Home কলাম পার্কিং লট থেকে শুরু হয়েছিল আমার রাজনৈতিক জীবন

পার্কিং লট থেকে শুরু হয়েছিল আমার রাজনৈতিক জীবন

মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

তেতাল্লিশ.
রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার জীবনটা শুরু হয়েছিল একটা পার্কিং লট থেকে। সেটা ছিল একটা মুদির দোকানের পার্কিং লট, একটু সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, একটা শরমা রেস্টুরেন্ট আর একটা চুল কাটার দোকান থেকে রাস্তার একেবারে অপর পারে ছিল পার্কিং লটটি। লিবারেল পার্টির হয়ে আমি পাপিনিউ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা শুনে রুদ্ধশ্বাসে যে সব সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যানরা আমার খবর প্রকাশ করার জন্য বিমানবন্দরে ছুটে গিয়েছিল, সেদিন তেমন কারো টিকি’টিও দেখতে পাইনি। শুধু আমি একা নিজে একটা ক্লিপবোর্ড হাতে নিয়ে যাকেই সামনে পাচ্ছিলাম, তারই দিকে এগিয়ে গিয়ে বিনয়ের সাথে দশ ডলারের দিয়ে লিবারেল পার্টির সদস্য হওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমি ওমনভাবেই সবাইকে কানাডার রাজনীতির জগতে স্বাগত জানাতে পারি।

ওটা আসলে রাজনীতির কোনো প্রচরণা ছিল না, ওটা ছিল পাপিনিউ থেকে লিবারেল পার্টির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য কে মনোনয়ন পাবে তার প্রারম্ভিক মাঠ পর্যায়ের লড়াই। আমি একেবারে নিজের আর্থিক স্বাবলম্বীতা ছাড়াই এই লড়াইয়ে নেমেছিলাম। তাছাড়া এমন রাজনীতির লড়াইয়ে নিজেকে জড়ানোর আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার এই লড়াইয়ে আমার সঙ্গে ছিল আমার কয়েক জন বন্ধু যারা নিজেদের উদ্যেগে আমার এই নতুন পথ চলায় সঙ্গী হয়েছিল, আর আমার সমস্ত দাপ্তরিক কাজে সহায়তা করার জন্য আমি যাকে পেয়েছিলাম সে হচ্ছে আমার স্ত্রী। আমার এই কাজে প্রবল ভালোবাসা আর উচ্ছ¡াস নিয়ে সোফি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমার সব পরিকল্পনা আর কোন সময়ে কোন কোন কাজ করা প্রয়োজন সে ব্যাপারে সব বুদ্ধি পরামর্শ দেবার জন্য সোফি সত্যিই চমৎকারভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলা যেতে পারে, আমরা দুজনেই একই সাথে কাজ করছিলাম আর কঠিন এই জগত সম্পর্কে ধীরে ধীরে জ্ঞান নিচ্ছিলাম। যে কোনো সংসদীয় এলাকায় পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য একজন প্রার্থীকে কি ধরনের লড়াইয়ে নামতে হয় সে সম্পর্কে কানাডার বেশীর ভাগ মানুষেরই কোনো ধারণা নেই। নির্বাচনী লড়াই পুরোদমে চলার পূর্বে পর্দার আড়ালে সাধারণ মানুষের জানার বাইরে যে খেলাটা হয়, সেটার ধরন যে কি রকম, এটার সাথে যারা প্রতক্ষ্যভাবে কখনও কাজ করেনি, তারা কখনও এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুই বুঝবে না। তবে যখন নামী দামী বা জনপ্রিয় কোনো প্রার্থী কোনো এলাকা থেকে নির্বাচনে দাঁড়ায়, তখন সাধারণত পর্দার আড়ালের এমন খেলা আর হয় না। কিন্তু যারা একেবারে নতুন এবং রাজনীতির জগতে সত্যিকারের কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ে সামনে এগুতে চায় এবং মনোনয়ন পাওয়ার জন্য দলের সদস্যদের সমর্থন পাওয়ার জন্য কাজ করতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে এটাকে এক কঠিন যুদ্ধ বলা যেতে পারে। এটাতে একজন প্রার্থী তার এলাকার কত ভোটারকে নিজের প্রার্থীতার কথা জানাতে এবং তার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে এবং কোনো কমিউনিটি হল বা কোনো স্কুল অথবা সেই এলাকার বিশেষ কোনো জায়গাই ভোটের দিনে হাজির করিয়ে তার পক্ষে ভোট নিতে পারে, সেটাই থাকে মূখ্য বিষয়। কাজটা কিন্তু খুবই পরিশ্রমের আর কষ্টের। কিন্তু আমি এই প্রক্রিয়ায় ভালোভাবেই কাজ করার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। বলা যেতে পারে, আমি খুবই আনন্দ আর আশা নিয়েই এই কাজ চালিয়ে যাবার জন্য পথে নেমেছিলাম।

২০০৬ সালের লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচন নিয়ে যে নাটক আর ঘটনা আমি কাছ থেকে দেখেছি, আর যে প্রক্রিয়ায় আমি নিজেই ওতপ্রোতভাবে কাজ করেছি, তার ফলে আমি খুব ভালোভাবেই এই পরিস্থিতিতে আমাকে কিভাবে সামনে এগুতে হবে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। চারিত্রিকভাবে আমি সব সময় খুবই সামাজিক। আর তখন আমার মধ্য আর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তা হচ্ছে, আমি শারীরিকভাবে কঠোর পরিশ্রম করতে পারতাম এবং মাঠ পর্যায়ে সবার সাথে মিশতে পারতাম। সেই সময় পাপিনিউ এর মত এক সংসদীয় এলাকার নির্বাচনের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন ছিল। সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় পায়ে হেঁটে হেঁটে সদস্য সংগ্রহ করে বেড়ানোটা আমার খুব ভালোই লাগছিল এবং প্রতিদিনই আমি সকাল থেকে ঠিকঠাক মত আমার কাজ শুরু করে দিতাম। প্রচারণার জন্য ভোটারদের ফোন করা যে কত বেশী কার্যকরী তা আমি জানতাম, কিন্তু সব বিষয় বিবেচনা করেই আমার মনে হয়েছিল, নির্বাচনী প্রচরণার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হচ্ছে, জুতা পায়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে মানুষের কাছে ভোটের বিষয় নিয়ে কথা বলা এবং তাদেরকে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ করা।

দলকে সংগঠিত করার জন্য আমার এই উদ্যোগ আর কাজটা একদিকে যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি অন্যদিকে এর ফলে আমি রাজনীতির আসল মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম। লিবারেল পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না, অধিকাংশ নেতাদের তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার ব্যাপারে একটা নাক উঁচু ভাব ছিল, আর তারা এ ব্যাপারে এত বেশী অহমিকায় ভুগতো যে, তারা মনে করতো সাধারণ মানুষ এমনি এমনিই লিবারেল পার্টির বাক্সে ভোট দিবে। সেই সব নেতারা এমন ভাব নিয়ে থাকতো যে নিজেদের মহল্লাতেও একটু হেঁটে হেঁটে ভোটের জন্য মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করতো না, তারা মনে করতো, লিবারেল পার্টির কাজ কর্ম মানুষ সবই জানে আর তারা লিবারেল পার্টিকে এমনিতেই ভোট দিবে। লিবারেল পার্টি নিয়ে তাদের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল না। নেতাদের এমন মনোভাব আর ধ্যান ধারনার জন্যই সেই সময় ধীরে ধীরে লিবারেল পার্টির সদস্য সংখ্যা কমতে থাকে। আমার বারবার মনে হয়েছিল, এমন অবস্থা থেকে আমাদের বের হতে হবে। আমাদের ভোটারদের বুঝিয়ে দিতে হবে, কানাডার লিবারেল পার্টির লাল রঙ’য়ের ভিতরে কি সব মূল্যবোধ আর দর্শন কাজ করে। সেই সময় সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল, কানাডার জনগণ যেন অনেক আশা আর প্রত্যাশা নিয়ে দেশ ও সমাজ গড়ার জন্য কাজ করতে পারে। এটা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়, কিন্তু আমার ভাবতে খুবই খারাপ লাগে, রাজনীতির সাথে জড়িত মানুষেরা তাদের আসল কাজটায় বারবার ভুলে যায়।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার কয়েক দিন আগে ২০১৫ সালের ১২ই অক্টোবরে টরন্টোর এক গ্রোসারী স্টোরে সাধারণ ভোটারদের সাথে লিবারেল পার্টির নেতা জাস্টিন ট্রুডো

এটা প্রায়ই বলা হয়, রাজনীতি হচ্ছে, মানুষের মধ্য বন্ধন তৈরী করার এক খেলা। আর এই বন্ধন সৃষ্টি করা খুব সহজ কোনো কাজ নয়। কথাটা অবশ্যই সত্য। এ কাজটা ভীরু আর পাতলা চামড়ার মানুষদের জন্য নয়। কিন্তু আমি এই রাজনীতিকে একটু অন্যভাবে আমার মত করে সব সময় দেখি। আমি বিশ্বাস করি, এটার মধ্যে মানুষ মানুষের প্রতি ভালোবাসার উষ্ণতার এক ব্যাপার আছে। যে মানুষগুলোর তুমি প্রতিনিধিত্ব করবে, সত্যিকার অর্থেই তাদের সাথে তোমাকে সময় কাটাতে হবে, বা বলতে পারো, তাদেরকে তোমার সত্যিকারের সময় দিতে হবে, যাতে তারা তোমার সত্যিকারের ভালোবাসার উষ্ণতা উপলব্ধি করতে পারে। আর এই সময়টা তোমাকে কাটাতে হতে পারে কফি শপে, খাবার টেবিলে বা ব্যাক ইয়ার্ডের বারবিকিউ পার্টিতে। তোমাকে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে আর তোমার সমাজের মানুষের ধ্যান ধারনা আর মূল্যবোধকে ভালোভাবে স্পর্শ করতে হবে। তোমাকে অবশ্যই এগুলোর জন্য কাজ করতে হবে। পাপিনিউ’তে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় আমি খুবই খেয়াল করে এ বিষয়গুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করেছি। সে সময় আমি অবিরতভাবে আমার সমাজের সার্বিক মঙ্গল আর সবার কাছে লিবারেল পার্টির গ্রহণযোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্য কাজ করেছি। তবে আমার কিছুটা খারাপ লাগে, আমি এ ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে যতটা সফল হয়েছি, জাতীয়ভাবে এখনো ততটা সফল হতে পারিনি। তবে আমি সর্বতোভাবে আমার এই চিন্তাভাবনাটাকে আপ্রাণভাবে জাতীয়ভাবে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ, আমি জানি সুন্দর পথে এগুনোর এটা একটা পরম ভালো এক পথ।

আমি জানতাম, আমার এই ভাবনাটা বিশেষভাবে প্রয়োজন আমার নিজের প্রাদেশিক অঞ্চল কুইবেকে। সেই স্পন্সর স্ক্যান্ডাল এবং এর পর পরই গোমারী কমিশন আমার কুইবেকবাসীর ওপর লিবারেল পার্টির এক দৈন্যতা তুলে ধরেছিল এবং এটা অনেক কষ্টেরও কারণ হয়েছিল। এখানে এটা উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৬ সালের লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের প্ররাচণায় আমি ফেডারেল রাজনীতির বাইরের একজন হয়েও জেরাড কেনেডীর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলাম। আমার মনে হয়, এটার ফলে তিনি ভাবতেই পারেন, দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আর আত্মিক শক্তির কি এক চরম সংকট বিরাজ করছিল তখন। দলের গ্রহণ্যযোগ্যতা তখন অনেকের কাছেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমার তখন যথার্থভাবেই মনে হয়েছিল, এই অবস্থা থেকে দলকে তুলে আনতে হলে আমদেরকে সেই পুরানো বিশ্বস্ত পথেই ফিরে যেতে হবে, যেখানে জনগণকে সত্যিকারের সম্মানের চোখে দেখতে হবে, মন দিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে আর তাদেরকে যা বলতে হবে তা যেন সত্যিকার অর্থেই সত্য হয়।

অবশ্যই কোনো কিছুর প্রতি প্রবল আগ্রহ আর ভালো চিন্তায় পারে তোমাকে বহুদূর নিয়ে যেতে। পাপিনিউ’তে সেই মানুষগুলো আমাকে সেই গ্রোসারী স্টোরের পার্কিং লট এ নিয়ে এসেছিল। আমার এই অভিজ্ঞতাটা সেই ২০০৬ সালে লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচনের জন্য লিবারেল পার্টির শত শত সদস্য যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছিলাম তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সেখানে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ব্যক্তিকে নেতা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমাদের সবারই পরিচয় ছিল একটা, তা হচ্ছে, আমরা সবাই ছিলাম লিবারেল পার্টির সদস্য এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের সবারই গন্তব্য পথ ছিল একটাই। কিন্তু পাপিনিউ এর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার বুঝার কোনো ক্ষমতা ছিল না, যে মানুষগুলোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি, তারা কে কোন দল করে। সত্যি বলতে কি, আমি এটাও জানতাম না, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যে সবাইকে আমার দলের কথা বলছি এবং তাদেরকে সম্ভাষণ জানাচ্ছি, তার প্রত্যুত্তরে এক ঝিলিক হাসি আর একটু মাথা নাড়ানো ছাড়া তাদের কাছ থেকে আর বেশী কিছু পাবো কি না! (চলবে)

Exit mobile version