স্বপন কুমার সিকদার : পূর্ণিমার চাঁদের রাতে সমুদ্র যেন রাশি রাশি নীল জলের অপরুপ এক সমুদ্র। আঁধারের বিছানো জালে যেন ধরা পড়ে চাঁদ। ঝকঝকে রৌপ্যকান্তি। পূর্ণিমার রাতে আকাশ যেন আলোর টিপ পরে কপালে। পূর্ণিমার এই চাঁদ কখনো ঘোমটা খোলা নব বঁধূর মতো বের হয়ে আসে মেঘের আড়াল থেকে। চাঁদ সত্যি ভারী আশ্চর্যের! আকর্ষণীয়- বিচিত্র তার রূপ।
বহু মানুষের বিশ্বাস চাঁদ ও মানবমন সম্পর্কিত। আসলে চাঁদ আমাদের বড় চেনা। যেন বড়ই আপনজন। ওই রহস্যময় বিশাল মহাকাশে চন্দ্রকেই আমরা কাছে পাই। চাঁদ এমনই স্নিগ্ধ যে, তাকে ঘিরে নিশ্চিত আবেগে – কল্পনায় আমরা ডুবে থাকি। আমিও ‘চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ শুনে আপ্লুত হয়েছি। আমার মূল আকর্ষণ ছিল উঠোনে ঠায় দাঁড়িয়ে চন্দ্রদর্শন – তাতে চড়কা কাটা বুড়ি অবলোকন করেছি দীর্ঘকাল। জ্যোৎস্না রাতে বিমোহিত হয়ে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্নও লালন করেছে অনেকে অনাদিকাল থেকে। অবুঝ মন বলেছে বহুবার – “হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ”।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের মনের অভিব্যক্তি-
“সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী,
সেহেলি “লায়লী” দিয়ে গেছে চুপে ক‚হেলী-মশারী টানি!”
পূর্ণিমার রাতে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না নামে পৃথিবীর বুকে। ভূমধ্য সাগরের বৃহৎ কোন মুক্তার মতো যেন অহংকারী হয় চাঁদ। প্রেম নিবেদন শোনে মধ্য রাতের চাঁদ হয়তো এই ভাবে –
“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সেকি মোর অপরাধ?
হেরিতে তোমার রূপ-মনোহর
পেয়েছি এ আঁখি, ওগো সুন্দর
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর
নয়নের সেই সাধ”— কাজী নজরুল ইসলাম
প্রাণের কবি, জীবনের কবি জীবনানন্দ দাশও পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে উনার মনের কথা প্রকাশ করেছেন –
“সে যে জানে কত পাথারের কথা, – কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জ্যোৎস্না, শুক্লাতিথি!
জানি না তো কিছু,-মনে হয় শুধু এমনি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হ’য়ে গেছে কত কী যে”!
কবি কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য্যে অবগাহন করেছেন ও তা প্রকাশ করেছেন বহুভাবে –
“কোন্ শরতে পূর্ণিমা-চাঁদ আসিলে এ ধরাতল।
কে মথিল তব তরে কোন্ সে ব্যথার সিন্ধু-জল”।
– কাজী নজরুল ইসলাম
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আমাদের আপ্লুত করেছেন উনার কাব্যছটায় –
“চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো ।
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো”। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা।
যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে”।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাঁদের দিকে চেয়ে বিরহ ব্যথায়ও ব্যাকুল হয়েছেন যা প্রকাশ করেছেন কবিতায়-
“কত উঠেছিল চাঁদ নিশীথ- অগাধ আকাশে!
বনে দুলে ছিল ফুলগন্ধ- ব্যাকুল বাতাসে!
তরু-মর্ম্মর, নদী কলতান কানে লেগেছিল স্বপ্ন সমান,
দুর হতে আসি পশেছিল গান শ্রবনে,
আজি সে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে”?
সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের দৃষ্টিতে “পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”।
নির্মলেন্দু গুণ চাঁদকে দেখেছেন প্রেমিকা হিসাবে- “ও আমি রাগ করেছি চাঁদের সাথে, মুখখানি সে দেয়নি ছুঁতে আমার হাতে”।
ওই মায়াবী আলোকময়তা কাউকে কাউকে মুগ্ধ করে রাখে আজীবন-
“ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে, কারো নজর লাগতে পারে
মেঘেদের উড়ো চিঠি, উড়েও তো আসতে পারে”
-পুলক বন্দোপাধ্যায়
চাঁদের রুপ-আকর্ষণ দুর্নিবার। আমাদের করে গৃহত্যাগী। প্রেম নিবেদনে ব্যাকুল হয় মন।
স্বামী প্রেম নিবেদন স্বরে স্ত্রীকে বলে, “দেখো দেখো, চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর”।
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ভালোবেসে সবাইকে আরো কাছে পেতে চায়।
কাব্য কথায় -“চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখো, জ্বলছে ভালোবাসায়
পৃথিবীকে রেখেছে ধরে, বর্নালী আলোর মায়ায়”।
পূর্ণিমার চাঁদ জীবনকে আরও উপভোগ্য করে। তাই কবি কণ্ঠ বলেছে -“আঁধার ঘুচিয়ে দিলে জীবনের আস্বাদ, ভরা নদীর বাঁকে তুমি পূর্ণিমার চাঁদ। (পূর্ণিমার চাঁদ, ঘাস ফুল)
পূর্ণিমা রাতের একটি সংগৃহীত ছবি সম্মানিত পাঠকের জন্য ঊপস্থাপন করা হলো।