অনলাইন ডেস্ক : টেকনাফে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন স্থানীয় বেশ কয়েকজন। ঘটনার সময় তারা আশেপাশেই ছিলেন। ঘটনার পর পুলিশের তৎপরতার কারণে তারা কেউ মুখ খুলেননি। ওসি প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর এখন তারা কথা বলতে শুরু করেছেন। ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিলেন এমন তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে মানবজমিন। তারা তাদের ভাষায় বর্ণনা দিয়েছেন ঘটনার। জানিয়েছেন, প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। নানা মাধ্যমে শাসিয়ে দেয়া হচ্ছে কথা না বলতে।

নাম ঠিকানা পরিচয় গোপন করে বাসায় এসে এমনটা করছে বলে অভিযোগ করছে ভুক্তভোগীরা। শুধু তাই নয়, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের নির্যাতনে শিকার ও ক্রসফায়ারের শিকার এমন ব্যক্তির পরিবারও যখন গণমাধ্যমে কথা বলছেন, তাদেরও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নাম ব্যবহার করে পরিচয় না দিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছে।

সিনহা হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হাফেজ শহিদুল ইসলাম। বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর বায়তুল নূর জামে মসজিদের ইমাম। বাহারছড়া ইউনিয়ন পুলিশ চেকপোস্টটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায় মসজিদের ছাদ থেকে। যেখানে পুলিশের হাতে হত্যার শিকার হন সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ঘটনার সময় ওই মসজিদের ছাদে ছিলেন শহিদুল। তিনি বলেন, এশার নামাজের পর কয়েকজন ছাত্র ছাদে গিয়েছিল। এর আধাঘণ্টা পর একটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমি মনে করেছি ছাত্ররা দুষ্টামি করছে। তাই ছাদের ওপর আমি দ্রুত যাই। ছাদে ওঠার পর আমি দেখি একজন ভদ্রলোক দুই হাত উপরে তুলে মাটিতে বসে আছেন। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কারণ ওখানে আলো ছিল।

কাজী হাফেজ শহিদুল ইসলাম বলেন, এই অবস্থায় এসআই লিয়াকত (অস্ত্র হাতে ছিল, পরে নাম জানতে পারি) কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাকে তিনটি গুলি করেন। এরপরে ওই ব্যক্তি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর তাকে রাস্তার পূর্বপাড়ে রাখা হয়। এর বিশ মিনিট পর দুটি সাদা গাড়ি আসছিল। আধা ঘণ্টার পর স্থানীয় ভাষায় ছারপোকা (লেগুনায়) করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর এখানে দুইজন ছিল, তাদেরকে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু কোথায় নিয়ে গেছে কি করছে কিছুই জানি না। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় এসব কথা বলার পর থেকে জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন হাফেজ শহিদ। তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সরাসরি বিভিন্ন জন এসে আমাকে হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে, শাসিয়ে যাচ্ছে। রোববার সকালেও একজন এসে গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয় দিয়ে বলে গেছেন, আমাকে তারা কষ্ট দিবেন। আমি নাকি এসব বলে ভুল করেছি। তবে আমি বলেছি, সত্য কথা আমি বলবোই। সত্য কথার জন্য মৃত্যু হলেও আমি বলে যাবো। মসজিদের এই ইমাম অভিযোগ করে বলেন, এই পর্যন্ত আমাকে তিন চারজন এসে বিভিন্ন সময় হুমকি ধমকি দিয়ে গেছে। আমার এখানে কেউ নেই। আমি মসজিদে আসছি কয়েকদিন হলো। পরিচয় না দিয়ে বিভিন্ন সময় আমাকে শাসিয়ে যাচ্ছে তারা। কথার বলার সময় মুখের মাস্ক পর্যন্ত খুলছে না। এই অবস্থায় আমি খুব ভয়ে আছি।

আরো একজন প্রত্যক্ষদর্শী অটোচালক সরোয়ার আলম। তিনি বলেন, মিডিয়াতে কথা বলার পর অচেনা এবং চেনা অনেক মানুষ আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি কোনো ভয় পাই না। যদিও প্রথম দুইদিন অটো নিয়ে রাস্তায় বের হইনি ভয়ে। কারণ সবাই দেখলেই ভয় দেখাতো। আমাকে কয়েকজন বিভিন্ন সময় বলে গেছেন, যাতে করে আমি আর কারো সঙ্গে এইসব বিষয়ে কথা না বলি। কথা বললেই আমার ক্ষতি হবে। সেইদিনকার ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে অটোচালক সরোয়ার আলম বলেন, সেইদিন ৯টা পনেরো বা বিশ বাজে। আমার হাতে ঘড়ি বা ফোন ছিল না। তাই সঠিক বলতে পারছি না। তখন আমি সারাদিনে ইনকামের টাকাগুলো ব্রিজের ওপর বসে গুনছিলাম। অটোচালক সরোয়ার আলম ঘটনাস্থল চেক পোস্টটির পূর্বপাশে পনেরো থেকে বিশ হাত দূরে একটি ব্রিজের ওপর অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেও পুরো ঘটনাটি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। তিনি বলেন, টাকা গুনে যখন আমি বাসায় যাবো ঠিক এমন সময়ে এসআই লিয়াকত ও মামুন মোটরসাইকেলে তাড়াহুড়ো করে এসে চেকপোস্টে থামেন। কিছুপক্ষ পর দেখলাম একটা সাদা গাড়ি আসছে, তখন লিয়াকত গাড়িটিকে সিগন্যাল দিয়ে থামান। তখন তাদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। তবে এখান থেকে যা দেখছিলাম, সিনহা সাহেব যখন গাড়িটির দরজা খুলে ডান পা দিয়েছে ঠিক তখনই এসআই লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করে। তখন সিনহার গাড়ি থেকে লম্বা চুলওয়ালা একটা ছেলে এসে সিনহাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে দুইজন পুলিশ সদস্য তার দুই হাত ধরে নিয়ে পাশের একটি দেয়ালের সঙ্গে নিয়ে তাকেও একটি গুলি করলো। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে লিয়াকত কানে ফোন দিয়ে জোরে জোরে বলছিল স্যার তিনটা দিয়েছি। কথা বলার আট দশ মিনিট পর গাড়ি নিয়ে হাজির হন ওসি প্রদীপ। ওসি সেখানে আসার পর একটি গালি দিয়ে সিনহার উপর পা রাখছিল। তারপর তাকে প্রদীপ আবার গুলি করলো। এই দৃশ্য দেখার পর আমি গাড়ি ফেলে পশ্চিম দিক দিয়ে দৌড়ে চলে গেছি। আমার বাসা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে। কিছুক্ষণ পরে দেখি পুলিশ ফাঁড়ি ও ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর গাড়ি ও পুলিশের গাড়িসহ দশ বারোটি গাড়ি এক হয়েছে। পরে আমি ভয়ে আর ওইদিকে যাইনি। এসব কথা মিডিয়াতে বলার পর আমাকে লোকজন ভয় দেখাচ্ছিল।

আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী চেকপোস্ট এলাকার শামলাপুরের বাসিন্দা সিএনজিচালক কামাল হোসেন। তিনিও অভিযোগ করে বলেন, মিডিয়াতে কথা বলার পর তাকে ২-১ জন হুমকি দিয়েছে।

শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই না ওসি প্রদীপের নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদেরও প্রত্যক্ষভাবে শাসিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জন। তবে তারা গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে পরিচয় দিচ্ছে। এমন একজন ভুক্তভোগী টেকনাফের ডেইলপাড়ার কামাল। গত বছরের জানুয়ারিতে তার ছোট ভাই আবুল কালামকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে কথিত ক্রসফায়ার দেন থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস। কিন্তু থানার এসআই সঞ্জিত দাশ ক্রসফায়ার দিবে না বলে আমাদের কাছ থেকে জোর করে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যায় কিন্তু পরে তারা আমার ভাইটাকে ক্রসফায়ার দিয়ে দেয়। কোনো দোষ ছিল না আমার ভাইয়ের। একজনের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল। বিষয়টি যখন আমি গণমাধ্যমে বলছি, তখন আমাকে সরাসরি এসে অচেনা লোকজন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বলে যাচ্ছে আমার ছোট ভাইয়ের মতো নাকি আমার অবস্থা হবে। তাই কথা বলতে না করেছে। বলেছে, সবঠিক হয়ে গেলে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে তারা।

শুধু কামালই নয়, এরকম আরো বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী রয়েছে যাদেরকে বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে নাম ঠিকানা গোপন করে শাসিয়ে যাচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।