হোসনে আরা মণি : হোসনে আরা মণি-র জন্ম ও বেড়ে ওঠা হিমালয় থেকে নেমে আসা উন্মুক্ত, অমলিন মধুমতি-ফটকি-গড়াই-নবগঙ্গা-চিত্রার কল্লোলিত স্রোতধারায় বাহিত পলি মাটিতে। বাবার এবং নিজের চাকরির সুবাদে বাস করেছেন রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে। তাই তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়লে আমরা দেখতে পাই স্মৃতি-বিস্মৃতির বাতায়ন ঘুরে তিনি কাহিনির পারম্পর্য তুলে এনেছেন তাঁর দেখা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনবোধ থেকে। একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে মানুষ মননশীলতা ও মানবিকতার যে খরায় পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য চাই মনোজাগতিক পরিবর্তন। হোসনে আরা মণি তাঁর উপন্যাস প্রবহমান- এ মানবমনের এই নিগুঢ় সংকট নিয়ে ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন: তুলে এনেছেন মানবিক ও মানবীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পূর্ণতা-অপূর্ণতা, আকাঙ্ক্ষা-দুরাকাঙ্ক্ষার কথা, রাজনীতি-সমাজ-সংসারের অগ্রন্থিত কাহিনিমালা। আজকের বাঙলা সাহিত্য প্রেম-পরিণয়, দারিদ্র্য-ক্ষুধা, আকাক্সক্ষা-অনাচার বা সমাজ-সভ্যতার ছকবাঁধা ও কষ্টকল্পিত কাহিনির পৌনঃপুনিকতায় কিছু মাত্রায় আক্রান্ত। জীবনের চিরচেনা নিবিড় আখ্যান বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে বিরল না হলে সংখ্যায় লক্ষণীয়ভাবে কম। বিপরীতে আঙ্গিকের ভিন্নতা, নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনা, পটভ‚মি, চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনি বিন্যাসে ভাবাবেগহীন স্বতঃস্ফূর্ততা হোসনে আরা মণি-র এই উপন্যাসটিকে স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহিত হতে দিয়েছে। তাঁর এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো ‘হাজার বছর ধরে’ নিজেদের মতো বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে হেঁটে চলে। দিন শেষে পাঠকই বিচারক। সম্পাদক হিসেবে তাঁদের কাছে ‘বাংলা কাগজ’-এর এই নতুন ধারাবাহিক উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মনিস রফিক, সম্পাদক

(২৪)

সেই কোন ধলপহর থেকে ভাতুরিয়া বিলে মাছ ধরছিল গোলাম রসুল। কাল সন্ধ্যায় মামাত ভাই আরজ আলী এসে ভাতুরিয়ায় সাত হাত বোয়াল ধরা পড়ার গল্প ঝাড়তেই গোলাম রসুলের মেছো মন ভাতুরিয়ার কালা পানি, ত্যাড়া ঘাড়ের উপর ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে অশিষ্ট ভঙ্গিতে যুগ যুগ ধরে দাঁড়ায়ে থাকা নির্ভীক হিজল গাছ আর পানির তলায় শিষ্টভাবে শুয়ে থাকা বুক সমান পাঁকে এমনই বিচরণ শুরু করে যে বাধ্য হয়ে লালফুল তারে খ্যাপলা জাল আর কোচ বের করার অনুমতি দেয়। তবু হাজার হলেও বিল। রাতের বেলা বিল-জলায় বিশ্বাস কী! যতই হাত-গলা-মাজায় কবচ বাঁধা থাক, যতই ছালেক ওঝার ধন্বন্তরী বিষহরি শিকড় সাথে থাক, মায়ের মন কী করে পারে ছাওয়ালেরে মাছের লোভে আন্ধার বিলের অনিশ্চয়তায় পাঠাতে? কিন্তু আঠারো বছরী পুরুষ রক্ত তো আর শুধু মায়ের বাধ্য সন্তান হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, তার চাই কিছু আ্যাডভেঞ্চার। তা গাঁও-গেরামে গভীর রাতে গহীন জলে মাছ ধরা, পথ চলতে আচমকা সামনে পড়া পাঁচ হাত ফনা তুলে দুলতে থাকা দশ হাত লম্বা গোখরাকে পালাবার অবসর না দিয়ে মুহূর্তে পিটিয়ে লম্বা করা কিংবা ঝোপের আবডালে হঠাৎ কোন খাড়া কান নড়তে দেখে রে রে শব্দে সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে শিকারীর আদিম উল্লাসে মেতে বেচারা খরগোশের লম্ফলীলা সাঙ্গ করার চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর কিইবা আছে? কাজেই ধলপহরে বের হওয়ার কথা মায়েরে না জানায়ে আরজ আলীর সাথে পরামর্শ করে জাল পলো আর কোচ নিয়ে প্রায় খরগোশের মতই নিঃশব্দে একটা শুকনো লিকলিকে ও আরেকটা মজবুত শক্তিশালী পা নিয়ে লাফায়ে লাফায়ে বিলের পথ ধরেছিল গোলাম রসুল।

আরজ আলীর বয়স কুড়ি। বসন্ত রোগে ভুগে তার একটা চোখ গেছে সেই কোন গ্যাদাকালে। মাছধরার উৎসাহ তারও বড় কম না। তবু গোলাম রসুলের পিছনে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তার কেমন ভয় হচ্ছিল। ভাতুরিয়া গ্রামে বাড়ি হলেও এই বিলে রাতের বেলায় কখনো মাছ ধরেনি সে। দরকারও পড়েনি। তাদের বাড়ির পাশেই আছে দোআ। বছরভর তাতে কম-বেশি পানি থাকে। টুকটাক মাছের যোগান ঐ খাস দোআ থেকেই মেলে। ভাতুরিয়া বিল সরকারের খাস জলমহাল নয়। এখানে নামতে হলে এর ভ‚মি মালিকদের কেউ হওয়া চাই। লালফুল ফুফুর অনেকখানি জমি এই বিলের গভীর আর কিনারা মিলে আছে। কাজেই তার কিছু হক আছে এর পানিতে আর পানির জীবে। তবু এই রহস্যময় ভাতুরিয়ায় কী এক অসোয়াস্তিবোধে সে আগে কখনো নামেনি। ভয়ে কিংবা মাঘ শেষের জাড়ে প্রথম দিকে সে বেশ একটু কাঁপতে থাকে। কিন্তু লন্ঠন হাতে গোলাম রসুলের পিছনে থেকে তার মাছ ধরার চেষ্টা আর কৌশল দেখতে দেখতে সব ভয় কখন যে দূর হয়ে যায়। নাহ্, গোলাম রসুলের সাথে থেকে জ্বিন-ভ‚তের ভয়ও তত নেই। আলিয়া মাদ্রাসায় আট বছর পড়া, নিজের চেষ্টায় পনেরো পারা হাফেজ গোলাম রসুল ভ‚ত-পেতœীতে বিশ্বাস করে না। বলতে গেলে কোরানের বাইরে কোন কথাতেই সে বিশ্বাস করে না। তবে কোরানে যেহেতু ‘জ্বেন’ জাতির কথা আছে, সেহেতু গোলাম রসুলেরও ‘জ্বেন’-এ বিশ্বাস আছে। কিন্তু জ্বেন যে মাছ খেতে ভালোবাসে বা মানুষেরে ভয় দেখাতে পছন্দ করে, এমন কোন কথা যেহেতু কোরান শরীফে নেই, সেহেতু অমন বিশ্বাসও গোলাম রসুলের নেই। সে বরং জ্বেনরে মনে করে ঈমানি তাগদের বশ। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান গোলাম রসুলের এতই জোরালো, কোরানের প্রতি আস্থা তার এতই দৃঢ় যে জ্বেনভয়ে পিছু হটার কথা সে ভাবেই না।

কিন্তু কোথায় সাত হাত বোয়াল? বোয়াল-চিতল দূরে থাক, একটা বড়সড় শোল-গজারই কি উঠলো তার জালে? কিছু কই-মাগুর-রয়না আর অনেকগুলো টাকি মাছে খলুই ভরে এলেও গোলাম রসুল খুশি হয় না। এসব মাছের মধ্যে কেবল কই ছাড়া আর কিছুই তার মা খায় না। টাকি মাছ তো বলতে গেলে তারা কেউই খায় না। আরজ আলী অবশ্য এতেই বেশ খুশি। ভাতুরিয়ায় মাঝ রাতে বোয়াল ধরার যে গল্প সে গোলাম রসুলরে কাল শুনায়েছে তা নিতান্তই গুপ্ত গল্প। তাদের পাড়ার কাদের মাঝি আর কালু সর্দার মিলে বিল-খালে পাতা জালের মাছ যেমন চুরি করে, তেমনি মানুষের পুকুরেও জাল ফেলে। ভাতুরিয়ায় মাঝ রাতে মাছ ধরা তাদের পক্ষে অসম্ভব ঘটনা নয়। তবে সাত হাত বোয়াল তারা সত্যি ধরছিল, নাকি কারো পুকুর থেকে রুই-কাতলা তুলে রাজাপুরের সাঁওবাড়ি বেচে বদলে ঘরের মেয়েছেলেদের ডুরে শাড়ি এনে সাত হাত বোয়ালের গল্প ফান্দিছে, তাই বা কিডা জানে! ডুরে শাড়ির ব্যবসা এ এলাকায় একমাত্র সাঁওরাই করে। খালি তো ডুরে শাড়ি নয়, বিয়ের চেলি, ঢাকাই শাড়ি, মিলের কাপড়, হোসিয়ারিসহ যাবতীয় মনোহারী ও মুদিখানার ব্যবসা তাগের একচেটিয়া। বছর পাঁচেক আগেও সাঁওরা কাপড় বেচতো না। ও কাজ তখন ছিল তাঁতীর। কিন্তু সাতচল্লিশের পর থেকে যেভাবে বামুন-কায়েতের সাথে কামার-কুমোর-ধোপা-নাপিত-তাঁতীর দলও ওপারে ছুটেছে, তাতে আরো বহু জিনিসের মতন তাঁতের শাড়িও যে এলাকায় অমিল হবে এতে আর আশ্চয্যি কী! সাঁওরা ভিন এলাকার জোলাদের কাছ থেকে ডুরে শাড়ি না আনলে এ এলাকার মেয়েলোকগের দশা এখনো সেই অসহযোগ আন্দোলনে বিলেতি দ্রব্য বর্জন কালের মতোই থাকতো। শাড়ি দূরে থাক, একখান ডুমো কিংবা তবন দিয়ে লজ্জা ঢাকার ব্যবস্থাও এগের থাকতো না।

বেলা নয়টা নাগাদ খলুই ভরা মাছ, বিমর্ষ মুখ ও লাল চোখ নিয়ে দুই ভাই বাড়ি ফিরলে লালফুল তাদেরকে গোসল সেরে এসে ভাত খেতে বসার তাগিদ দেয়। গোসলটা কোনমতে সারে গোলাম রসুল। কিন্তু ভাত খেতে সে আর বসতে পারে না। তার সারা গা কাঁপায়ে আসে জ্বর।

(২৫)

ক্ষিতিশ ডাক্তারের বয়স কত তা নিয়ে জল্পনা আছে ম্যালা। কেউ বলে শ’য়ের উপর, কেউ বলে শ’ ছুঁই ছুঁই। ডাক্তারের নাতির পুত বলে যে সাত পুরুষের লোহার সিন্দুকে রক্ষিত তুলট কাগজের কোষ্ঠীতে ঠাকুর্দাবাপের যা জন্ম বিত্তান্ত পাওয়া যায় তাতে দিনক্ষণ পড়া গেলেও জন্মসনটা আর পড়া যায় না। তবে তার ঠাকুর্দা বেঁচে থাকলে যে বয়স হতো তার সাথে আঠারো/কুড়ি যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাতে ঠাকুর্দাবাপের বয়স নিশ্চয় একশ কুড়ি বছর। খোদ ডাক্তারকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার উপায় নেই কারণ তিনি এখন চোখেও না দেখেন, কানেও না শোনেন।

ডাক্তারের প্রপৌত্র হরিদাস এখন নাম-যশে ঠাকুর্দাবাপের কাছাকাছি পৌঁছাতে চেষ্টা করছে সাধ্যমত। কিন্তু নানা করণে তার মগজ ডাক্তারি বিদ্যার চেয়ে অডাক্তারি তথ্য আর তত্তে¡ ভরতি থাকে অধিকাংশ সময়। যেমন এই কদিন ধরে তার মাথায় এক চিন্তা জেঁকে বসেছে- কিছুতেই ছাড়তে চাইছে নাঃ পাকিস্তানের ভবিষ্যত আসলে কেমন?

ভাবনাটা মাথায় এসেছিল খবরটা শোনামাত্রই। কী আজব ব্যাপার! স্বাধীনতার পাঁচটা বছরও পূর্ণ হৈলো না, এর মধ্যি এমন কাণ্ড! না হয় দেশের রাষ্ট্রভাষা দুডেই হৈলো- তুরা এট্টু কষ্ট কৈরে বাংলা শেখ, যেমন আমরা শিখতি শুরু করছি উর্দু। তা না, দাবী মাইনে নিবি না বলে তোরা গুলি করবি? তাও ছাত্রগের মিছিলি? তাহলি ভিনদেশি শাসক ইংরেজগের সাথে তোগের পাত্থক্য কী? আর ধম্মের দোহাই দিয়ে সেই যে ভারতবর্ষরে টুকরো করলি; মোছলমান-মোছলমান ভাই-ভাই হয়ে থাকপি বলেই তো, নাকি? তা যাগের খুনে আজ তোগের দেশভাগের কুদরতি হাত, পাকরাজদণ্ড, চাঁদ-তারা আঁকা ‘পবিত্র’ পতাকা কলঙ্কিত করলি, তারা কি মোছলমান না? গোমুর্খের দল! শুরুতেই তোরা ‘ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই’ করছিস এমনভাবে, যেনু এরা তোগের সৎ ভাই! আরে, আমরা তো এহন নিজ দ্যাশের মাটি কামড়ে পড়ে থাইকেও উদ্বাস্তু প্রায়- ওপারেই যাই আর এপারেই থাহি, আমাগের দশা প্রায় এক। মন যার উন্মূল হয়, সে যেহানেই থাউক- বাস্তুহারা ছাড়া আর কী?

সামনে টুলে বসা রোগীটা মুসলমান। পাশের বেঞ্চিতে অপেক্ষমান জনা চারেক রোগীও মুসলমান। এদের দু’জন ডাক্তারের চোখে অচেনা মুখ। ইদানীং অচেনা মুখের মুসলমানের সংখ্যা এলাকায় বেশ বেড়েছে। এমন না যে হরিদাস ডাক্তার দশ গ্রামের সব মুসলমানের মুখ আগে থেকেই চিনতো। তবু কী যেন একটা ব্যাপার আছে, যার দরুণ এ এলাকার মুসলমান মাত্রকেই এক নজরে চেনা যায়। যেমন হিন্দুদের কে কোন জাত, তা এক নজরে অনেকটা ধরা যায়।

ডাক্তার একে একে রোগী দেখতে থাকে। অবশ্য সবাই রোগী না। কেউ কেউ লক্ষণ বলে ওষুধ নিতেও আসে। বাড়ির মেয়েছেলের অসুখ হলে এভাবে ওষুধ নেয়া ছাড়া উপায় কী? যদিও ডাক্তার এতে একটু বিরক্ত হয়, মুখ গম্ভীর করে বলে, ঠিকঠাক উত্তর দিবা- পায়খানা মোট কয়বার হইছে? রোং কেমন? গোন্ধ?

রোগী তো তো করতে শুরু করলে তাকে টুল ছাড়ার ইঙ্গিত করার পরও যদি বেকুব লোকটা উঠে না দাঁড়ায় তো অপেক্ষমান পরবর্তী রোগী ডাক্তারের সহকারীর ভ‚মিকা পালন করেঃ ওঠো তো ম্যাভাই, যাও, ঐ বেঞ্চিতি বসো। আর বসেই বা কী হবি, তার চে দপাদফ হাঁইটে বাড়ি যাইয়ে শুনে আসো পরিবারের হাগার বিত্তান্ত। সব শুনে-মেলে না আসলি কি ডাক্তারেরে ঠিকঠাক কওয়া যায়?।
‘ঝাড়া ফিরার কতা কি মায়্যেলোকে অত খুলে-মেলে কয়?’ লোকটা অসন্তুষ্ট স্বরে বলে।

তা না বললি তো চিকিৎসে দিয়া যাবি নে ময়জদ্দি। হয় রুগী আনবা, নয় নিজি সব শুইনে আইসে সব সওয়ালের ঠিকঠাক জবাব দিবা। হোম কলের ভিজিট তো আর দিতি পারবা না যে…
আজ্ঞে, আমরা গরীব-গুর্বো মানুষ, ওষুদির পয়সাই নেই তো…
তা তো জানিই। সে জন্যিই তুমার পরিবারের লজ্জা ইট্টু কুমাতি কবা। স্বামী তো আর ভাসুর না যে…
লোকটা এবার এমন একটা হাসি দেয় যাতে করে মনে হয় যেন তার বৌ আসলে তার ভাদ্রবঁধূ।

এবার ডাক্তারের চোখ যায় বেঞ্চের এক কোনায় পা তুলে গুটিসুটি বসে থাকা এক চোখ কানা গুটিবসন্তের চিরস্থায়ী দাগভর্তি কালো-গোলগাল মুখটার দিকে। ডাক্তার কিছু বলার আগেই ছেলেটা বেঞ্চ থেকে ঝপ করে খসে পড়ে সোজা ডাক্তারের পায়েঃ ডাক্তার বাবু, আমার ভাইডারে বাঁচান। যত্ত টাহা ভিজিট চান, আমার ফুফু দিবি। আপনি খালি ভাইডারে বাঁচান…
আহা! আহা! কী যে করিসনে তুরা! সর, সর, পাও ছাড়…
আপনি এহনই আমার সাতে চলেন। আমার বাড়ি ভাতুরে। আপনি সাইকেলে গেলি আমি পিছন পিছন দোইড় দে আপনার সাতে সাতে…
এ্যা! সাইকেলের সাথে দোড়ঐ পাল্লা? আমি প্যাডেলে দুই চাপ দিলিই তো তুই কুড়ি হাত পিছনে পড়বি।
পড়বো না। আমি আপনার সাতেই থাকপানি। দেহেন…
দেখতি হবিনে। তোর বাড়ি ভাতুরে কোন পাড়ায়? ঠাঁয়-ঠিকানা কয়ে যা, দেহি, ও বেলায়…

ও বেলা হলি হবিনে ডাক্তার বাবু। ভাই আমার মরো মরো। ফুফু খালি কাইনতেছে আর আমারে ঘাপা-শাপা কইত্তেছে। আমি কেন তার পরানের পরানরে নাত্তিরকালে মাছ ধরতি…
আচ্ছা খাড়া, আমি এই রুগী কয়জনরে দেহে নেই।
উনাগারে দেখতি গেলি দেরী হবি ডাক্তারবাবু। ভাই আমার যায় যায়।
আচ্ছা ওর সাথেই আগে যাও হরি। আমরা নাহয় ওবেলা আসি। কী কও যোগেন? কাল রাত্তিরেরতে গাও এট্টু জ্বর জ্বর কত্তিছে। তা থাক, দেহি বাড়ি যায়ে ইট্টু বার্লি খায়ে শুয়ে থাহি। ও বেলায় না হয় নাতিডারে পাঠায় দিবানি, ইট্টু মিক্সার বানায় দিও।

কিন্তুক আমারে দেহে তয় উঠতি হবি ডাক্তার বাবু। তিন দিন তিন নাইত ধরে এই চোখ নিয়ে এক দণ্ডও ঘুমাতি পাত্তিছিনে। দরদে মর মর। দ্যাহেন কেমন ফুলিছে।
আহারে! তুমরা সব আসো বিপদ বাড়ায় নিয়ে। চোখির কী দশা করে আইছো কও। এখন যদি শ্যাষকালে চোখ অন্ধই হয়ে যায় তো সব দায় ডাক্তারের, নাকি?

ডাক্তার চোখ দেখতে শুরু করে। আরজ আলীর আর্জি যেন সে ভুলেই গেছে এমনই মনোযোগে যন্তর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চোখ পরীক্ষা করতে থাকে। আরজ আলীর অস্থিরতা বেড়ে ওঠে। তবে আর মিনিট পনেরোর মাঝে সে ডাক্তারকে নিয়ে রওনা হতে সক্ষম হয়। ডাক্তার তারে বলে সাইকেলের পিছনে বসতে। আরজ আলী বিস্ময় বিনয় ও আর কী কী বোধে তাড়িত হয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলে। সাইকেল তেমন গতিতে ছুটতে পারে না। হরিদাসের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। আহারে নিরামিষাশী। আর পিছনে বসা এই গোখাদকের ওজন কমচে কম দেড়মন। তো মেঠোপথ, বাঁশবন, কাঁচা রাজপথ এসবের ভিতর দিয়ে মোটামুটি দ্রুতগতিতে যাওয়ার চেষ্টায় অবিরত প্যাডেল করতে করতে হাঁফায়ে গেলেও এরই মধ্যে ডাক্তার জেনে নেয় রোগীর বৃত্তান্ত। রোগীবাড়ি পৌঁছে ডাক্তারের মনের অনুভ‚তি হয় বরাবরের মতোই, মানে মুসলমান বাড়িতে কলে এলে তার যেমন হয় আরকি। এই গোখাদকেরা ভালো-মন্দ খাওয়ার ব্যাপারে যেমন উৎসাহী, বাড়ি-ঘরের যত্নে তেমনই উদাসীন। বাড়ির চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সম্পন্ন গিরস্থ। বেশ বড় বড় চারচালা টিনের ঘর উত্তর-দক্ষিণ দুই পোতা জুড়ে আছে। আছে আলাদা ঢেঁকিঘর, পাকশালা ও গোয়ালঘর। কিন্তু ছিরি দেখ না! উত্তর ঘরের টিনের চালে বাঁশপাতার স্তুপ। ঘরের পিছনের বাঁশঝাড়ের বেশ ক’টি বাঁশ হেলে পড়েছে চালের পিঠে। দক্ষিণের চালে চালকুমড়ো, পুঁইলতা আর কী কী সব ফলে-ফুলে ভরে থেকে চাল নষ্ট করে চলছে। ঘরগুলোর বেড়া কোথাও টিন, কোথাও কাঠ, এমনকি বাঁশের চাটাইয়ের। ঢেঁকিঘর, পাকশালা ও গোয়ালে চেলার জোতে বোনা পাটকাঠির বেড়া। এই বেড়াগুলো মুসলমানেরা বেশ ভালো বানায়। এদের মেয়েরা ঘরে ঘরে বানায় খেজুরপাতার মাদুর, আর সেলাই করে নকশি কাঁথা। কিন্তু ঘরবাড়ি নিয়মিত লেপেপুছে চকচকে রাখায় তাদের আলস্য। এরা যে মাদুরে বসে খায়, সেই মাদুরেই ঘুমাতে পারে অনায়াসে। এঁটোকাটার বোধ এদের নেই। বতরের সময় ছাড়া উঠোনে গোবর দূরে থাক, প্রতিদিন ঝাঁটও পড়ে কিনা ঠিক নেই। এদের তুলনায় হিন্দুদের গরীব গিরস্থবাড়িগুলোও অনেক পরিষ্কার চেহারা এবং তাতে সুরুচির ছাপ থাকে। প্রতি হিন্দুবাড়িতেই আবশ্যকভাবে আছে নানা ফুলের গাছ। মাটির বাড়ি ও উঠোন নিয়মিত নিকানো হিন্দুদের নিত্যপূজারই একটা অংশ। হিন্দুরা যেখানে খায়, সেখানটা সাথে সাথে লেপে-পুছে ফেলে। ফলে হিন্দু বাড়িতে মাছির উৎপাতও কম। কিন্তু এসব বাড়িতে খাবার বাড়ার আগেই হাজার খানেক মাছি হাজির। ডাক্তার হরিদাস নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মন পরিবারের সন্তান। রোগী দেখা শেষে বাড়ি ফিরে আগে ইন্দারাপাড়ে স্নান সেরে গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে তবে ঘরে ঢুকতে হয়। তাই এসব বাড়িতে তাকে কোন খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করার চেষ্টা হবে না জেনেও সে অস্বস্তিতে থাকে, এই বুঝি কেউ হাতে করে পানের খিলি এনে হাজির হয়!