মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
বিয়াল্লিশ.
ওই দুই জায়গার মধ্যে পাপিনিউ’কেই আমার ভালো লাগতো। পার্ক-এক্সটেনশনের সেই বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের রেস্টুরেন্টগুলোর খাবারের সাথে আমার ইতিমধ্যে ভালোই পরিচয় ঘটেছিল, সেই সাথে আমার বেশ কিছু বন্ধুর বিয়ের কাজ সেখানকার অর্থোডক্স গীর্জাগুলোতেই সম্পন্ন হতো, আর অনেক মন্ট্রিয়লবাসীর মত পর্দা কেনাকাটার কাজটা সেই সেন্ট-হারবার্টেই করতে হতো। রু জ্য-তালুন দিয়ে হেঁটে গেলে শুধু ফরাসী ভাষাটাই শোনা যেত না, বরং ইংরেজী, গ্রীক, পাঞ্জাবী, বাংলা, তামিল, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ, আরবী, ক্রিয়ল, ভিয়েতনামী এবং ইটালিয়ান ভাষা কানে এসে লাগতো। ঐ জায়গা দিয়ে হাঁটলে মনে হতো আমি গোটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছি।
মন্ট্রিয়লের একেবারে পূর্ব কোণের শেষে এবং ভৌগোলিকভাবে এর কেন্দ্রের কাছে, পাপিনিউ’র দক্ষিণ দিকে আউটারমন্ট আর পশ্চিম দিকে আমার বাবার সংসদীয় এলাকা মাউন্ট রয়েল। মাত্র নয় বর্গ কিলোমিটারের পাপিনিউ কানাডার সংসদীয় এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ছোটগুলোর মধ্য পড়ে। ২০০৬ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী, কানাডার সংসদীয় এলাকার মধ্য এখানকার মানুষদের গড় উপার্জন সবচেয়ে কম। যদিও কানাডায় বিভিন্ন ভাষার ও জাতিগোষ্ঠীর সব মানুষই এখানে বাস করে, কিন্তু ফরাসী ভাষার লোকসংখ্যাই এখানে বেশি। যদিও বেশ কয়েক দশক ধরে লিবারেলরাই ঐ আসনে বিজয়ী হয়ে এসেছে, কিন্তু ২০০৬ সালে ঐ আসনটা ব্লক কুইবেকোইস এর হাতে চলে যায় যখন হাইতি’তে জন্ম নেয়া ভিভিয়ান বার্লোট নামে এক জনপ্রিয় তারকা লিবারেল এর পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী পিয়ের পেট্টিগ্রিউ’কে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন।
আমার বারবার মনে হচ্ছিল, সেটাই হচ্ছে মোক্ষম সময় আর আসল জায়গা যেখানে আমি সবার কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রমাণ করতে পারি। আমার এটাও মনে হয়েছিল, লিবারেল পার্টি যদি পরের নির্বাচনে সত্যি সত্যি দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে তাহলে পাপিনিউ’র মত বহু সংস্কৃতির প্রাণবন্ত এক আসনে লিবারেল পার্টিকে জিততে হবে। বহু সংস্কৃতির ঐ জায়গাটার মূল বসতি হচ্ছে ফরাসীদের। ফলে লিবারেল পার্টি যদি কুইবেক’কে কুইবেক স্বাধীনতাকামীদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে চায়, তবে এই সংসদীয় আসনটি লিবারেল পার্টির দখলে আনার কোনো বিকল্প নেই। আর ঐ আসনটার যতটুকু আয়তন তাতে একজন স্বপ্নদেখা প্রাণ উদ্দীপনায় ভরপুর প্রার্থী খুব সহজেই পায়ে হেঁটে হেঁটে এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে গিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবে।
কিন্তু তখন ডিওন এর লোকজন আমাকে উপদেশ দেবার চেষ্টা করতে লাগলো যে পাপিনিউ আমার জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা নয়। কারণ তারা ভাবছে যেহেতু জায়গাটার বেশীর ভাগ ভোটার বহু সংস্কৃতির মানুষজন, সে জন্য সেখানে নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে তাদেরই একজনকে মনোনয়ন দেওয়া উচিৎ। সত্যি বলতে কি, তারা আমাকে আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে অনেকটা সরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা আমাকে জানিয়েছিল, ওখানকার মনোনয়নের সিদ্ধান্তে উন্মুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তারা ভেবেছিল, এর ফলে পার্টি মনোনয়ন পাওয়ার যুদ্ধে আমি জিততে পারবো না, আর এমন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে দাঁড়ানোর কথা ভেবে আমি হয়তো আর নির্বাচনে দাঁড়ানোর চিন্তা করবো না।
কয়েকদিন পরই ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো, ডিওন এর লোকজন চাচ্ছিল ঐ আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়াবে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ম্যারী ডেরস যিনি ১৯৯০ সাল থেকে পার্ক-এক্সটেনশন থেকে কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তারা ভেবেছিল, আমি এমন একজন যে কঠিন কোনো প্রতিক‚ল অবস্থার মুখে নিজের সব দিয়ে লড়াই করার ক্ষমতা রাখি না।
কিন্তু পাপিনিউ থেকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত আমি নৈতিকভাবে নিয়ে ফেলেছিলাম, ফলে বিভিন্ন দিক থেকে আসা এসব বাঁধাকে আমি কোনোভাবেই গায়ে মাখলাম না। বরং আমার বারবার মনে হয়েছিল, এই যে সব বিরূপ পরিস্থিতি আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, এগুলো আমার জন্য কিছুটা আশীর্বাদস্বরূপ, কারণ এগুলোকে দমিয়ে যদি আমি সামনে এগুতে পারি তাহলেই আমি সবাইকে বলতে পারবো, আমি আমার বাবার পরিচয়ে রাজনীতিতে আসতে বা কাজ করতে চাচ্ছি না, বরং আমি আমার নিজের ক্ষমতা আর যোগ্যতায় আমার ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে চাই। আর এই কাজের জন্য আমি ধনীর লাল্টুস মার্কা কোনো ছেলে নয়, বরং আমার রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখানোর জন্য যে কোনো কঠিনতর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে আমি সদা প্রস্তুত।
কিন্তু যখন আমার নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে আমি মনোনয়ন জয়ের কাছাকাছি চলে এসেছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল, আমাকে এটাও দেখাতে হবে আমি সত্যিকার অর্থেই দলের একজন হয়ে সব কাজ করতে চাই। আমি গভীরভাবেই বিশ্বাস করতাম দলের নেতাদের প্রতি সত্যিকার অর্থে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো এবং দলের সিদ্ধান্ত মেনে কাজ করার মধ্যে সুন্দরভাবে সামনে এগুনো যায়। আমি এটাও বিশ্বাস করতাম, এর মধ্য দিয়েই লিবারেল পার্টিকে কানাডার জনগণের সমর্থন পাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে হবে। সেই জন্য, ২০০৭ সালের ফেব্রæয়ারির এক সকালে যখন খবরটা ছড়িয়ে পড়লো যে, আমি পাপিনিউ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করছি, তখনই আমি ডিওন এর দলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমি কিভাবে বিষয়টাকে সামলাবো। আমার মনে হয়েছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে কোনো সাংবাদিক এসে এ ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করবে এবং আমি যদি বলে ফেলি যে আমি সত্যি সত্যি নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছি, তাহলে ওটা একটা ঝড় তোলার মত সংবাদ হয়ে যাবে। সেই জন্য আমি লিবারেল পার্টির নির্বাচন বিষয়ে কাজ করা দলের সাথে যোগাযোগ রাখতে লাগলাম।
কিন্তু আমি যে উত্তর পেলাম, সেটা আমি কখনও ভাবিনি। এক ধরনের অবজ্ঞা করেই আমাকে বলা হলো, সাংবাদিকরা যা জিজ্ঞেস করবে তার উত্তর আমি যা ভাবচ্ছি, তাই দিতে পারি। বিষয়টা আমার আরো বেশি খারাপ লাগলো যখন তারা আমাকে বুঝাতে চাইলো, আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে একটা হৈ চৈ বাঁধানোর জন্য আমি নিজেই সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করেছি। এসব কথা শুনে আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। আমার তখন বারবার মনে হচ্ছিল, রাজনীতির মত এক জটিল বিষয় ভালোভাবে জানার জন্য আমাকে আরো বেশি কঠিনতর পথে হাঁটতে হবে।
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রেডিও কানাডার এক সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চাইলো, আমি সত্যি সত্যিই পাপিনিউ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করছি কি না। আমি যখন জানালাম, আমি সত্যিই এমন পরিকল্পনা করছি, তখন তিনি আবার জানতে চাইলেন, আমি ক্যামেরার সামনে এ বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার দিবো কি না। আমি জানালাম, আমার পক্ষ থেকে কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু সেটা যদি তারা আজকেই নিতে চাই, সেটা নিতে হবে এয়ারপোর্টে, কারণ ‘তুষারধস থেকে নিরাপদ জীবন’ বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য আমি ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় যাবার জন্য আমি ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গেছি।
আমি যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম, দেখলাম চারিদিক থেকে অনেকগুলো ক্যামেরা আমাকে জেঁকে ধরলো। ঝটপট একটা প্রেস কনফারেন্সে আমি আমার নির্বাচনে দাঁড়ানো বিষয়টা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরলাম। ভ্যাংকুভার এর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য যখন প্লেনে চেপে বসলাম, তখন একটা আশার আলো আমার সারা দেহমন ছুঁয়ে গেলো।
আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর বিষয়টা নিয়ে সাংবাদিকরা যখন স্টিফেন ডিওন এর সাথে কথা বলেছিল, তখন তিনি বিষয়টা নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি সত্যিই আমার এই সাহস ও সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান, সেই সাথে তিনি বলেছিলেন, আমি সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য কোনো সহজ সরল রাস্তা বেছে নেইনি, বরং সবচেয়ে এক কঠিন পথে হাঁটার জন্য আমি পা বাড়িয়েছি।
কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যেই ডিওন এর লোকজন এ সংবাদ শুনে কিছুটা রেগে গেলো। সেই দিন ডিওন মন্ট্রিয়লে সন্ত্রাস ও নাশকতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, কিন্তু গণ মাধ্যম সেই বিষয়ে তেমন কোনো সংবাদই প্রকাশ করে নি, বরং সেদিন গণ মাধ্যমের মূল সংবাদ ছিল আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর বিষয়টা। পরের কয়েকটি দিন লিবারেল পার্টির অনেক প্রবীণ সদস্য খোলাখুলিভাবেই আমার নির্বাচনে দাঁড়ানো সিদ্ধান্তকে সমালোচনা শুরু করে দিলো। শুধু আমিও না, তাদের সমালোচনার হাত থেকে ডিওন মুক্তি পেলেন না।
সেই দিনগুলো আমার জন্য ছিল এক কঠিন সময়। তবে আমি উপলব্ধি করি, ওভাবে রাজনীতিতে আমার প্রবেশ, আমাকে দীর্ঘ পথ চলার শক্তি আর আলো জুগিয়েছে। আমি সেই পথে হাঁটতে গিয়েই বুঝে ফেলেছি, লিবারেল পার্টি অফ কানাডায় কাজ করতে হলে কিভাবে কাজ করতে হবে আর কিভাবে এই দলকে ঠিক করে সামনে এগুতে হবে। কারণ সেই সময় দলের মধ্যে অন্তর্দ্ব›দ্ব, ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ আর সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে বিরাজ করছিল।
কিন্তু এই সব বিরূপ পরিস্থিতিতে হতাশ বা দিক হারা না হয়ে আমি নব উদ্যমে জ্বলে উঠেছিলাম। নিজেকে বার বার শাণিত করেছিলাম সামনে এগুনোর জন্য এবং সুন্দর কানাডা গড়ার জন্য। সেই সাথে লিবারেল পার্টি যে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারে ধীরে ধীরে সেই অবস্থার জন্য কাজ করতে। তবে এই সামনে এগুনোটা কোনোভাবে কঠিন মানসিক চাপ হিসেবে আমি নিতে চাই নি, বরং জীবনের এক বিশাল স্বপ্ন আর সম্ভাবনার পথে সামনে এগুনোকে আমি আমার জীবনের এক পরম আনন্দের কাজ বলেই মনে করেছিলাম । (চলবে)