কামাল কাদের : পুলিশের চাকুরীটা যে মিস্টার জাফর মল্লিক তার জীবনের পেশা করে নিবে তা সে কখনো ভাবিনি। কেন তার পুলিশের চাকরির প্রতি অনীহা ছিল তারও কারণ আছে। তার ছোট বেলার একটা ঘটনা আজও তার স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে রয়েছে। তখন কতই বা বয়স হবে? বড়জোর ১০ /১২ বছর। তাদের বাসার কাছা কাছি অনেকগুলি সরকারি গুদাম ঘর ছিল। সেই গুদাম ঘরগুলিতে সরকারি ধান, চাল, গম প্রভৃতি মওজুদ করা হতো। তারপরে সেখান থেকে দেশের নানা জায়গায় প্রয়োজন মতো সরবরাহ করা হতো। একদিন প্রতিদিনকার মত নিয়ম অনুযায়ী একদল কুলী “ট্রাক গাড়ি” থেকে যথারীতি চালের বস্তাগুলি মাথায় করে গুদাম ঘরের ভিতর রেখে দিচ্ছিলো। এর মধ্যে কোন কোন বস্তার ছিদ্র থেকে কিছু কিছু চাল মাটিতে পড়ে যায়। আর সেই সময় কয়েকজন গরীব ছেলে মেয়ে পালা করে ঝাড় দিয়ে মাটিতে পড়া চালগুলো কুড়িয়ে নিতে ছিল। তারপরে যে ঘটনা ঘটলো তা ভাবলে আজও জাফর মল্লিকের গাঁ কেঁপে উঠে। হঠাৎ করে এক পুলিশ এসে চাল কুড়ানো ছেলে মেয়েদেরকে লাঠি দিয়ে সমানে পেটাতে শুরু করলো। ফলে সে লক্ষ্য করলে যে লাঠির প্রহারে আর ভয়ে একটা ছোট্ট ছেলের হাফ-পেন্টটা ভিজে গেলো। জাফর মল্লিকের প্রতিবাদ করার ইচ্ছে জাগলো। আবার পরক্ষণেই ভাবলো, তাকেও যদি ওই ছেলেটার মতো লাঠিটি দিয়ে কয়েক ঘা লাগিয়ে দেয় তাহলে নিশ্চয়ই তারও ছেলেটার মতো অবস্থা হয়ে যাবে। আর তাছাড়া সে এও ভাবলো, তার মতো অল্প বয়সী ছেলের প্রতিবাদে তাদের কিই বা আসতো যেত। তাই সে এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবার চিন্তা মনের ভিতর থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো।
অদৃষ্টের পরিহাস, তা না হলে একান্ত অনিচ্ছাসত্তে কেন সে এই পুলিশের চাকরি নিতে বাধ্য হলো। এম,এ, পাস্ করে আর কোথাও কোন চাকরি না পেয়ে অনেকদিন ধরে বেকার হয়ে বসে রইলো। অবশেষে পুলিশের চাকরিটা পেয়ে গেলো। সে মনে মনে নিজেকে সান্তনা দিলো, “হোক না পুলিশের চাকরি, নিজে ঠিক থাকলে পেশার কি দোষ?” যখন সে ইতিবাচক চিন্তা করলো, তখন সে ভাবতে পারলো, “পুলিশের পেশা তো এক মহৎ পেশা। জনগণকে সেবা করার এক মহান পেশা। জনগণের সেবা করার এক বিরাট সুযোগ। পুলিশ ফোর্স হলো শান্তি আর শৃঙ্খলা রক্ষা করার অতন্দ্র প্রহরী।”
রাজারবাগ পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে জাফর মল্লিকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করা হলো এবং ওখানেই সকল শিক্ষার্থীদের থাকা খাবারের ব্যবস্থা করার হলো। অর্থাৎ কোর্সটি সম্পূর্ণ রেসিডেন্সিয়াল। প্রশিক্ষণ ব্যাচের সবাই শিক্ষিত তরুণ। সবারই মনে প্রাণে উচ্চ আশা। জাফর মল্লিকের রুমমেটের নাম হলো কফিল। সে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়লয় থেকে এম, এজি, (মাস্টার অফ এগ্রিকালচার) ডিগ্রীধারী। একসাথে থাকার সুবাদে নিজেদের মধ্যে কিছুটা জানাজানি হয়ে গেলো। কথায় কথায় একদিন জাফর মল্লিক কফিলকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি এম, এজি, ডিগ্রীধারী হয়েও পুলিশের চাকরি নিলেন, ব্যাপারখানা কি?” তারপর সে একটু থেমে আবার জিজ্ঞাসা করলো, “আপনিও কি আমার মতো বেকারত্ব অবসানের জন্য এ চাকুরী নিয়েছেন?”। কফিল জাফর মল্লিককে একটু অবাক করে মৃদু হেসে জানাল, “ব্যাপারটা তা নয়। আমি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে একটি আধা -সরকারি রিসোর্ট সেন্টারে প্রধান নির্বাহী অফিসার ছিলাম। আমার ওখানে প্রায় ৫০/৫৫ জন লোক কাজ করতো। সারা বাংলাদেশ থেকে গণ্যমান্য পর্যটকরা আমাদের রিসোর্টে এসে বৃহত্তর সিলেটের আশেপাশে বেড়িয়ে যেত। আন্তর্জাতিক পর্যটকদেরও কোনো কমতি ছিলো না।” কফিলের সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই জাফর মল্লিক বললো, “এতো সুন্দর চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এখানে এলেন কেন? মনে তো হচ্ছে মান-সম্মান নিয়ে ভালোই ছিলেন।”
“আপনার কাছে তাই মনে হচ্ছে?”, কফিল বলে চললো, “অবশ্য কথাটি সত্যই, অসম্ভব রকমের মান-সম্মান ছিল, তবে উপরি পয়সা ছিলো না। উপরির মাঝে শুধু ছিল সেলাম আর সেলাম। আজকালকার দিনে ও দিয়ে কি দিন চলে? প্রাচুর্য আনা যায়? বলুন?” কথাটি শুনে জাফর মল্লিক কথা আর বাড়ালো না, চুপ করে থাকলো। মনে মনে ভাবলো, “চাকরিই পাচ্ছিলাম না, তার উপর প্রাচুর্যের কথা ভাবা দুঃস্বপ্ন ছাড়া নয়তো কি”।
জাফর মল্লিকের মৌনতা দেখে কফিল আবার বলতে শুরু করলো, “ওই যে ঘরের বারান্দায় আমার মোটর সাইকেলটা দেখছেন, ওটা কিনতে আমার তিন বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। আর আমার এক সহপাঠী অর্থাৎ আমরা একই সাথে এম, এজি পাস করি, সে পুলিশের চাকরিতে ঢুকে এক বছরের মধ্যেই ব্র্যান্ড নিউ টয়োটা গাড়ি কিনে ফেললো। তখন থেকেই আমার মাথায় চেপে বসলো, আমাকেও পুলিশের চাকরি করতে হবে। আল্লাহর অশেষ কৃপায় এতদিন পরে এই চাকরিটা পেলাম। আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ”। এই বলে কফিল তার কথা থামালো। তার এই কথাবার্তায় এবং চিন্তাধারা জাফর মল্লিকের কাছে মোটেও ভালো লাগলো না, তাই সে আর কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করে কথা বাড়ালো না।
যথাসময়ে মিস্টার মল্লিকদের ট্রেনিং শেষ হলো এবং যে যার নির্ধারীত পোস্টিং এ চলে গেলো। ঘটনাচক্রে মিস্টার মল্লিকের পোস্টিং হলো শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গলে এসে মিস্টার মল্লিক সেখানকার চারিদিকটার সৌন্দর্য্য দেখে অভিভূত, বিশেষ করে চা বাগান গুলি দেখে। তার কাছে তখন মনে হলো তাহলে বাংলাদেশেও এতো সুন্দর জায়গা রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দের্য্যে একেবারে ভরপুর। কিছুদিনের মধ্যে সে স্থানীয় গণ্যমান্য লোকদের সাথে পরিচিত হলো এবং তার সাথে পুলিশ অফিসার হিসেবে অনেক জনপ্রিয়তাও অর্জন করতে শুরু করলো। প্রায়ই নানান বাড়ি থেকে দাওয়াত-নিমন্ত্রণ লেগেই থাকতো। কফিল যে রিসোর্টে পরিচালনায় ছিল, একদিন সেখান থেকে মিস্টার মল্লিক নিমন্ত্রণ পেলো। তাদের উদ্দ্যেশ নুতন পুলিশ অফিসারের সাথে পরিচিত হওয়া। সময় করে আমন্ত্রিত হয়ে এক মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিলো। সেখানকার পরিচালক হেলাল সাহেব বয়সে তরুণ। সদ্য বিদেশ থেকে হোটেল এন্ড ক্যাটারিং ম্যানেজমেন্টের উপর ডিপ্লোমা করে এখানে জয়েন করেছেন। মধ্যাহ্নভোজ শেষে তিনি মিস্টার মল্লিককে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রিসোর্টখানি দেখালেন এবং ভবিষ্যতে তার কি কি পরিকল্পনা রয়েছে তাও মিস্টার মল্লিককে অবগত করালেন। শুনে এবং দেখে মিস্টার মল্লিকের খুবই ভালো লাগলো। হেলাল সাহেব আরো জানালেন যে, এই শ্রীমঙ্গলে এবং বৃহত্তর সিলেটে এতো নৌসর্গিক সৌন্দর্য্য রয়েছে যে, এগুলি যদি বিভিন্ন কার্যকারিতা নিয়ে আরো আকর্ষণীয় করা যায়, তাহলে তারা আরো বেশি পর্যটক পাবেন এবং এর ফলে অনেক লোকের কর্মস্থান হবে আর আর্থিক দিক থেকেও দেশ আরো লাভবান হবে।
হেলাল সাহেবের কথা-বার্তায় এবং তার চিন্তাধারাতে মিস্টার মল্লিক অপরিসীম আনন্দিত হলো। সে মনে মনে বলছে আমাদের দেশ তো এমন সন্তানই চায়। মিস্টার মল্লিকের কাছে চাকরিটা বেশ লোভনীয় মনে হলো, আর কফিল কিনা এতো সুন্দর চাকুরী ছেড়ে পুলিশের চাকরিতে জয়েন করলো, কথাটি ভাবতে সত্যিই তার অবাক লাগছে!
তারপরে যথারীতি দিন চলে যায়। সময় তো কারো জন্য থেমে থাকে না। মিস্টার মল্লিক যথাসম্ভব জীবনটা সততার সাথে চালিয়ে নিচ্ছিলো। নিয়মমাফিক একটার পর একটা প্রমোশনও পেয়ে যাচ্ছিলো। সততার জন্য হউক অথবা অন্য যে কারণেই হোক আজ সে সমাজে অতি পরিচিত লোক। জানা-অজানা, সবাই তাকে সম্মানের সাথে দেখে। নিজেকে সে সুখিই ভাবে, যদিও আর্থিক দিক থেকে সেরকম সফলতা করতে পারেনি, সুযোগ থাকা সত্তে¡ও। তবে এ ব্যাপারে তার কোনো আক্ষেপও নাই। কারণ তার আদর্শবাদী মন এবং চিন্তাধারাকে আজও অটুট রাখতে পেরেছে বলে।
হঠাৎ করে তার জীবনটা ওলোট পালট হয়ে গেলো। হাঁ, হঠাৎই বলতে হবে। রাজধানী ঢাকায় পোস্টিং। একদিন বিকেল বেলায় অফিসে খবর এলো, ঢাকা শহরের অদূরে আশুলিয়ায় মোটর কারের দুর্ঘটনা হয়েছে। মিস্টার মল্লিককে তৎক্ষণাৎ সরেজমিনে তদন্ত করতে হবে। ক্রিমিনাল কেস। একজন পথচারী মারাত্মকভাবে আহত, জীবন মরণ সমস্যা। মিস্টার মল্লিক অফিসের জীপ্ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ঘটনাস্থলে মিস্টার মল্লিক যখন পৌঁছালো তখন সময় সন্ধ্যা, তবুও আকাশে অনেক আলো ছিল। খবর নিয়ে জানতে পারলো যে, আহত ব্যক্তি মারা গিয়েছে। মৃত ব্যক্তিটিকে দেখে তার মনে হলো সে তারই ছেলের বয়সী হবে। এই ১৭/১৮ বছর। স্থানীয় এক শ্রমিক। মা-বাবা আছেন, কিন্তু তারা খুবই দরিদ্র। নিয়মমাফিক সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাশটাকে মর্গে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হলো। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারা গেলো যে, মোটর গাড়িটি খোদ মালিক নিজেই চালাচ্ছিলেন। কোন কারণে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় ছেলেটিকে ধাক্কা মেরে তিনি গাড়িটিসহ পাশের খাদে পড়ে যান। গাড়িটির মধ্যে অন্যান্য যাত্রীও ছিল। তাদের একটু-আধটু কাটা-ছেড়া ছাড়া তেমন বিশেষ কিছুই হয়নি।
গাড়ির মালিকের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ করে তাকে থানায় নিয়ে আসা হলো। ভদ্রলোকের কথা-বার্তায় জানা গেলো যে, তিনি এক বিরাট ব্যবসায়ী এবং তিনি অকপটে তার দোষ স্বীকার করলেন। তারপর হঠাৎ করে তিনি মিস্টার মল্লিককে বললেন, স্যার, আমি আপনাকে পাঁচ লাখ দেব এবং ছেলেটির অভিবাবককে দেব দশ লাখ টাকা।” কিছু মোলায়েম সুরে বললো, “স্যার কেসটা খারিজ করে দিন”। কথাটি শুনে মিস্টার মল্লিক মনে মনে ভাবছে, “আমি এ কি শুনছি, এ যে ‘বøাড মানি’, খুনের টাকা। দেশে আইন আদালত রয়েছে, আমি বিচার করার কে?” মিস্টার মল্লিককে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক সাহস সঞ্চয় করে বললেন, “স্যার, যা হবার তা তো হয়ে গেছে, ওরা তো ওদের ছেলেকে ফিরে পাচ্ছে না, তাই বলছিলাম কি আমার এই দশ লাখ টাকা দিয়ে ওরা কিছু একটা করে খেতে পারবে। যদিও ওদের ছেলে হারানোর বেদনার ক্ষতিপূরণ কখনো হবে না।”
ভদ্রলোক জামিনে ছাড়া পেলেন এবং যাবার আগে মিস্টার মল্লিককে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, “ব্যাপারখানা ভেবে দেখবেন স্যার।” বাড়িতে এসে সেদিন মিস্টার মল্লিক সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। একদিকে এক অতিশয় দরিদ্র পরিবার তাদের পুত্র হারানোর বিচার চায়, অন্যদিকে তার এক কলমের খোঁচায় পাঁচ লাখ টাকা চলে আসে। সে কি যে করবে। রাতটা ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিলো। অবশেষে সে স্থির করলো সে এ টাকা নেবে না। এই পাঁচ লাখ টাকার শতকরা একশ ভাগ ঘুষের টাকা। তাছাড়া এর মধ্যে এক সর্বহারা পরিবারের সন্তান হারা বেদনা জড়িত। তার সিদ্ধান্তটি গিন্নিকে জানাল। গিন্নী এ ব্যাপারে কোনো কিছু শুনতে অনীহা প্রকাশ করলো। তার কারণ তার এই সাধুবাদিতার জন্য গিন্নীর জীবনে কোনো আনন্দ বা সাধ-আহলাদ মিস্টার মল্লিক মেটাতে পারেনি। সে জন্য গিন্নী জীবনের এই মাঝ বয়সে এসে কি সিদ্ধান্ত নেবে না নেবে সেটা মিস্টার মল্লিকের উপর ছেড়ে দিলো। মিস্টার মল্লিক শুধু ভাবছে আর ভাবছে। নাওয়া খাওয়া, ঘুম সব যেন বন্ধ হয়ে গেলো।
এই ঘটনার কয়েক দিন পরই মিস্টার মল্লিকের জীবনে এক চরম ধাক্কা এলো। বড় ছেলেটি এসএসসি পাস্ করেছে এবং কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে। বাধ সাধলো আচমকা এক প্রস্তাবে। কলেজের প্রিন্সিপাল তার ছেলের ভর্তির জন্য দুই লাখ টাকা দাবি জানালো। কথাটা শুনে একটু আহত হয়ে কলেজ প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞাসা করলো, “দু লাখ টাকা কেন চাইছেন?” প্রিন্সিপালের সাফ জবাব, “এটা হলো আমাদের কলেজের ভর্তির নরমাল বিষয়, কলেজের জন্য চাঁদা। আমরা প্রত্যেক অভিভাবকের কাছ থেকে এ অঙ্কটা নিয়ে থাকি।” “আর যারা দিতে পারে না, তাদের কি হয়?” মিস্টার মল্লিকের পাল্টা প্রশ্ন। প্রিন্সিপাল সাহেব এক গাল হেসে উত্তর দিলেন, “তারা অন্যত্র চেষ্টা করে”। মিস্টার মল্লিকের ফের প্রশ্ন, “অন্য কলেজের কর্তৃপক্ষও যদি আপনাদের মতো একই দাবি করেন, তাহলে কি হবে?” “সেটা আমাদের ভাবার বা জানার বিষয় নয়।
তাছাড়া কে কি করলো বা করে সেটা নিয়েও আমাদের মোটেই আগ্রহ নেই। তার কারণ হলো আপনি চাঁদা না দিতে পারলেও আমাদের ওয়েটিং লিস্টে আরো অনেক ছেলে রয়েছে, তার হু হু করে চলে আসবে” কথাগুলি প্রিন্সিপাল সাহেব গড় গড় করে বলে গেলেন।
মিস্টার মল্লিক এ সমস্ত কথাগুলি শুনে ভাবছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে নৈতিকতা এতো নীচে নেমে গেছে। আমাদের সময়ে এমন ব্যাপার চিন্তা করার কথা তো কল্পনার বাইরে ছিল, এমন সব অসামাজিক দাবি শিক্ষকরা করতে পারেন? শিক্ষকরাই যদি এমন বিপথগামী মন নিয়ে এই পবিত্র পেশায় নিয়োজিত থাকেন তাহলে উনারা ছাত্রদেরকে কি নৈতিকতা শিখাবেন?
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি” এ ধারণা আজ কোথায় গেলো? মিস্টার মল্লিকের মৌনতা দেখে, প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, “আপনারা পুলিশের বড় কর্তা। দু লাখ টাকা আপনাদের জন্য কিছুই না। আপনাদের তো কাড়ি কাড়ি টাকা। আমার কথা শুনে আপনার তো আৎকে উঠার কোনো কারণেই দেখছি না।” কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব জানেন না যে, মিস্টার মল্লিক সে লোক নয়, যেটা তিনি ভাবছেন। বেতনের টাকা দিয়ে সংসার কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। সঞ্চয় কোথা থেকে হবে? কথাটি বললে প্রিন্সিপাল সাহেব নিশ্চয়ই এ কথা বিশ্বাস করবেন না। রাগে মিস্টার মল্লিক ফেটে পড়ছিলো, কিন্তু সেটা দেখাতে পারছিলো না। শুধু অসফুটো স্বরে বললো, “দেখি কি করা যায়”।
প্রিন্সিপাল সাহেব মিস্টার মল্লিককে তিন সপ্তাহের সময় দিলেন। আর এও জানালেন যে, টাকা জোগাড় না করতে পারলে অন্য এক ছেলেকে অফার করবেন। বাড়িতে এসে মিস্টার মল্লিক দুশ্চিন্তায় পড়লেন। আজকাল যে প্রতিযোগিতার দিনকাল। ছেলেটিকে যদি কলেজে লেখাপড়া না করাতে পারে তাহলে ওর দশা তার মতো হবে, নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবে। অবশেষে ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিবেকের কাছে হার মেনে গেলো। পরদিন বাদীর বাসায় গিয়ে বাদীকে বোঝালো যে, গাড়ির মালিক তাকে দশ লাখ টাকা দিতে চায়, বিনিময়ে তিনি যেন মালিকের বিরুদ্ধে কেসেটা উঠিয়ে নেন এবং এ ব্যাপারে সে তাকে সাহায্য করবে। তাকে আরো বুঝলো এটা সত্যি যে, ঘটনাটা খুবই দুঃখের, কিন্তু যেটা হারিয়ে গেছে সেটা তো আর কোনোদিন ফিরে পাওয়া যাবে না বরং দশ লাখ টাকা নিলে তাদের ভবিষ্যত জীবন সুখ-সাচ্ছন্দে কাটাতে পারবে। বিশেষ করে টাকাটা কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে খাটালে বাকী জীবনটা ভালো ভাবে কেটে যাবে। তাছাড়া কোর্ট-কাচারীর ঝামেলা তো আছেই। মিস্টার মল্লিক বললো, “আমার দিক থেকে বলতে পারি, প্রস্তাবটা খুবই ভালো। আপনি যদি রাজি হন, তাহলে আমি সব বন্দোবস্ত করে ফেলি এবং কেসটাকে খারিজ করে দেই”।
ভদ্রলোক নীরবে কিছুক্ষণ মিস্টার মল্লিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর তার দু চোখ দিয়ে অশ্রুকণা ঝরতে শুরু করলো। চোখের অশ্রুতে হয়তো তিনি বোঝাতে চাইছেন, তার ছেলের জীবনের মূল্য শুধু দশ লাখ টাকা। এরকম দৃশ্য দেখার জন্য মিস্টার মল্লিক প্রস্তূত ছিলেন না। কিন্তু সে নিরুপায়। মিস্টার মল্লিককে হতবাক করে ভদ্রলোক বললেন, “স্যার, আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করুন।” কথাটা শুনে মিস্টার মল্লিকের স্বার্থবাদী মন বলছে, “কয়েক ঘন্টা পরে আমারও পাঁচ লাখ টাকা আয় হয়ে যাবে, আর সে সুযোগে আমার ছেলেটারও কলেজে ভর্তির সুযোগ বয়ে আনবে। এক বাবার পুত্র হারাবার বেদনা দিয়ে অন্য এক বাবার পুত্রের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে। এটাই আমাদের সমাজ, আমিও তাই করলাম”।
সব কিছু সেটেল করে মিস্টার মল্লিক বাসায় ফিরলো। রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে গেলো। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকালো। সে দেখতে পেলো শত জীর্ণ বস্ত্র পরে এক মা তার ছোট ছেলেটিকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ফুটপাতে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। কিন্তু আজ কেন এতো আরামদায়ক বিছানা থাকা সত্তে¡ও তার চোখে ঘুম নাই। সে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলো না। শুধু বাড়ে বাড়ে তার মন বলছে, “আমি একি করলাম? তাহলে সত্যিই আমি আমার বিবেকের কাছে হেরে গেলাম”। সে হাত জোর করে প্রাথর্না করছে “হে, বিবেক! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি বাস্তব জীবনের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে তোমাকে হারালাম”। শেষ
লেখক : কামাল কাদের
ই-মেইল: quadersheikh@gmail,com
ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড