হাসান গোর্কি : ইসলামী বিপ্লবের পর প্যারিসের নির্বাসিত জীবন থেকে ইরানে ফিরে আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি তেহরান থেকে ১৪০ কিমি দক্ষিণে কোম নগরীতে বাস করতে শুরু করেন। তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেন না। বহু কষ্টে গার্ডিয়ানের এক সাংবাদিক তাঁর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি পেলেন এবং সাক্ষাৎকারের শুরুতে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইসরাইলকে অপছন্দ করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ কে?” খোমেনি বললেন, “সবচেয়ে খারাপ যুক্তরাষ্ট্র। তার চেয়ে খারাপ যুক্তরাজ্য। এদের দুই জনের চেয়ে খারাপ ইসরাইল। এই তিন জনের চেয়ে খারাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর এরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের চেয়ে খারাপ।” এই প্যারাডক্স থেকে অর্থ বের করা কঠিন। সবচেয়ে খারাপ যদি যুক্তরাষ্ট্র হয়ে থাকে তাহলে অন্য কেউ আবার তার চেয়ে খারাপ হয় কীভাবে!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে ১৯৪৫-র মে মাসের ৭ তারিখে। এরপর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের নৌ-আধিপত্য ভেঙে পড়ে এবং তাদের প্রতিরোধ সীমিত হয়ে পড়ে। মিত্র শক্তির পক্ষে যুদ্ধ জয় তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আগস্টের ৬ ও ৯ তারিখে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বর্ষণ করে। প্রায় তিন লাখ মানুষের দগ্ধ হয়ে করুণ মৃত্যুর এই ঘটনাকে খারাপ মনে না করার কারণ নেই। মিত্র শক্তির ব্যাখ্যা ভিন্ন। তারা মনে করে মূল ভূখণ্ডে জাপান যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা রেখে দিয়েছিল সেটা ভাঙতে গেলে জাপানের মূল ভূখণ্ডে সর্বাত্মক আক্রমণ করতে হতো। এতে জাপানের কয়েক লাখ নিরীহ মানুষের মৃত্যু হতো। পাশাপাশি জাপানের ওপর এই হামলার মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে কোন দেশ আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করলে তার পরিনতিও এরকম হবে। এখনও আমরা যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হইনি সেটা সম্ভব হয়েছে মূলত হিরোশিমা-নাগাসাকি থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার কারণে। ঐ সময় বোমা ফেলা না হলে পরের কোন বড় যুদ্ধে হয়তো কয়েক কোটি মানুষ মারা যেতো। এই বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা দুটির কোনটা সত্য বা দুটিই আংশিক সত্য কিনা সেটা আমরা জানি না। এখানে যে প্যারাডক্সটি আছে সেটা হলো মিত্র শক্তি তিন লাখ নিরীহ জাপানির জীবন বাঁচাতে অন্য তিন লাখ নিরীহ জাপানিকেই মেরে ফেলেছে।

এক সময় তুর্কি, আরব ও মধ্য এশিয়ার যোদ্ধারা ভারত দখল করেছে, এশিয়া, আফ্রিকা সহ উভয় আমেরিকায় সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে ব্রিটিশরা। ফ্রেঞ্চ এবং ডাচরাও খুব পিছিয়ে ছিলনা। এই কলোনিয়ালিজমকে আমরা সভ্যতার ইতিহাসে অনাচার হিসেবেই মানি। তবে তাদের ক্ষুদ্র একটা অংশের ব্যাখ্যা অন্যরকম, যারা এসবকে হিউম্যান মাইগ্রেশনের একটা স্তর বা ধরণ হিসেবে দেখতে চায়। প্রাক সভ্যতার যুগে মানুষ আহার্যের খোঁজে নতুন ভূখণ্ডে গেছে। তখন তারা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা বয়ে নিয়ে গিয়ে ঐ নতুন ভূখণ্ডকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু ইতিহাস জুড়েই শুরুতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলো বহিরাগতদের বাধা দিয়েছে এবং কখনও কখনও দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলেছে। যেমন রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইটস, মেটিসরা ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীদের (বা কলোনিস্টদের) বাধা দিয়েছে। সে বাধা অতিক্রম করে উত্তর আমেরিকায় সভ্যতা এসেছে ইউরোপ থেকে। সারা পৃথিবী এর সুফল ভোগ করছে।
এই মতকে কি আমরা সরাসরি মেনে নেবো বা অবজ্ঞা করব? হয়তো বিষয়টা মাঝামাঝি একটা কিছু। এখন ভাবা হয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে টিকে থাকার অধিকার সব জনগোষ্ঠীর থাকা উচিত। এই স্বাতন্ত্র্য সহজাতভাবে মুল্যবান। তাহলে কি দারিদ্র্য, অনাহার, মড়ক, অপুষ্টি, অশিক্ষাসহ স্বতন্ত্র্যভাবে কোন জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার অধিকারকেও সম্মান করা উচিত? বঙ্গোপসাগরে আন্দামান সংলগ্ন নর্থ সেন্টিনাল আইল্যান্ডে কিছু সংখ্যক আদিবাসী বাস করে। সেখানে বাইরের কেউ গেলে তারা মেরে ফেলে। দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে অনুমান করা গেছে তাদের সংখ্যা ১৫ থেকে ৫০০ জন। তবে তারা যে বিলুপ্তির পথে রয়েছে সেটা বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য যদি সেখানে ভারত অভিযান চালায় তাহলে সেটা অন্যায় হবে কিনা আমরা জানি না। আবারও সেই প্যারাডক্স- কারো ভাল করার উদ্দেশ্যে তার কিছু অনিষ্ট করা।

হুতু-তুতসিরা পরস্পরকে হত্যার যোগ্য চূড়ান্ত খারাপ মনে করে ১৯৫৯ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ৫০ লাখ মানুষ মেরে ফেলেছে। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে দুই গ্রামের মানুষ যুগের পর যুগ টেটা-বর্শা নিয়ে যুদ্ধ করছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোও এই ঘৃনার সংস্কৃতির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আছে। পক্ষগুলোর মধ্যে কিছু অংশ কি নিরঙ্কুশ ভাল, আর বাকিরা নিরঙ্কুশ খারাপ? ব্যাপারটা সেরকম হলে তারা বুঝতে পারছে না কেন?
বেঁচে থাকার সংগ্রামে অনেকের সাথে আমরা বৈরিতার সম্পর্কে আবদ্ধ। প্রকৃতির সূত্র থেকে বিষয়গুলো এভাবে উদ্ভূত হয়েছে। প্রকৃতি আমাদের জন্য এমন অনেক কিছুই অনিবার্য করে রেখেছে যা ন্যায়ানুগ না হলেও আমরা মানতে বাধ্য। ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতে মানুষ মারা গেলে কাউকে দায়ী করার থাকে না যদিও ঘটনার শিকার কেউ-ই এসবের জন্য দায়ী নয়। এরকম এক পাক্ষিক বৈরিতা প্রকৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। একটা বাঘিনী যখন একটা মা হরিণ শিকার করে তখন হরিণ শাবকরা অনাহারে কষ্ট পায়। কোন অপরাধ না করেই হরিণীটি প্রাণ দিচ্ছে। আর বাঘিনী যখন ঐ মৃত হরিণ নিয়ে গিয়ে তার সন্তানদের খেতে দেয় তখন ব্যাঘ্র শাবকদের প্রাণ বাঁচে।

ঘটনাটা হরিণী ও তার সন্তানদের জন্য কষ্টের, বাঘিনী ও তার সন্তানদের জন্য সুখের। হরিণী এবং বাঘিনী উভয়ই তাদের সন্তানদের কাছে সমান স্নেহময়ী। হরিণদের কাছে বাঘেরা চূড়ান্ত খারাপ ধরণের একটা কিছু। কিন্তু বাঘেরা তো তাদের জন্মের জন্য বা মাংসাশী হবার জন্য দায়ী নয়। বাঘের হিংস্রতা হরিণ ও আমাদের কাছে চূড়ান্ত খারাপের উদাহরণ। এটাকে আমরা পশুত্ব বলে গালিও দেই। মনুষত্ব যদি ভাল গুণ হয়ে থাকে পশুত্ব তাহলে খারাপ গুণ কেন! সেটা তো প্রকৃতি থেকে পাওয়া তার বৈশিষ্ট্য। এমন হতে পারে যে বিষয়টা ভাল-খারাপের নয়- ভিন্নতার। পাঁচটা সিংহ দল বেঁধে একটা মহিষ মেরে মাংস খায়। এ কাজটি তো আমরাও করি। শুধু কৌশলে অল্প পার্থক্য থাকে। সিংহরা মহিষ পালন করা এবং ছুরি-চাকু-রশির ব্যবহার করা জানলে তারাও আমাদের পদ্ধতিতে মহিষের মাংস খেতো।
আমরা রান্না করা মাংস খাই। মাংসাশী সব প্রাণী অন্য জীবন্ত প্রাণী ধরে খায়।
চিড়িয়াখানাগুলোতে অজগরের খাঁচায় খাদ্য হিসেবে জীবন্ত খরগোশ এবং মুরগি ছেড়ে দেওয়া হয়। ঢাকা চিড়িয়াখানায় কয়েকদিন আগে খাঁচার মধ্যে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সন্ত্রস্ত এক খরগোশের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সমালোচনা হয়। এরপর খরগোশটাকে বের করে আনা হয়েছে।
(এই লিংকে ভয় পাওয়া বাবুদের মত খরগোশের ছবিটা দেখুন https://www.prothomalo.com/bangladesh/অজগরের-খাবার-জীবন্ত-খরগোশটির-জন্য-ভালোবাসা

এই বের করে নিয়ে আসায় কি মুক্তি মিলবে? অজগরটাকে তো কৃত্রিম মাংস খেতে দেওয়া যাবে না। এই খরগোশটাকেই হয়তো হত্যা করে খাঁচায় ফেলা হবে। প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে আসা, বন্দী, ক্ষুধার্ত অজগর মৃত খরগোশটাকে খাবে। এর অর্থ কোন পক্ষের স্বার্থই ভালভাবে রক্ষা করা গেল না। প্রাণীদের প্রতি আমাদের যে দ্বৈততাপূর্ণ সহানুভূতি আছে সেটাও একটা প্যারাডক্স।

প্রচলিত একটা গল্প শোনা যাক- এক দেশে ছিল এক নিষিদ্ধ নগরী। কেউ বাইরে থেকে সেখানে গেলে উপযুক্ত কারণ দেখাতে হতো। কারণটা মিথ্যা প্রমানিত হলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হতো। যেমন কেউ যদি বলে “আমি নগরীর সৌন্দর্য দেখতে এসেছি” এবং নগর ভ্রমনের সময় সে যদি কিছু কেনাকাটা করে তাহলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। একদিন এক ব্যক্তি ঐ নগরীতে প্রবেশ করতে গেলে দ্বার রক্ষী প্রবেশের কারণ জিজ্ঞেস করল। সে বলল “আমি ফাঁসিতে ঝুলতে এসেছি।” দৌবারিক বুঝতে পারল এটা মিথ্যা কথা। কেউ স্বেচ্ছায় মরতে চায় না। তাকে নগরাধিপতির কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। মিথ্যা বলার অপরাধে তার ফাঁসির আদেশ হলো। কিন্তু সেটা কার্যকর করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। কারণ ফাঁসি কার্যকর করা হলে এটা প্রমানিত হয় যে লোকটা সত্য বলেছিল। ঐ লোকটা সত্য না মিথ্যা বলেছিল সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কেউ যদি বলে, “আমি সব সময় মিথ্যা কথা বলি” তাহলে তার ভাষ্য অনুযায়ী এই কথাটাও মিথ্যা। যার অর্থ সে সবসময় মিথ্যা বলে না। ফলে তার এই কথা থেকে বোঝার উপায় নেই যে সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে। আমাদের বিবেচনা, আকাঙ্ক্ষা, পর্যবেক্ষণ গুলোও এরকম অদ্ভুত কিছু পরস্পরবিরোধী জোড়াতাড়া দিয়ে তৈরি।
আমরা নিজেদের জন্য একটা কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতে পারি আমাদের মধ্যেও কেমন করে কিছু আত্ম-দ্বৈততা কাজ করে। আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান নিজের জীবন। যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমরা জীবন রক্ষা করতে চাই। ধরা যাক একজন মানুষ খুব অসুস্থ। সংকটাপন্ন অবস্থায় সে তার প্রতিপালকের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইল। মুক্তি পেলে সে তার সকল সম্পদ উপাসনালয়ে দান করে দেবে। আকাশ থেকে একজন দেবদূত এসে লোকটাকে এই সুখবর জানিয়ে গেল যে লোকটার অমরত্ব অনুমোদন করা হয়েছে- সে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। কোন কিছুই তার মৃত্যু ঘটাবে না। লোকটা যে এই সুখবরে খুশি হবে না সেটা আমরা তার জায়গায় নিজেদের বসিয়ে চিন্তা করলেই বুঝব। তার বা আমাদের ওপর এরকম কোন প্রত্যাদেশ এলে সেটা যাতে প্রত্যাহার করা হয় তার জন্য আমরা আবার প্রার্থনায় বসে যাবো। আমরা মরতে চাই না- এই অন্তহীন আকুলতাও সত্য নয়, দ্বৈততায় পূর্ণ: সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্যারাডক্স হয়তো এটাই।

hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, জুন ২০, ২০২১।

ভুল সংশোধন: প্রান্তরে তেপান্তরে-৪ (সম্রাট ও পেয়াদার গল্প) এর দ্বিতীয় প্যারায় লেখা হয়েছে “অন্য কথায় এক ও দুই— এই দুটি সংখ্যার মধ্যে অনন্ত সংখ্যক সংখ্যা লেখা সম্ভব যাদের যোগফল এক এর চেয়ে কম হবে।“ এখানে পড়তে হবে “ আবার ০ ও ১ এর মধ্যে অনন্ত সংখ্যক সংখ্যা লেখা সম্ভব যাদের যোগফল ১ এর চেয়ে কম হবে। যেমন ০.৯+০.০৯+০.০০৯+০.০০০৯+০.০০০০৯+০.০০০০০৯… এভাবে অনন্তকাল লিখতে থাকলে ভগ্নাংশগুলোর যোগফল ১ এর সমান হবে না; ০.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯…এরকম হবে। (কৃতজ্ঞতা: জিনাত রেহানা, ফরিদপুর, বাংলাদেশ।)