ফরিদ আহমেদ : বাংলা আধুনিক গানের গীতিকারদের মধ্যে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম সেরা একজন। তাঁর সঙ্গে তুলনীয় একজনই আছেন। তিনি হচ্ছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলা আধুনিক গানের এই দুই সেরা গীতিকার ছিলেন সমসাময়িক। ফলে, তাঁদের মধ্যে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিলো। একজন একটা ভালো গান লিখলে, আরেকজন চেষ্টা করতেন তার চেয়ে ভালো আরেকটা গান লেখার জন্য। সৃষ্টিশীল জায়গায় এই ধরনের এই প্রতিযোগিতা দারুণভাবে কাম্য। এতে আখেরে লাভবান হয় সৃষ্টি পিয়াসীরা।
গান লেখার ব্যাপারে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কতোখানি প্রতিভাবান ছিলেন তাঁর একটা স্বীকৃতি পাওয়া যায় মান্না দে-র কাছ থেকে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গানই মান্না দে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে গেয়েছেন। দু’জনের বেশ ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্কও ছিলো। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুব কাছে থেকে গান লিখতে দেখেছেন তিনি। ফলে, তাঁর মূল্যায়নের একটা আলাদা মূল্য রয়েছে। তিনি লিখেছেন, “গান লেখার ব্যাপারে পুলকবাবুর প্রতিভার কোনও সীমা ছিল না। যে কোনও অবস্থার মধ্যে যে কোনও পরিস্থিতি বা সেন্টিমেন্টের গান পুলকবাবুকে একটু ধরিয়ে দিলেই, উনি তার থেকে লিখে দিতে পারতেন অপূর্ব সব গান। ছোট ছোট ঘটনা, ছোট ছোট কথা থেকেই উনি অসাধারণ সব গান লিখে ফেলতে পারতেন।”
ছোট ছোট ঘটনা, ছোট ছোট কথা থেকেই উনি অসাধারণ সব গান লিখে ফেলতে পারতেন, এই কথাটা দারুণভাবে সত্য। একবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে ভুলবশত অন্য বাড়ির কলবেল টিপে দিয়েছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এক নারীকে হাসিমুখে বের হতে দেখে তিনি লিখে ফেলেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো, অমনি করে ফিরে তাকাল’! একবার দুর্গাপূজায় তিনি গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হেমন্তর বাড়িতে পৌঁছালেন, তখন হেমন্ত ছিলেন গোসলখানায়। বাড়িতে পুলক এসেছে শুনে, তড়িঘড়ি করে প্রায় ভিজে শরীরে সামনে এসে হাজির হলেন। বললেন, ‘কত দিন পরে এলে, একটু বসো, তৈরি হয়ে আসি।’ ব্যস, এই বাক্যগুলো মনে ধরে গেল তাঁর। হেমন্ত সেখান থেকে সরতেই খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লেন পুলক। লিখলেন, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোন’। সে গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই গেয়েছিলেন। বিমানভ্রমণে এক বিমানবালাকে দেখে তিনি লেখেন, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’। একবার এক অনুষ্ঠানে এক নারীর কান থেকে ঝুমকো খুলে পড়ে গিয়েছিলো। সেটি কুড়িয়ে নিয়ে তিনি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। আর এই স্মৃতি থেকে লিখে ফেললেন, ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি ঝরে পড়েছে’। এভাবেই যেকোনো মুহূর্তকে অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে গান লিখে ফেলতে পারতেন তিনি।
১৯৮৬ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ক্যান্সারে মার যান। এর পরে বাংলা গানকে একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই তিনিও ১৯৯৯ সালে হুট করে আত্মহত্যা করে বসেন। লঞ্চ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলেন তিনি।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক কী কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন সেটা জানা যায়নি। একজন মানুষ বিনা কারণে আত্মহত্যা করে না। এর পিছনের অবশ্যই কোনো না যন্ত্রণার কাহিনি থাকে। তাঁর জীবন যন্ত্রণার কাহিনিটা আমাদের জানা নেই, এই যা।
প্রথম আলোতে মাসুম অপু একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন। সেটার শিরোনাম ছিলো ‘কেন গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন তিনি’। সেই প্রবন্ধে তিনি লেখেন যে কবি না হতে পারার দুঃখে হয়তো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। মাসুম অপু হয়তো দিয়ে যে কারণটা বলেছেন সেটার স্বপক্ষে যুক্তি টানতে গিয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী থেকে এই বিষয়ে আক্ষেপকে তুলে এনেছেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী কথায় কথায় রাত হয়ে যায়-এ লিখেছিলেন, ‘আমি আধুনিক গানই লিখতাম। আধুনিক গানই লিখছি, আর যত দিন বাঁচব, তত দিন এই আধুনিক গানই লিখে যাব। আমি কবি ছিলাম কি না জানি না, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের গীতিকার আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি, কবি হতে পারিনি।’
এই আক্ষেপে কেউ আত্মহত্যা করবে, এটা আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাসুম অপু নিজেও তা জানেন। যে কারণে, ‘কী জানি’ ‘হয়তো বা’ এই সব অনিশ্চিত শব্দ-বন্ধকে ব্যবহার করেছেন তিনি।
কেউ মারা গেলে আমরা তাঁর মৃত্যুর আগের কথাবার্তা বা কর্মকাণ্ডকে বিশ্লেষণ করি। তারপর সেখান টুকরো কথামালা বা কর্মকাণ্ডকে তুলে এনে সেটা দিয়ে একটা উপসংহার টানার চেষ্টা করি।
মান্না দে-র কথাই ধরা যাক। তিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগের বছরই পুজোর গান করছিলেন। গানগুলো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়েরই লেখা ছিলো। গানের সিরিজটার থিম বা নাম ছিলো মা। সেই সিরিজের একটা গান ছিলো। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মহত্যার পরে তাঁর মনে হয়েছিলো ওটাই আসলে ছিলো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনের কথা। তিনি ‘জীবনের জলসাঘরে’-তে লিখেছেন, “প্রথম গানটি ছিল – ‘আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’। শুনে বেশ ভাল লাগল। এইভাবে চলতে লাগল গান ঠিক করার পালা, একটা গানের কথায় এসে আম আটকে গেলাম। বললাম, না পুলকবাবু, এ গান আমি গাইতে পারব না। পুলকবাবু চাপ দিতে থাকলেন আমায়। বললেন, না মান্নাদা, এই গানটা গাইতেই হবে আপনাকে। এই গানটা আমি অনেক যত্ন করে লিখেছি। আপনি না বলবেন না প্লিজ! এটা আমার বিশেষ অনুরোধ। এই গানটা আপনাকে গাইতেই হবে।
পুলকবাবুর সঙ্গে সম্পর্কটা তখন আমার এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ওঁর অই রকম বারবার অনুরোধ আমি কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারিনি। গররাজি হয়েই গেয়েছিলাম- ‘যখন এমন হয় জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা, ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই, রেলের লাইনে মাথা রাখি……।’
এই গানে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবার যে কথা আছে, বাস্তবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক সেই কাজটাই করেছেন। তিনি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছেন। যে কারণে মান্না দে-র কাছে মনে হয়েছে ওটাই ছিলো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনের কথা। তিনি রেলের লাইনে মাথা রেখে আত্মহত্যা করলেও অবশ্য তাঁর জীবনের সাথে এই গান মিলে যেতো।
মৃত্যুর ঠিক আগে যিনি গানের কথা লেখেন মনে হয় গঙ্গায় ঝাঁপ দেই, এবং সত্যি সত্যিই গঙ্গায় ঝাঁপ দেন, তখন এটাই স্বাভাবিক মনে করা যে সেটাই আসলে গীতিকারের মনের কথা ছিলো। মান্না দে-র অমন ভাবনাতে তাই ত্রুটি ধরার সুযোগ কম।
থাকতোও না, যদি না এই গানের বিষয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই লিখে না যেতেন। আগেই বলেছি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও একটা আত্মজীবনী আছে। তাঁর সেই আত্মজীবনী ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ এর একেবারে শেষ পাতার আগের পাতায় এই গান নিয়ে কিছুটা স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি। সেখানে তিনি লিখেছেন,
“তখন ১৯৯৭ এর সম্ভবত আগস্ট মাস। পুজোর গানের সময় পেরিয়ে গেছে। মান্নাদা বললেন- এ বছর তা হলে থাক। ভাল গানের কোনও সময়ের পরিধি নেই। যখন প্রকাশিত হবে তখনই তা আদৃত হবে। আমি এটা আর বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের পুজোর জন্য করব। চার-পাঁচ মাস ধরে শুধু গাইব আর গাইব। আপনি সুরকারের সঙ্গে বসে যান। বললাম – আপনিই সুর করুন। বললেন – না। এই সাবজেক্টে আমি আর একটা ডিফারেন্ট ব্রেন চাইছি। তখন আমরা নির্বাচন করলাম সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু অনিবার্য কারণে উনি সরে গেলেন। এবার আমরা বসে গেলাম মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মৃণাল গানের সুর করে রাখতে লাগল। যখনই মান্নাদা কলকাতায় আসতেন তখনই বসত আমাদের অ্যালবামের গান নিয়ে মহড়া। আমি যখনই মুম্বাই যেতাম তখনই মান্নাদা বলে উঠতেন, আচ্ছা, এ গানটা না করে সেদিন আপনি যে আর একটা গান শোনালেন সেটা করলে কেমন হয়? কথাটা শেষ করেই আবার বলে ফেলতেন –আহা! পুলকবাবু কী লিখেছেন- ‘যখনই এমন হয়/জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা,ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই/রেলের লাইনে মাথা রাখি/কে যেন হঠাৎ বলে আয় কোলে আয়/আমি তো আছি ভুললি তা কি? মা সে কি তুমি?’ আর মৃণাল দারুণ সুর করেছে, বলেই, কিছুটা গেয়েই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে গান থামিয়ে দিতেন।’
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য সত্যি হলে এই গানটা নিয়ে তিনি যতোটা আবেগী ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আবেগপ্রবন ছিলেন মান্না দে। অথচ মান্না দে লিখেছেন তিনি এই গান করতে চাননি। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে দিয়ে জোর করিয়ে এই গান গাইয়েছে। তাঁর নিজের জীবনের হতাশা, বেদনা আর দুঃখকে ঢেলে দিয়েছেন তিনি এটাতে। অন্যদিকে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী থেকে মনে হয় এটা নিছকই একটা গান ছিলো। তখনও জীবনকে আবর্জনা ভাবেননি তিনি, গঙ্গায় ঝাঁপ দেবার পরিকল্পনাও করেন নাই।