Home কলাম পরিষেবা বা সার্ভিসে গুনগতমানের গুরুত্ব

পরিষেবা বা সার্ভিসে গুনগতমানের গুরুত্ব

স্বপন কুমার সিকদার : পরিষেবা হলো কোন প্রাথমিক অথবা পরিপূরক কার্য যা সরাসরিভাবে বাস্তবে কোন বস্তু সৃষ্টি করে না- অর্থাৎ এটা হলো ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে পণ্য নয় এমন কিছু বিনিময়। পরিষেবা প্রকৃতপক্ষে স্পর্শ দ্বারা অনুভব করা যায় না এমনকিছু বিনিময় করে।

আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন হিসাব করে দেখেছেন গড়ে কোম্পানীসমূহ প্রতি বৎসর শতকরা পঁয়ত্রিশ ভাগ ভোক্তা হারান যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হারান দুর্বল ভোক্তা পরিষেবার কারণে। নূতন একজন ভোক্তা পেতে পুরাতন একজন ভোক্তা ধরে রাখতে যে ব্যয় হয় তার পাঁচ গুন বেশি ব্যয় হয়। অবশ্যই এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, পরিষেবা ভোক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী হতে হবে অর্থাৎ পরিষেবা অবশ্যই “ভোক্তার আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ বা অতিক্রমণ” করতে সমর্থ হতে হবে।

ভোক্তাগণ প্রাথমিকভাবে পরিষেবার মানকে মানুষের সংস্পর্শ দিয়ে বিবেচনা করে। গবেযকগণ দেখেছেন, যখন পরিষেবায় কর্মরত কর্মচারীগণ কাজের প্রতি বেশি সন্তুষ্ট, পরিষেবায় ভোক্তাগণের সন্তুষ্টিও বেশি। অন্যদিকে যখন পরিষেবায় কর্মরত কর্মচারীগণের কাজের প্রতি কম সন্তুষ্ট, পরিষেবায় ভোক্তাগণের সন্তুষ্টিও কম।

অনেক পরিষেবা কোম্পানী এই আদর্শের উপর কাজ করে যে “যদি আমরা আমাদের কর্মচারীদের যতœ নিই, তারা আমাদের ভোক্তারও যত্ন নিবে”।
উচ্চ গুনগতমানযুক্ত পরিষেবা কর্মচারীগণের জন্য পুরস্কৃত করণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন যাহা গ্রাহক সন্তুষ্টি ফলাফল ও গ্রাহক নিবদ্ধ আচরণ এবং কাজটি সম্পাদনের জন্য যথাযত দক্ষতা ও সামর্থ্যতার স্বীকৃতি দেবে।
সুপারভাইজারকে প্রশাসকের ভ‚মিকা থেকে সরে এসে বেশি করে প্রশিক্ষক এবং পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করতে হবে। পরিষেবা কর্মচারীগণের প্রত্যেক ভোক্তাকে অভিবাদন জানানোসহ সঠিক বাক্য বিনিময় বা সঠিক প্রশ্ন করার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। প্রত্যেক কর্মচারী ভোক্তাকে সন্তুষ্ট করণের জন্য স্বর্গ্য-মর্ত্য আলোড়িত করার মতো বা যথেষ্ট ক্ষমতাবান হওয়া দরকার।

পরিষেবায় কর্মরত কর্মচারীগণের দায়িত্ব ভোক্তার জন্য এমন কিছু করা যাহা ভোক্তার স্মৃতিতে স্মরনীয় হয়ে থাকবে। রিটজ্ কার্লটন কোম্পানী অতিথি যেভাবে আপ্যায়িত হন, ঐ ভাবেই প্রত্যেক কর্মচারীর সাথে আচরণ করেন।

কোম্পানীর দৃষ্টি দক্ষ এবং ক্ষমতায়িত কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করা যারা আনন্দ ও গর্বের সাথে কাজ করবে এবং তারা প্রত্যেকে জানেন তাদের কি করণীয়, তারা কতটুকু ভাল করছেন এবং প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতাবান। এখানে প্রশিক্ষণ বিশেষ প্রয়োজন। “প্রাইড এন্ড জয়” কনসেপ্ট এবং কোয়ালিটির উপর তার প্রভাব ডব্লিউ, ই, ডেমিং-এর ভিত্তিমূলক দর্শনের একটি। ডেমিংসহ জোসেফ এম, জুরান এবং ফিলিফ বি, ক্রসবি উনারা সবাই কোয়ালিটি রিভলুশানে “ম্যানেজমেন্ট গুরু” হিসাবে বিবেচিত বা সন্মানিত।

ডেমিং দাবি করেন যে, উচ্চ গুনমান উৎপাদন বাড়ায় যা দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিযোগীতামূলক শক্তি অর্জনের দিকে কোম্পানীকে পরিচালিত করে। ডেমিং-এর ‘চেইন রিএকসান’-এর মর্মার্থ হলো উচ্চ গুনমান বা গুনমান উন্নত করণ ব্যয় কমায়। তুলনামূলক কম খরচ কোম্পানীকে প্রবৃদ্ধিতে উৎসাহিত করে। এই ভাবে উচ্চ গুনমান অথচ কম খরচের ফলে কোম্পানী বাজার দখল করতে সমর্থ হয়, ব্যবসা চালিয়ে যায় ও ব্যবসার স¤প্রসারণ করে এবং অধিকতর কাজের বা জনবল নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। ডেমিং জোর দিয়ে বলেন, উচ্চ ব্যবস্থাপকের বা ব্যবস্থাপনার সেবার গুনাগুন উন্নত করণে অনেক কিছুকে উপেক্ষা করে অনেক কিছু করার অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, যে কোন পদ্ধতির উপাদান বা অঙ্গসমূহকে অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে যেন পদ্ধতিটি ফলদায়ক হয়। ডেমিং-এর মতে, “ভয়কে বিতাড়িত করুন, বিশ্বাস সৃষ্টি করুন এবং নূতন কিছু সৃষ্টির পরিবেশ বা আবহাওয়া তৈরী করুন”। তিনি বলেন, ইহা হলো দুর্বল ব্যবস্থাপন। যেমন, খরচ কমানোর জন্যে সবচেয়ে কম মূল্যে কর্মী বা সেবা ক্রয় করা।

একজন কর্মীর কর্মক্ষমতা একটি সিষ্টেমের মধ্যে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে। যেমন- কর্মচারীর গৃহীত শিক্ষা ও ট্রেনিৎ, সংস্থানকৃত তথ্য ও সম্পদ, সুপারভাইজার ও ব্যবস্থাপকের নেতৃত্ব, কাজে বাধা দেয়া বা সংহতি নাশ করা বা ব্যাহত করা এবং ব্যবস্থাপনা পলিসি বা নীতি ও অনুশীলন। ডেমিং পরামর্শ দেন বা প্রস্তাব করেন যে, ব্যবস্থাপনাকে আগে বুঝতে হবে কি করণীয় এবং পরবর্তীতে টেকনোলজী, প্রোসেস ডিজাইন এবং প্রশিক্ষণের উন্নয়নের মাধ্যমে তারতম্য বা ব্যতিক্রম বা পার্থক্য কমায়ে আনতে হবে। আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও)-এর প্রধান কাজ শিল্প ও বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয়ের উপর মান নির্ধারণ, প্রণয়ন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে মানের সনদপত্র প্রদান। ইহা সরকারসমূহকে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, পরিবেশ ও আইনগত ভিত্তি প্রদান করে। আন্তর্জাতিক মান সংস্থায় নিবন্ধিত করণ বা নিবন্ধিত করণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা ইহা ভোক্তাগণকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে প্রতিষ্ঠানটির ভাল মানের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে যাহা প্রতিষ্ঠানটির বাহিরের অডিট দল নিরীক্ষিত ও উর্ত্তীর্ণ।

সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য গুনগতমান (Quality) ভোক্তা ধরে রাখা, লাভযোগ্যতা বজায় রাখা এবং মার্কেট শেয়ার লাভের জন্য একান্ত অত্যাবশ্যক। সন্তুষ্ট ভোক্তাগণ কোম্পানীকে আনুগত্য, পুনরায় ব্যবসা করণ, ইতিবাচক উল্লেখের মাধ্যমে পুরষ্কৃত করেন। ভোক্তাকে পরিতৃপ্ত করণের জন্য তাদের প্রয়োজন এবং ইচ্ছার প্রতি দ্রুত এবং কার্যকর সাড়া এবং সমাধান যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন ভাল সম্পর্ক সৃষ্টিকরা ও বজায় রাখা। হারসি ফুড কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা মিল্টন হারসি বলতেন, ‘তাদের গুনগতমান (Quality) দিন, তাহাই এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বা ভাল বিজ্ঞাপন’। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, নূতন একজন ভোক্তাকে পেতে পুরাতন ভোক্তাকে খুশী রাখার জন্য ব্যয়ের পাঁচ গুন বেশি ব্যয় হয়। অতএব, সফলতার সাথে ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোম্পানীসমূহকে অবশ্যই সেবার গুনগতমানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে যাহা তারা ভোক্তাগণকে প্রদান করতে চান। ভোক্তাগণের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুধাবন করে ক্রমাগতভাবে পরিষেবার উন্নয়ন প্রতিযোগীতামূলক বিশ্ব বাজারে সফলতার একমাত্র চাবিকাটি।

সংযুক্ত পাঁচটি ছবির মধ্যে প্রথম ছবিটি আমার এলবাম থেকে নেয়া। চারটি সংগৃহীত। ভাল থাকুন। ধন্যবাদ।

* প্রকৌশলী, ইনস্টিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, ঢাকা, বাংলাদেশ-এর সদস্য, কোয়ালিটি এসুরেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্টে অনার্সসহ স্নাতক(অন্টারিও) এবং একজন সমাজ হৈতষী কর্মী।

Exit mobile version