হোসনে আরা মণি : হোসনে আরা মণি-র জন্ম ও বেড়ে ওঠা হিমালয় থেকে নেমে আসা উন্মুক্ত, অমলিন মধুমতি-ফটকি-গড়াই-নবগঙ্গা-চিত্রার কল্লোলিত স্রোতধারায় বাহিত পলি মাটিতে। বাবার এবং নিজের চাকরির সুবাদে বাস করেছেন রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে। তাই তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়লে আমরা দেখতে পাই স্মৃতি-বিস্মৃতির বাতায়ন ঘুরে তিনি কাহিনির পারম্পর্য তুলে এনেছেন তাঁর দেখা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনবোধ থেকে। একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে মানুষ মননশীলতা ও মানবিকতার যে খরায় পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য চাই মনোজাগতিক পরিবর্তন। হোসনে আরা মণি তাঁর উপন্যাস প্রবহমান- এ মানবমনের এই নিগুঢ় সংকট নিয়ে ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন: তুলে এনেছেন মানবিক ও মানবীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পূর্ণতা-অপূর্ণতা, আকাক্সক্ষা-দুরাকাক্সক্ষার কথা, রাজনীতি-সমাজ-সংসারের অগ্রন্থিত কাহিনিমালা। আজকের বাঙলা সাহিত্য প্রেম-পরিণয়, দারিদ্র্য-ক্ষুধা, আকাক্সক্ষা-অনাচার বা সমাজ-সভ্যতার ছকবাঁধা ও কষ্টকল্পিত কাহিনির পৌনঃপুনিকতায় কিছু মাত্রায় আক্রান্ত। জীবনের চিরচেনা নিবিড় আখ্যান বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে বিরল না হলে সংখ্যায় লক্ষণীয়ভাবে কম। বিপরীতে আঙ্গিকের ভিন্নতা, নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনা, পটভ‚মি, চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনি বিন্যাসে ভাবাবেগহীন স্বতঃস্ফূর্ততা হোসনে আরা মণি-র এই উপন্যাসটিকে স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহিত হতে দিয়েছে। তাঁর এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো ‘হাজার বছর ধরে’ নিজেদের মতো বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে হেঁটে চলে। দিন শেষে পাঠকই বিচারক। সম্পাদক হিসেবে তাঁদের কাছে ‘বাংলা কাগজ’-এর এই নতুন ধারাবাহিক উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মনিস রফিক, সম্পাদক
(১২)
রমিজ মিঞা নাতিনের বিয়ে এই মাঘেই সেরে ফেলতে চায়।
শরাফত নিমরাজী। মাইয়্যের বিয়ে যহন দিয়াই লাগবি তহন বেশি দেরি করার হেতু থাকতি নেই। তার মাঝে আলতার মা’র শরীলির ব্যাপার আছে। এহন তিন মাস চলতিছে। এই মাঘে পাঁচ মাস হবি। এট্টু ঢাহেঢুহে চললি না হয় জামোইপক্ষের চোখ ফাঁহি দেয়া যাবি, কিন্তুক মাঘ পার হলি আর সে উপায়ও থাকবিনে।
হিরণবালার শরীর-মন সব আইঢাই। কত স্বপ্ন ছিল আলতা মা ল্যাহাপড়া শিখবি। ডুরে শাড়ি পিন্দে, চুল বাইন্দে ইশকুলি যাবি। হাহ্! স্বপ্নভঙ্গের বেদনার সাথে নিজের শরীরে আরেকটা শরীর ধারণের কষ্ট তাকে ইদানীং সারাক্ষণই কেমন হতবল করে রাখে।
ভালোমন্দ কিছুই বোধ করে না রওজান বিবি আর আকিমন। মাইয়্যে ঝিপুত বিয়ে তো একদিন দিয়াই লাগে- দুই দিন আগে আর পরে। দাদার ইচ্ছে নাতিনের বিয়ে দিয়া। তা দিক না। ভালো ঘর-বর সব সময় তো মেলে না। বৌয়ের মন খারাপ। মাইয়্যেরে সে এত কম বয়সে বিয়ে না দিয়ে ইশকুল পাশ দিয়াবার কথা ভাবে। তা পুষ্যে ছাওয়াল হলে সে ভাবনা কি আর বাপ-দাদায় ভাবতো না? খালি ইশকুল ক্যান, কলেজ-মাদ্রাসা যে জাগাতেই পড়তি যাতি চাইতো নাতি, দাদা কি আর তাতে আপত্তি কইরতো?
রাতে হিরণবালা স্বামীর কাছে তার আর্জিটা জানায়। দুর্বল শরীরে হাঁফাতে হাঁপাতে বলে, আমার শইলডা বালো না। এমন সুমায় আলতা মারে আমার কাছেত্থে না সরালি হৈতো না?
আলতারে আবার কহানে সরাচ্ছি? শরাফত যেন বিস্মিত।
বিয়ে দিচ্ছেন। উরা যদি এহানে না রাহে?
রাকপি নে ক্যা? বৌ যদ্দিন বড় না অয় তদ্দিন তো বাপের বাড়ি থাহাই নিয়ম।
তেমু। আলতারে আপনি এহনই বিয়ে দেন না। আর কয়ডা বছর সবুর অরেন।
কয়ডা বছর মানে? মাইয়্যেরে কি তুই বিয়ে না দিয়ে ডোলে ভরে রাহার খোয়াব দেহিস?
কী কন না কন! ডোলে ক্যা ভরে থোবো? আমি কই ওর ডাঙ্গর হওয়া তামাইৎ সবুর অরার কতা।
মাইয়্যে মানুষ ডাঙ্গর হতি সুমায় লাগে না। তুই কয় বচ্ছরে ডাঙ্গর হইছিলি মনে আছে?
তা আর মনে নেই হিরণবালার! সেকথা কি কেউ ভোলে! বিশেষ করে যার ডাঙ্গর হওয়ার প্রত্যাশায় গোটা পরিবার দিন গোনে তার কি আর সে সময়ের হিসেবে ভুল হয়! এগারো নাকি সাড়ে এগারো বছর বয়স ছিল তখন হিরণের? অত দিন-মাস মেপে বয়সের হিসেব তো আর করা হয়নি কখনো। তবে বাড়ির সবাই বলছিল যে বারো বছর হওয়ার আগেই ফুল দেখলো বৌ। তার ফুল দেখার ঘটনায় রওজান বিবি সহ গোটা পরিবারে চাপা খুশির বান বয়েছিল। পাক গোসলের দিনে শাশুড়ি আকিমন এক হাঁড়ি ক্ষীর রেঁধে পাড়া-পড়শিরে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছিল। আর ঠিক সেই রাতেই প্রথম শরাফত পেয়েছিল বৌ নিয়ে দুয়ারে খিল আঁটার পারিবারিক অনুমোদন। ক্লিষ্ট হাসির সাথে কেমন এক লাজুক ভাবের যৌগিক ছায়ায় হিরণের মুখ এখন মাখামাখি। সেই মুখে চুমু খেতে শুরু করেছে শরাফত। সদা অরুচি আর বমিবমিভাব লেপ্টে থাকা পোয়াতি শরীরটা আগ্রাসী চুমুর তীব্র আবেদনেও কেমন গুটিয়ে থাকে। কিন্তু স্ত্রীর শরীর গুটানো কি বিছানো তার দিকে দৃকপাতের সময় তো এখন নেই স্বামীর। সে ব্যস্ত তার জমিনে যেমন খুশি চাষ দেবার কাজে।
এমন সোহাগী সময়েও আজ হিরণের মুদিত দু’চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামে।
(১৩)
ফাল্গুনের শেষাশেষি এমন আষাঢ়ে বাদল নাকি কেউ কোনদিন দেখেনি। আর সব বছর এ সময় কম-বেশি ঝড়-টড় হয়। সেটা সবাই কাল বোশেখির আগাম বার্তা বলে জানে। কিন্তু ঝড় না কিচ্ছু না, খামোখা দম মেরে থাকা আন্ধার আকাশ থেকে টিপটিপিয়ে ঝরছে তো ঝরছেই।
আজ আলতার হলদি কুটা।
‘বিয়েও লাইগলো, ডলকও আইলো, মাইয়্যেডা কি মামুবাড়ি পুড়া ভাত খাইছিল?’ আয়নালের মার সরস প্রশ্ন।
‘মামুবাড়ি কহানে যে তার পুড়া ভাত কপালে জুটবি?’ আকিমনের ঠেস জবাব।
কথাটা হিরণবালার কানে যায়। কিন্তু সে একবার চোখ তুলেও চায় না। হাতনের এক কোনায় বসে নকশাকাটা বরনকুলোর পরে মাথা ঝুঁকায়ে খুব মনোযোগ দিয়ে সে যে ধান-দুব্বো-কাঁচাহলুদ-মঙ্গলদীপ সাজাচ্ছিল, তা সে সাজায়েই চলে। কারে যেন দুধের সরবাটা তাড়াতাড়ি করে আনার জন্য কে তাগিদ করে। মেয়েরা পয়মানা দেখে। নতুন তোরঙ্গে ভরা শাড়ি-চুড়ি-আলতা-সাবান, সুগন্ধী কেশ তেল আর আয়না-চিরুনী-খোঁপার কাঁটা-রঙিন ফিতের সমাহার দেখে ঘুরায়ে-ফিরায়ে। কেউ পয়মানার প্রশংসা করে, কেউ করে বদনাম। কনের শাড়ি দেখে কপাল কুঁচকে যায় অনেকের। ‘এই শাড়িতি যে নিকারিগার মাইয়্যের বিয়ে অয় লো!’ এক খনখনে কণ্ঠে এমন মন্তব্য শুনে হিরণ চোখ তুলে একবার জটলার দিকে তাকায়। অমনি সদ্য ভাঁজভাঙা ফ্যাকাশে লাল রঙের একটা নতুন শাড়িতে তার চোখ পড়ে। এই শাড়ি পিন্দে তার মাইয়্যে যাবি শ্বশুরবাড়ি! ইরা কি মাইয়্যেডারে এহেবারে গাঙেই ভাসাইচ্ছে? ক্যান? এট্টা মোটে মাইয়্যে তার। আরেট্টু ভালো অবস্থার ঘর দেহে কি বিয়ে দিয়া যাইতো না? পাওয়া যাইতো না ভালো পড়ালেহা জানা সুন্দর দেখতি জামোই?
অভিযোগটা সে করতে পারে না কারো কাছেই। মেয়ের গায়ে হলুদ লাগার পর বাড়িভরা আত্মীয়-কুটুম্বের মাঝে এ প্রশ্ন এখন তোলাই অবান্তর, অনুচিত। কিন্তু মনের ভার তো সে নামাতে পারে না। দিনমান কাজ করে হিরণ। আর ক্ষণে ক্ষণে মোছে চোখের পানি। তা কনের মায়ের চোখের পানি এতই স্বাভাবিক ঘটনা যে ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বরং চোখ শুকনো থাকলেই মানুষ কথা কইতো তা নিয়ে।
বিয়ের আয়োজন শুরু হতেই পাড়ার মেয়েরা কেউ ডাক পেয়ে কেউ উপযাচক হয়ে এসে নানা কাজে সহযোগিতার পাশাপাশি গীত গাইছিল থেমে থেমে। গীত সবাই গাইতে পারে না। যে ভালো গীত গায় তার এ সময় বেশ কদর। বাড়ির গিন্নী তারে সমাদর করে পিঁড়েটা আগায়ে দিয়ে পানের বাটা সামনে মেলে ধরে। পানের রসে ঠোঁট রাঙায়ে জিভের তলায় আলাতামুক পুরে গীতঅলী গীত ধরে, সাথে গলা মেলায় আর সবাই। গীতের পাশাপাশি চলে রসিক দাদী-নানীর নৃত্য বা বলা ভালো নৃত্যচেষ্টা। হাত ঘুরায়ে, কোমর বাঁকায়ে তারা যেসব শারিরীক কসরত ও অভিনয় করে, তাতে করে দর্শকদের মাঝে উচ্ছ¡ল হাসির বান বয়ে যায়। হলদিকোটায়- কনেরে হলুদ মাখায়ে গোসল করাবার দিনে নাচ-গীত বেশি জমে ওঠে।
গীত-১ উঠোনের পর চান্দুয়া
তারির তলে আলেয়া
আরে তারির তলে
আলতা গোসল করে না রে।
কাঁচা হলদির যেই না রোং
আমার আলতার সেই না রোং
আরে চান্দুয়ার তলায়
আলতা গোসল করে না রে।।
গীত-২ কইলকাতার শহরে
ঐ না চম্পক নগরে
আমি দেখে আইলাম
শাড়ি বড় সস্তা না রে।।
একশ টাকা ভাঙ্গাইলাম
ঐ না শাড়ি কিনিলাম
আমি দেখে আইলাম
শাড়ি বড় সস্তা না রে।।
পড়ন্ত বিকেলে উঠোনের এক কোনায় ঢেঁকি ঘরের সামনে আলতারঙা নকশাদার পিঁড়ের পিঠে ডুরে শাড়ি পড়া নতমুখী আলতা। বিয়ের কনে কথা কইতে নেই, চোখ ড্যাবডেবিয়ে এদিক সেদিক চাইতে নেই। কনে থাকবে মাথা হেঁট করে থুতনি বুকের পরে লাগায়ে। কেউ যদি মুখ দেখতে চায় তো নিজেই মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে তবে দেখবে। এসব আদব লেহজের ছবক বেশ কিছু দিন ধরেই পাচ্ছিল আলতা। স্বভাবনম্র মেয়েটাকে যা বোঝানো হচ্ছিল তার সবতাতেই সে মাথা নাড়ছিল। মান্যতার যে দুর্বহ বোঝা তার মাথার পড়ে চিরকালের তরে সেঁটে দেয়া হচ্ছে সেই মাথার পরে একটা রঙিন শাড়ি চাঁদোয়ার মতো করে ধরে আছে পাড়ার দুই ভাবী। খোলা আসমানের নিচে বিয়ের কনের গোছল দিতে নেই কিনা, তাই। হলুদের ডালি হাতে প্রথম আকিমন। রওজান বিবি শয্যাগত। আধাঅঙ্গ লাগা শরীরে তার যেমন সাড় নেই, তেমনি নেই জ্ঞান-গম্যিও। আকিমনই তাই এখন বাড়ির মুরব্বী। আলতার দুধে-আলতা মুখটা কাঁচা দুধের সরে বাটা কাঁচা হলুদে মেখে শাড়ির আঁচল দিয়ে বড় যতেœ পোছে আকিমন। আলতাকে গোল করে ঘিরে থাকা সধবা নারী আর কলকল করতে থাকা শিশুর দলের মাঝ থেকে এক বয়স্কা প্রশ্ন করে, কী মুছাও?
সুহাগ মোছাই। আকিমনের উত্তর।
কার সুহাগ? বয়স্কার প্রশ্ন।
আমার আহ্লাদি পুতনির সুহাগ। আকিমনের জবাব।
কী মুছাও? ফের আরেকজনের প্রশ্ন।
সুহাগ মোছাই। আকিমনের একই উত্তর।
কার সুহাগ?
আমার রাজরানী আলতার সুহাগ।
এভাবে তিনবার করে সোহাগ মোছানো , দর্শকদের মাঝ থেকে তিন কিস্তি প্রশ্নমালা, আর আকিমনের সোহাগমেশানো দোয়াময় জবাব।
আকিমনের সোহাগ মোছানো শেষ হলে হিরণের ডাক পড়ে, কই লো কনের মা, কহানে গেলি? আয় তোর ঝি’র সুহাগ মুছা।
ধীর পায়ে হিরণ এসে দাঁড়ায়। পেটটা তার এরই মধ্যে বেশ উঁচিয়েছে। বিয়ের তারিখ মাসখানেক পেছানোতে এই বিড়ম্বনা। নতুন জামাইয়ের সামনে- বেচারা! পলকা মুখঅলা ফালুর দাদী হয়তো এ নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হিরণের মুখে চেয়ে মুখে তার আর রা না যোগায়। হিরণবালার মুখ তো নয়, ডলকের আসমান। কি তার চাইতেও থমথমে। আকাশের মতন তার চোখও যে ঝরেছে ক’দিন। মেয়ের বিয়েতে সব মা-ই কাঁদে। কিন্তু এ কান্না যেন কেমন! যেন সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে না, চিরতরে বনবাসে কি পরবাসে পাঠাচ্ছে। হিরণের মুখটা যারা একপলক দেখে, তারাই কেমন থতমত খায়। মুহূর্তেই বিয়ের আমেজ লাগা মুখগুলো বদলে কেমন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। যেসব রসিকার দল গীত গাইছিল তাদের গীত থেমে যায়, বাতরসভারী কোমর বাঁকায়ে নৃত্যের চেষ্টা করছিল যে রসবতী প্রবীনা, সেও থমকে গিয়ে গম্ভীর মুখে বসে পড়ে।
রাতে চেরাগ উঁচায়ে ধরে শরাফত স্ত্রীর মুখ দেখে। ফোলা ফোলা লাল চোখে হিরণ স্বামীর চোখের দিকে সোজা তাকায়। শরাফতের শ্যামলা মুখ চাপা ক্রোধে কালো হয়ে যায়। চেরাগটা নামিয়ে রেখে সে বলে, তুই কি তালি মাইয়্যের বিয়ে দিবি না ঠিক করছিস?
আমি ঠিক করার কিডা?
তালি এমন ওরছিস ক্যা?
কোন জবাব না দিয়ে হিরণবালা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে দেখে শরাফত আপন মনে বলে, তোর মাথায় কবে এই পোকা ঢুকছিল তা আমি জানি। সেই যে কোন ফিরিঙ্গি ইশকুলি পড়া কোইলকেতে বিটি আইছিল মিদ্দা বাড়ির ফয়জুর বিয়েতে, তারে তোর এমন ভালো লাগছিল যে আলতারে তুই তার মতো বানানোর খোয়াব দেহিস। কিন্তু ইডা তো আর কোইলকাতা শহর না, ভাতুরে। এহানে তুই মাইয়্যেরে পড়ানোর নাম করে ধুমসি বানালি পরে মানষি যে মন্দ কবি।
আমি তা জানি। সব বুঝি আমি।
তালি অবুঝের নাহাল করিস ক্যা?
পাশ ফিরে স্বামীর মুখোমুখি হয় হিরণ। কী ভেবে উঠে বসে তক্তার বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে আধশোয়া হয়। তারপর বলে, আলতার বিয়ের সম্বন্ধ করার খবর শুনে সেদিন সলিম চাচা আইছিল, জানেন?
কবে?
ঐ যেদিন আপনি লালী গাইডারে পাল দিতি বুনোপাড়ায় নিয়ে গেলেন।
ভরদুফোরে বুড়ো এ্যাদ্দুর আইছিল? তা কী কৈলো? দাওয়াত দিতি পারিনি বুলে মন খারাপ?
মন খারাপ, তয় সেজন্যি না।
তালি?
এমনি ইডা সিডা ম্যালা গল্প ওইরলো। জানেন তো, দ্যাশ-দুনিয়ার তামান খবর তার জানা। দ্যাশের নানান জাগায় নাহি এহন মোছলমান মাইয়্যেগের আলাদা ইশকুল অইছে। মোছলমান জমিদার-নবাবেরা সেসব ইশকুল পরতিষ্ঠা করিছে। বগুড়া, মোমেনসিংয়ে চাচা নিজির চোহি সেসব ইশকুল দেহিছে। আবার ভাগলপুর না কহানে, একজন মাইয়্যেমানুষ অনেক চেষ্টায় এট্টা ইশকুল দেছে। চাচা আমারে কয়, মাগো, দইনে এহন পাল্টে যাইচ্ছে। মাইয়্যেরা এহন ভোট দিবার চায়। বিলাত-আমরিকায় নাহি এ জন্যি মাইয়্যেমানুষ রাস্তায় নাইমে আন্দুলোন না কী করতিছিল। এহন তাগের সরকার তাগেরে ভোট দিয়ার অনুমতি দেছে। চাচা কয়, নিজির কতা নিজি না কলি, নিজির অধিকার নিজি আদায় না করলি কেউ আগ বাড়ায়ে কিছু করে দেয় না। আর শুনছেন, এই দ্যাশে এক কবি নাহি পইদ্য লেহিছে ‘নারী’ নাম দিয়ে। চাচা সে পইদ্যর খানিক মুহস্থ শুনোলো। কী যে সুন্দর সব কতা……
আরে কবিরা তো চিরকাল ফুল-পাহি-নারী এসব নিয়েই পইদ্য ল্যাহে। এ আর নতুন কী খবর?
এই পইদ্য তেমন পইদ্য না। দাঁড়ান, দুই-এক লাইন আমার মনে আছে, শুনোই……
রাইতদুফোরে কী তামশা জুড়ছিস? বাড়িভরা মানুষ। এহন তুই পইদ্য কবি? ঘুমা। কাইল আমাগের মাইয়্যের বিয়ে। ভোরে উঠা লাগবি।
সলিম চাচার মন খারাপ ক্যান, তা শোনবেন না?
সংক্ষেপে ক। ব্যাখ্যান করা লাগবিনে।
দিন-দইনে বদলে যাচ্ছে। কিন্তুক আমরা, গাঁও-গিরামের মুখ্যুসুখ্যু মুসলমানেরা বদলাচ্ছি নে।
তা উনি নিজি তো সহাল-সন্ধ্যে বদলান। আর সব মানুষ কি উনার মতন অত বদলের খ্যামতা রাহে?
রাগ করেন ক্যা? উনি ম্যালা ল্যাহাপড়া না জানলিউ চোখ-কান খুলা মানুষ। মাইয়্যেলোকের পড়াশুনো করা যে কত দরকারি তা নিয়ে উনি কত কতা কলেন। গেল মহাযুদ্ধে কোন দ্যাশে মাইয়্যেরা যুদ্ধখেত্তরে কত সেবা-যতেœর কাম করিছে সেসব গল্প করলেন। যুদ্ধের পর দুনিয়ার বহু কিছু এহন বদলে যাইচ্ছে, অথচ আমরা আলতারে এই সাত বচ্ছর বয়সে বিয়ে দিচ্ছি বুলে খুব মন খারাপ করলেন।
তা উনি উনার মাইয়্যেগারে বিয়ে না দিয়ে গোলায় ভরে রাখতি পারতেন কি লেহাপড়া করায়ে জজ-ব্যারেষ্টার বানাতি কোইলকাতায় পাঠাতি পারতেন। সেসব কিচ্ছু না করে উনি ক্যান তাগেরে চাষা-ভ‚ষোর সাথে বিয়ে দিছিলেন?
সে কতদিন আগের কতা। এহন জমানা বদলে যাইচ্ছে।
বদলালি অন্য দ্যাশে বদলাইচ্ছে কি বড় শহরে বদলাইচ্ছে। আমাগার এহানে কিছু বদলাইচ্ছে না। তোর যেমন বিয়ে হইছে, তোর মাইয়্যের যেমন বিয়ে হইচ্ছে, তোর মাইয়্যের মাইয়্যেরও তেমন হবি। বাঁইচে থাকলি দেহিস।
হিরণবালা আর কথা বলে না। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কখন জানি আলগোছে গড়ায়ে শুয়ে পড়ে। তারপর হয়তো একসময় ঘুমায়েও পড়ে।
ঘুমিয়ে হিরণ কী স্বপ্ন দেখে? আমরা তা জানি না। তবে তার অনুক্ষণ দেখা দিবাস্বপ্ন যে একদিন বাস্তব রূপ পায় তা আমরা দেখতে পাই হিরণের তৃতীয় প্রজন্মে। ১৯৯৩ এর এক ঘনবর্ষার দিনে ছাতা মাথায় পা টিপে টিপে হিরণের স্বামীর রক্তের উত্তরসূরী তরুণীটি যেদিন বাবার পিছু পিছু গ্রাম ছেড়ে যায় উচ্চশিক্ষা ও শহরবাসের স্বপ্ন নিয়ে, সেদিন হয়তো সাত দশক আগে দেখা হিরণের স্বপ্নের জয়যাত্রার পথ তৈয়ার হয়। ওদিকে ততদিনে হিরণের রক্তধারা বহু গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। হিরণের অধস্তন তৃতীয় প্রজন্মের নারীদের অনেকে স্কুলে গোল্লাছুট খেলার দিন সাঙ্গ না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও কোন কোন ভাগ্যবতী স্কুলজীবন শেষ করে পা রাখে কলেজে। এদের কেউ কলেজ থেকে ঝরে যায়, কেউবা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় উচ্চশিক্ষার পথে। সময়টা নব্বইয়ের দশক। কিন্তু ১৯২৫ সালে এক হতভাগী কন্যা সন্তানের জননীর পক্ষে ১৯৯৩ এর লড়াকু আত্মপ্রত্যয়ী তরুণীর স্বপ্নসার্থক চোখের ঝিকিমিকি কল্পনা করে শান্তি খুঁজে পাওয়া নিতান্তই অসম্ভব। তাই আজ হিরণের কন্যার বিবাহের দিনে হিরণকে দেখায় এক সদ্য ঘটা মহাপ্রলয়ে সব হারানো মানুষের মতো- রিক্ত, নিঃস্ব, নিরাশ, হতোদ্যম।