেত্রের মান আরও অনেক বড় হবে। বিমান চালকরা যখন আকাশে ওড়েন তখন তাদের কাছে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি কাজ করে না। ধরা যাক বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বা গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের (থাইল্যান্ড-লাওস-মায়ানমার) কোন অঞ্চলে একটা বিমান হারিয়ে গেল। উদ্ধারকারী বিমান যদি এই ত্রিভুজকে ১৮০ ডিগ্রি ধরে কাজে নামে তাহলে সে নিজেই হারিয়ে যাবে।

ছোটবেলায় আমার খুব পছন্দের গান ছিল আশা ভোঁসলের গাওয়া “নাচ ময়ূরী নাচ রে।” বড় হয়ে জানলাম ময়ূরীর পেখম নাই এবং সে কখনও নাচে না। লতা মঙ্গেশকরের একটা গানের প্রথম কলি : “আকাশপ্রদীপ জ্বলে, দূরের তারার পানে চেয়ে” আমি ভাবতাম ‘আকাশপ্রদীপ’ বলতে তারাকেই বুঝাচ্ছে। কিন্তু আসলে ‘আকাশপ্রদীপ’ অর্থ হারিকেন বা এই ধরণের প্রদীপ যা লম্বা বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু পুরাণ মতে কার্তিক মাসে স্বর্গবাসী মৃত পূর্ব-পুরুষরা মর্ত্যে এসে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে অদৃশ্য অবস্থায় বসবাস করে কালী পূজার অমাবস্যার দিন থেকে ফেরত যেতে শুরু করেন। অন্ধকার রাতে পথ চিনতে তাদের যাতে অসুবিধা না হয় সেকারণে এই প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে এর অর্থ লেখা হয়েছে, “পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে কার্তিক মাসের সন্ধ্যায় বাঁশের মাথায় উঁচু করে জ্বেলে রাখা প্রদীপ”। (ধাঁধাঁ: উদ্দেশে অর্থ কী?)

মোরারজী দেশাই ১৯৭৭ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে বেঁচে যান। ধান খেতে বিমানটিকে জরুরি অবতরণ করাতে গিয়ে ৫ পাইলটের সবাই মারা যান। এ বিষয়ে অনেক পরে হিন্দুস্থান টাইমস এ প্রকাশিত রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, Pilots were sanguine of a safe emergency landing, আমি জানতাম Sanguine অর্থ নিশ্চিত থাকা। ভাবলাম ইঞ্জিন অচল হয়ে যাওয়া একটা বিমানের পাইলটরা কীভাবে নিরাপদ অবতরণের বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বসে ডিকশনারি খুলে Sanguine শব্দের অর্থ দেখলাম, লেখা আছে- cheerfully optimistic, hopeful, or confident, অর্থাৎ আশাবাদী বা আস্থাশীল। ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হবার পর থেকে পরবর্তী ৬০ বছর অক্সফোর্ড লার্নারস ডিকশনারিতে সাইফনের সংজ্ঞায় শুধু বায়ুচাপের কথা লেখা ছিল। কিন্তু প্রক্রিয়াটা যুগপৎ ঘটে বায়ুচাপ ও মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে। এটা সবাই জানে। কিন্তু ভুলটা সপ্তম শ্রেণি পড়া এক ভারতীয় বালকের চোখে পড়ে ২০০৮ সালে— প্রচলিত হবার ছয় দশক পর।

সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা হলো, ফাঁসি সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুগুলোর একটা। সিয়াটল টাইমস (ডিসেম্বর ৩০, ২০০৬) ড. লরেন্স কিবলিনস্কির বরাতে লিখেছিল, “ফাঁসি কার্যকর করার সময় সাদ্দাম হোসেন কোন ব্যথা অনুভব করেননি। তবে আমরা নিশ্চিত নই। এটা একটা দার্শনিক প্রশ্ন।” কিছু স্কলারলি আর্টিকেলে লেখা হয়েছে, জেলখানায় যেভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হয় সেটা প্রায় যন্ত্রণাশূন্য। এটাকে বলা হয় জুডিশিয়াল হ্যাঙ্গিং যা ‘লং ড্রপ’ এর মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পায়ের নিচ থেকে পাটাতন টান দেওয়ার পর সে নিচের কুড়ি ফুট গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। গলায় লাগানো রশির দৈর্ঘ্য এমন থাকে যে তার পা গর্তের তলদেশ থেকে কয়েক ফুট উপরে থাকে। এতে মেরুদণ্ডের হারের যে অংশ মাথার সাথে লেগে থাকে সেটা ভেঙে যায় এবং স্পাইনাল কর্ড অকার্যকর হয়ে যায়। মেডিকেল সায়েন্স অনুযায়ী এটা ঘটে সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই। ফলে ঐ ব্যক্তি কোন কষ্ট অনুভব না করেই মরে যায়। তবে যারা নিজেরা গলায় রশি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে তারা দম বন্ধ হয়ে মরে যাবার কারণে অনেক কষ্ট পায়।

প্রাচীনকাল থেকে ধ্রুবতারাকে আমরা যে শাশ্বত ভেবে এসেছি এর নামই তার প্রমাণ। এক সময় নাবিকরা দিক নির্ণয়ের জন্য এই তারার অবস্থানকে ব্যবহার করতো। বাস্তবে ধ্রুবতারাও ধ্রুব নয়। এখন যাকে আমরা ধ্রুবতারা বলছি তার নাম পলারিস। এখন থেকে ৮০০০ বছর পর পলারিস সরে যাবে এবং সেখানে আসবে দেনেব নামের অন্য এক নক্ষত্র। তখন মানুষ দেনেবকে পরবর্তী ১২,০০০ বছর ধ্রুবতারা বলবে। এরপর ধ্রুবতারার আসন পাবে ভেগা।
ধরুন, আমি দোকানে লটারির টিকেট কিনতে গেলাম। একটা টিকেটের নাম্বার ৭৪৩৮৬৬৫, অন্যটির নাম্বার ৯৯৯৯৯৯৯। আমার মনে হবে দ্বিতীয় টিকেটটার বিজয়ী হবার সম্ভাবনা অনেক কম। তাই আমি প্রথমটাই কিনবো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুটি টিকেটের বিজয়ী হবার সম্ভাবনা সমান। ড্র অনুষ্ঠানের সময় একটা গোলোকের মধ্যে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত ১০ টা গুটি রাখা হয়। প্রথম ডিজিট পাওয়ার জন্য গুটিগুলোকে সজোরে বাতাস চালিয়ে ঘুরানো হয়। এরপর নিচের ফুটা দিয়ে একটা গুটি পড়ে গেলে ফুটাটা নিজের থেকে বন্ধ হয়ে যায়। যে গুটিটি প্রথম পড়বে সেটা ৭ হবার সম্ভাবনা ১০ ভাগের এক ভাগ। আবার ৯ হবার সম্ভাবনাও ১০ ভাগের এক ভাগ। দ্বিতীয় গুটিটিরও ৪ হবার সম্ভাবনা ১০ ভাগের এক ভাগ। আবার ৯ হবার সম্ভাবনাও ১০ ভাগের এক ভাগ। এভাবে ৭৪৩৮৬৬৫ সংখ্যাটি আসার সম্ভাবনা ০.০০০০০০১%। একইভাবে ৯৯৯৯৯৯৯ সংখ্যাটি আসার সম্ভাবনাও ০.০০০০০০১%।
হিসাবটা আমিই দিলাম। কিন্তু টিকেট কেনার সময় আমি ৭৪৩৮৬৬৫ নাম্বারের টিকেটটিই কিনবো। কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার বিশ্বাস হবে পর পর ৭ বার ৯ আসার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ অংকের হিসাবের চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে আসা আমার বিশ্বাস আমার কাছে বড়। যেমন একটা প্রচলিত ধাঁধাঁর উত্তর আমাদের বুদ্ধিকে বিহ্বল করে দেয়। দাবার বোর্ডের প্রথম ঘরে একটা গমের দানা রেখে পরবর্তী সব ঘরে পূর্ববর্তী ঘরের দ্বিগুণ দানা রাখতে হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় ঘরে দুটি, তৃতীয় ঘরে চারটি, চতুর্থ ঘরে আটটিৃ এভাবে ৬৪ তম ঘর পর্যন্ত গমের দানা রাখলে সব মিলিয়ে কী পরিমাণ গম পাওয়া যাবে? উত্তরটা এতই বিস্ময়কর যে সেটা মাথায় নেওয়া যায় না। গমের দানার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩, ৭০৯,৫৫১,৬১৫ টি, পরিমাণে ১.৪ ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন — যা বর্তমানে পৃথিবীর বাৎসরিক গম উৎপাদনের ২০০০ গুন বেশি।

আমাদের মস্তিষ্কে যে তথ্য সংরক্ষিত থাকে তার সাথে মিল না থাকলে সেটা গ্রহণ করা কঠিন। যেমন উপরের ছবিটা দেখুন। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না; কারণ আমাদের মস্তিষ্ক মানুষের মুখায়ববের যে চিত্র ধরে রেখেছে তার সাথে এই ছবিকে মেলাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ ও অবসন্ন হয়। আমরা যদি আগে কখনও মানুষ না দেখে থাকতাম তাহলে এই ছবিটা আমরা কোন অসুবিধা ছাড়াই স্পষ্ট দেখতাম। আবার আমরা যে আমাদের মস্তিষ্কে রাখা তথ্যগুলোর সাথে অল্প কিছু মিল দেখেই নতুন তথ্যকে বিশ্বাস করে ফেলি তার সহজ একটা উদাহরণ দেখুন। এটা একটা অণুগল্প।

“খুব সংক্ষেপে বললে কাহিনীটা এরকমঃ ছোট বেলায় এক পীপিলিকাভূক বন্ধুর সাথে আমার সখ্যতা ছিল যার নামের আদ্যক্ষর ‘ব’ এবং ও শেষের অক্ষর ‘ল’, সাতার শিখতে দেরী হচ্ছে বলে তার দুঃখের সীমা ছিলনা। বাড়ীর পাশে দিঘীর কিণারায় বসে সে এক দিন উচ্চস্বরে চীৎকার করে কাঁদতে লাগল। আমার আশংকাই সত্যি হলো। দাদী এসে তাকে সজোড়ে চড় বসিয়ে দিলেন। ভাবলাম ন্যুন্যতম দয়া মায়া নাই অশিতীপর বৃদ্ধার মনে? মুহুর্তের মধ্যে বন্ধুটি গ্রীস্মের অপরাহ্নের নৈঃশব্দ ভেঙে চতুস্কোন দীঘিটার কাল জলে ঝাপিয়ে পড়ে প্রান দিল। এযাবতকাল খুদপিপাসায় কাতর, দারিদ্রক্লিষ্ট সন্তানহীণ, শ্রমজীবি পরিরাবের একমাত্র শান্তনা দশ বছরের ছেলেটির মৃত্যুর সাথে পরিবারটি অমাবশ্যার অন্ধকারে ঢেকে গেল”।
এই গল্পটা আমাকে পড়তে দিয়েছিল আমার গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী এক অকৃতদার যুবক। সে একটা কম্পিউটারের দোকান চালায় আর কবিতা লেখে। গল্প পড়া হয়ে গেলে সে জিজ্ঞেস করলো গল্পে কোন সমস্যা আছে কিনা। আমি বললাম, আশি বছর বয়সের বৃদ্ধা তার নাতিকে চড় দেওয়ার কথা নয়। সে বলল, “আর কিছু?” আমি বললাম, “না, আর সব ঠিক আছে।” সে বলল ৮৫ শব্দের এই গল্পে ৩৪ টি বানান ও ৩ টি শব্দ-সংগঠন ভুল আছে।

ভুলগুলো এরকম: কাহিনীটা (কাহিনিটা), ছোট বেলায় (ছোটবেলায়), পীপিলিকাভূক (পিপীলিকাভুক), সখ্যতা (সখ্য), আদ্যক্ষর (আদ্যাক্ষর), সাতার (সাঁতার), বাড়ীর (বাড়ির), দেরী (দেরি) পরীসিমা (পরিসীমা)। দিঘীর (দিঘির), কিণারায় (কিনারায়), এক দিন (একদিন্) উচ্চস্বরে (উচ্চৈঃস্বরে), চীৎকার (চিৎকার), আশংকাই (আশঙ্কাই), দাদী (দাদ্)ি, সজোড়ে (সজোরে), নুন্যতম (ন্যূনতম ), দয়া মায়া (দয়ামায়া), অশিতীপর (অশীতিপর), মুহুর্তের (মুহূর্তের), গ্রীস্মের (গ্রীষ্মের), অপরাহ্নের (অপরাহ্ণের) নৈঃশব্দ (নৈঃশব্দ্য), চতুস্কোন (চতুষ্কোণ) দীঘিটার (দিঘিটার), কাল (কালো), ঝাপিয়ে (ঝাঁপিয়ে), প্রান (প্রাণ), এযাবতকাল (এতাবৎকাল), খুদপিপাসায় (ক্ষুৎপিপাসায়), দারিদ্রক্লিষ্ট (দারিদ্র্যক্লিষ্ট), সন্তানহীণ (সন্তানহীন), শ্রমজীবি (শ্রমজীবী), পরিরাবের (পরিবারের), শান্তনা (সান্ত¡না), অমাবশ্যার (অমাবস্যার)।

যতিচিহ্নের ভুল আছে তিনটি: প্রথম বাক্যের শুরুতে ‘এরকম’ এর পর বিসর্গ (ঃ) এর পরিবর্তে কোলন (:) এবং শেষে ‘ল’ এর পর দাঁড়ি বা সেমিকোলন দিতে হবে। “ভাবলাম ন্যূনতম দয়ামায়া নাই অশীতিপর বৃদ্ধার মনে?” এই বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্নের পরিবর্তে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন (!) দিতে হবে এবং শেষ বাক্যের শেষে “ৃৃৃৃৃৃৃৃ” পরিবর্তে এলিপসিস (ৃ) দিতে হবে। এ বানানগুলোর অর্ধেক আমার জানা ছিল; সেগুলোও চোখে পড়েনি। কারণ, আমার মনোযোগ ছিল গল্পের কাহিনির দিকে। ভুল ও শুদ্ধ শব্দগুলোর ছবি কাছাকাছি হওয়ায় এই বিভ্রান্তি ঘটেছে। এরপর বুঝেছি, ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি কমানোর জন্য “উড়াইয়া দেখো ছাই” নীতি-ই সর্বোত্তম। তাই কোন লেখা পত্রিকায় পাঠানোর আগে আমি আমার এক বানান পরীক্ষক বন্ধুর কাছে পাঠাই।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, আগস্ট ১৩, ২০২১।