হোসনে আরা মণি : হোসনে আরা মণি-র জন্ম ও বেড়ে ওঠা হিমালয় থেকে নেমে আসা উন্মুক্ত, অমলিন মধুমতি-ফটকি-গড়াই-নবগঙ্গা-চিত্রার কল্লোলিত স্রোতধারায় বাহিত পলি মাটিতে। বাবার এবং নিজের চাকরির সুবাদে বাস করেছেন রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে। তাই তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়লে আমরা দেখতে পাই স্মৃতি-বিস্মৃতির বাতায়ন ঘুরে তিনি কাহিনির পারম্পর্য তুলে এনেছেন তাঁর দেখা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনবোধ থেকে। একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে মানুষ মননশীলতা ও মানবিকতার যে খরায় পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য চাই মনোজাগতিক পরিবর্তন। হোসনে আরা মণি তাঁর উপন্যাস প্রবহমান- এ মানবমনের এই নিগুঢ় সংকট নিয়ে ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন: তুলে এনেছেন মানবিক ও মানবীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পূর্ণতা-অপূর্ণতা, আকাঙ্ক্ষা-দুরাকাঙ্ক্ষার কথা, রাজনীতি-সমাজ-সংসারের অগ্রন্থিত কাহিনিমালা। আজকের বাঙলা সাহিত্য প্রেম-পরিণয়, দারিদ্র্য-ক্ষুধা, আকাঙ্ক্ষা-অনাচার বা সমাজ-সভ্যতার ছকবাঁধা ও কষ্টকল্পিত কাহিনির পৌনঃপুনিকতায় কিছু মাত্রায় আক্রান্ত। জীবনের চিরচেনা নিবিড় আখ্যান বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে বিরল না হলে সংখ্যায় লক্ষণীয়ভাবে কম। বিপরীতে আঙ্গিকের ভিন্নতা, নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনা, পটভ‚মি, চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনি বিন্যাসে ভাবাবেগহীন স্বতঃস্ফূর্ততা হোসনে আরা মণি-র এই উপন্যাসটিকে স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহিত হতে দিয়েছে। তাঁর এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো ‘হাজার বছর ধরে’ নিজেদের মতো বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে হেঁটে চলে। দিন শেষে পাঠকই বিচারক। সম্পাদক হিসেবে তাঁদের কাছে ‘বাংলা কাগজ’-এর এই নতুন ধারাবাহিক উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মনিস রফিক, সম্পাদক

(৩০)

সকালে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা কবির অভ্যেস নয়। ফজরের নামাজ মোটামুটি নিয়মিতই তার পড়া হয়। তার বাপ ফরজ আলী মোল্লা ফরজ পালনের ব্যাপারে বড়ই কড়াক্কর। পাঁচ ওক্ত নামাজ, রমজানের ত্রিশ রোজা- এসবের সবক সে পেয়েছে পাঁচ বছর বয়স থে’ই। সাত বছর বয়সে সে নামাজ পড়া পুরোপুরি শেখে, আর দশ বছরের পর থে’ নামাজ ক্বাযা করার কথা ভাবতেও পারে না। যত না আল্লার ভয়, তারচে ঢের বেশি সে ভয় করে তার বাপের রক্তলাল চোখকে। ফরজ আলী মানুষটা দেখতে ছোটখাটো, কিন্তু তার মেজাজ ছোটখাটো না। কোন হল্লাচিল্লা নয়, মাইরধোর নয়, কেবল চোখের দৃষ্টি দিয়েই সে তার চেয়ে এক হাত লম্বা বৌয়ের দিলদরিয়া কইলজার সব পানি শুকোয়ে দিতে পারে পলকে। বড় ছেলে মোহাম্মদ রাফিকে কঠিন শাসনে মানুষ করা গেছে, সে এখন লজিং থেকে জেলা সদরের কলেজে বিএ পড়ছে। মেজ ছেলেটার অবশ্য মানুষ হওয়ার লক্ষণ তেমন নেই, অথচ এই ছেলেই ছিল সবচে মেধাবী। ছোটগুলোর ভবিষ্যত ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তো বাপের শাসন সব ছেলের ব্যাপারে সমান কার্যকর না হতে পারে, কিন্তু ‘মায়্যে ঝিপুত’রে ঠিকই মেনে চলতে হয় বাপসহ আর সবার শাসন। পাড়া-পরতিবেশিরাও কঠিন চোখে ‘মায়্যে ঝিপুত’ এর হাঁটা-চলা দেখে, হাসি-কথার খেয়াল রাখে। কাজেই ফজরের ওক্তে ঘুম ভেঙ্গে তড়িঘড়ি ওজু করে নামাজ পড়া আরামের কাজ না হলেও বাপের ডাকের ভয়ে সময় মতোই ঘুম ভাঙ্গত কবির। বাপজান যখন ডাক দেন তখন প্রথম ডাকটা নরম সুরেই দেন। কিন্তু সেই এক ডাকে বিছানা না ছাড়লে এরপর যে ডাকটা বের হয়, সে ডাক শোনার ইচ্ছে জাগে না কোন প্রাণেই। আর মা? সে তো ফজরের ওক্তেরও আগে কোন সময় উঠে হয় ধান সিদ্ধ করছে, নয় ধান ভানছে। মস্ত বড় গিরস্থ না হলেও ফরজ আলীর জমি-জিরাত যা আছে তাতে চাষ আর বতরের মওসুমে আট-দশ জন জন-মুনিশ খাটে। তাদের দুই বেলা আহারের বন্দোবস্ত করতে হয় মায়ের, এক হাতে। এছাড়া সংসারের নানা কাজ, ফসল গোলাজাত করা কিংবা গোলাজাত ফসলের তদারকি, সব তো মায়েরেই করতে হয়। কাজেই মা যে কখন ঘুমাতে যায় আর কখন ঘুম থেকে জাগে, তা টের পাওয়া বড়ই কঠিন। তো এমন বাপ-মায়ের মেয়ে হয়ে কবি কি পারে সূর্য ওঠারও পরে পড়ে পড়ে ঘুমোতে! কিন্তু আজ সকালে তাই-ই ঘটেছে। কেমন করে যে এত বেলা হলো! মা গো! না জানি এ বাড়ির মানুষেরা কে কী ভাবতেছে! তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়তে যেতেই- এ কী! আঁচল ধরে কে টানে পিছু!

নাজাত মিঞা মিটিমিটি হাসে। এত বেলা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথাই নেই। এই মানুষ কাল কত রাত যে জাগায়ে রাখছে, কবি তা সঠিক বলতে পারবে না। ঘড়ির পাঠ কি এ বাড়িতে আছে? মনে হয় না। কবির বাপের বাড়িতেও খুব যে ঘড়ি আছে, তা না। তার মিঞা ভাই মোহাম্মদ রাফির এট্টা ঘড়ি আছে যা সে বিএ ক্লাসে ওঠার পর কোন এক বন্ধুর থেকে বাকিতে কিনে ছয়মাস ধরে দেনা শোধ করেছে। বন্ধুরও নাকি ছিল ধার শোধের দায়। তাইতো সে সিকিভাগ দামে তার প্রায় নতুন দামী সুইস ঘড়িটা মিঞা ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে। তা সে ঘড়ি দেখে বাপজান মুখ এমন ভয়ঙ্কর করে ছিল যে আশঙ্কায় বাড়ির সবাই চুপসে ছিল কদিন। শেষে অবশ্য কী বিবেচনা করে বাপজান মিঞাভাইরে কিছুই বলেনি। তারপর সেই ঘড়ি দেখে দেখে কবি ঘড়ি দেখা শিখেছে। মিঞাভাই ঘড়িটা হাত থেকে খোলার পর কত যে যতেœ তুলে রাখতেন! কাউরে ছুঁতে দেতেন না। কিন্তু কবির ক্ষেত্রে আর সব ব্যাপারের মতন ঘড়ির ব্যাপারেও মিঞাভাই উদার। তবু বলতেন, ‘দেখিস, ভাইঙ্গে ফেলিসনে যেনু।’ সেই ঘড়ির মতন একটা ঘড়ি এ বাড়িতে আছে কী?

নাজাত মিঞা ঘর থেকে বের হতেই মাইজে ভাবী ফুলটুসির মুখোমুখি। ভাবী কি দরজায় কান পাইতে ছিল?
কি গো রাঙা মিঞা? ঘোম কি ভাঙ্গে না?
ঘরে যাও ভাবী। নতুন বৌরে টাট্টি চিনায় দেও।
তা তো দেব বুলেই এই কপাটের গুড়ায় খাড়ায় আছি সেই ফজরেত্তে।
তা ডাক দিলিই পাইত্তে।
ও মা! ডাক দেব ক্যান? তুমরা কি আর ঘুমায় ছিলে নাহি? কী সুন্দর পুটুর-পাটুর……

কথা না বাড়ায়ে নাজাত মিঞা বদনা হাতে বাগানের দিকে রওনা হয়। ফুলটুসি ঘরে ঢুকে নতুন বৌয়েরে নিয়ে পড়ে। কিন্তু বৌয়েরে সে রসের কথা তত কয় না, যত কয় দরকারি কথা। নতুন বৌয়ের দেরিতে ঘুম ভাঙ্গা যে লজ্জার ব্যাপার এবং শাউড়ি যে ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন এ বিষয়ে সংক্ষেপে কয়ে ঝটপট তোরঙ্গ থেকে হলদি কোটার সুতি শাড়িটা বের করে দিয়ে বলে, যাও, পুষ্কন্নিতি যায়ে নায়ে-ধুয়ে নিয়ে চুলোর পিঠি আসো। তুমার সুংসার তুমার বুঝে নিয়া লাগবি নে?

সংসার বুঝে নেয়া! বেশ অবাক হয় কবি। কথাটার মানে বুঝতে পারে না। তবে নতুন বৌয়ের রীতিমাফিক আচরণ হিসেবে সে চুপ থাকে।
এই টুকুন এক ডোবার নাম পুষ্কন্নি। পানির কী রং! চারপাশে বাঁশঝাড় ঘেরা ডোবার পানি বাঁশপাতা পচেই কিনা এত কালো যে দেখলেই গা কেমন শিরশির করে। যে ঘন বাঁশঝাড়! দিনের বেলাতেও শেয়াল লুকায়ে থাকতে পারবে অনায়াসে। এই পানিতেই কিনা করতে হবে গোসল! তাও এই সকালে!
কোনমতে এক ডুব দিয়ে পারে উঠে আসতেই যেন সারা গায়ে কাঁপুনি। আশ্বিনেই পানি এত ঠাণ্ডা! পোষ-মাঘে না জানি কী হয়!

নতুন বৌয়ের গোছল করা দেখতে পুষ্কন্নির পাড়ে এসে ভীড় জমায়েছে কয়েকজন শিশু ও কিশোরী। তাদের চোখে দারুণ কৌতুক। ঢেঁকিঘরের পিছনে পাটখড়িতে বোনা দুইখান কওড় খাড়া করে আবডাল বানানো জায়গাটাতে ফুলটুসির সাহায্যে কোনমতে ভিজে কাপড় পাল্টে শুকনো কাপড়ের ভেতরে ঢুকে স্বস্তি বোধ করার চেষ্টা করে নতুন বৌ। মাথার ভিজে চুলের বোঝা গামছায় মুড়ে হাতখোঁপা বেঁধে দেয় জা ফুলটুসি। এর উপর টেনে দেয় ঘোমটা। মাত্র মাস তিনেক হয় ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরা শুরু করেছে কবি। এখনো সে কায়দা করে শাড়ি গুছায়ে চলতে শেখেনি। আটপৌরে করে কোন মতে প্যাঁচ দিয়ে চলতে সে পারে, কিন্তু একা একা কুঁচি করে শাড়ি পরা…নাহ্, এই শাড়ি জিনিসটা বড়ই ফ্যাসাদের। এর চেয়ে ফ্রক-পায়জামা কত্ত ভালো! আর এই হাঁটু ছুঁই ছুঁই লম্বা চুল! গোছল করার পর এই যে ভেজা চুলের খোঁপার উপর ঘোমটা টেনে দিল, এখন এ চুল শুকোবে কখন?

কথাটা মুখ ফুটে বলতেই ভীড় জমানো কিশোরীরা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তারপর এ ওর গায়ে প্রায় গড়িয়ে পড়ে রঙ্গ করতে থাকে। ‘ওলো শোন, নতুন বো’র কতা শোন। ক্যাম্মায় কতা কয়! এ যে ইংরেজি কয় লো!’ এর পর ভাতুরিয়া গ্রামে কম-বেশি প্রায় ত্রিশ বছর বাস করেছে কবি এই অপবাদ মাথায় নিয়ে, নাজাত মিঞার বৌ ইংরেজি কয়।

কেবল ‘ইংরেজি’ কওয়া নয়, কবির পায়ে নিয়মিত পরা স্যান্ডেল বা চপ্পলও ছিল তাদের চোখে তামাশার বস্তু: নাজাত মিঞার বৌ হাগতিও যায় জুতো পায়!