ড: বাহারুল হক : জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটা মানুষের আছে একটা পারিবারিক নাম বা বংশনাম যাকে ইংরাজিতে বলে সারনেম। বংশ পরম্পরায় এই নামটি থাকে পরিবারের সকলের নামের সাথে এবং সাধারণত এই পারিবারিক বা বংশনামটি থাকে পরিবারের সকলের শেষ নাম হিসেবে। ভারতীয়দের বংশনাম গণে শেষ করা যাবে না। শুধু বাঙালীদের মধ্যে আছে অসংখ্য সারনেম। সেসবের কিছু আছে শুধু বাঙালী হিন্দুদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, আবার কিছু আছে যেগুলো শুধু বাঙালী মুসলিমদের মধ্যে দেখা যায়। তবে হিন্দু মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মানুষের নামের শেষাংশ হিসেবে দেখা যায় এরকম কিছু সারনেমও আছে। ভুঁইয়া, মজুমদার, সরকার, চৌধুরী, মন্ডল, ঠাকুর, লস্কর, বিশ্বাস, হাজারী, ইত্যাদি সে রকম কিছু সারনেম যেগুলো কোন একটা ধর্মের মানুষের মধ্যে আটকে নাই। তবে শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে এসব সারনেম ব্যবহারের প্রবণতাও কমে আসছে।

প্যাটেল খুব চেনা একটা ভারতীয় সারনেম। দক্ষিণ ভারতের গুজরাট রাজ্যে প্যাটেলদের বসবাস। সম্ভ্রান্ত গুজরাটী বলতে প্যাটেলদের বুঝায়। গুজরাটের রাজনীতি জগতের নামকরা ব্যক্তিত্ব প্রায় সকলেই প্যাটেল। তম্মধ্যে হিরন্ময় দ্যুতিতে দেদিপ্য যিনি তার নাম সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। বৃটিশদের হটিয়ে ভারতকে স্বাধীন করতে জীবনভর যে সব রাজনীতিবিদ লড়াকু হয়ে সংগ্রাম করেছেন বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। ফলে কিশোর কালে স্কুল ছাত্র হয়েও এ নামটির সাথে আমি পরিচিত ছিলাম। শুধু এই প্যাটেল নয় গুজরাটের আরেক প্যাটেলও বেশ খ্যাতিমান। তিনিও বল্লভভাই প্যাটেলের মত রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বেশ উচ্চ সারির একজন নেতা। ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মিসেস সোনিয়া গান্ধীর পলিটিক্যাল সেক্রেটারী। তার নাম আহাম্মদ ভাই প্যাটেল। আশির দশকে আমি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্ণাটকের কর্ণাটক ইউনিভার্সিটিতে গেলাম পিএইচডি করতে। সেখানে ল্যাব-ম্যাট হিসেবে পেলাম সুহাশ পাতিলকে। আমি সুহাশকে বললাম- “তুমি কী প্যাটেল? সুহাশ বললো- “না, আমি পাতিল”। আমি বললাম- “পাতিল আবার কী? আমি তো জানি ভারতে আছে প্যাটেল নামে একটা বংশনাম”। এ বংশনামের বিখ্যাত কয়েক জনের নামও বলে দিলাম, যেমন- ভল্লবভাই প্যাটেল, আহাম্মদ ভাই প্যাটেল, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নীতিন প্যাটেল, এ সব। সুহাশ আমার কথা শুনে হাসলো। তারপর বললো- “এখন জেনে রাখ ভারতে প্যাটেল নয় শুধু পাতিলও আছে; এই যেমন আমি, আমাদের ডীন প্রফেসর যশোভন্ত পাতিল, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর সুরেশ পাতিল, এ রকম”। এটুকু বলে সুহাশ থেমে যায়নি। সুহাশের বর্ণনা থেকে জানলাম পাতিল বংশনামটি বহু কাল আগে থেকে সে দেশে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাতিল অর্থ হেডম্যান। পাতিলের মুখে হেডম্যান শব্দটি শুনে আমার মনে পড়ে গেল বাংলাদেশের রাঙামাটি খাগড়াছড়ি অঞ্চলের হেডম্যানদের কথা। ওখানেও পার্বত্য অবাঙালী অধ্যুষিত জনবসতিতে দেখা যায় হেডম্যান, কর্ণাটকের হেডম্যানদের মত। পার্থক্য এই, কর্ণাটকের গ্রামের হেডম্যানদেরকে হেডম্যান না বলে কান্নাড়া ভাষায় বলা হতো পাতিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে গ্রাম প্রধানদের জন্য ইংরেজ শাসকরা পার্বত্য অধিবাসিদের ভাষায় তকমা ঠিক না করে ইংরেজি ভাষায় তকমা ঠিক করলেন হেডম্যান। বাংলাদেশে ইংরেজদের দেয়া সেই নাম হেডম্যান এখনও চলছে। কর্ণাটকের হেডম্যানদের উপর দুইটি দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। দায়িত্ব দুইটির একটি হলো – গ্রামে আইনের শাসন বজায় রাখা এবং অপরটি হলো খাজনা আদায় করা। সংগৃহিত খাজনার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ যেত পাতিলের ভাগে। ফলে পাতিল পরিবারগুলোকে কখনো আর্থিক সংকটে পড়তে হতো না।
তারা বেশ আরামে দিন পার করতো। কিন্তু সে ধারা সবাই শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি। ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে তারা খাজনা আদায়ের ক্ষমতা হারালো। অর্থ আয়ের সে পথ বন্ধ হয়ে গেলে তারা অর্থ সংকটে পড়ে গেল। এদের অনেকেই অর্থ বিত্ত থাকা সত্তে¡ও শুধু খেয়ালের বশে শিক্ষা থেকে দূরে ছিল। শিক্ষা বিবর্জিত পাতিল পরিবারগুলো তাই অর্থ সংকটে পড়লো নিদারুণভাবে। দ্বিতীয় কাজটি অর্থাত খাজনা আদায়ের কাজটি ইংরেজ শাসনামলে বাংলার জমিদাররা করতো। কর্ণাটকের এই সব হেডম্যানদের হেডম্যানশিপ একসময় চলে গেল। কিন্তু তারা তাদের পাতিল উপাধিটা বর্জন না করে রেখে দিল। বংশ পরম্পরায় পাতিল উপাধিটা নামের শেষে নামের অংশ হিসেবে এখনও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এরা নামের শেষে পাতিল লাগিয়ে প্রকাশ করে যাচ্ছে যে সমাজে তারা উচ্চ শ্রেণীভুক্ত। সুহাশ পাতিলের কথায় বুঝলাম পাতিলরা বরাবরই ক্ষমতাবান ধনীক শ্রেণীর মানুষ।

কর্ণাটকের এক গ্রাম থেকে উঠে আসা সুহাশ উদার মনের বেশ বন্ধু বত্সল একটা ছেলে। আমি তার খুব প্রিয় একজন মানুষ হয়ে উঠলাম অল্প সময়ের মধ্যে। সুহাশের গ্রামের বাড়ি কর্ণাটক ইউনিভার্সিটি থেকে আড়াই/ তিন ঘন্টার বাস জার্নি। সুহাশের মা-বাবা গ্রামের বাড়িতেই থাকে। সুহাশের খুব ইচ্ছা আমি একবার ওদের গ্রামের বাড়ি যাই। আমার আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সে সব সময় বলতো ওদের গ্রামটা খুব সুন্দর, বাস জার্নিটাও নাকি চমত্কার; আমার নাকি খুব ভালো লাগবে। যাবো যাচ্ছি করে কেটে গেল দুই বছর। তারপর একদিন বললাম- “সুহাশ, আমি তোমার গ্রামে যাবো”। সুহাশ খুব খুশি। যাওয়ার দিন-ক্ষণ ঠিক হলো। নির্দিষ্ট দিনে সকাল বেলায় আমরা বের হলাম। বাসে উঠলাম। বাস ভর্তি যাত্রী। বলে রাখি, বাসটা ছিল লোকাল বাস। বাস চলছে। কন্ডাক্টর ভাড়া নিচ্ছে টিকেট দিচ্ছে। আমাদের সামনের সিটে বসা একটা লোককে নিয়ে কন্ডাক্টর পড়লো সমস্যায়। লোকটা কিছুতেই তার জামার বুক পকেট থেকে টাকা বের করে আনতে পারছিল না। লোকটা বার বার চেষ্টা করছে পকেটে আঙুল ঢুকাতে, কিন্তু পারে না। আবার আঙুল ঢুকালেও টাকা চিপে ধরে পকেট থেকে বের করে আনতে পারছে না। কন্ডাক্টর তাড়া দিচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমি সুহাশকে বললাম- কী ব্যাপার? সুহাশ বললো লোকটা বেশি গিলেছে তাই টালমাটাল অবস্থা।

কর্ণাটকে টাউন সিটিগুলোতে পানের দোকানের থেকে মদের দোকান বেশি। মদ খাওয়া কোন গর্হিত কাজ নয় কর্ণাটকে। মদ অত্যান্ত সহজলভ্য একটা পানীয়। ফলে লোকজন যখন তখন কিনছে খাচ্ছে। সে তুলনায় অবশ্য ভারসাম্যহীন অবস্থায় পড়ে যাওয়া লোকজনের সংখ্যা কমই বলতে হবে। দুই একজন পড়ে যায়, এই যেমন বাসের মধ্যে এই লোকটি। কর্ণাটকের মানুষ অতিশয় ভদ্র। এই রকম অবস্থায় কাউকে দেখলেও কেউ কোন সময় রাগ ক্ষোভ বিরক্তি প্রকাশ করে না। এটাকে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় বলে ধরে নেয় এবং নির্লিপ্ত থাকে। যাই হোক, কন্ডাক্টর এবার সেই অসহায় যাত্রীর অনুমতি নিয়ে নিজ হাতে যাত্রীর পকেট থেকে কাগজের নোট বের করে আনলো। যাত্রী কোথায় যাবে তা ভালো করে জেনে ভাড়াটা রেখে বাকি টাকা সুহাশকে স্বাক্ষী রেখে যাত্রীর পকেটে রেখে দিল। এত ভিড় ভাট্টা ব্যস্ততার মধ্যেও কন্ডাক্টর সেই যাত্রীকে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিতে কোন ভুল করলো না। দুপুরের আগে আমরা পৌঁছে গেলাম। যেখানে নামলাম সে জায়গার নাম হাছান। হাছান একটা থানা সদর। বাস আরো দূরে কোথায় যেন যাবে। আমরা দুই জন হাঁটা দিলাম বাড়ির দিকে। বাস স্ট্যান্ড থেকে সুহাশদের বাড়ি এক কিঃ মিঃ-এর বেশি হবে না। অনেকক্ষণ বসে ছিলাম বাসে তাই হাঁটতে ভালোই লেগেছিল। পৌঁছে গেলাম বাড়িতে। রাস্তার পাশেই বাড়ি। বাড়ি কি, একটা বিরাট ঘর। কোন সীমানা দেয়াল নাই, ঘরের সামনে উঠান নাই। রাস্তা থেকে দুপা ফেললেই ঘর, ঘর থেকে দুপা ফেললেই রাস্তা। চারদিক খোলা। ঘরের দেয়াল সব মাটির। পুরো ঘরটার উপরটা টিন দিয়ে ঢাকা।

ভিতরেও মাটির দেয়ালে চিহ্নিত সব কক্ষ। তবে কোন কক্ষেই দরজা নাই, পর্দা আছে। দরজা মাত্র দুইটি একটা ঘরের সামনে, আরেকটা একেবারে পিছনে। পাকের ঘরও বড় ঘরটার মধ্যে; আলাদা নয়। আমি চুরি চামারির কথা তুললাম। সুহাশ অত্যান্ত গর্ব করে বললো ওসব ওদের দেশে নাই। শুনে আমি কিছুটা লজ্জা বোধ করলাম আমার নিজের দেশ বাংলাদেশের কথা মনে করে। ঘর রাস্তা সবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দেখে খুব ভালো লাগলো। ঘরে ঢুকলেই প্রথম রুমটা গেস্ট রুম। আমি গেস্ট রুমে বসলাম।

কিছুক্ষণ পর সুরেশের মা এলো। আমি চেয়ারে বসা ছিলাম। সুহাশ মা বলতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার মা যা করলেন তা আমি আশা করাতো দুরের কথা কল্পনাও করিনি। তিনি শাড়ির লম্বা আঁচল মাথার উপর টেনে ঘোমটা দিলেন আর আঁচলের বাকি অংশ গলায় পেঁচিয়ে মাথাটা বেশ নুইয়ে দুই হাত জোড় করে আমাকে নমস্কার বললেন। আমি তার ছেলের বন্ধু এবং তিনি জানেন আমি মুসলমান। তারপরও তিনি আমাকে ওখানকার প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অভিবাদন জানালেন। তিনি যেভাবে অভিবাদন করছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল তিনি বধু আর আমি শ্বশুর সম্পর্কের কেউ। আমি সুহাশকে পরে বললাম এমন করে তিনি অভিবাদন জানাবেন আমি ভাবিনি। আমি খুব লজ্জা বোধ করেছি। সুহাশ বললো- “পাতিল সমাজে ছেলের বিবাহিত বন্ধুরা মায়ের নিকট থেকে এভাবে সম্মান পান। তুমি যে বিবাহিত তা আমি মাকে বলেছি”।

তারপর গ্রাম দেখতে বের হলাম। অনুচ্চ সব পাহাড় আর নিচু উপত্যকা নিয়ে পরিচ্ছন্ন এক গ্রামাঞ্চল। পাহাড়গুলো অন্যরকম। লতা-গুল্ম বৃক্ষহীন; শুধু ছোট ছোট দুর্বা ঘাসে ঢাকা। মাটিতে জলকণা কম, শুস্ক মাটি। চলাচলের জন্য আছে পাকা রাস্তা। বেশ সুন্দর। কিছুক্ষণ হাঁটার পর পেলাম একটা জায়গা যেটির সীমানা ইটের অনুচ্চ দেয়াল দ্বারা চিহ্নিত। এটা কী জানতে চাইলে সুহাশ বললো- “এ জায়গায় মুসলমানেরা শুক্রবার দিন জুমার নামায পড়ে”। বুঝলাম মসজিদের বিকল্প। তার পাশেই একটা মন্দির। আমি জানতে চাইলাম মুসলমানের সংখ্যা কেমন। সুহাশ বললো- “তা বেশি নয়; ১২% থেকে ১৫% হবে”। শহরের মন্দিরগুলোতে দেখি সব সময় উপাসকের আসা যাওয়া। এ মন্দিরে কিন্তু সে সময় কাউকে দেখলাম না। যদিও মন্দিরের দরজা ছিল খোলা। শুধু মন্দির যে উপাসকহীন তা নয় রাস্তায়ও কারও দেখা মিললো না।

একেবারেই জনমানবহীন। শুধু আমরা দুইজন মানুষ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। বাহিরে ঘুরা ঘুরি করে আমরা ঘরে ফিরলাম। খাওয়ার সময়। খাওয়া রেডি। সুহাশ আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে ঢুকলো তাদের রান্না ঘরে। দেখি মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। সুহাশের মা একটা পিড়িতে বসে আছেন সব খাবার দাবার সামনে পাশে নিয়ে। আমি রান্না ঘরে ঢুকেই ভাবতে থাকলাম- এ কেমন কথা! আমি একজন মুসলমান, আমাকে নিয়ে এল রান্না ঘরে! এ বসার ব্যবস্থাটাতো গেস্টরুমেও করতে পারতো। কোথায় জাত-পাত! কোথায় হিন্দু-মুসলমান!

আমি অবাক হলাম সুহাশদের উদারতা দেখে। সুহাশের মায়ের কাছে এখন আমি আর সুহাশ দুজন যেন তার দুই সন্তান। দুজনকে তিনি একসাথে পাশাপাশি বসিয়ে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। আমার দুচোখ ভিজে উঠলো। সেই বহু দুরে বাংলাদেশে ফেলে আসা আমার। মাকে মনে পড়লো। অন্য সব হিন্দু পরিবারের মত সুহাশদের পরিবারও নিরামিষভোজী। এরা মাছ – মাংস খায় না। সুহাশের মা আমার জন্য বাদাম দিয়ে (বাদাম বাটা) ডিম রান্না করেছিলেন; সাথে ঐতিহ্যবাহী নানা রকম সবজী আর ডালতো ছিলই। বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলাম সব। ওদের ভদ্রতা, আন্তরিকতা, উদারতা, আচার ব্যবহারে বুঝলাম ওরা আসলে উচ্চ বংশের মানুষ। পাতিল বংশ উচ্চ বংশ সুহাশ পাতিলের এ দাবি যথার্থ।