Home কলাম পালকি

পালকি

মণিজিঞ্জির সান্যাল : পালকি এক ধরনের বিলাসবহুল যানবাহন যাতে সাধারণত অর্থবান ব্যক্তিরাই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে থাকেন। চাকাবিহীন যানবাহন হওয়ায় কয়েকজন ব্যক্তি ঘাড়ে বহন করে পালকিকে ঝুলন্ত অবস্থায় এক জায়গা থেকে অন্য আর এক জায়গায় নিয়ে যায়। যিনি পালকির ভার বহন করেন, তিনি পালকি বেহারা নামে অভিহিত হন। প্রথমদিকে দেব-দেবীকে আরোহণ কিংবা দেবমূর্তি বহনের উদ্দেশ্যে এরূপ যানবাহন তৈরি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। অনেক মন্দিরের দেওয়ালেই পালকি সহযোগে দেবতাদের বহনের দৃশ্যমালা ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরার দৃশ্য চিত্রিত আছে। পরবর্তীকালে এই পালকিতে করে মুখ্যত ইউরোপীয় উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও ভদ্রমহিলাগণ ভারতীয় উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত চলাফেরা করতেন। আধুনিককালে পালকির ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবুও সীমিত আকারে ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠান, তীর্থযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে পালকি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “পল্যঙ্ক” বা, “পর্যঙ্ক” থেকে। এর অর্থ বিছানা বা খাট। হিন্দী এবং বাংলা উভয় ভাষায় একে পালকি বলা হয়ে থাকে। পালি ভাষায় একে “পালোঙ্ক” বলা হয়। পর্তুগীজরা এর নাম দিয়েছিলো পালাঙ্কুয়িন। কাঠ মিস্ত্রীরা সেগুন, শিমুল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি করতো পালকি। পালকির বহন করার দন্ডটিকে বাঁট বলে। এই বাঁট তৈরি হত বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার ছিল। ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এর দু দিকে দুটি দরজাও থাকতো।

প্রাচীন রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে।

পালকি প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। তখনও কলকাতা কলকাতা হয়নি। জলে-জঙ্গলে ঘেরা গণ্ডগ্রাম। ক্লিভল্যান্ড সাহেব ভারতে এসেছেন ব্রিটিশ রাজের কাজে। অচেনা দেশে এক অজানা যানের সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর। কাঠের তৈরি ছোট্ট খাঁচার মত ঘর। দু’পাশে দন্ড। জনা কয়েক পালোয়ান চেহারার পুরুষ সেই যান বয়ে নিয়ে যায়। নাম তার পালকি। ক্লিভল্যান্ড সাহেব তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর প্রথম পালকি সফরের কথা। পালকি চলছে, কাহাররা মাঝে মাঝে হাঁক দেয়, রাস্তা খালি করে। অচেনা দেশে অজানা যানে সাহেবের ভয় করতে থাকে। পালকি বাহকদের হুমহুমনা শুনতে শুনতে তাঁর মনে হয় বাহকরা বোধহয় পথের ক্লান্তিতে এমন শব্দ করছে মুখে। তাদের রেহাই দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি পালকি থেকে নেমে পড়লেন ক্লিভল্যান্ড। ভেবেছিলেন তাদের ক্লিষ্ট মুখ দেখবেন হয়তো বা কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথায় কী! কাহাররা তো বেজায় খুশি। তাদের মুখে কোথাও কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। দেখেশুনে আবার পালকিতে ফিরে গেলেন ক্লিভল্যান্ড। কিন্তু আবার একই ধুকপুকানি। এই টেনশন আর বেশিক্ষণ নিতে পারলেন না। পালকি থামাতে বলবেন। পালকি থামতেই কাহারদের হাতে টাকা দিয়ে দৌড় লাগালেন সাহেব।

পালকি প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত ডায়রির পাতায় এক রাজকীয় শোভাযাত্রার কথা লিখেছিলেন স্যার টমাস রো। জাহাঙ্গিরের আমলে ভারতে এসেছিলেন। প্রথম ইংরেজ রাজপ্রতিনিধি। তিনি লিখেছেন, শোভাযাত্রার প্রথমে দেখা গেল সম্রাটের রথ। সুসজ্জিত ঘোড়ায়। তাঁর পিছনে বাদ্যকারের দল। সঙ্গে ছত্রধারী। তার পিছনেই রত্নমালায় সাজানো নটা ঘোড়া। একদম শেষে চোখ ধাঁধানো পালকিবহর। সোনা দিয়ে বাঁধানো। পালকির ভিতরে বসার জায়গাও সোনায় মোড়া। দরজার দু’পাশে ঝালর। তার গায়ে পদ্মরাগ মনি আর পান্নার লতাপাতা।

ঠিক কবে এবং কিভাবে এই পালকির প্রচলন হল তা সঠিক জানা যায় না। কিন্তু আকবরের সভার গুরুত্বপূর্ণ রতœ আবুল ফজলের লেখায় ‘পালকি’র উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। তিনি পালকির নাম দিয়েছিলেন ‘সুখাসন।

ইউরোপে পালকিকে শোবার উপযোগী করে উন্মুক্ত কিংবা বন্ধ অবস্থায় নির্মাণ করা হতো। দুইটি শক্ত খুঁটি সহযোগে প্রান্ত সীমায় পালকি বেহারা কিংবা ভারবাহী জন্তুর মাধ্যমে টেনে নেওয়া হতো। ধারণা করা হয় যে, স্লেজচালিত গাড়ীর ধারণা থেকে পালকি পরিবহনটির ব্যুৎপত্তি ঘটেছে। মিশরীয় চিত্রকর্মে এর প্রকাশ ঘটেছে। পরবর্তীতে তা পারস্য রাজ্যেও ব্যবহৃত হয়। প্রাচ্য দেশসমূহে এই বাহনটি পালকিরূপে পরিচিতি পায়। মূলতঃ প্রাচীন রোমের সম্রাজ্ঞী এবং সিনেটরদের স্ত্রীদের ন্যায় সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে বরাদ্দ ছিল পালকি। কিন্তু সাধারণ লোকদের জন্যে এই পরিবহন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। সপ্তদশ শতকে ইউরোপে পালকি পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল; মজবুত নির্মাণশৈলী এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায়সহ উভয় খুঁটিতে চামড়ার বর্ম আচ্ছাদন করা হয়। পরবর্তীকালে গুরুতর অসুস্থ রোগী ও আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকেও পালকি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।

লন্ডনে পালকিকে সিড্যান চেয়ার নামে আখ্যায়িত করা হয়। এজাতীয় পালকিতে একজন ব্যক্তির জন্যে একটি চেয়ার অথবা জানালা সহযোগে কেবিন রাখার উপযোগী করে তৈরী করা হয়। এর সামনে ও পিছনে কমপক্ষে দুইজন লোক ভার বহন করে নিয়ে যেত। ভারবহনকারীরা চেয়ারম্যান রূপে পরিচিতি পেতেন। ঊনবিংশ শতকে এসে তা খুবই কম দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু মর্যাদাসম্পন্ন পরিবহনরূপে কয়েক শতক এর ব্যবহার ছিল যাতে অবরুদ্ধ নারীগণ যাত্রী হতেন। রাতের বেলায় মশাল সহকারে লিঙ্ক-বয় পালকির সামনে থেকে পথ নির্দেশ করত।

১৯৭০-এর দশকে উদ্যোক্তা এবং বাথউইকের অধিবাসী জন কানিংহ্যাম সংক্ষিপ্তকালের জন্য সিড্যান চেয়ারের পুণঃপ্রচলন ঘটিয়েছিলেন।

চীনে সনাতনী ধারায় সিড্যান চেয়ারের উপযোগিতা রয়েছে। সাধারণতঃ তা ভাড়া করে বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। লাল সিল্ক দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় কনেকে নিয়ে আসা হয়। একসময় হংকংয়ে সিড্যান চেয়ার জনসমক্ষে ব্যবহৃত হতো। জনসাধারণের জন্যে ব্যবহৃত চেয়ারের জন্য নিবন্ধন করতে হতো। পাশাপাশি করও প্রদান করতে হতো। ব্যক্তিগত চেয়ার বা পালকি ব্যবহারকারীকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। সরকারী কর্মকর্তারা এ পালকিতে কত জন বেহারার দরকার হতে পারে তা নির্ধারণ করতেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ পালঙ্ক থেকে যার অর্থ বিছানা বা খাঁট। আনুমানিক খ্রীষ্ট-পূর্ব ২৫০ সালে রামায়ণে পালকির কথা তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে চাকা চালিত রিকশার প্রচলন ঘটে। এর ফলে পালকি তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করে।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা স¤প্রদায়ে পালকির প্রচলন রয়েছে। দুই খুঁটিতে গড়া জোলি বেহারারা কাঁধে করে পারাপার করতেন এবং যে-কোন যাত্রী অর্থের বিনিময়ে ভ্রমণ করতে পারতেন।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অসাধারণ সেই কবিতাটি ছোট বড় সবারই খুব প্রিয়,
পালকি চলে!
পালকি চলে!
গগন তলে
আগুন জ্বলে!

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় উত্তরবঙ্গে কাহার স¤প্রদায়ের সন্ধান মেলে। তবে সংখ্যায় তা নগণ্য। ক্ষেত্রানুসন্ধানে জানা যায়, জীবন-জীবিকার তাগিদে স্বপেশা ত্যাগ করে স্বচ্ছল জীবনযাপনের লক্ষে এ স¤প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন পেশা যেমন- রিকশা, দিনমজুর, গার্মেন্টসকর্মী, ইটভাটার শ্রমিক ইত্যাদি গ্রহণ করেছে। উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে দাসপ্রথা বিলোপের পর বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে পালকি বাহকরা শুষ্ক মৌসুমে বাংলায় আসতে থাকে। বাংলায় আসার পর এরা বর-কনে, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ কিংবা অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসালয়ে বহনের কাজ করত। এক পর্যায়ে তারা এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কাহার স¤প্রদায়ের পাশাপাশি বহু সাঁওতালও পালকি বাহকের কাজ করতেন।

পেশাগত দিক থেকে বেহারা ও কাহার শব্দ দুটি একে অপরের পরিপূরক। বেহারা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- পালকি-বাহক, কাহার। অনেকের মতে, ইংরেজি বিয়ারার শব্দ থেকে বেহারা নামের উদ্ভব হয়েছে। অন্যদিকে কাহার আরবী শব্দ। ফারসী ভাষায়ও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ জবরদস্তকারী, জুলুমবাজ। হিন্দু ধর্মের একটি তত্ত মতে, কাহারদের উৎপত্তি হয়েছে নিম্নবর্ণের এক হিন্দু স¤প্রদায় থেকে এবং এই শ্রেণি ব্রাহ্মণ পিতা ও চন্ডাল মাতার বংশোদ্ভূত এক মিশ্রবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী। কাহারগণ অবশ্য নিজেদের মগধের রাজা জরাসন্দের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। একই সামাজিক মর্যাদার অন্যান্য বর্ণের অনুসৃত ধর্মের মতোই কাহারদের ধর্ম। তাদের অধিকাংশই শিব বা শক্তির পূজারী এবং তাদের মধ্যে বৈষ্ণবদের সংখ্যা ন্যূন। সামাজিক বিচারে কাহারগণ কুর্মি ও গোয়ালা বর্ণের সমকক্ষ। এ প্রসঙ্গে জাহিদুর রহমান বলেন- কাহার নিচুজাতের হিন্দু স¤প্রদায়ের লোক। কথিত আছে কাহারদের আদি পুরুষ ছিল বাংলার শেষ পাঠান বাদশাহর সৈনিক। মোগল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপন করে এবং বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দু চাড়াল বেহারা জাতীয় ডুলি-পাল্কী বাহকদের নিকট আশ্রয় ও সাহায্য পায়। এরা পরস্পর বিয়ে-শাদীতে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীকালে তারাও ডুলী-পাল্কী বহন করার পেশা গ্রহণ করে।

অতএব বলা যায়, কাহাররাই বেহারার স¤প্রদায়ভুক্ত। এরা মূলত পালকি বহনের কাজ করত। অতীতে কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি অথবা বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়ি যাতায়াতের জন্য বেহারাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। এছাড়াও জমিদার, তালুকদার, ভূস্বামী, রাজা-বাদশা ও উচ্চবিত্তদের নিজস্ব পালকি ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আঠারো শতকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পালকির প্রচলন শুরু হয়। ক্রমেই তা বাঙালি সমাজে যানবাহনের অন্যতম মাধ্যমে রূপ নেয়।

এ স¤প্রদায়ের লোকদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি- যা বাংলার সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এর মধ্যে পালকি নৃত্য অন্যতম। নব দম্পতিকে পথে পথে পালকিতে বহন করার সময় বেহারা এক হাতে পালকির বেরিয়ে থাকা কাঠের টুকরো লম্বা অংশটিকে ধরে, আর অন্য হাতে সবাই এক সাথে তালে তালে গা দুলিয়ে এই নৃত্য পরিবেশন করত। এই নৃত্য ছিল শাস্ত্রীয় বর্হিভূত নৃত্য। কিন্তু পরিবেশনা ছিল অত্যন্ত চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর। নৃত্যের তালে তালে সঙ্গীত পরিবেশনাও এই স¤প্রদায়ের অন্যতম আকর্ষণ। পালকির প্রসঙ্গটি উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া গানে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন-
ও মুই পালকি না চড়োং ধুল্যা নাগিবে
সোয়ারিতে না বসোং গাও এড়াইবে।
লোকসঙ্গীতে যেমন বেহারাদের প্রসঙ্গ এসেছে তেমনি বাংলা লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্য লোকছড়াতেও পালকির বিষয়টি পরিস্ফুট। যেমন-
“গরিব মানুষ ফড়িং খায়
পাল্কী চড়ে বাহ্যে যায় ”
মণিজিঞ্জির সান্যাল : শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ

Exit mobile version