ফারহানা আজিম শিউলী: টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র সাতচল্লিশতম ভার্চুয়াল আসরটি নভেম্বর মাসের ষোল তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এই আসর একইসঙ্গে ছিল পাঠশালার সপ্তম বর্ষপূর্তি আসরও। এবারের আলোচক ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্রমে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেবার পথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পোস্টারশিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তী এবং সমকালীন কথাসাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও পাঠকপ্রিয় লেখক সুহান রিজওয়ান।

শিক্ষার্থী-জনতার এক অভ‚তপূর্ব ও রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী-লুটেরা-স্বৈর সরকারের পতন হয়েছে ৫ আগস্ট ২০২৪। ভিন্নমত দমন, অদৃশ্য ভয় আর স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল দেয়াল, সমতল থেকে পাহাড়, সর্বত্র। এই আন্দোলনে প্রবলভাবে শামিল হয়েছিল পুরো দেশের দেয়াল জুড়ে আঁকা গ্রাফিতি। বহুদিনের অনুচ্চারিত ক্ষোভ যেমন ভাষা পেয়েছে, তেমনি গ্রাফিতি সহ পোস্টার, র?্যাপ ইত্যাদি আন্দোলনের একরকম নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে।

ওদিকে এবারের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা ২০২২ সালে প্রকাশিত সুহান রিজওয়ানের লেখা “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” নামের ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসটিতে দেখা যায় ভবিষ্যতের কল্পিত বাংলাদেশের কথা, যেখানকার বিদ্যমান স্বৈরশাসনে ভিন্নমতের জায়গা নেই, আছে দমনমূলক আইন, পীড়ন। সেই দমবন্ধ করা-ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশেও অজ্ঞাতপরিচয় এক শিল্পী দেয়ালে দেয়ালে এঁকে চলে নিষিদ্ধ গ্রাফিতি। একসময় দীর্ঘদিন জেঁকে বসা প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসকের পতন ঘটে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে।

‘পাঠশালা’র এবারের আসরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অনুসঙ্গ গ্রাফিতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মাত্রা সহ আরো নানা অনুসঙ্গের সংলগ্নতার কথা এবং সমকালের গণচৈতন্য “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাসে রূপ পাবার কথা তুলে ধরেন আলোচক সুহান রিজওয়ান ও দেবাশিস চক্রবর্তী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গ্রাফিতি প্রসঙ্গে দেবাশিস বলেন, “আমরা এই নভেম্বর মাসে এসে গ্রাফিতিগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখব, পুরো আন্দোলনের সময় জ্ঞানে এবং অজ্ঞানে বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠী যা কল্পনা করছিল, যে আকাঙ্ক্ষা তার ভেতর জমা হচ্ছিল সেগুলো লিপিবদ্ধ অবস্থায় আছে দেয়ালে। আমাদের যদি নানা বৈষয়িক হিসাব নিকাশের কারণে দ্বিধা তৈরি হয়, তাহলে আমরা গ্রাফিতিগুলোর দিকে ফেরত যেতে পারি।

“গ্রাফিতি একটা পশ্চিমা পরিভাষা। গ্রাফিতি কেমন হয় সেই ধারণাটাও পশ্চিমা। কিন্তু পশ্চিমে এর চর্চা শুরু হলেও সঙ্গতকারণেই সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষ গ্রাফিতিকে তাদের মতো করে আত্মীকৃত করে নিয়েছে, ব্যবহার করেছে। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া সহ অনেক জায়গায়ই গ্রাফিতির ব্যবহার হয় এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কেন্দ্রস্থলগুলোতেও মানুষ তাদের প্রয়োজনে গ্রাফিতি ব্যবহার করে। আর শব্দগতভাবে গ্রাফিতি এসেছে ইতালীয় শব্দ থেকে, যার গ্রিক উৎস থাকলেও থাকতে পারে। গ্রাফিতি কোন নান্দনিকতার প্রশ্ন না। এটা রাজনৈতিক এবং “এ কোশ্চেন অফ সারভাইভেল” বা প্রতিরোধের প্রশ্ন, যা মানুষ এঁকেও করতে পারে বা লিখেও করতে পারে। এবং সেটার অবস্থান হতে হবে পাবলিক পরিসরে, ঘরের ভেতরের দেয়ালে না, যেখানে সংঘবদ্ধ অবস্থায়-সামষ্টিকভাবে মানুষ দেখতে পাবে।

“বাংলাদেশের মানুষ নজিরবিহীন নিপীড়নের ভেতর ছিল গত অন্তত ১২ বছর। একটা ভয়ের সংস্কৃতি চেপে বসে মানুষকে অসাড় করে রেখেছিল। এবং জনগোষ্ঠীর ভেতরের সক্রিয় সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও নিপীড়িত অবস্থায় চুপচাপ ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জুলাইয়ের ১৬ তারিখ নাগাদ আসা কিছু উচ্চারণ এবং আগে থেকে পরিকল্পিত না এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ চুরি করে লুটপাট, খুন আর গুমের রাজত্ব কায়েম করা স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ধ্বস নামতে শুরু করে। সেই মুহূর্ত থেকে খেয়াল করলে দেখব, আমাদের দেয়ালগুলোতে যেই কথাগুলো আসছে, সেগুলো আবেগের, একইসাথে চিন্তারও। সামষ্টিকভাবে আমরা কী চিন্তা করছি, কী আকাঙ্ক্ষা, আমরা এই নিপীড়কের বাইরে কী চাই, কী কল্পনা করি, কেমন রাষ্ট্র চাই, সব দেয়ালে লিপিবদ্ধ আছে। এটা আসলে সিভিল ইমাজিনেশন। বুঝে না-বুঝে। আমরা কীভাবে শাসিত হব এবং যারা আমাদের শাসন করবেন তাদের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, সব দেয়ালে লিখেছে মানুষজন। এসব একেবারেই আগে থেকে বুদ্ধি করে লেখা না। প্রতি মুহূর্তে তারা আবিষ্কার করেছে। এর চেয়ে অর্গানিকভাবে আর হওয়া সম্ভব না। আর আমরা সবাই জানি যে, আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন তো ছিলই, কিন্তু তার বাইরে সাধারণ মানুষরা এই ছবি আঁকতে আঁকতে, লিখতে লিখতে তাদের সামনের পরাক্রমশালী দানবের সাথে লড়াই করার শক্তি সঞ্চয় করেছে। বলে রাখা দরকার, শক্তি সঞ্চয়ের একটা মূল জায়গা কিন্তু মিছিলে।

“আন্দোলন-সংগ্রামে গ্রাফিতি যে বৈশ্বিক পরিসরে মোবিলাইজ করে, এর সাথে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতির সরাসরি তুলনা করা যাবে না। পৃথিবীর অন্য সব আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে জীবন দেয়ার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু আমাদের আন্দোলনের সাথে জীবন দেয়ার প্রশ্ন ছিল এবং আমরা জীবন দিয়েছিও। খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়েছে এইসব ছবি আঁকতে আঁকতে, এগুলো লিখতে লিখতে। শুধু নান্দনিকতা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। এটা মানুষের অস্তিত্বের গভীরতম প্রশ্ন এবং গভীরতম অভিব্যক্তি। তাই শুধু শিল্পকলার ইতিহাস দিয়ে একে বুঝতে গেলে ভীষণরকম বোকামি হবে এবং আমরা কিছুই বুঝতে পারব না। আমরা জানি, সারা দুনিয়ায় অনেকগুলো সংকট এই মুহূর্তে বিদ্যমান। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ চলছে। বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন চলছে। এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। সেইসব আন্দোলনের কথা, আন্দোলনের ছবি আসছে। কিন্তু সেগুলোতে মানুষজন সফল হয়নি। আমরা সফল হয়েছি অংশত এবং প্রাথমিক অর্থে। এর ব্যাপ্তি কতটা হবে, এর বাস্তবায়ন কতটা হবে তা ভবিষ্যতে আমাদের সামষ্টিক কাণ্ডজ্ঞান এবং তৎপরতার ওপর নির্ভর করবে।

“গ্রাফিতি মানে তো শুধু ছবি না, লেখাও গ্রাফিতি। আন্দোলনের শুরুর দিকে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং তাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো তাদের সব কথা মান্য করে হত্যাযজ্ঞ সহ সব অন্যায় চালাচ্ছিল, ঐ সময়ের গ্রাফিতিগুলো হচ্ছে গ্রাফিতির ক্ল্যাসিক উদাহরণ। অসম ক্ষমতা সম্পর্কে নিপীড়িতের কথা যেহেতু মিডিয়া বলবে না, কেউ বলবে না, কেউ শুনবে না, কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে। তাই গেরিলা কায়দায় সে দ্রুত একটা জায়গায় যাবে, দ্রুততম উপায়ে কোন একটা স্প্রে পেইন্ট বা কাটআউট নিয়ে স্টেনসিল করে ছবিটা এঁকে বা কথাটা বলে চলে যাবে। যদি সমাজে সেই মাত্রায় নিপীড়ন বিদ্যমান না-থাকে, তাহলে ঐভাবে বলার দরকার পড়ে না। নিপীড়ন ছিল। আমরা একদমই কথা বলতে পারিনি। এখনও সবটুকু পারি না ঐ অর্থে। ৫ আগস্টের আগের সময়টাতে ছিল গ্রাফিতির ক্ল্যাসিক এবং সবচেয়ে মোক্ষম উদাহরণ। তা আমাদের তত্ত¡ায়ন করতে হবে এবং এগুলো নিয়ে সামনে আগাতে হবে। বিস্তৃত ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে, কারণ আমাদের সামনে প্রমাণ হাজির আছে। ৫ আগস্টের পরে যা আঁকা-লেখা হয়েছে, সেখানটায় কিছুটা নান্দনিকতার লক্ষণ এবং শরীরী উপস্থাপন দেখা যায়। এবং খেয়াল করলে দেখব, সব শরীরের এনাটমি কিন্তু খুব একটা নিখুঁত না, হওয়ার দরকারও ছিল না। কারণ আমরা বুঝতে পারি, যারা এগুলো করেছে তাদের শৈল্পিক প্রশিক্ষণ নেই। তারা এসেছে অন্য একটা আবেগের জায়গা থেকে, যেটা আরো গভীরতর। তাদেরকে আসতে হয়েছে।

“গ্রাফিতিগুলোর কথা খেয়াল করলে দেখা যায়, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যেই কথাগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, কাজী নজরুল ইসলাম যেই কথা ব্যবহার করেছেন, জহির রায়হান যেই কথা ব্যবহার করেছেন, সেগুলো আমরা আবার ব্যবহার করেছি। ৭১ এর যে জনযুদ্ধ নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে, সেই যুদ্ধের অনুপ্রেরণা আমরা ব্যবহার করেছি। ২৪ একা না, ৫২-৬২-৬৯-৭১ সহ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের যেই লড়াকু ঐতিহ্য এবং যে অভিজ্ঞতা জ্ঞানে ও অজ্ঞানে জমা হয়ে ছিল আমাদের প্রজন্মগুলোর ভেতর, তার বাঁধ খুলে গেছে। এর লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রাফিতিগুলোতে।”

“গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাসে গ্রাফিতির অনুপ্রেরণা নিয়ে সুহান বলেন, এদুয়ার্দো গালিয়ানোর ভাষ্যে “দেয়াল হচ্ছে শোসিত মানুষের প্রকাশক।” ওদিকে ২০১৬-১৭ সালের দিক থেকে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে অজ্ঞাতনামা শিল্পীর আঁকা সুবোধের গ্রাফিতিকে ঘিরে অন্য অনেকের মতো তাঁর মনেও আলোড়ন ওঠে। এই দুই মিলে গ্রাফিতির অর্থ ধরা দেয় এমনভাবে — এটি এমন ধরনের দেয়ালচিত্র যা আমাদের মনে অস্বস্তির জন্ম দেয়, যা কোন অপ্রাপ্তি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে। এবং সর্বোপরি গ্রাফিতি শব্দটা সেন্সরশিপের যে বোধ তৈরি করে, “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” সেই ভাবনাটার সাথে বোঝাপড়া।

“গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সুহান জানান, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর আত্মপ্রকাশ এবং একই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজীব্য করে তাঁর লেখা উপন্যাস “পদতলে চমকায় মাটি” প্রকাশের সময় মানুষের মত প্রকাশে ভয়ের ব্যাপারটা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা, আর সেইসাথে সেন্সরশিপকে তিনি লেখার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন।

সুহান বলেন, “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে”র দুটো ভরকেন্দ্র। প্রথমটা হচ্ছে সেন্সরশিপের অধীনে লেখক-শিল্পীর শৈল্পিক দ্বিধা। দ্বিতীয়টা হচ্ছে কর্তৃপক্ষের আরোপিত সেন্সরশিপ কীভাবে একটা সমাজের শিল্পীদের নিয়ন্ত্রণ করে। উপন্যাসে দেখা যায়, ভবিষ্যতের বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের ক্ষমতাকাঠামো সেখানে বিদ্যমান। উপন্যাসের একটা পর্যায়ে এই ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ করে, রাজপথে নামে, মিছিলে পুলিশের গুলি চলে, পুলিশ রাস্তায় নামে। এরপর যা ঘটে তার অনেকটুকুই আমরা দেখেছি ২০২৪ সালে।

“গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাস নিয়ে দেবাশিস বলেন, সুহান রিজওয়ান ২০২২ সালে “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাস লিখেছেন, একটা স্বৈরাচারী সরকার গেঁড়ে বসে থাকা অবস্থাতেও। তখন কারো কল্পনায় ছিল না আমরা কীভাবে মুক্তি পাব বা আদৌ কি আমাদের সামনে মুক্তির সম্ভাবনা আছে কিনা। ঠিক এইরকম সময়ে একজন শিল্পী-লেখকের ভেতর সমাজের ঘটনাগুলো জমা হয়, অজ্ঞানে জমা হয় এবং সেটা তাকে কোন না কোনভাবে প্রকাশ করতে হয়। “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে”তে একজন লেখক একটা পরাক্রমশালী ক্ষমতাকাঠামো এবং স্বৈরাচারের পতন কল্পনা করেছেন বাংলাদেশে বসে ২০২২ সালে। সমাজে এই বাস্তবতা না-থাকলে তিনি লিখতেন না। এই গণ অভ্যুত্থানের উপযোগিতা নিয়ে এখন যারা প্রশ্ন তুলছেন, শৈল্পিক দিক থেকে এটার একটা মোক্ষম জবাব সুহান রিজওয়ানের এই উপন্যাস। এবং এই লেখককে বিতর্কিত করার কিংবা খারিজ করারও সুযোগ নেই। আমাদের সমাজে আগে থেকেই গণঅভ্যুত্থানের কল্পনা হাজির ছিল। সাপ্রেসড অবস্থায়, অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়, কিন্তু ছিল। “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” একটা শৈল্পিক উদাহরণ, এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক নানা আয়োজনেও গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কিত শব্দগুলো জারি ছিল। কিন্তু কেন? গনঅভ্যুত্থান তো কোন ছেলেখেলা না। এখানে জীবন দানের ব্যাপার ছিল। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিচ্ছে এবং যারা ঐ মুহূর্তে আন্দোলনে যুক্ত ছিল, তারা কোন না কোনভাবে জানত তারা বৈষয়িকভাবে এবং প্রাণের সংশয়ে আছে। এই বিষয়টা আমাদের খেয়াল রাখা দরকার। এবারের গণঅভ্যুত্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ? রাজনৈতিকতা ও গণতান্ত্রিকতা এবং ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা থাকলেই বোঝা যায় যে, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল নিজেরাই। এইরকম একটা মুহূর্তে জনগোষ্ঠীর নিজের দায়িত্বে ক্ষমতার পালাবদল করা ছাড়া আর কোন পথই খোলা ছিল না।

দেবাশিস বলেন, “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাসে আমরা ঋজুশির নামে এক শিল্পী চরিত্র পাই, যে প্রচণ্ড ভয়ের পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন পীড়নে যেখানে মানুষের মাথা পর্যন্ত চলে যায় এমন প্রযুক্তির উপস্থিতিতে, যখন কেউ কিছু বলতে পারছে না এমন সময় — গ্রাফিতির মাধ্যমে কিছু ভিজ্যুয়াল কল্পনা হাজির করে। সেই কল্পনাগুলো কোন অর্থেই অতিবিপ্লবী না। খুব সাধারণ কথা বলে, মুক্তির কথা বলে সেইসব কল্পনা। সে ভয়ের রাজত্বের ভেতরে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়। ওখানে তখন একটা ঘটনা ঘটে। গ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা নিম্নবিত্তের এক ছাত্র খুন হয়। এর প্রতিবাদে শাহবাগে ঐ ছেলের বাবা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে আগুন রূপকার্থে আর আগুন থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে তা বাস্তবের জমিনে। মানুষজন পথে নেমে আসে এবং তারা লড়াই-সংগ্রাম করে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কের বাসা পর্যন্ত গিয়ে আক্রমণ করে তার পতন ঘটায়। এটাই ক্ল্যাসিক গণঅভ্যুত্থান এবং এটাই আমরা হতে দেখেছি ২০২৪-এ। পুরো উপন্যাসটা খেয়াল করলে দেখা যায়, শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যুক্ত এক মধ্যবিত্ত ছেলে যে উপন্যাস লিখতে চায়, এটা তার লেন্স থেকে দেখা ঘটনা। এখানে গণঅভ্যুত্থান যে হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে এই খবরগুলো আমরা জানতে পাই কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ভেতরে ঢুকতে পারি না। মধ্যবিত্ত সেই যুবকের পক্ষে তা সম্ভবও ছিল না। কারণ যারা গণঅভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে, সে সেই শ্রেণির মানুষ না। গণঅভ্যুত্থানের যে স্পিরিট লাগে এবং যেই রুহানি শক্তিতে পরমের সাথে সম্পর্ক নিয়ে লোকে প্রাণ দিতে যায়, সে ঐ শ্রেণির মানুষ না। যেই ছেলেটা জানে যে সামনে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে অটোমেটিক রাইফেল হাতে, আরেক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ, কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে গুলি তাক করে হয়তো বাংলাদেশেরই নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য কোন স্নাইপার- এই পরিস্থিতিতে জীবন দিতে সে কেন যায়? সে তো জানে না সে সফল হবে। বাংলাদেশের মানুষ এইভাবে জীবন দিতে দিতেই পরমের সাথে সম্পর্কিত হয়েছে। উপন্যাসের যেই লোকটা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় সে কিংবা ছাত্র-জনতা সফল হতে হয়তো পারবে না জেনেও কীভাবে পরাক্রমশালী শক্তির সাথে লড়াই-সংগ্রাম করে এসবের নজির আমরা “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে”তে দেখতে পাই। একটা জিনিস আমাদের পরিষ্কার করে ফেলা দরকার যে, গণ অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি বাংলাদেশে হাজির ছিল। নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আমাদের শিল্পী-লেখকদের ভেতরেও যে তা জমা হচ্ছিল তার প্রমাণ সুহান রিজওয়ানের উপন্যাস। এই লেখার অনেক শৈল্পিক সমালোচনা হয়তো করা যাবে, কিন্তু এই ব্যাপারটাকে অস্বীকার করা যাবে না।

মাধ্যম হিসেবে গ্রাফিতি ও সাহিত্য সম্পর্কে সুহান বলেন, প্রত্যেক শিল্পমাধ্যমের নিজস্ব একটা গতি থাকে। গ্রাফিতির ব্যবহারটা পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। আর এই জিনিসটা শিল্পের পক্ষে উৎপাদন করা সম্ভব কি না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে গ্রাফিতি যেই অভিঘাত তৈরি করে, সাহিত্য যদি লেখালেখিতে সৎ হয়, সময় সময় কোন সাহিত্যও, যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাইয়ের একটা দৃশ্যের বর্ণনা একইরকম অভিঘাত তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ মাধ্যম হিসেবে একদম ভিন্ন হলেও গ্রাফিতি ও কোন সাহিত্যের অভিঘাত সমতূল্য হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে।

“অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা” জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা, অন্যতম স্পিরিট, যার প্রতিফলন আমরা দেখেছি গ্রাফিতিতে, কিন্তু এর কতটা দেখছি গণঅভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে- এ প্রসঙ্গে দেবাশিস বলেন, বোঝাই যাচ্ছে যে, অভ্যুত্থান পরবর্তী কিছু নাশকতা এবং বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার কারণে উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে মানুষের ভেতর। এটা খুব স্বাভাবিক। একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে যে, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায়-বিরল একটা ঘটনা ঘটে। পুলিশি আউটপোস্ট থানা এসব খালি হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এবং ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে কোন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না-থাকাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রচুর ঘটনা ঘটেছে তখন আমরা চাই আর নাই চাই। যে ঘটনাগুলোর তদন্ত করে বিচার করা উচিত। তবে পরিস্থিতি আরো অনেক খারাপ হতে পারতো। কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেল? সেনাবাহিনী ছিল কিছু জায়গায়। সেনাবাহিনী ঠিকমতো কাজ করতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে কিংবা বলা চলে, আকাঙ্ক্ষা আরো বেশি ছিল। এর মধ্যে শুরুর দিকে ছিল র-এর জ্বর, তারপরে ডাকাত, তারপরে আরও অনেক ঘটনা। বিভিন্ন পাড়ায়-মহল্লায় বাংলাদেশের মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে এগুলো প্রতিরোধ করতে হয়েছে। অন্তর্ভুক্তি না-হলে এইধরনের প্রতিরোধ মানুষ একসাথে করতে পারত না। এটাই গণ অভ্যুত্থানের নগদ প্রাপ্তি। কিন্তু বাংলাদেশ সমাজে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আগে থেকেই বৈষম্য আছে। এটা এই আন্দোলনের ফলে নতুন করে তৈরি হওয়া বিষয় না। এর মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বিশাল প্রচারণা চলেছে। হয়তো যেইভাবে ভারতীয় মিডিয়া বা অন্যান্য মিডিয়া প্রচার করেছে সেভাবে না-হলেও কিছু ঘটনা তো ঘটেছেই বাংলাদেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে। সেগুলো আমরা ঠিকমতো সামাল দিতে পারিনি বা আমাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা এবং সেইসব ঘটনার বিচার নিশ্চিত করা এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভেতরের উদ্বেগ দূর করার দায়িত্বটা আমাদেরই। এখন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা তৈরি হবে কি হবে না, এটা আন্দাজ করা একটু মুশকিল। গ্রাফিতি বা দেয়াললিখনগুলোর দিকে খেয়াল করা দরকার আবারও, এবং যারা লিখেছে তাদের দিকেও। সজ্ঞানে অনেকে লিখেছে, অনেকে বাস্তবের সাথে লিপ্ততা থেকে অর্জন করে নিয়েছে, রোজগার করে নিয়েছে। প্রত্যেকটা আকাঙ্ক্ষা- কীভাবে আমি শাসিত হবো, আমার শাসকের চরিত্র কী হবে, রাষ্ট্রের চিহ্নায়ন কী হবে- লেখা আছে আমাদের দেয়ালে। সেখানটায় লক্ষ্য একটাই — বাংলাদেশ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের কল্যাণ করতে পারবে এরকম একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা চাই। রাষ্ট্র মাত্রই নিপীড়ক একটা সত্ত¡া কিন্তু নিপীড়নও মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল পতিত স্বৈরসরকারের সময়কালে। বাংলাদেশে ছিল মারণ রাজনীতি। যেখানে আওয়ামীলীগ এবং দু-একটা পরিবারের কাছের লোক ছাড়া সবাই ছিল বধযোগ্য প্রাণ। এর থেকে মুক্তি সবাইকেই পেতে হবে এবং আগের থেকে আমাদের সাংস্কৃতিক কারণে যে কিছু ভেদাভেদ আছে, সেগুলো আমাদের এড্রেস করতে হবে, সেগুলো নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। প্রত্যেকটা পক্ষেরই কিছু ন্যায্য উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা আছে। আগে ভিন্ন ভিন্ন পক্ষের মানুষজন কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারত না। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঐ পরিস্থিতি কিছুটা লাঘব হয়েছে। আমরা কথা বলতে পারছি। অনেক উদ্যোগ-আয়োজনে দেখছি এমন পক্ষের মানুষজন আসছে, যাদের কখনোই আমরা একসাথে দেখার কথা কল্পনাও করতে পারিনি। এটা মাত্র শুরু। ৫০ বছর ধরে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেসবের সমাধান এক মুহূর্তে সম্ভব না। গণঅভ্যুত্থানের কারণে কিছু সমস্যার নগদে সমাধান হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে প্রাথমিক শান্তি লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা নিরসনে প্রত্যেক বর্গের মানুষের সাথে কথা বলার ভাষা তৈরি করতে হবে। মোদ্দা কথা এটাই, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ মানে সেক্যুলার-ধর্মপ্রাণ-নাস্তিক ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার সমাজ। যেমন, আমরা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি দেখেছি। ক্যালিগ্রাফি-শিল্পী কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতিকে মেরে কেটে সমান করে ফেলার জন্য আসেনি। সে এতোদিন করার সুযোগ পায়নি, সুযোগ খুঁজছিল, সুযোগ পেয়েছে এখন, তাই এঁকেছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে লেখক-শিল্পীদের একটা বড় অংশের “অপ্রাসঙ্গিক” হয়ে পড়া প্রসঙ্গে সুহান বলেন, যে লেখক সমকালের স্পন্দন বুঝতে পারে না, সে আদতে মৃত লেখক। যেমন বলা যায় এবারের আন্দোলনে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ভ‚মিকার কথা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই দেখা যায়, শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটা বড় অংশ স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে গণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে। প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যার পরেও তাদের পক্ষ পাল্টায়নি। কেন তাদের এমন অবস্থান? তারা ইতিহাসের হাতসাফাইটা ধরতে পারেনি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ এর তুমুল ক্রান্তিকালে কিছু মানুষ পথ হারিয়েছিল এভাবেই। অথচ তারাও একদা রাস্তায় নেমেছিল, ‘হাত মে বিড়ি, মু’মে পান, লড়কে লেঙে পাকিস্তান’ বলে হাসিল করেছিল একটি রাষ্ট্র। ফলে, উনিশশো সত্তর কি একাত্তরে নতুন দিনের চ্যাংড়া পোলাপান যা করছে, তাতে তাদের আস্থা ছিলো না মোটেই। বলা বাহুল্য, তাদের সকলেই বৃদ্ধ ছিল না। কিন্তু আইয়ুব আর ইয়াহিয়া যত যাই করুক, অত কষ্ট করে ২৪ বছর আগে যে পাকিস্তান অর্জন করা হয়েছে, সেটা আবার ভাঙা মানে তো এই মানুষদের সারাজীবনের কিংবা প্রথম তারুণ্যের আদর্শটাই ভেঙে যাওয়া! ছাত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারকে যারা সমর্থন দিয়েছে, তাদের অবস্থাও তেমন অনেকটা। ‘জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার’ ঘোষণাপত্রে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো যে রাষ্ট্র, দরবেশ বাবারা সেটা ফাঁপা করে দিয়েছে আগেই। মানুষগুলো তবু শূন্য দালানে একটা-দুটো রড আঁকড়ে তখনও পড়ে ছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিদ্যমান স্বৈরাচার তখনো প্রাসঙ্গিক। সময় বুঝতে না-পারা এই মানুষগুলোর অবস্থা অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের ‘সূর্যের দিন’ উপন্যাসের বড়চাচার মতো, কিংবা ‘গুড বাই লেনিন’ সিনেমার সেই মায়ের মতো। মুসলিম লীগ বড় চাচার জগৎ আটকে গেছিলো সাতচল্লিশে, আর জার্মান সেই মায়ের দুনিয়ায় এখনো বিরাজ করে বার্লিন দেয়াল। কিন্তু সময় ক্ষমাহীন। উনিশশো সাতচল্লিশে পৃথিবীর আবর্তন থামেনি, দুনিয়া শেষ হয়নি বার্লিন দেয়াল ভেঙে যাবার মুহূর্তেও। আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে খেয়ে ফেলার পরেও তাই পৃথিবী এখনো ঘুরে যাচ্ছে। নতুন বাংলাদেশে “প্রাসঙ্গিক” থাকতে হলে তাই ইতিহাসের ওই হাতসাফাই বুঝেই তাদের নিজের দিকে তাকাতে হবে। তবে ইতিহাসের বাঁকবদলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবার কারণে সেইসব লেখক-শিল্পীরা হয়তো কম চর্চিত হয়, কিন্তু তারপরও নিজেদের কাজ নিয়ে তারা কোথাও না কোথাও থেকে যায়।

জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গ্রাফিতি সহ অন্যান্য অনুসঙ্গ যেমন পোস্টার, রাজনৈতিক কার্টুন, র?্যাপ ইত্যাদির সংলগ্নতা নিয়ে দেবাশিস বলেন, আমরা পুরো ঘটনাটাকে গণঅভ্যুত্থান বলতে পারছি কারণ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন ধর্মের, জাতির যতভাবে পারা যায় বিভিন্ন পার্থক্যসমেত মানুষজন এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, প্রাণ দেবার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। আমরা খেয়াল করে দেখব, এত খুন, এত নিপীড়ন, চোখের সামনে দেখতে পেয়ে অনেকের সামনে বাস্তবতা অনেকদূর পর্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যায়, দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করে। সেসময় অনেক শিল্পী নিজস্ব মাধ্যমে কাজ করেছে। গণঅভ্যুত্থান চলমান থাকায় অনেক শিল্পীর পক্ষে শিল্প-মাধ্যম এবং ফর্মের সীমাবদ্ধতায় থেকেই কাজ করতে হয়েছে। যেমন চাইলেই একটা উপন্যাস লিখে সেই সময় প্রকাশ করে দেয়া যায় না কিংবা একটা সিনেমা করে ফেলা যায় না। যে ফর্মগুলি ঐরকম সময়ে তাৎক্ষণিক উপায়ে বিলিবন্টন করা গেছে, সেইসব মাধ্যমের শিল্পীরা তাই করেছে। আমরা অনেক শিল্পীকে দেখেছি কাজ করতে। তারা তরুণ বয়সী। সবাইকে দরকারও নেই সবসময়। সময় তার নিজস্ব চরিত্র তৈরি করে নেয়, এবারও নিয়েছে।

নতুন ভাষা হয়েছে কি হয়নি সেটা নান্দনিক প্রশ্নের জায়গা। আমরা যখন ফুরসৎ পাব, তখন হয়তো সেসবের আঙ্গিক, কনশাস-আনকনশাস দিক খুঁজে দেখতে পারব, চিহ্নায়ন করতে পারব। গণঅভ্যুত্থানের শিল্প নিয়ে আলোচনা করা, শিল্পে ধরে রাখা সেই সময়ের অনুভ‚তির পুনর্মঞ্চায়ন করা জরুরি। কারণ গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি এখন আর নেই, কিন্তু আকাঙ্ক্ষাগুলো রয়ে গেছে। এবং অনেক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়নি, হয়তো ভবিষ্যতে হবে। ঐ আকাক্সক্ষাগুলো জারি রাখতে হবে।

আলোচক দেবাশিস-সুহানের সাবলীল আলোচনা ও এর ফাঁকে ফাঁকে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি-পোস্টার-রাজনৈতিক কার্টুনের স্থিরচিত্র প্রদর্শন দর্শক-শ্রোতা উপভোগ করেন ও মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণ করে ও জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা জাগরূক রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করে সমাপ্তি টানা হয় পাঠশালার ৪৭তম আসরের। আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।