হিমাদ্রী রায় : মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথি থেকে শীতের রুক্ষতা সরে যেতে থাকে, ঋতুতে লাগে বসন্তের প্রথম ছোঁয়া। এমন তিথিতে আসেন সরস্বতী মুক্ত করে দিতে সকল জড়তা, ঋতুর ও মনের। কেউ বলি সরস্বতী পুজো আবার কেউ জানি বসন্ত পঞ্চমী।

মনের দিক থেকে আমি তখনও কাঁচা, গোঁফে পড়েনি তখনো চাঁছা। পলাশ গোঁজা জোড়া বিনুনির খোঁজে, শ্রী পঞ্চমীর প্রথম প্রহরে বুকের বাঁ পাশে বীণা উঠেছিলো সপ্তম সুরে বেজে। সেই ছন্দময় দিনগুলি, শুভ্রতা মাখা দিনগুলি, পলাশ রাঙা দিনগুলি আজ শুধুই শীতল স্মৃতির ভাঁজে।

সরস্বতী পুজা সেই উৎসব। গোটা কিশোর সমাজকে সুশৃঙ্খল করে আনতো এক আকাশে নিচে, যেন গ্রহে-গ্রহে মিলনের দিন। ঐ একটা দিন, মনে শুধু সাদা ভাবনা আর লাল স্বপ্ন। কল্পনার রঙ সাদা আর ভালোবাসার রঙ লাল। একা একা আর কতকাল এবার হৃদয় পদ্মে বীণার ছন্দে এসে বসো হে জোড়া বিনুনি, আমাকে অশেষ করো। হঠাৎ ডেকে উঠে বনের কোকিল মনে, চোখে চোখে কি অত কথা তাহার সনে। চলে যায় সময়, ইশারায় কথা বলতে শেখা, লুকিয়ে-চুপিয়ে দেখার আয়ু বড়জোর কয়েক মাস। তারপর একদিন লাভ এট ফার্স্ট সাইট, ব্রেকাপ এট ফার্স্ট ফাইট। ঘুম নেই, উলটি আসা, আমি কার কে আমার, রাত আসে রাত যায়, ভালোবাসার ধুপ জ্বলেপুড়ে খাক, কোকিলের ক্লান্ত গানে পঞ্চমী আর বসন্ত দুটোই শেষ। পরের বছর আবার হবে সরবে, এই মনোবল নিয়ে অপেক্ষা।

এর পর কত বসন্ত পঞ্চমী এসে চলে গেল পথের দেবীকে পথে রেখে জীবন শুধু লক্ষীর দিকে ছুটে। আমদের সমাজ জীবনে যেমন সরস্বতীর গুণের মেয়েরা, মঞ্চে নাটকের সংলাপ বলবে, পায়ের ঘুঙুরে বুকে ঝঙ্কার তুলবে, কবিতায় ফুঁটাবে স্থলপদ্ম। তাদের খোঁপায় পলাশ গোঁজে প্রেমের কল্পনা করতে কিংবা একসাথে কফির উত্তাপ নিতে ভালো লাগে ঠিক, কবুল হওয়ার পর কিংবা সাতপাঁকে বাঁধা পড়ার পর সরস্বতীর সকল গুণ গুলিই হয়ে দাঁড়ায় বাধা। বৌ মানেই তোমাকে ঘরের লক্ষী হতে হবে হয় উপার্জন না হয় সকল সাধ বর্জন করে উনুনে পঞ্চব্যাঞ্জন রাঁধা।

আজ তুষারে মোড়ানো শহরে বসে, শুভ্রতার উপর ফেলে আসা হংসিনীর রুপ কল্পনায় আঁকি। ঠিক এই সময়ে ওখানে বাঙালির জীবন পৃষ্ঠায় আবার বসন্ত পঞ্চমী দেয় উঁকি, শুক্লা পক্ষের শুরু। বীণাবাদিনীর রাজ হংসের বাহন হয়ে ফেরা বর্তমানের ধপাস তত্তে¡র বাংলায়। তমসার তীরে ধর্মীয় অন্ধত্ব একটা প্রজন্মকে ঘিরে।

এই দারুণ দুর্যোগে পথের দেবীই পথ দেখাতে পারে। পুকুরে যেমন রাজ হাঁস খেলা করে অথচ গায়ে জল লাগায় না, গলা ডুবিয়ে সার টুকু তুলে আনে। অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে গ্রহণ করার এই শিক্ষাটুকু নিয়ে হোক প্রজন্মের লেখাপড়ায় প্রবেশ, নবীনের হাতেখরি জ্ঞানের পাঠশালায়।

তবে আমার সরস্বতীকে দেখি, দেবী থেকে নেমে আসা মানবীয় স্তরে, গীতাঞ্জলি সাধনায়, নজরুলের কবিতায়, জয়নুলের চিত্রকলায়। আমি যেন তাঁর ধ্যানমগ্ন থাকি।তাঁর পদ্মবনের পাপড়ি এসে বসে আমার কলমে। রজনীগন্ধার শুভ্রতা হয়ে সে বসে আমার জিহ্বায় আর আমি অবচেতন মনে বলে উঠি ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম’। হে জ্ঞানদায়িনী, রত্নাকর থেকে বাল্মিকী স্তরে উন্নিত করো মানবেরে।
টরন্টো