‘ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ উপলক্ষে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন স্ক্যারবরো সাউথ ওয়েস্ট এর এমপিপি ডলি বেগম

অনলাইন ডেস্ক : গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার কানাডায় প্রথমবারের মত ‘ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ পালিত হয়েছে। কানাডার রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের হতভাগ্য মৃত শিক্ষার্থী, বেঁচে যাওয়া ছাত্রছাত্রী এবং তাদের পরিবার ও জাতির প্রতি সম্মান জানাতে সরকারিভাবে এই দিনটি পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কাম্পলুপ্সের পরিত্যক্ত ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে শিক্ষার্থীদের গণকবর আবিষ্কারের ঘটনার পর আরও কয়েকটি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে গণকবর আবিষ্কারের ঘটনা দেশব্যাপী তুমুল প্রতিবাদ এবং দোষীদের বিচারের দাবি উঠে। দাবিটি গণমানুষের অনুভূতিতে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, এবারের ১লা জুলাই এ সরকারিভাবে ‘কানাডা ডে’ পালন করা হয়নি। এই দিনটিতে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের হতভাগ্য শিক্ষার্থী, তাদের পরিবার এবং সমাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত কমলা রঙয়ে আলোকিত করা হয়।

উল্লেখ্য, গত ২৭ মে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পরিত্যক্ত ‘কামলুপ্স ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল’ এ ২১৫ শিশুর গণকবর খুঁজে পাওয়ার পর সারা দেশব্যাপী অবলুপ্ত কানাডিয়ান ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। সেই সাথে কানাডার বিভিন্ন প্রদেশ ও টেরিটোরীর আদিবাসী সদস্য ও সুধীসমাজ আবাসিক স্কুলের মৃত শিক্ষার্থীদের প্রতি নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শোক জানায়।
উল্লেখ্য, গত আঠার ও উনিশ শতকে কানাডা সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডিয়ান এফেয়ার্স’ আদিবাদী শিশুদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে সরিয়ে কানাডার মূলধারার ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মেশানোর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বোর্ডিং স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করে। এই ব্যবস্থা অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী মেনে না নিলেও সরকার তার তোয়াক্কা করেনি। সরকারের জোরপূর্বক এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য মূলত ক্যাথলিক চার্চকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৮৬৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবার থেকে নিয়ে এসে এসব বোর্ডিং স্কুলে রাখা হয়েছিল। এই শিশুদের প্রায়ই তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে ও তাদের সংস্কৃতি চর্চা করতে দেওয়া হতো না, তাদের অনেকের সঙ্গেই মানসিক, দৈহিক ও যৌন নিপীড়ন চালানো হতো। এই পদ্ধতির প্রভাবগুলি নথিবদ্ধ করতে ২০০৮ সালে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশন দেখতে পায়, বিরাট সংখ্যক আদিবাসী শিশু আর কখনোই তাদের নিজেদের সমাজে ফিরে যায়নি। ধারণা করা হয়, এই সময়ের মধ্যে ৩২০০ থেকে ৬০০০ আদিবাসী শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটে। আবাসিক এই স্কুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ছিল কামলুপ্স ইন্ডিয়ান রেজিডেনশল স্কুল। রোমান ক্যাথলিকদের পরিচালিত এই স্কুলটি ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ এর দশকে স্কুলটিতে ভর্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল আর তখন এখানে ৫০০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। ১৯৬৯ সালে কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার স্কুলটির প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং স্থানীয় শিক্ষার্থীদের আবাস হিসেবে ১৯৭৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার স্কুলটি পরিচালনা করে।

‘ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ উপলক্ষে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন(বাম থেকে) সৈয়দ আব্দুল গফফার, শেখ হাসিব হোসেন, এনায়েত করিম বাবুল এবং সোলাইমান তালুত রবিন

২১৫ শিশুর গণকবর আবিস্কৃত হওয়ার পর সারা দেশে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেই সব শিশুদের সম্মানে কানাডার বিভিন্ন স্থানে প্রার্থনা ও আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গত শুক্রবার কামলুপ্স স্কুলের সামনে স্তলো আদিবাসীর সদস্যরা একটা ক্যানো (ডিঙি জাতীয় নৌকা) কাঁধে নিয়ে শোভাযাত্রা করে এবং আবাসিক স্কুলের মৃত শিক্ষার্থীদের জন্য শোক করে ও তাদের আত্মার প্রতি সম্মান জানায়। গত শনিবার বিকেলে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার স্যারির পিস আর্চ পার্কে লুম্মি জাতির প্রায় দুই শত সদস্য জড় হয় এবং আবাসিক স্কুলের সব মৃত শিক্ষার্থীদের প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা জানায়। এছাড়াও ভ্যাংকুভার, ম্যানিটোবা, এডমিন্টন, নিউ ব্রæন্সউয়িক, শার্লোটটাউন, ইয়োলোনাইফ, হোয়াইটহর্স, আইকালুট, কিংস্টোন, অটোয়া, মন্ট্রিয়ল এবং টরন্টোতে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী ও সুধী সমাজ শোভাযাত্রা, প্রার্থনা এবং কানাডার যে সব জায়গায় আদিবাসীদের জন্য এমন সব আবাসিক স্কুল তৈরী হয়েছিল, সেগুলোতে অনুসন্ধান করার দাবি জানায়। তারা বলেন, প্রায় ছয় হাজারের মত আবাসিক স্কুলের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের কোন খোঁজ তাদের পরিবার পায়নি। সঠিক অনুসন্ধান হলে সেগুলোর সুষ্ঠু তথ্য বের হয়ে আসবে।

২১৫ শিশুর গণকবর আবিস্কার হওয়ার পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কানাডিয়ান ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ব্যবস্থার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, যে কাউকে তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে রাখার যে কাজ রাষ্ট্র করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। এ পরিকল্পনা যারা করেছিলেন এবং এর বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের সবাইকে এর জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ সব পরিবারের প্রতি আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেই সাথে তিনি রোমান ক্যাথলিক প্রধান পোপের প্রতি ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান।

গত রবিবার ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার স্ট্রীটে সাপ্তাহিক প্রার্থনায় পোপ ফ্রান্সিস কামলুপ্স ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের গণকবর আবিস্কারের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলেও এমন ঘটনার জন্য রোমান ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে কোন ক্ষমা চাননি। পোপের ক্ষমা না চাওয়ার ঘটনায় কানাডার আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

কামলুপ্স ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের গণকবর আবিস্কারের পর কানাডার আরও কয়েকটি প্রভিন্সের পরিত্যক্ত রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান মিলে যা সারা কানাডার সংবেদনশীল মানুষদের চরম কষ্টের কারণ হয়।

‘ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ পালনের জন্য টরন্টো ফিল্ম ফোরাম গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সংগঠনটির ৩০০০ ড্যানফোর্থস্থ ‘মাল্টিকালচারাল ফিল্ম স্ক্রীনিং সেন্টার’এ এক আলোচনা এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। আলোচনায় অংশ নেন স্ক্যারবরো সাউথ-ওয়েস্ট এর এমপিপি ডলি বেগম, প্রকৌশলী সৈয়দ আব্দুল গফফার, রিয়েলটর শেখ হাসিব হোসেন, টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সভাপতি এনায়েত করিম বাবুল প্রমুখ। আলোচকরা এই দিনটি পালনের তাতপর্য তুলে ধরার সাথে সাথে কানাডায় বসবাসরত আদিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ফেডারেল এবং প্রভিন্সিয়াল সরকার সত্যিকার অর্থে আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আলোচকরা এমন এক আয়োজনের জন্য টরন্টো ফিল্ম ফোরামের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। আলোচনা শেষে ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের তিন জন শিক্ষার্থীদের বেদনা বিদুর অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি নিয়ে জন স্যানফিলিপ্পো নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ওয়াওয়াদেঃ স্টোরিজ ফ্রম রেসিডেন্সিয়াল স্কুল সারভাইভার্স’ এবং এনায়েত করিম বাবুল নির্মিত অন্টারিও’র রামার চিপওয়েজ ফার্ষ্ট নেশন এর বাতসরিক ‘পও ওয়া’ উতসবের ওপর প্রামাণ্যচিত্র ‘রিদম অব সোল’ প্রদর্শিত হয়।

‘ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন’ উপলক্ষে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত আলোচনা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ফোরামের কার্য নির্বাহী সদস্য সোলাইমান তালুত রবিন।