কবি নয়ন হাফিজ তাঁর কবিতায় কথা বলে যান তাঁর আশপাশের চিরচেনা জগত নিয়ে, যে জগতে তাঁর দেহজগত আর মনোজগতের নিত্ত বসবাস। কবি সুদূর দূর পানে তাকিয়ে কবিতার শব্দ আর চিত্রকল্প খুঁজে ফেরেন না, বরং আমাদের প্রাত্যহিক অতি আপন জগৎ আর জীবন বলয়ের মধ্যে যে অনাবিল সৌন্দর্যের এক ঝলমলে আকাশ-বাতাস একেকার করা এক ভাষা আছে, সেটা অপূর্বভাবে পাঠকের সামনে হাজির করিয়ে দেন। নয়ন হাফিজ একেবারে সাদামাটা শব্দ দিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে ফেলেন তাঁর ভালোবাসার জগতকে আর পাঠককে এক কাব্যিক আবেশে নিজের দিকে একটু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে নিজেকে অবিরাম খুঁজে বেড়ানোর পথ উম্মোচিত করে দেন।
কবি নয়ন হাফিজের কবিতা তাঁর চলমান সময়ের হাত ধরে এগুতে থাকে কালের যাত্রায়। এই যাত্রায় তাঁর আলোকিত চৈতন্যের অবগাহনে তিনি বর্তমান থেকে সামনের দিকে এগুতে থাকলেও, মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে চোখ মেলেন ফেলে আসা দিনগুলিতে, যেখানে সতত জাগরুক থাকে না হারিয়ে যাওয়া সময়ের অকথিত অমূল্য আখ্যান।
নয়ন হাফিজ সময়ের সাথে চলতে থাকা সময়োতীর্ণ এক প্রাকৃত কবি।

মনিস রফিক

সংগঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মী নয়ন হাফিজ-এর জন্ম বাংলাদেশের নীলফামারীর সৈয়দপুরে, ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে। বাবা তকিব প্রামাণিক এবং মা হাফিজা বেগম।
তিনি লিটল ম্যাগাজিন ও নাট্য আন্দোলনের তুখোড় কর্মী। আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়া জাগানো কবিতাপত্র ‘শব্দায়ন’ এর অষ্টম সংখ্যার সম্পাদক। তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্ত নাটক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নয়ন হাফিজ নাট্যদল অনুশীলন ও দেশনাটক-এর সক্রিয় কর্মী এবং সৈয়দপুরে তরুণ নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কানাডার টরন্টো থিয়েটার ফোক্স ও টরন্টো ঢাকা কালচারাল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়াসন্ন্যাস’। নয়ন হাফিজ পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে এবং এমবিএ করেছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। তিনি কানাডার সেন্টিনিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা ইন ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এ ডিগ্রী নিয়েছেন।
নয়ন হাফিজ বাংলাদেশে কাজ করেছেন ঢাকার সাপ্তাহিক অর্থনীতি, অক্সফাম, ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এবং বিজিএমইএ’তে। বর্তমান কর্মস্থল কানাডার সিআইবিসি ব্যাংকে।
স্ত্রী ও বন্ধু সবিতা সোমানী এবং কন্যা সৃজনী রহমানকে নিয়ে নয়ন হাফিজ টরন্টো শহরে বসবাস করেন।

এই শহরে

এখানে, এই শহরে অনেক কিছুই হয়
গালগল্প, সখ্য এবং ছাড়াছাড়ি, বাড়াবাড়িও হয়।
শিল্প হয়, সাহিত্য হয়, কথার পিঠে কথা হয়
বইমেলা আর পথের নাটক
হয় সবই হয়।

ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়,
দলে দলে জোট হয়
ভোট হয়, ক্ষমতার বদল হয়
চাঁদ রাত, মেহেদি রাত, সেলফি তোলা- তাও হয়
কখনোবা বিপ্লব-নামে খেলাও হয়
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হয়
হয় হয় অনেক কিছুই হয়।

হয় না শুধু এক সকালে তোমার সঙ্গে
লংড্রাইভে যাওয়া
তোমার পাশে মুগ্ধ শ্রোতা নিজের করে
তোমার কথা শোনা।

হয় না চেনা

নানা রঙে রঙিন তুমি-
কখনো লাল কখনো নীল
কখনো দিন
কখনো রাত।

কখনো বিপ্লবী
কখনো মতলবি।

কখনো গুরু
কখনো শিষ্য।

নানা রঙে রঙিন তুমি-
তোমাকে হয় না চেনা।

যুদ্ধের প্রয়োজনে

ফের আমাদের দেখা হবে।
দেখা হবে অনাবিল আড্ডায়
কবিতার প্রতিটি শব্দের
স্বরকম্পনে।

দেখা হবে নূপুরের প্রগাঢ় আলোড়নে
মঞ্চের মায়াবী সম্মিলনে।

ফের আমাদের দেখা হবে
এক আলো ঝলমল সকালে।

আপাতত আমরা দূরে থাকি
যুদ্ধের প্রয়োজনে।

ফেরে না যুবক

কার জন্য তোমার এতো বিনিদ্র রাত
কার জন্য- এই প্রৌঢ় পৌষে!

কার জন্য এতো ছবি, নানান রঙে নানান ঢঙে
চোখের তারার উত্তাল উত্তাপে
ফেসবুকের পাতায় পাতায় লাল বেগুনি নীলে
কাকে জাগাতে চাও যাপিত মধ্যরাতে!

তুমি জানো অথবা জানো না সে যুবক
মধ্যরাতে জেগেই থাকে, ফেরে না ঘরে
কখনই ফেরা হয় না তার!

প্রতি রাতে জোনাকির আলোয় সে পথ হারায়
জোছনার ছায়া দেখে অন্টারিও লেকের জলে
প্রতিজ্ঞা করে- একদিন পূর্ণিমা রাতে অন্টারিও লেকে
কবিতা পাঠের আসর করবে।
অথবা হাঁটতে হাঁটতে আলো-আঁধারে
আলোড়ন তুলে
মিছেমিছি কানামাছি খেলবে
কমেডি বারে।

হাঁটতে হাঁটতে ভোরের আলোয় সে বিষন্ন হয়
ফ্যাকাশে চাঁদ হারিয়ে যায় দিনের আলোয়।

ঘরে তার ফেরা হয় না কখনো
রাত হলে জোনাকির ডানার আলোয়
সে পথ হারায়।

ছায়াসন্ন্যাস

কি খুঁজছো তুমি আতিপাতি
সকাল বিকেল রাতে?
স্মৃতির কৌটায় রাখা
কালো ভ্রমর?
লাল পদ্ম? নীল পদ্ম?
কপালের মায়াবী টিপ?
চোখের কাজল? একটু সুখ?
একটি মুখ?

কি খুঁজছো তুমি অষ্টপ্রহর?

ওখানে কোনো কিছু ছিল না
ওখানে কেউ কখনো ছিল না!

তোমার চারপাশে যা ছিল
সবই ছায়া।

ছায়া কখনো কথা বলে না
দরোজায় দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে
হাত নেড়ে বলে না বিদায়
শুধু নিঃশব্দে হারিয়ে যায়।

ওখানে কেউ কখনো ছিল না
ছিল শুধু তোমারই ছায়া!
ছিল বৈরাগ্য, ছিল ছায়াসন্ন্যাস
অভিমানে অভিমানে নীল জ্যোৎস্না
সুনীল বেদনার ভার।

আমি এই ছায়াটিকে ছায়া হয়ে
অনুসরণ করছি সেই কবে থেকে।
এই সন্ন্যাস, ছায়াসন্ন্যাস
একান্তই আমার।

অন্যরকম শূন্য ছিল

অনেক বিকেল অনেক সকাল
অন্য মতোন ছিল!
সুখ ছিল সুর ছিল
অকারণে অনেক দূর উড়ে যাওয়া ছিল!
রাতজাগা ভোর ছিল
নানান মতো ঘোর-বেঘোর দুটোই ছিল!
আকাশের তারা ছিল চাঁদ ছিল
তুমি ছিলে তোমার মন ছিল
তোমার আসা ছিল তোমার যাওয়া ছিল
রাগ ছিল ভয় ছিল অভিমান ছিল প্রেম ছিল
রাত দুপুরে কান্না ছিল আলিঙ্গন ছিল
অনেক কিছুই ছিল!
শুধু একটা সকাল একটা বিকেল শুন্য ছিল
অন্যরকম শূন্য ছিল!

সে যায়

সরীসৃপের মতো হেঁটে যাই
আমার আমি
আমারই ভেতর।

ধীর লয়ে অথবা দ্রুত
একাকী তোমার সাথে
হেঁটে যাই।

দেখতে সে অবিকল আমারই মতো
আমার মতোই সে কথা কয়
অদ্ভুত সে কথা-
শুরু নেই, শেষ নেই
কেবলই যেন কথার কথা।

আমি টের পাই- সে হেঁটে যায়
আনমনে হেঁটে যায়
রাতদিন হেঁটে যায়।

যেতে যেতে যেতে যেতে
যেন সে ঘন কুয়াশায় হারিয়ে যায়।
হারিয়ে যায় তোমার হাত ধরে
তোমার খোঁজে।

সে যায়-
সরীসৃপের মতো হেঁটে যায়!

প্রিয় বৃক্ষ আমার

প্রিয় বৃক্ষ, তোমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে
তোমার নষ্ট লতাপাতা
শেকড়-বাকড়।
ক্রমশ তোমাকে ঘিরে ফেলছে
নষ্ট সময়।

প্রিয় বৃক্ষ, কদাচিৎ আলো পাও তুমি
ঘন অন্ধকার খুবলে খাচ্ছে তোমাকে
বড় স্যাঁতসেঁতে তোমার ভ‚মিতল।

পোকামাকড়ের উৎসুক উৎসবে
ব্যথাতুর তোমার বাকল অস্থিমজ্জা।

প্রিয় বৃক্ষ, তোমাকে নিয়ে
অবিরত লেখা হচ্ছে ভুল ইতিহাস
স্বনামে বেনামে!

প্রিয় বৃক্ষ আমার, সাবধান সাবধান!

পিতামহের মতো

গাছটি ছিল
কালও গাছটা ছিল
দাঁড়িয়েছিল
ঋদ্ধ একাকী।
গাছটি ছুঁয়ে ছিল ভোরের আকাশ
পাখিদের নরম পালক।
গাছটি পিতামহের মতো
দুপুরের রোদে
বিকেলের বাতাসে
বিবশ সন্ধ্যার মৌনতায়
উঠোনে বসে অপেক্ষায় থাকতো
আমার ঘরে ফেরার।
গাছটি
জ্যোৎস্নারাতে
চাঁদের আলোর চাদরে
তার ডালপালা ছড়িয়ে
তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে
রূপকথার গল্প আর
স্বপ্নের কথা বলতো।

গাছটি দাঁড়িয়ে ছিল।

গাছটি দাঁড়িয়ে ছিল কাল অবধি
আমার পিতামহের মতো।

ভোর হয়েছিলে

এক সকালে প্রণয়পীড়িত তুমি
আলুথালু একরাশ আলোর ভেতর
আগুনজ্বলা ভোর হয়েছিলে।

হেঁটেছিলে অনেক দূর
তোমার চোখের তারায় ছিল
সাগরের উচ্ছ্বসিত জল
ছিল গাঙচিলের ওড়াউড়ি।

এক একটি গাঙচিল
তোমার এক একটি স্বপ্নচর
তুমি অনেক স্বপ্নের কথা বলেছিলে
অনেক স্বপ্ন ছিল তোমার।

আজ এই বরফ পড়া সকালে
অনেক গোছানো তুমি
আগুন আর উত্তাপ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত
তোমার চারদিকে বরফ
তুমি দাঁড়িয়ে আছো একা
সব গাঙচিল উড়ে গেছে অনেক দূরে
তোমার অলক্ষ্যে।

বৈশাখে ছুরির ঘ্রাণ

এ কোন বৈশাখ-
অবয়বে উন্মাদনা নেই।

বাতাসে অদৃশ্য ঘাতকের ছুরির ঘ্রাণ।

এ কোন বৈশাখ
একরাশ শূন্যতা
ঘরে ও বাইরে!

একরাশ শূন্যতা
উঠানের টিউলিপে
সময়ের ভাঁজে ভাঁজে।
আলো নেই, রোদ ও ছায়া নেই
এ কোন বৈশাখ!

চুরি গেছে মঙ্গল মিছিল
ঢাকের আওয়াজ।
পথে আজ নৈঃশব্দ্যের গান
এ কোন বৈশাখ!

বাতাসে অদৃশ্য ঘাতকের ছুরির ঘ্রাণ।