অনলাইন ডেস্ক : মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্যসহ মোট ১০ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব। তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন পুলিশের মামলার সাক্ষী। তারা তিনজনই অনেক দিন ধরে টেকনাফে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে আসছেন।
ওই সোর্সদের ভুল তথ্যের ফাঁদে পা দিয়ে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের প্রধান পরিদর্শক লিয়াকত আলী এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, নাকি পরিকল্পিত অথবা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে সিনহাকে গুলি করা হয়েছে তা তদন্ত করছে র্যাব। তিন সোর্স নুরুল আমিন, আয়াছ উদ্দিন ও নিজাম উদ্দিন কেন, কী কারণে সিনহা ও তার সহযোগীকে ডাকাত বলে বিশ্বাস করেই লিয়াকতকে ফোন করেছিলেন তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের দিন ভিডিও ধারণের জন্য মারিশবুনিয়ার একটি পাহাড়ে উঠেছিলেন সিনহা। একজন ইমামসহ দুই প্রত্যক্ষদর্শী তিন সোর্সকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, পাহাড়ে যারা উঠেছিলেন তারা ডাকাত নন, তারা প্রশাসনের লোক। ঘটনার দিন বিকেলে পাহাড়ে ওঠার সময় তাদের দেখেছেন তারা। এর পরও পুলিশের তিন সোর্স তাদের ডাকাত বলেই দাবি করতে থাকেন।
এদিকে সিনহা হত্যা মামলার প্রধান তিন আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব। প্রথম দফায় পুলিশের চার সদস্যসহ যে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে; তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য প্রদীপ-লিয়াকতসহ প্রধান তিন আসামির বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। তারা মনে করছেন, প্রদীপ-লিয়াকতের বক্তব্যেই খুলবে এ হত্যারহস্যের জট। তবে প্রধান তিন আসামি মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। এ ঘটনা এত দূর যাবে- এটা তারা বুঝতে পারেননি।
সূত্র জানায়, সাবেক সেনা কর্মকর্তা পরিচয় পাওয়ার পরও কেন সিনহাকে গুলি করা হলো- এটা লিয়াকতের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, হাত উঁচু করার পরও কেন গুলি করার দরকার হলো? কেন একাধিক গুলি করা হলো?
সাধারণত ডাকাতদের প্রাইভেটকারে চড়তে দেখা যায় না। মাদক কারবারিরা প্রাইভেটকার ব্যবহার করে। অনেক সময় খালি প্রাইভেটকারে মাদক কারবারিরা রেকি করে। যেসব গাড়িতে মাদক বহন করা হয় তার আগেপরে প্রাইভেটকার চালিয়ে মাদক পাচার নির্বিঘ্ন করা হয়।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, সিনহার ঘটনায় জব্দ আলামতের অনেক কিছু তারা হাতে পেয়েছেন। কিছু কিছু আলামত এখনও তারা পাননি। যেসব আলামত পেয়েছেন তা বিশ্নেষণ করে দেখা হচ্ছে। আসামিদের বক্তব্যের বাইরে অন্য সাক্ষীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হবে। এছাড়া মেরিন ড্রাইভ ও আরও কিছু এলাকা থেকে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, রিমান্ডে আসামিরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন। প্রথম দফায় সাতজনের রিমান্ড শেষে আজ বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে তোলা হবে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করতে প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুলালকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, সিনহা হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পাওয়া গেছে। তদন্তের পর যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তারাই আসামি হবেন। আবার তথ্য-উপাত্ত পেলে অন্য কেউও আসামি হতে পারেন।
শিপ্রার কম্পিউটার, ডিভাইসসহ ২৯ সামগ্রী হস্তান্তরের নির্দেশ :সিনহার সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথের কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, ল্যাপটপসহ ২৯টি সামগ্রী মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ। এসব সামগ্রী পুলিশের কাছে আছে। গতকাল র্যাবের আবেদনের শুনানি শেষে আদালত এ নির্দেশ দেন।
শিপ্রার আইনজীবী মাহবুবুল আলম টিপু জানান, শিপ্রার ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিওসহ নানা কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১৬ আগস্ট আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক হাইকোর্টে একটি আবেদন করেন। গতকাল বুধবার ওই আবেদনের প্রথম দফা শুনানি হয়। আজ হাইকোর্ট আদেশ দেবেন। এ কারণে কক্সবাজারের রামু থানায় মামলা করা থেকে তারা বিরত আছেন। মামলা করতে গিয়েও তারা ফিরে এসেছেন।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহা হত্যা মামলার মূল সাক্ষী শিপ্রা ও সিফাতের কম্পিউটার ডিভাইসসহ ২৯টি সামগ্রী কক্সবাজারের রামু থানায় পুলিশের হেফাজতে জিডি মূলে রক্ষিত আছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের মাধ্যম ওই সরঞ্জামাদি র্যাব হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করেছেন। আদালতের আদেশের পর এসব সামগ্রী তদন্ত কর্মকর্তা বুঝে নেবেন।
প্রদীপকে জিজ্ঞাসাবাদে জটিলতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটি :স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, কমিটির সদস্যরা গত সোমবার জেলা কারাগারে মামলার প্রধান তিন আসামি লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ এবং নন্দ দুলাল রক্ষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিলেন। কমিটি সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে লিয়াকত আলী ও নন্দ দুলালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওইদিন সময়ের অভাবে প্রদীপ কুমারকে জিজ্ঞাবাদ শেষ করতে পারেনি। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকালে প্রদীপ কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল কমিটি। কিন্তু এদিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের সিনিয়র এএসপি খায়রুল ইসলাম প্রদীপ কুমারসহ তিন আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে গেছেন। ফলে এদিন আর প্রদীপ কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি।
তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, র্যাবের রিমান্ডে থাকা প্রদীপ কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তারা আদালতের অনুমতি চেয়ে পত্র দিয়েছেন। কিন্তু আদালত এ বিষয়ে কোনো সম্মতি দেননি। ফলে প্রদীপকে জিজ্ঞাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তদন্ত কাজে কিছুটা বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, প্রদীপ ছাড়া বাকি সব আসামি এবং সংশ্নিষ্ট সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পন্ন করেছে কমিটি। অন্যান্য কার্যক্রমও গুছিয়ে এনেছে। এখন প্রদীপকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে প্রতিবেদন তৈরির কাজে হাত দেওয়া হবে। তবে সার্বিক অবস্থার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।
হত্যাকারীরা ছিলেন সিভিল পোশাকে :৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফিরছিলেন মেজর সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাত। শামলাপুর এলাকায় এপিবিএনের তল্লাশি চৌকিতে গুলিতে নিহত হন সিনহা। মামলার তদন্ত সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে কীভাবে সিনহাকে গুলি করা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে তা এখন স্পষ্ট হয়েছে। পুলিশের যেসব ব্যক্তি ওই রাতে এপিবিএনের চেকপোস্টে গিয়েছিলেন তারা সবাই সিভিল ড্রেসে ছিলেন। সিভিল পোশাকে কেন তারা সেখানে গিয়েছিলেন, তার সঠিক জবাব দিতে পারছেন না।
গত ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন বাদী হয়ে একই আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, থানার এসআই নন্দ দুলালসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। বাদীপক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে সবগুলো মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে র্যাবকে। এ মামলায় সন্দেহভাজনসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।